মুকিদ চৌধুরীর নাট্যোপন্যাস
গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৯
গোমতীর স্রোত: রাজমালা
তোমার ঘরে বসত করে কারা, ও মন জানে না
সংগীতসুধায় মর্ত্যলোক পরিপ্লাবিত হয়ে কেন যায় না
আবার মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্যের পথচলা শুরু হলো। অরণ্য অতিক্রম করে নদী, নদী পেরিয়ে গ্রাম, গ্রামের প্রান্তে দিগন্তছোঁয়া কৃষিজমি, কৃষিজমি পেরিয়ে আবার নিবিড় বনভূমি। এই অরণ্যে আকাশস্পর্শী বনস্পতিদের বংশ পরস্পর নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িত, তাদের শাখা-প্রশাখার জটলা পেরিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া কঠিন। এই কঠিন পথ ভেঙেই চলেছে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তার অনুগামীদের নিয়ে। এই কঠিন পথে রাত্রি হয়, গভীরতর অন্ধকার আচ্ছন্ন করে বনভূমি, আবার কেশবতী কন্যার কঙ্কতিকার মতো অরণ্যের পত্রছাঁদ অতিক্রম করে নেমে আসা সূর্যকিরণ; বনভূমিকে সামান্য আভায়িত করে রাখে। এই আভায় ঝিলমিল করে ওঠে এ-বৃক্ষ থেকে ও-বৃক্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত ঊর্ণাজাল, যা চোখে-মুখে-মাথায় লেগে প্রগাঢ় অস্বস্তির জন্ম দেয়। কোথাও কোথাও সুদীর্ঘ সরীসৃপ বৃক্ষডাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে; কিন্তু অজান্তে স্পর্শ করলেই অবধারিত মরণ। কোথাও অরণ্যের অন্তরাল থেকে বন্য শিয়ালের চিৎকার শোনা যায়। এই ভয়াবহ অরণ্যের মধ্যে মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য যেন নিজের চোখ জ্বেলে পথ খুঁজে ফিরছেন। মনে হচ্ছে, তিনি যেন আর ত্রিপুরেশ্বর নন, তার অতীতের সুখস্মৃতি তার মগজে আর নেই, বর্তমানে তার কোনো কর্মতৎপরতা নেই, ভবিষ্যতের স্বপ্নও নেই, পথ চলতে হচ্ছে তাই চলা, উপনীত হওয়ার গন্তব্যে পৌঁছতে হবে তাই চলা; যেন তার অতীত মুণ্ডহীন প্রেতাত্মা, আর বর্তমানে গভীর অরণ্যে মুক্তির আলোক অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছেন।
গভীর অরণ্য ভেঙেই মহারাজ দ্রুহ্য মাণিক্য তার অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে এসে উপস্থিত হন শশিভূষণ ও কৃষ্ণাভামিনীর প্রাসাদগৃহে। পার্বত্য ত্রিপুরার এই অঞ্চলটি সবুজ অরণ্য ও ঝোপঝাড়ে পরিবেষ্টিত। মাঝেমধ্যে দু-একটি গ্রাম, লোকালয়। মানুষগুলো নিতান্তই দরিদ্র। প্রচুর ধান ও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন হয় না এখানে; যা হয় তা আবার সামন্তপ্রভুদের ভোগে চলে যায়। চাষবাস করে খেটে-খাওয়া মানুষ সামন্তপ্রভুদের অধীন একধরনের চাষিদাস হিসেবে কাজ করে। এইসব সামন্তপ্রভু প্রায় সকলই অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর। ত্রিপুরার এই সামন্তগোষ্ঠী যে কোনো মানুষের জন্য এক শাঁখের করাত। রাজারও তাদের ছাড়া রাজত্ব চলে না। রাজকোষের অর্থ জোগানদারই তারা। আবার তাদের অত্যাচার থেকে রাজ্যের সাধারণ প্রজাদের রক্ষা করতে হয় রাজাদেরই। ফলে কখনো পিঠে হাত বুলিয়ে, কখনো চাবুক দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তাদের। ভেতর থেকে ঘুণপোকার মতো শক্তি খেয়ে ফেলায় রাজশক্তির অনেকটা নষ্ট হয়েছে। সেই জন্য বর্মণদস্যুদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা কষ্টকর হয়ে পড়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের। আর এই সুযোগে সামন্তগোষ্ঠী নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে ত্রিপুরাকে রক্ষা করে চলেছে। প্রায় সবাই ঢাল-সড়কি, বল্লম-বর্শা প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকে। শশিভূষণেরও নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী রয়েছে।
