লেখা তৈরি হয় শিলালিপির মতো: মোস্তফা তারিকুল আহসান

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৫৯ পিএম, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

মোস্তফা তারিকুল আহসান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক। তিনি নিভৃতচারী সাধক। তার লেখায় সমাজের অসংগতি, রাজনীতি, হতাশা, মানবিক দ্বান্দ্বিকতা প্রকটভাবে উপস্থিত হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—গল্প: মহাপ্রস্থান, কয়েকটি বালকদিগের গল্প, গল্প গল্প খেলা, মাহবুবের কুটিরশিল্প, নমস্কার, কাআ তরুবর। উপন্যাস: অবগাহন। কবিতা: যদিও জাতিস্মর নই, এ দৃশ্য হননের, কন্টিকিরি রাত, মেঘেদের ইশতেহার, কপিলাবস্তুর পথে। কাব্যনাট্য: আনত কুসুমের ঘ্রাণে। অনুবাদ: বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প-১। ছোটদের গল্প: তিতিরের স্কুলে যেতে দেরি হয়। প্রবন্ধ: সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য; বাংলাদেশের কবিতা: উপলব্ধির উচ্চারণ; সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যকর্ম; বাংলাদেশের কথাসাহিত্য: মেঘ ও রৌদ্র; বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চা: তত্ত্ব ও অধ্যয়ন; ক্ষেপুউল্লাহ বয়াতির জীবন ও সাহিত্য।

সম্প্রতি এই লেখক কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি ও প্রাবন্ধিক বঙ্গ রাখাল—

জাগো নিউজ: আপনার লেখালেখির বিষয়ে জানতে চাই—
মোস্তফা তারিকুল আহসান: লেখালেখির বিষয় কী না হতে পারে? বিশেষ করে একজন লেখক যখন নানা মাধ্যমে লেখেন। সেখানে বিষয়ের বর্তমান-অতীত বলে কিছু নেই। যে গল্পটি ১৯৮৭ সালে লিখতে চেয়েছিলাম; সেটি হয়তো আজ লিখছি। আবার নতুন যাপিত জীবনের নানা গল্প যোগ হয়ে যাচ্ছে নিভৃতে। জীবনের নানা প্রসঙ্গ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞান হয়তো আমাকে রাঙিয়ে দিয়ে যায়, সবটা তো লেখা হতে পারে না, মাথার মধ্যে জমা হতে থাকে টুকরো টুকেরা এপিসোড, একসময় তা প্রবলবেগে আক্রমণ করে, তখন লেখা শুরু হয়। হতে পারে কোনো কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি, গল্পের কোনো উৎসমুখ, অথবা কোনো গানের দ্বিতীয় অন্তরা। তাই বর্তমানে কী নিয়ে লিখছি; সে বিষয়ে বলা মুশকিল। যদিও দীর্ঘদিন লিখতে লিখতে আমার লেখার একটা ভূগোল তৈরি হয়ে গেছে, একটা গঠনও মানি। তবে সাময়িক ঘটনা নিয়ে তাৎক্ষণিক গল্প বা কবিতা দৈনিক পত্রিকায় কখনো লিখিনি। লেখা তৈরি হয় শিলালিপির মতো, স্তরে স্তরে জমা হয়। একটা ধ্রুপদী চেহারা সামনে আসে একসময়; তখন সেটি লেখা হয়ে ওঠে। অসহ্য অধুনা নিয়ে লিখতে গেলে সাহিত্যের মূল সত্যকে মাথায় রাখা দরকার, কালের কণ্ঠস্বর হতে পারে কি না সেটি ভাবতে হয়। না হলে লেখার কী দরকার? বাংলাদেশের, বাঙালির সামূহিক জীবনযাত্রার নানা পরিক্রমা, লড়াই, উত্তরণ, মানবিক সংকট, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রমবিকাশে ব্যক্তির অবস্থান, দার্শনিক অভীক্ষা, যাপিত জীবনের সুখ-অসুখ নিয়ে মূলত লিখি। তবে বাংলাদেশের মৌলিক মানবিক গণতান্ত্রিক সংকট নিয়ে প্রতিবাদ হিসেবে ফিকশনে কথা বলতে চেয়েছি। লেখক সমাজে সবচেয়ে অগ্রণী মানুষ, সাহসী মানুষ, সেই দায় থেকে লিখি। জাতিকে সামান্য প্রেরণা দেওয়া, সাহস দেওয়া বোধহয় লেখকের অন্যতম কাজ। এখন কী লিখছি, তা আলাদা করে বলার নেই।

