মননে নজরুল
অভিরূপ ভট্টাচার্য্য
‘তুমি কি পদ্মা, হারানো গোমতী, ভুলে যাওয়া ভাগীরথী?’ কাকে এমন ব্যাকুল হয়ে খুঁজেছিলে কবি? অভিমানী বিশ্বের বুকে তুমিই তো সেই পরাধীন কবি, একদিন যার প্রাণ ভালোবাসার আগুনে জ্বলে জ্বলে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে গেল। কীসের জন্য যেন ছিল সে বিদ্রোহ? তার বর্ণ-বিশ্লেষণ না করেই মানুষের ইতিহাস এঁকে দিলো তোমার ছবি ‘বিদ্রোহী কবি’। হায়রে এ সমাজ। জগতের সবচেয়ে বড় পরিহাস তোমরাই। তোমাদের আজীবনের এই অভ্যাস। এইভাবে নিজেদের খুশিমতো পরিচয়ের বেড়া দিতে দিতে তোমরা কী শান্তি পাও? গোষ্ঠী-সংঘ-জাতি-ধর্ম-অধর্ম-পরিচয়... প-রি-চ-য়... কোনোদিন জানলেই না, যার মনের দরজায় তোমরা বিদ্রোহের দলিল পেরেক দিয়ে গেঁথে রেখে এসেছিলে, সে নিজের হারানো প্রেম, হারানো সন্তান, হেরে যাওয়া বিপ্লবের প্রতি ব্যঙ্গ করে বলেছিল কোনোদিন-
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুঁছবে।’
আর যদি মেনেও নিই, তোমাদের কাছে সে ছিল শুধু ‘স্বাধীনতা’ আদায়ের আগুন; বিদ্রোহের আরেক নাম। তাহলে এ উত্তর দিও নিজের কাছে, ক’জন হতে পেরেছিলে তার ‘বন্ধ কারার অন্ধ কূপে’ মানবরূপী দেবতা। তোমরা কি ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলে দীপান্তরে পীড়িতা ভারত-ভারতীকে? এই প্রশ্ন করো কোনোদিন মহাকালকে সাক্ষী রেখে। উত্তর পাবে, ‘আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে...’
আর কোন সে ভগবান শুনি? যার কাছে জীবন-মরণ লুটিয়ে রেখে বলেছিল কবি, ‘আমি মা বলে যত ডেকেছি/ সে ডাক নূপুর হয়েছে ওই রাঙা পায়...’। না... না তিনি তো সেই ভগবান, যিনি এক লহমার উপহাসে কেড়ে নিলেন সেই ব্যথিত কণ্ঠ যার ভক্তিতে স্নেহ কথা বলতো, ‘আমি সাধ করে মোর গৌরি মায়ের নাম রেখেছি কালি...’। তাই আর ভক্তি আসে না মনে। জানতে ইচ্ছে হয়, দীর্ঘ নির্বাক জীবনে কখনো এমন দিন এসেছিল কি না; যেদিন কবি বিস্মৃত হয়েছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য হলেও নিজের সেই সিংহ-কণ্ঠস্বর? জানতে ইচ্ছে হয়, তখনো কি স্নেহের ছলে বলতেন, ‘খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’। কে জানে এতটুকু সান্ত্বনা দিয়েছিল কি না কৃষ্ণমহম্মদের নিষ্পাপ শিশু-স্পর্শ! তাই যখন মন বলে আহত হয়েছে প্রিয়তম কবির বিশ্বাস, ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাঁর কণ্ঠ, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর সন্তান; বিরক্তি আসে জগতের প্রতি, নির্বাক-শূন্য বিধির প্রতি। বিদ্যুৎ স্পর্শ লাগে যেন জন্মগত দম্ভের সিন্দুকে, মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় মনুষ্যত্বের অহংকার, যে অহংকারের বর্ণপরিচয়—
‘আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর।’
আরও পড়ুন
ধিক্, ধিক্ ধিক্, এ জীবনের ব্যর্থতাকে, এই শূন্য বিধির কাছে নতজানু হওয়াকে, এই ভিক্ষাপ্রাপ্ত স্বাধীনতাকে, এ দেশের মানুষের সংকীর্ণ দরিদ্র মানসিকতাকে। জাত ধর্ম আর রাজনীতির ধ্বজা তোলার আগে এদের কি একবারও মনে পড়ে না বাকরুদ্ধ কবির জলে ভেজা দুটো চোখ? যদি তা-ই হয়, তবে তোমার জন্মদিন পালন বৃথা, বৃথা, বৃথা। শুধু উপহাসের স্মরণ-নামা, আর অভিনয়ের রাখ-ঢাক। যদি কোনোদিন, কোনদিন আর্ফিয়াসের বাঁশির সুরে আর দেবাদিদেবের পদধ্বনিতে আসে তোমার স্বপ্নের সেই নতুন ভোর, সেইদিন, শুধু সেইদিনই হবে তোমার জীবনপাত, তোমার সংগ্রাম, তোমার বিদ্রোহ, এদেশের মাটিতে ফেলে যাওয়া তোমার সব ব্যর্থতার মুক্তি লাভ।
সেদিনের অপেক্ষায় থেকো কবি। জানি আজও কোনো নির্বাক অভিমানে সুর গাঁথছো তুমি কোন দীপান্তরের বাঁশির শব্দ শুনে শুনে। শান্তি পেয়েছো কি আজ? নাকি আজও বুলবুলের মৃতমুখের দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে বিস্মৃতির ব্যথায় ব্যথিত দীর্ঘশ্বাস, তোমার হয়ে কথা বলে?
‘ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ স্বপন সম,
আঁচলে গাঁথা মালা, ফেলিও পথ পরে/...
...বিরহী কুহু কেকা, গাহিবে নীপ শাখে
যমুনা নদী পারে শুনিবে কে যেন ডাকে/...
...শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে...।।’
লেখক: দ্বাদশ শ্রেণি, বিজ্ঞান বিভাগ, দয়ানন্দ অ্যাংলো বৈদিক পাবলিক স্কুল, হলদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
এসইউ/এমএস