হেমন্তে গোমতী নদীর স্রোত ধীর হয়ে এসেছে অনেকটা। জলধারা স্বচ্ছ। নদীর উভয় তীরজুড়ে কাশফুলের সীমাহীন বিস্তার। শশিভূষণ ও কৃষ্ণাভামিনীর প্রাসাদগৃহে অবস্থানকালেই মৎস্য-শিকারে বেরুলেন মহারাজ। এই মৌসুমে অলস সময় কাটাতে তার পছন্দ। রাত্রিগুলোও থাকে ঝকঝকে। আকাশে উজ্জ্বল তারা। সন্ধ্যা হতে-না-হতে লোকালয়ের পথগুলো নর্তকীদের নূপুর ও নিক্বণে চঞ্চল হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাট মাতিয়ে তোলে তাদের বিভিন্ন কলাবিদ্যা ও পারদর্শিতা। পুরুষদের সব রকম বাসনা মেটানোর কোনো ঘাটতি নেই সামন্তগোষ্ঠীর। স্থান করে নেয় সেবাদাসীরাও। সেবাদাসীদের কোমল অঙ্গের সুখ্যাতি ছাড়িয়ে পড়ে বহু দূর পর্যন্ত। তাদের কোমল লবঙ্গলতা বাহুবন্ধনে যারা একবার বাঁধা পড়ে তাদের জীবনে আনন্দের সীমা থাকে না।
গোমতী নদীর ভাটির বিস্তীর্ণ উপকূলে মহারাজের নৌবহর ভেড়ানো হলো। গোমতীর এই অংশে জলের বিস্তার বোঝা কঠিন। কোনটা মূল স্রোত তা বোঝার উপায় নেই। একটি বালুচর নদীর বুকজুড়ে ভেসে আছে। চিকচিকে বালুচর। মাঝেমধ্যে সোনালি জলের বিস্তার এক স্বর্গীয় আবহ এনে দিচ্ছে। এটি যেন এক স্বর্গরাজ্য। বালুচরের স্থলচর কোনো প্রাণীর দেখা পাওয়া যায় না এখানে। কোথাও কোথাও অলসভাবে রোদ পোহায় গাংচিল, রং-বেরঙের বক, কাদাখোঁচা, হট্টিটি প্রভৃতি পাখির ঝাঁক। জলে ভেসে বেড়ানো অসংখ্য প্রজাতির হাঁস, স্বচ্ছ কাকচক্ষুজলে মাছের ঝাঁকও স্পষ্ট দেখা যায়। শান্ত জলের ওপর হঠাৎ এক ঝাঁক ছোট মাছ লাফিয়ে ওঠে। জলের উপরিতলে আলোড়ন সৃষ্টি করে আবার মিলিয়ে যায়।
রাজকীয় নৌবহরের প্রতিটি নৌকায় অন্ততপক্ষে একজন মাল্লা রয়েছে। বৈঠা বাইতে গিয়ে বা দাঁড় টানতে গিয়ে আপন মনে গান গেয়ে ওঠে ওরা। গোমতীর বুকে এখন শত শত জেলে-নৌকা মাছ ধরছে। মাছ-ধরা শেষ হলে নদীতটের ছোট-বড় হাটে বিক্রি করতে নিয়ে যাবে তারা। এই রকম একটা হাটের কিছুটা দূরেই মহারাজের নৌবহর নোঙর ফেলে। হাটের এক প্রান্তে বিশাল তাঁবু খাটিয়ে যাত্রাপালার আয়োজনও করা হয়েছে। পাশেই দাঁড়িয়াবাঁধা খেলছে ছেলেরা। খুব কোলাহল চলছে। হাটের এক কোনায় তেলেভাজার এক সারি দোকান রয়েছে। বাদাম ও তিল তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগে। পদ্মপাতায় বানানো ঠোঙায় ওসব কিনে গরম গরম খেয়ে নেয় ক্রেতারা। গৃহে নেওয়ার জন্য বাঁশের ছোট চাঙারিতে কেউ কেউ এসব কিনে রাখে। ধূলিধূসরিত হাটের ভেতর দিয়ে এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছেন বিচিত্র রঙের পোশাক পরা ও ভিন্ন চেহারার মহারাজের বীরযোদ্ধারা। মাঝখানে মহারাজ। তাদের বেশভূষা দেখে স্থানীয় কোনো সামন্ত ভেবে ভয় পাচ্ছে সাধারণ মানুষজন।
একটু কাঁপা গলায় একজন বলল, প্রণাম।