জাগো নিউজ: আপনার প্রথম লেখা কত সালে কোথায় প্রকাশিত হয়?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: লেখা শুরু করেছিলাম স্কুলে। ১৯৮০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। তারপর থেকেই লেখা শুরু। বাড়িতে বড় ভাই লিখতেন, মা লিখতেন। মা ছাপতেন না। বড় ভাইও ছাপতে চাইতেন না। মূলত কবিতা লিখতেন। আমিও কবিতা দিয়ে শুরু করি। প্রথম কবিতা ছাপা হয় সম্ভবত ১৯৮২ সালে, ‘প্রগলভ’ নামে পত্রিকা বের করতেন জি এম মুজিবর রহমান, আশাশুনি থেকে, লিটল ম্যাগ বলা যায়, কবিতার নাম মনে নেই। পেন ফ্রেন্ড কাজি মনিরুল ইসলামের পত্রিকায় একই সময়ে কবিতা ছাপা হয় কুষ্টিয়া থেকে। তখন প্রচুর লিখতাম। একটি হাতে লেখা কবিতার বই নিজে প্রচ্ছদ এঁকে বের করি এসময়; নাম দিলাম ‘শৈশবের উন্মুক্ত আঁখি’। এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে। ১৯৮৩ সালে আমার বাংলা শিক্ষক মাহমুদ স্যার আমাকে কী মনে করে গল্প লিখতে বললেন দশম শ্রেণির বিদায় অনুষ্ঠানে পাঠ করার জন্য। আমি ‘তবুও সূর্য ওঠে’ নামে একটি গল্প লিখে স্যারকে দিলাম পরের দিন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গল্প। অনুষ্ঠানে পাঠ করলো আমার সহপাঠি কুদ্দুস, আজও গল্পটি তার কাছে আছে। আমার বিপুল অলসতার জন্য সেটি আনতে পারিনি।

জাগো নিউজ: কবিতা লিখতে ছন্দ জানা কতটা জরুরি?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে গানের চর্চা হতো। বড় বড় ওস্তাদেরা গান শেখাতেন। রবিকেও সেখানে পাঠানোর চেষ্টা করা হতো। তিনি যেতেন না। আশেপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। সেই ঠাকুরের গান বাঙালির জীবনে সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও হৃদয়স্পর্শী গান। তিনি তার দুই হাজারের বেশি গানের সুরও দিয়েছেন। নতুন নতুন রাগ তৈরি করেছেন। তিনি প্রথাগত সারগামের ক্লাসে না গেলেও তাকে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন, তাতে সিক্ত হয়েছিলেন তার মতো করে। অনেক কবি নতুন কবিদের ‘ছন্দের বারান্দা’ বা ‘কবিতার ক্লাস’ পড়তে বলেন, আমি কাউকে বলিনি কখনো। ছন্দ থাকে হৃদয়ে, মাথার ভেতরে, তাকে আত্মস্থ করতে হয়। আগে কবিতা, পরে ছন্দ। বহু কবিকে দেখেছি আঙুল গুণে গুণে ছন্দ ঠিক করছেন আর কবিতার পদ লিখছেন। শেষ পর্যন্ত ছন্দ হয়তো ঠিক থাকে, কবিতা হয়ে ওঠে না। কবিতা হয়ে ওঠার ব্যাপার, ছন্দ তাকে একটি গঠন দেয়। সেটিও জরুরি। তবে কবিতা তো জোর করে লেখার বস্তু নয়। জোর জবরদস্তি করে ছন্দ চাপিয়ে দিলে কবিতা মারা যেতে পারে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে লেখা বের হয়, তাকে যত্ন করা যেতে পারে নানা টেকনিক্যাল টুলস দিয়ে।

