তাশফীয়া কাফীর গল্প: ঘোরগ্রস্ত পৃথিবী
সূর্যকে ঠিক মাথার ওপর নিয়ে ঘরে ফেরার পর গুলিবিদ্ধ পাখির মতো বিছানায় পড়ে গেলাম। আঙুলে আঙুল লাগতেই বুঝলাম শরীরটাই সূর্য হয়ে আছে। এরপর জানি না কী হলো? ঘণ্টাখানেক পর দেখলাম একটা হাওয়ার বেলুনের ভেতর আমি। বিশ্রামহীন একটা ফ্যান ঘুরছে। তার বাতাস অবশ্য আমার শরীর ছাড়া পুরো দুনিয়াকে উজাড় করে দিচ্ছে!
খালি ঘরে কেউ পা টিপে টিপে বারবার আমার দিকে আসছে। সে যত কাছে আসে; আমি ততই সরে যাই। আমি তো বেলুনের ভেতর উড়ছি! এই ভরদুপুরে কে যেন দরজায় কড়া নাড়ে। আমার ওই একটা আঙুলের ভারই তখন পুরো দুনিয়ার সমান। ব্রুসের মাকড়সার মতো কয়েকবার অ্যাটেম্পট নিয়ে দরজা খুলতেই দেখলাম একটা মানুষ। নারী-পুরুষ বোঝার ক্ষমতা ছিল না। তাই পরে আসতে বলে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
আগের রাতে দু’ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। ভাবলাম বাকি ৪ ঘণ্টা পূর্ণ করি। প্রথম এক মিনিটে এগারোবার করে বাইশবার এপাশ-ওপাশ করলাম। বিছানায় কাঁচের টুকরো দেওয়া ছিল। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত নিয়ে আমি ছটফট করছিলাম। এই কাঁচ সম্ভবত রাতেও ছিল। আমার চোখে গাঁথা দুটো আলপিন বের করতে পারছি না। তার ওপর আবার এই কাঁচগুলো! সরু একটা সোনালি আলো আমার ডানপায়ের পাতার ঠিক মাঝে এসে পড়ে আছে, সরছে না। আমি উঠতে পারলে হয়তো সবার আগে এই আলোটার গলা খুঁজে বের করতাম।
মাথার ভেতর ‘এপিটাফ’ গান বাজছে। গানটাই মনে হয় আমাকে এনার্জি দিচ্ছে আরেকবার শ্বাস নেওয়ার। একটা ক্রোধ আছে গানটায়। গান শুনবো, কিন্তু ৭ মিনিট ধরে টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার বালিশটা আমার সারাশরীর চেপে ধরে আছে। চোখগুলো সমুদ্র হয়ে আছে। সে সমুদ্রের ঢেউয়েই সম্ভবত আমার কান ভিজে গেছে। চোখ বন্ধ করতেই আমার বুকের ভেতর একটা ছোট্ট মেয়ে সরু পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি শুরু করলো। আমি এক চোখ সমুদ্র নিয়ে তার কাছে আকুতি-মিনতি শুরু করলাম তার এই আঁকাআঁকি বন্ধ করতে। সে রেগে গিয়ে আমার প্রতি নিশ্বাসে একটা করে দাগ দিচ্ছিল। আমি ছোট ছোট শব্দে ঈশ্বরের কাছে বিচার দিলাম।
এরপর হঠাৎ চোখ মেলে দেখি পুরো ঘরে কুয়াশা, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, কুয়াশায় ভিজে গেছি আমি। এক দৃষ্টিতে ফ্যানটাকে খুঁজছিলাম, কুয়াশার জন্য ফ্যান ঘুরছে না, আটকে আছে। হঠাৎ ধূসর আলোয় দেখি বারান্দা দিয়ে কুয়াশা বের হয়ে গেল। ফ্যান ঘুরতে শুরু করলো। আমার ক্ষতগুলোতে বাতাসে কামড়াচ্ছে। কাঁথা দিয়ে শরীরটা লুকালাম, বাতাস আমাকে আর দেখবে না।
আরও পড়ুন
কিন্তু রুমের দরজার বাইরে দাঁড়ানো এই মানুষটা সম্ভবত আমাকে এখনো দেখতে পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তাকে ডেকে পাশে বসিয়ে এই দুনিয়ায় আমার জন্য কে কতটুকু করেছে সব বলি। কিন্তু লোকটা আমার কাছে এলেই গলা চেপে ধরবে। সে আমার পুরো ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমার কাছে আসতে পারছে না, হয়তো ভয় পাচ্ছে। প্রায় আড়াই মিনিট ধরে হাসলাম তাকে নিয়ে।
আজান দেয়! কয়টা বাজে? কোন ওয়াক্ত? এত সুন্দর শোনাচ্ছে, মনে হয় যেন শেষবার শুনছি। ইঁদুরগুলো খাবার না পেয়ে আমার পেটের ভেতর থাকা সর্বশেষ হাড়টাও খেয়ে নিলো। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে আমি ব্রেড বিস্কুট রাখা বক্সটার দিকে তাকিয়ে আছি। দেওয়ালগুলো দু’দিকে সরে যাচ্ছে। এখনই সামনের দেওয়ালটা এসে আমাকে চেপে দেবে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম!
হঠাৎ একটা সুন্দর গানে চোখ খুললাম। ফোন বাজছে। রিংটোনের গানটা আমাকে সাহস সঞ্চয় করায়। গানটার মানে কিছুটা এমন যে, আমিই আমার দুনিয়ার হিরো। অনেক খুঁজে টিউনটা বের করে রিংটোনে দিয়েছিলাম কিন্তু তারপর থেকে এই রিংটোন এত অপছন্দ করতাম যে, ফোনটা ভাইব্রেশনে দিয়ে রাখতাম।
আজ এত ভালো লাগছে এই রিংটোন যে, আমি আর উঠে কল রিসিভ করতে পারিনি। চোখের ভেতরের আলপিন, বিছানার কাঁচ সব এখন সহ্য হচ্ছে। সহ্য হচ্ছে না শুধু মাথার ভেতর থাকা বৈঠকটা। এরা আমাকে আজীবন জ্বালিয়ে গেলো, আজও জ্বালাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে পুরো ঘরে বৈঠক করছে। অথচ আমি এই দুনিয়ায় আজ একা।
এসইউ/জিকেএস