লোকটির মুখ ও গায়ের রং ফ্যাকাশে। ঠোঁটের দুই প্রান্তে দুই-গাছি হালকা গোঁফ। তার কণ্ঠে যেন একটা সর্বস্ব হারানোর বিষাদবিপন্ন সুর ছিল। এই সুরটি ছিল বিমর্ষ অথচ মত্ত, বলিষ্ঠ অথচ বিপন্ন।
রাধারমণ তার শান্ত নয়ন দুটি তুলে মন্দ্র স্বরে বললেন: প্রণাম।
লোকটি চলে গেলে রাধারমণের দৃষ্টি অনুসরণ করেই মহারাজ দেখলেন, বিপরীত দিক থেকে একজন ভিক্ষুক এগিয়ে আসছে। ত্রিশোর্ধ্ব বয়ঃপ্রাপ্ত, কিন্তু তার মুখদর্শন করে মনে হচ্ছে, সে তরুণ। বেশ কিছুদিন শিরোদেশ মুণ্ডন করেনি, ফলত অযত্নবর্ধিত কুঞ্চিত পিঙ্গল কেশগুচ্ছ মাথার ওপর স্তূপাকৃতি রুদ্রাক্ষের রূপ পরিগ্রহ করেছে। অঙ্গের কান্তি ঈষৎ তাম্র। লোকটি ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলল, কিন্তু তার গতি মন্থর নয়। পথ প্রান্তে তার উপস্থিতি মহারাজকে ব্যথিত করল। সর্বোপরি তার চোখে-মুখে এক রকম অপার্থিব বেদনা বিকশিত হতে থাকে যে, তার মুখের চারিদিকে যেন কালো মেঘে ঢাকা। তার এক হস্তে একটি ভিক্ষার পাত্র। এই তরুণটিকে দেখতে দেখতে রাধারমণের উদ্দেশ্যে মহারাজ বললেন, জানি না এই অঞ্চল কোন্ সামন্তগোষ্ঠীর অধীনে আছে! তবে মনে হচ্ছে এখানে মানুষের জীবন নিরাপদ নয়। তাদের অবস্থা আমাকে আহত করছে।
ঝরাপাতার মতো ঝরঝর শব্দে রাধারমণ বললেন: না, না, এমন করে দেখবেন না। আপনার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এখানে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মহারাজ বিস্ফারিত চোখে বললেন, জনসাধারণের এমন অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। এই অপরাধের শাস্তি আমারই প্রাপ্য।
মহারাজের বিস্ময়কর কথালাপ শুনতে শুনতে রাধারমণ নিশ্চুপ এবং অবাক হয়েই মহারাজের মুখের পানে তাকিয়ে রইলেন।
স্থির হয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে মহারাজ বললেন, আগামী দিনগুলো বোধহয় ভালো যাবে না, রাধারমণ। সামন্তদের অন্যায় কর্মকাণ্ডে ছেয়ে গেছে ত্রিপুরা। তাদের দমন না করে অবসর গ্রহণ আমার সাজে না।
সত্যি মহারাজ, সামন্তরা জনগণের রক্ত শুষে খাচ্ছে। সামন্তদের দমন করা একান্ত কর্তব্য। সামন্তগোষ্ঠী না-থাকলে রাজ্যের অস্তিত্ব থাকে না—একথা যেমন সত্য, তেমনই সামন্তদের লোভকে বশে রাখার চেষ্টা করা অন্যায় কিছু নয়।
কিন্তু প্রকৃতির নিয়মচক্রে কিছু মানুষ ভালো থাকে, আর কিছু মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষুদ্র চায় বিশাল হতে, বিশাল চায় আরও বিশাল হতে... রাজা হতেও পিছু-পা নয়। মানুষ ছুটে চলছে শিকারের পশ্চাতে, লোভের পশ্চাতে, ক্ষমতার দম্ভের পশ্চাতে, অহমিকার পশ্চাতে, বাসনার পশ্চাতে। মানুষের ছুটে চলার শেষ নেই, রাধারমণ। এই চক্রে কিছু মানুষ ভালো থাকে, আর-কিছু মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়।
এসব বলতে বলতে মহারাজ যেন হাহাকার করে উঠলেন। এই অমোঘ-অব্যর্থ হাহাকার বাতাসকেও যেন ভারাকান্ত করে দিলো, রুদ্ধশ্বাস ক্রন্দনবাষ্পে।
রাধারমণের মুখ এইবার মহারাজের এসব কথা শুনে উত্তেজনায় এক মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তেজিত কণ্ঠেই রাধারমণ বললেন: কিছু মানুষ নয় মহারাজ, অনেকের বিলুপ্তির পরিণামে ক্ষুদ্র একটা অংশ শুধু বেঁচে আছে।
রাধারমণের একথা শুনে মহারাজ নিতান্ত বিস্মিত হলেন। বলদৃপ্ত স্বরে বললেন: তোমার কথা সত্য বটে, কিন্তু বিকল্প কী তা বলুন রাধারমণ!