জাগো নিউজ: সমকালীন কবিতা সম্পর্কে অভিমত কী?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: আমাদের সমসাময়িক কবিদের প্রায় সবার সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে, তাদের লেখালেখির সঙ্গেও পরিচিত। লেখালেখি ও পত্রিকা সম্পাদনার সুবাদে এ জানাশোনার সুযোগ হয়েছে। যারা অগ্রজ তাদের নিয়ে লিখেছি, সমসাময়িকদের নিয়েও লিখেছি। তবে কারো সম্পর্কে আলাদা করে মন্তব্য এখানে করতে চাই না। কবিরা এক অর্থে ঈশ্বর, তিনি স্বয়ং ব্রহ্মা, তার সৃষ্টি নিয়ে আমি কথা বলার কে? আমাদের সমকালীন কবিদের নিয়ে আমি আশাবাদী। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি পেরিয়ে নব্বই দশকে আমরা যারা শুরু করেছিলাম সেটি নিশ্চয় মনে রাখার মতো। বিষয়বস্তু ও প্রকরণের বিবেচনায় অনেক শক্তিমান কবি আছেন এ পর্বে। পরের দুই-তিন পর্বে অজস্র কবিরা এসেছেন, এক নতুন ভাবনার জগৎ তারা তৈরি করেছেন, সূক্ষ্ম ও গভীর দ্যোতনা তৈরি করেছেন অনেকে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশের মাটি প্রকৃতি নিসর্গ বা জনপদের ছবি কম দেখা যায়; এটিকে আমি দোষের মনে করি না। বরং সাময়িক বিশ্ব, ব্যক্তিজীবনের দহন ও বোধজাত অধীরতাকে তারা শিল্পময় করে তুলেছেন গভীর অথচ নিখুঁত বুননে। একধরনের ভাষাবোধ ও ভাষার চলও লক্ষ্য করা যায় তাদের কবিতায়, যাকে খুব শক্তিশালী মনে হয়েছে আমার। আধুনিক বিশ্ব ও প্রযুক্তির ছোঁয়া কারো কারো কবিতায় রয়েছে বেশ নতুন মাত্রায়। উন্মুক্ত ও উন্মুল চিন্তার এক রেখা অনেকের কবিতায় স্পষ্ট। রোমান্টিকতা অনেকাংশে বিদায় করতে পেরেছেন অনেকে। শূন্য বা পরের দুই দশককে আলাদা করে চিহ্নিত করা আমার কাছে কঠিন মনে হয়। তবে আমি এদের সবার কবিতা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি, আপ্লুত হই। কল্পনা শক্তিকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কারো কবিতায় বেশ বাড়াবাড়ি মনে হয় কখনো কখনো। কাউকে অবাক করে দেওয়া আর প্রাণিত করা এক জিনিস নয়। কেউ কেউ পাঠককে অবাক করার চেষ্টা করেন কখনো কখনো। জাদুকরের কাজ আর কবির কাজ এক নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় তারা মাটিকে স্পর্শের চিন্তা করছেন না, সেটি এক প্রবণতা হতে পারে, শব্দকে কুহকী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা আছে কারো মধ্যে, চিন্তা ও দর্শনের শূন্যতাও লক্ষ্য করা যায় এদের কবিতায়। যার অভাবে এই শব্দকর কবি হারিয়ে যাবেন কি না ভেবে দেখা দরকার। কবিতা তো একটা দাগ রেখে যেতে চায় মানবপ্রজন্মের কাছে, সেটি শুধু শব্দের কারিগরি দিয়ে হতে পারে না। ফেসবুকে যুক্ত হয়ে কবিদের আত্মপ্রচার বেড়ে গেছে, নিভৃতি কমে গেছে। কবিদের জন্য এটি খুব ক্ষতিকর। তারা হয়তো এখন বুঝতে পারছে না অনেকে। কবিকে সেই গভীরে যেতে হয় যা কারো মতো নয়, সেই ধ্বনি, স্বর আবিষ্কার করতে হয় যা স্বতন্ত্র। তার আগের প্রজন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমস্ত কবির হাঁটাচলা মুখস্থ করে নিজেকে নতুন পথের পথিক হিসেবে দাঁড় করাতে হয়। কবিতা সবচেয়ে প্রাচীন, শক্তিশালী ও কঠিন সাহিত্যমাধ্যম, তাকে অনেকে হালকা করে দেখছেন। এখন অনেকে কবি হওয়াকে বিশেষ কিছু হওয়ার সহজ পথ হিসেবে নিচ্ছেন। নিজের গাঁটের টাকা দিয়ে কবি হওয়ার জন্য প্রচুর কবিপ্রার্থীকে আমরা দেখছি একালে। এটি শিক্ষিত সভ্য সমাজের জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। দুর্বল কবি বরাবরই ছিলেন, তবে এভাবে কাব্যবোধহীন হাজার হাজার কবি নিয়ে আমরা কী করবো জানি না।

