দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর গুচ্ছ কবিতা
চোখের গভীরের গভীরে জল ও অন্যান্য
এক.
প্রাণিমাত্রের ভিড়ে মানুষ
মন খারাপের কত কারণ সামনে আসে ক্ষণে ক্ষণে
অনেকেরই কষ্টের নোনা জলের প্লাবন দৃশ্যমান নয়
দানের প্রতিদানে অভিঘাত করে কেউ কেউ
পশুর উন্মাদনায় জীবন ধসায় ।
মানুষ ভুল করে, করবেই; মানুষ তো ঈশ্বর নয়
তার ভুলটুকু বাদ দিয়ে শুদ্ধটুকু উচ্চারণ করার বুকের ভেতর
কিংবা পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে উর্বর জমিন আছে ক’জনার
এর উত্তর মেলা ভার, বরং শুনতে হয় অকৃতজ্ঞের আরও বাক্যবাণ!
শত দিন শত কিছু দাও এক দিন দিতে না পারলে
খারিজের খতিয়ানে উঠে যাবে নাম
মানুষ নামধারী প্রাণিমাত্রের ভিড়ে
মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব ভার, মানুষ নয় সবাই।
অকৃতজ্ঞতার বীজ যারা পুঁতে রেখেছে হৃৎপিণ্ডে-মগজে
তাদের তুষ্ট করা কঠিন, বড়ই কঠিন
ওরা মুখোশের আড়ালে রেখেছে পরশ্রীকাতরতার মতো
কতই না সংক্রামক জীবাণু, মুখোশধারীদের চেনা খুব দায়
মানুষ নামধারী এ প্রাণীরা যে আবর্জনা সৃষ্টি করে
কোনো পশুরও তা সাধ্য নাই।
বিনয়-কৃতজ্ঞতা-নতমুখ জীবনের অঙ্গশোভা
অন্যকে কষ্ট দিয়ে যারা পুষ্ট হতে চায়, তারা মানুষ নয়
মানুষ হওয়া এত সহজ নয়, মোটেও নয়
বারবার বলি, অশ্রুহীন কষ্টগুলো খুব বেশি পোড়ায়।
দুই.
চোখের গভীরের গভীরে জল
তুমি আমার চোখ দেখেছ, অবিরত দেখছ কিন্তু
চোখের গভীরের গভীরে টলমল জল দেখনি
তুমি বহুবার জানতে চেয়েছ এত প্লাবনের কথা বলি কেন
তোমার এমন প্রশ্নে মনের মাঝে অন্তর্যামী হেসেছে
তবু বুকের মধ্যে শীতলপাটি বিছিয়ে দিয়েছি
কত মাতাল চাওয়া হয়ে গেছে উড়নচণ্ডী
বিন্দুর মাঝেই সিন্ধু খুঁজি, থমকে দাঁড়ানো জীবনও স্বপ্ন দেখে
কখনও কি শোনোনি জলকণ্ঠস্বর!
সমুদ্রের স্বরে-সকাতর প্রেমে উদাসী ক্ষণে রাত্রি নামে
এসো, স্পর্শ করো; দেখো নিজেকে ভেঙে কতটা ভ্রুক্ষেপবিহীন
আমাকে বাজাও , সেতারের তারে আঙুল বোলানোর মতো বাজাও
ব্যথিত প্রশ্নের হাড়, কঙ্কাল সব নিশ্চিহ্ন করে দাও
পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে চাপ দাও দুই হাতের আঙুলে
সব কষ্ট ঠেলে দাও দূরে, আলোকবর্ষ দূরে
বাঁধভাঙা উৎসের অনিবার্য স্রোতে তুমিই তো একমাত্র পরিত্রাণ।
শখের নিছক শব্দব্যবসায়ীদের উন্মত্ততায় শান্তি অক্ষত রাখা মুশকিল
শর্তে ভরা সম্পর্কগুলো আড়ালে রাখা কঠিন হয়ে যায়
বন্ধুত্ব, মানবসংসর্গ, আনন্দ-ব্যর্থতা বোধে ওষ্ঠাধারে উষ্ণতা পাই
এসো, স্পর্শ করো; তোমার পায়ে নূপুর পরাই
তুমি আমার চোখ দেখেছ, অবিরত দেখছ কিন্তু
চোখের গভীরের গভীরে টলমল জল দেখনি কখনও।
ঘুমচোখে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন অতল ঘুমের মধ্যে জল টলমল
তোমাকে অনেক দিন পর বলছি, জটিলতাহীন সূর্যরশ্মির দিকে তাকাও
সেখানেও দেখবে জলের ভেতর জল টলমল, অবিরত চঞ্চল
লক্ষ শব্দ মাথায়, লক্ষ শব্দ বুকে, লক্ষ শব্দ শিরা-উপশিরায়
শুধু চোখের গভীরের গভীরে জলের কোনো শব্দ নেই।
তিন.
তুমি অলৌকিক আসর
যতবার স্পর্শ করো ততবারই
অন্যরকম সতেজ হয়ে উঠি
যতবার উপেক্ষা করো ততবারই
নুইয়ে পড়ি, একেবারে নুইয়ে
যতবার বলো এসো, উজ্জ্বল বিভায় এসো
ততবারই বাকি অর্ধেক জগৎটা খুঁজি।
যতবার হাত বাড়াও বৃহত্তর ভালোবাসায়
ততবারই অন্তর্গত ভাবনায় ডুবে যাই
পরম আত্মার গভীরে তুমি জেগে রও
তোমার বোধের মাঝে সমাহিত করো
সময়ের বন্য হাওয়া, নেমে আসুক নতুন ভোর
অশ্বারোহী হয়ে যাব সূর্যভ্রমণে।
যতবার তুমি তোমাকে আমায় দাও
ততবারই রোরুদ্যমান স্বপ্ন আবার প্রেরণায় জেগে ওঠে
শরতের আকাশে হীরের স্তূপ গড়ে
অনন্ত অঙ্গীকার স্ফটিকশুভ্র জীবনের সন্ধান দেয়
শালবনের ভেতর চকচক করে শান্তির আলো
দৈবযানগুলো বায়ুমণ্ডল পেরিয়ে যায়।
তুমি প্রসন্ন থাকলে নিরর্থক তর্ক, গর্জন, লড়াই
আলোকবর্ষ দূরে সরে যায়, অদৃশ্য হয়ে যায়
মৌমাছির ঝাঁক মধু জড়ো করে মধুচক্রে
সৃষ্টি উল্লাসের ঘণ্টাধ্বনি সুমিষ্ট প্রতিধ্বনি ছড়ায়
সম্ভাবনার আলোয় সব বিষণ্নতা কেটে যায়
মানবিক বিশ্ব গড়ে ওঠে, অলৌকিক আসর।
এইচআর/এএসএম