রাধারমণ ধ্রুবস্বরে বললেন: মহারাজ, এখন আর চিন্তা করে লাভ নেই! রাজ্য তো বিলিয়ে দিয়েছেন আপনার দুই কন্যাকে।
রাধারমণের কথা শুনে গভীর যন্ত্রণায় মথিত মহারাজ বললেন, তাহলে আমার ভাগ্যই মন্দ।
সন্ধ্যা এগিয়ে এলো, সূর্য ডোবা পর্যন্ত এই চিন্তার মধ্যেই ডুবে থাকেন মহারাজ। এখানে দিবসের রূপ যেরকমই হোক-না, রাত্রির রূপ অন্য রকম। সুর চেতনার গভীরতম পার্বত্য অঞ্চলে নেমে আসে। রাত্রি হয় শান্ত, গম্ভীর। অবচেতনের সকল চিন্তাচেতনাকে পরম মমতায় স্পর্শ করে শুশ্রূষা করে, রূপান্তরিত করে। বলতে থাকে, ঊর্ধ্বে উঠে এসো। তোমাকে এক নির্ভয়, অমোঘ সত্যের কাছে নিয়ে যাব, যেখানে সূর্য উদিত হয় না, অথচ আলোকেরও অভাব নেই...
নিস্তব্ধ মধ্যরাত্রির বিজন প্রহর। উন্মুক্ত বাতায়নপাশে এক সৈনিক বাঁশিতে এক সকরুণ রাগিণীর আলাপ করছে। রাগিণীটি পাহাড়ি। তারই বাঁশিতে এই রাগিণী শশিভূষণ ও কৃষ্ণাভামিনীর প্রাসাদগৃহে প্রবেশ করেছে। সহজ, অনাড়ম্বর চলন, কিন্তু হৃদয়ের অন্তস্তলে গিয়ে বেঁধে। অন্তরের সুগভীর বিরহবেদনা, ফেলে আসা দিনগুলোর প্রতি স্মৃতিকাতরতা বাঁশির সুরের সঙ্গে মিশিয়ে যেন রাত্রির আকাশকে ভরিয়ে দিচ্ছে। এই রাগিণী শুনেই কত কথা মনে পড়ে গেল রাধারমণের: সেই ময়নামতী, গোমতীর তীর... যাদের ফেলে মহারাজের মঙ্গলকামনায় তিনি দেশ ছেড়েছিলেন, কিন্তু মঙ্গলের কোনো দর্শন এখনো মেলেনি। চিরবিচ্ছেদের এই বেদনা কেঁপে কেঁপে উঠছে তার অন্তরে। কৃষ্ণকালো অন্ধকারের গাত্রে তিনি হাত বোলাচ্ছেন শুধু। কক্ষের এক পাশে ম্লান প্রদীপের ক্লান্ত শিখাও কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রহরকাল হৃদয় মথিত করে নিঃশব্দ বেদনার ভেতর অবশেষে রাগিণীটি থেমে গেল।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০১
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০২
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৩
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৪
- গোমতীর উপাখ্যান: পর্ব-০৫
এসইউ/এমএস