জাগো নিউজ: নাটক এবং কাব্যনাট্যের মধ্যে কতটুকু পার্থক্য রয়েছে?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: কাব্যনাট্য আধুনিক নাটকের একটি ফর্ম। কবি, নাট্যকার ও সমালোচক টিএস এলিয়ট এর প্রবক্তা। তিনি এর তত্ত্ব দিয়েছিলেন এবং প্রথম কাব্যানাট্য লিখেছিলেন। ফর্ম হিসেবে কাব্যনাট্য বেশ জটিল এবং সূক্ষ্ম। সামান্য ভুলে কাব্যনাট্য মাটি হয়ে যেতে পারে। কবিতাকে কাব্যনাট্যে ব্যবহার করা হলেও কবিতার প্রসাদগুণের সবটা এখানে থাকে না। কবিকে কাব্যের অনুভববেদ্য অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয় নাটকের প্রয়োজনে। একথা ঠিক যে কবিরাই কাব্যনাট্য লিখবেন, সেই কথা এলিয়ট খুব স্পষ্ট করে বলেছেন। তবে কবিকে সাবধানও করেছেন তিনি। তিনি এরকমও বলেছেন যে, একজন প্রকৃত কবি কাব্যনাট্য লিখে প্রমাণ করবেন যে তিনি প্রকৃত অর্থে কবি। তার এই কথা আমাকে বেশ উত্তেজিত করেছিল সেসময়, পরে ১৯৯৯ সালে আমি একটি কাব্যনাট্য লিখি, যা কবি নামে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, পরে ‘আনত কুসুমের ঘ্রাণে’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। কাব্যনাট্য অভিনীত হতে গেলে বিশেষ ধরনের কুশীলব লাগে, যারা কাব্যনাট্যের মূল বিষয়কে হজম করতে পারবেন এবং একই সঙ্গে অভিনয় করতে পারবেন আনুভূতিক দ্বান্দ্বিক বিষয়বস্তুকে। প্রকৃত কবি দীর্ঘসময় কবিতার মেদুর শষ্পিত স্বর ধরে রাখার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি পারেন হৃদয়ের গভীরে ঢুকতে, যা কাব্যময়তার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

জাগো নিউজ: কবিদের মধ্যে কীভাবে দশকওয়ারি কাব্যচর্চা শুরু হলো?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: কবিদের কাছে তার সময়টা এক অর্থে খুব তাৎপর্যপূর্ণ। যে সময়ে তিনি বাস করেন তার সাথে অতীত ইতিহাস যুক্ত থাকলেও সমসাময়িক জীবনপ্রবাহ কবিকে প্রভাবিত করে। যদিও সেখান থেকে কোন উপাদান তিনি কীভাবে কতটুকু নেবেন, আদৌ নেবেন কি না, তাকে শিল্পিত করে তুলতে পারেন কি না অথবা চান কি না তা ভেবে দেখা খুব জরুরি। তার সমকালের লেখার ধরন তাকে প্রলুব্ধ করে বেশি, পুরোনো কবিদের রচনাপদ্ধতি তিনি অনুসরণ করে সেকেলে হতে চান না। সে কারণে সাময়িক রচনার বৈশিষ্ট্য দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ছাড়া খুব উপায় থাকে না। এটা ঠিক যে দশকওয়ারি সাহিত্য আলোচনা খুব উন্নত কোনো সমালোচনা পদ্ধতি নয়। তবে কবিকে চিহ্নিত করতে অনেক সময় এ বিভাগসূত্র কাজে লাগে। নিঃসন্দেহে এটি কবিদের বিষয় নয়, সমালোচকের বিষয়। কবি তার নিজস্ব মনোপ্রতিন্যাস নিয়ে লেখেন, তার প্রভাব বলয় নিশ্চয় আছে, তিনি কোনো দশকের কবি তা ভেবে হয়তো কবিতা লেখেন না, তবু লিখতে লিখতে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য তার আয়ত্তাধীন হয়ে পড়ে। তাকে তখন একটি পর্বে ফেলা হয়; সমালোচকেরা ফেলেন। বস্তুত কবিকে এসব ঘেরাটোপে বন্দি করা যায় না। প্রকৃত কবি বারবার নিজেকে অতিক্রম করেন, সময়ের সাথে সাথে নিজের রচনাক্রমের শক্তি ও সম্ভবনাকে নিরীক্ষা করেন, প্রয়োজনে থেমে যান, একই পৃথিবীতে বাস করে, একই উৎস ব্যবহার করে নতুন ধারার কবিতা লেখা শক্ত। আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে বুদ্ধি ও চিন্তার স্বাধীনতা নেই, সামাজিক সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য আপানাকে কার্যত স্থবির করে ফেলে; সেখানে নতুন চিন্তা ও বিভূতি যোগ করা কঠিন। ফলে দশকের বন্দিশালায় আটকা পড়েন কবিরা। কবিতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন ফরাসিরা, তাদের জীবন সমাজ সংগ্রাম স্বাধীনতা ও ক্রম অগ্রসরমান চেতনাপ্রবাহকে তারা কবিতার সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছেন। তারা কবিতার ক্ষেত্রে এরকম করতে পেরেছেন। কারণ একটি চলমান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক জীবন তারা যাপন করেছেন; আর তা থেকে যে ব্যক্তিক এষণা, মনোদৈহিক চঞ্চলতার জন্ম হয় তা কবিতার পঙ্ক্তিতে যুক্ত হয়। আমরা হয়তো এখন সাইবার জগতে থেকে বিশ্বের তাপ বা উত্তাপ গ্রহণ করছি, তবে নিজের দেশের সমাজে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না হলে তা থেকে কাব্যরেণু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ফলে যারা প্রচুর লিখছেন এবং কবি হিসেবে জীবিত আছেন বলে আত্মশ্লাঘায় ভোগেন, তারা মূলত আবর্জনা রচনা করছেন বেশি। তার রচনা কৌশলের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, তিনি তার দশকে থেকে যাচ্ছেন।

জাগো নিউজ: আধুনিক সময়ে ফোকলোর চর্চা কেন দরকারি?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: মহাত্মা লালন গেয়েছিলেন, আমি পেয়েছি এক ভাঙা তরী, জনম গেল সেঁচতে পানি, এ দেশেতে এ সুখ হইল রে, আল্লা, আবার কোথায় যাই না জানি; এই দর্শন তো পুরোনো নয় বরং মৌলিক, আদি। যতীন সরকারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি খুব রাগ করে আমাকে বলেছিলেন, তোমরা লোককবি, লোকগায়ক লোকদর্শন বলো কোন যুক্তিতে? আমি একটা যুক্তি তাকে দিয়েছিলাম, যদিও তা ধোপে টেকে না। বলেছিলাম, মূলত তাদের চেনার জন্য এরকম বলা। বাস্তবতা হলো আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদ্দীনকে কবি বলছি, আধুনিক কবি বলছি আর লালনকে বলছি লোককবি। বস্তুত এরা সবাই লালনের কাছে ঋণী। এই লোক শব্দের মধ্যে শুধু হীন্মন্যতাই খোঁজে অনেক। এই লোক অর্থ আদি, সাধারণ, যা সবার জন্য প্রযোজ্য। আমি একটি প্রবন্ধে লিখেছিলাম, সক্রেটিসের চেয়ে লালন বড় চিন্তক। কথাটি কেউ না মানলে আমার কিছু আসে যায় না। লালনের তো বহু গান আছে আমাদের কাছে, যা আমাদের মহাজীবনের পথ দেখায়। সক্রেটিস কি লিখেছেন আমরা ঠিক জানি না, যা আছে তা অন্যের মুখে জানা যায় তা গুরুত্বপূর্ণ, তবে লালনের বাণী আরও গুরুত্বপূর্ণ। লোকগান, লোকনৃত্য, লোকসংগীত, লোকদর্শন মূলত যথাক্রমে ধ্রুপদী গান, ধ্রুপদী নৃত্য ও ধ্রুপদী সংগীতের মূল উৎসধারা। ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য ও সংগীত বিশ্লেষণ করলে এই কথার সত্যতা মিলবে। সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অন্য জনরার বেলায়ও এটি প্রযোজ্য। আর সময়কে ভাগ করা সাহিত্য শিল্পে বোকামি, এখানে পুরোনো নতুন বলে তেমন কিছু হয় না, শুধু জামা পাল্টায়, শরীর আত্মা ঠিক থাকে। খ্রিষ্ট জন্মের তিন হাজার বছর আগেকার গিলগামেশের গুরুত্ব ও বিষয়বস্তু আজও আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে অন্বিষ্ট। আর যাকে আমরা পুরোনো নাম দিয়েছি সেই তথাকথিত পুরোনো নতুন মিলিয়ে জীবন ও সংস্কৃতিকে চিনে নেওয়া জরুরি। না হলে সব বাঁধন আলগা হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: একজন কবির ব্যক্তিজীবন এবং শিল্পজীবনের মধ্যে পার্থক্য কী?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: কবির ব্যক্তিজীবন ও শিল্পজীবন আলাদা হওয়া উচিত নয়। তবে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে কোনো কবি শতভাগ কবিজীবন যাপন করতে পারেন না। সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। যারা পায় তারাই যে আবার মহৎ কিছু করে ফেলবে তার নিশ্চয়তা যদিও দেওয়া যাবে না। তবে সেরকম জীবন যাপন করতে পারলে এক মোক্ষে পৌঁছানো যায়। এর বাইরে কথা আছে অনেক। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবনে কবিকে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেও আলাদা হয়ে যেতে হয়, ছদ্মবেশ নিতে হয়; কবিকে এদেশে কদাচিৎ সম্মান করা হয়। একসময় রাজদরবারে কবিরা কবিতা পড়তো। সবার সেই সৌভাগ্য না হলেও যারা পেতেন তারা বেশ সম্মান পেতেন। এখন একজন কবিকে অনেকটা লুকিয়ে নিভৃতে তার সত্তাকে টিকিয়ে রাখতে হয়। শিল্পি যদি সবসময় শিল্পজীবন যাপন করতে না পারেন। তাহলে তিনি উত্তম কিছু সৃষ্টি কীভাবে করবেন। সব কিছুকে সরিয়ে রেখে কবিকে নিভৃতি খুঁজে তার শিল্পজীবন তৈরি করতে হয়। সেখানে ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা ঘাত-প্রতিঘাত তার কাজে লাগে। তবে অন্তত শিল্পসহায়ক না হলে তার চলে না। সে কারণে অধিকাংশ কবি পালিয়ে বেড়ান সংসার জীবন থেকে। সংসার তাকে ভুল বোঝে। সমাজে বাস করলেও কবি তো খুব সামাজিক হতে পারেন না, সম্ভব না তার পক্ষে। তিনি মাথার ভেতরে বোধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পাগলের মতো। আবার জীবনের আটপৌরে অচলায়তন কবিকে যে অভিজ্ঞতা দেয়, তা কবিতার জন্য মোটেও মহার্ঘ কোনো বস্তু নয়। তার প্রয়োজন বিচিত্রভাবে মানুষ ও পৃথিবীকে দেখা; না হলে নতুন বিচিত্র পঙ্ক্তি কীভাবে তৈরি হবে? রবীন্দ্রনাথের দুটো প্রবন্ধ আছে, বাঙালি কবি নয়, বাঙালি কেন কবি নয়। তিনি এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমাদের সব কবির লেখা দুটো পড়া উচিত। তিনি বলতে চেয়েছেন, বাঙালির একঘেয়ে বৈশিষ্ট্যহীন অভিজ্ঞতাহীন জীবনে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব নয়। কারণ সেখানে নতুন কোনো চিন্তাও আসার কথা নয়, বারবার তার কাঁচা অভিজ্ঞতার পুনঃপুন বর্ণনা দিতেই তার জীবন শেষ। কবি হয়ে ওঠার জন্য অবশ্যই কবিজীবন প্রয়োজন; সেই জীবন ব্যক্তিজীবন থেকে আলাদা না হলে তার কবিসত্তা নষ্ট হতে বাধ্য। সেটা এদেশে প্রচুর হয় বলে প্রচুর অখাদ্য কবিতার জন্ম হয়।

জাগো নিউজ: বর্তমানের কথাসাহিত্যিকেরা পূর্বসুরিদের কতটা অতিক্রম করে আগাচ্ছেন?
মোস্তফা তারিকুল আহসান: এই প্রশ্নের কোনো যুতসই উত্তর আমি দিতে পারবো না। প্রথমত, এখনকার কথাসাহিত্য সত্যি সামনের দিকে যাচ্ছে কি না সেটি কীভাবে মাপা যাবে? দাঁড়িপাল্লা কী, বাটখারাইবা কী? কোনটা উন্নত কোনটা অনুন্নত তা কে বিচার করবে? দায়িত্ব কে নেবে? যারা লেখেন তারা নিশ্চয় নেবেন না। তাদের কাজ তো লেখা। আর যারা একই সঙ্গে দুই কাজ করবেন, তাদের মধ্যে নিশ্চয় অনেক সমস্যা থাকবে। কারণ তার নিজের কাজটিই ভালো করে করা উচিত। আর সত্যিকার অর্থে কোনো সমালোচনা সাহিত্য এদেশে গড়ে ওঠেনি। যারা আলোচনা করেন, তারা কেন সমালোচনা করেন না, শুধু আলোচনা করেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচিত বা কাছের মানুষের লেখা নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন। তবু যদি বইটা ভালো করে পড়ে আলোচনা করেন তা হলেও ভালো হতো। বরং তারা মলাট সমালোচনা করেন। আমাদের কথাসাহিত্য দুর্বল তা বলতে চাই না। দুর্বল লেখা সবল লেখা মিলেই দেশের সাহিত্যকে মূল্যায়ন করতে হবে। তবে যারা সত্যিকার অর্থে সিরিয়াস; তারা জানেন কথাসাহিত্য সহজ ব্যাপার নয়। প্রতিভার সাথে প্রচুর পরিশ্রম এখানে জরুরি। এদেশের অনেকে তার আগের প্রজন্মের বা সমসাময়িক লেখকদের লেখা না পড়েই কথাসাহিত্যিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। তারা মুখে মুখে পৃথিবীর লেখকদের নাম করেন, বাস্তবে কোনো লেখকের লেখা পড়েন না। শ্রেফ চাপাবাজি করেই চলেন। ধরুন, এখনকার সময়ের ওরহান পামুকের রচনাভঙ্গি কজন জানেন, তিনি উপন্যাস লেখার জন্য যে প্রস্তুতি নেন, যেভাবে এগিয়ে যান, সে সম্পর্কে কজন খোঁজ রাখেন। কাজেই বাংলা কথাসাহিত্যই ভালো করে না পড়েই আপনি আগাবেন কী করে? আমার মনে হয় আমাদের পূর্বসুরিদের থেকে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। এখন আমরা ইচ্ছে করলে পৃথিবীর কথাসাহিত্য সম্পর্কে জানতে পারি, যে সুযোগ আমাদের আগের প্রজন্মের ছিল না। তবু আমরা খুব এগিয়ে যেতে পারছি না। কারণও বলা যায় অনুমান করে দু’একটা। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সময় ব্যয় করি, তা যদি লেখাপড়া ও লেখালেখিতে ব্যয় করতাম, আর ফেসবুক জাতীয় প্লাটফর্মে সারাদিন প্রধানত আত্মপ্রচার ও দ্বিতীয়ত লোকনিন্দা না করে আরও বেশি নিজের কাজে মনোনিবেশ করতাম। তাহলে হয়তো ভালো কিছু হতো। আমাদের শওকত আলী, মাহমুদুল হক, হাসান, ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ ছিলেন, আমরা তাদের অতিক্রম করার কথা কখনো ভেবেছি বলে মনে হয় না। সেই রকম এষণা আমাদের মধ্যে তেমন নেই।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।