এমরান কবিরের গল্প: ভ্রম ও বিভ্রম
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছি। হঠাৎ চোখ গেল এক ভদ্রলোকের দিকে। গাড়ি থেকে নামছেন। ড্রাইভার এসে দরজা খুলে দিলো। ভদ্রলোক কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা সুপার শপে ঢুকলেন। আমি হা হয়ে তাকিয়ে থাকি।
বউ রাগ ঝারে আমার ওপর, ‘কী হলো, ভাড়া না দিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
আমি যেন সম্বিত ফিরে পাই। ভাড়া দিয়ে সুপার শপের দিকে হাঁটতে থাকি বউ আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে।
আমার ঘোর কাটে না। কারণ যে ভদ্রলোকের দিকে আমি তাকিয়েছিলাম তিনি দেখতে অবিকল আমার মতো। লম্বা নাক, খাঁড়া খাঁড়া ঝিলিক দেওয়া কালো চুল, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আমার অনতিতরুণ বয়সের মতো হাঁটার ধরন। আমার তো অর্ধেকের বেশি চুলই পেকে গেল। চেহারায় বয়সের ছাপ। অথচ উনি আমারই নকল প্রতিচ্ছবি যেন। তরুণতর। উচ্ছল। সফল মানুষের এক ধরনের ভঙ্গি থাকে। ঠিক বর্ণনা করা যায় না। দেখলেই বোঝা যায়। লোকটা সেরকম। খুব আকর্ষণীয়।
সুপারশপে ঢুকেও আমার ঘোর কাটে না। আমি লোকটাকে খুঁজতে থাকি। বউ আমার অস্বাভাবিকতা ধরে ফেলে, ‘কী হয়েছে তোমার? এমন ত্যাবদা মেরে আছো কেন? আমাদের দিকে কোনো খেয়াল নাই!’
আমি কাচুমাচু মুখে তাকাই, ‘না তো!’
বউ একটা ডলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। থ্রি পিছটা দেখতে থাকে মুগ্ধ হয়ে। হাত দিয়ে ধরে এর সুতা পরখ করার নামে ট্যাগ দেখে। দাম দেখে চোখ-মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়। দ্রুত সেখান থেকে সরে অন্য দিকে যায়।
আমি বউয়ের হাত ধরে বলি, ‘এটা নাও।’ বউ চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘নাহ।’ নাহ বলার সাথে সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টাও থাকে। আমার অনুভূতিতে সেটাও এড়ায় না। তবুও আমি জোর করি। বউ কী ভাবে আমি বুঝতে পারি। সাড়া দেয় না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যায়। এই সাড়া না-দেওয়া আর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়ারও একটা মানে আছে। নীরব অবজ্ঞা আর আমার সামর্থহীনতার প্রতি তাচ্ছিল্য।
বউ এটা সেটা দেখতে থাকে। কিছুই কেনে না। এরই মধ্যে আমার একমাত্র ছেলে একটা খেলনা দেখিয়ে বলে, ‘বাবা এটা নেবো।’ আমি ট্যাগ দেখি। আমার বউ ছেলের হাত থেকে খেলনাটা কেড়ে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দেয়। বলে, ‘বাবা ওটা পচা।’ পচা বলতে বলতে আমার দিকে তাকায়।
এই তাকানোরও একটা মানে আছে। এই মানেটা সে মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে বলেই আমার সংসারে আছে। আমিও মেনে নিয়েছি।
এরই মধ্যে ওই লোকটাকে দেখি। অবিকল আমার মতো। কী তীক্ষ্ন ভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে হেঁটে যাচ্ছে। কী দারুণ দীপ্তিময় তার অভিব্যক্তি। এমন আভিজাত্য তার অবয়বে। মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
তিনি কার্ডে বিল পে করলেন। তার সহকারীর হাতে অনেক জিনিসপত্র। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি। আমার মতো কেন হবে! ওটা তো আমিই। আমি যে ব্যাংকের কার্ড ইউজ করি সে ব্যাংকের কার্ড দিয়েই তিনি বিল পরিশোধ করলেন। আমি ভিড় ঠেলে কাউন্টারের দিকে যাই। আমি যেতে যেতে তার বিল পে করা হয়ে যায়। তাকে দরোজা দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখি।
কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। ভাই একটু আগে যিনি কার্ড দিয়ে বিল পে করলেন তাকে চেনেন? নাম জানেন?
কাউন্টার কর্মী একটু ভাবেন। তারপর প্রিন্টেড মেমো দেখে বলেন, ‘ওনার নাম এমরান কবির।’
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বলে কী! দেখতে আমার মতো! আবার নামটাও আমার নামে!
বউয়ের ধমক কানে বাজে, ‘এই তুমি এখানে কী করছো। আমাদের ওদিকে একা একা রেখে? এতদিনেও দায়িত্বজ্ঞান হলো না?’
অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে আমরা বাসায় ফিরি। রিকশায় বসেও বিষয়টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে পারি না।
দুই.
বাসায় ফিরে সাহস করে বউকে কথাটা বলতে চাই। প্রথমে আমতা আমতা করি। বলি, ‘আমি একটা কথা বলতে পারি তোমাকে?’
বউ ফোন টেপাটেপি করছিল। আমার এরকম কথা শুনে মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মনের ভাবটা বুঝতে পারছি। হঠাৎ আদিখ্যেতা কেন, বউ হয়তোবা এরকম ভাবছে। মুখের অভিব্যক্তি তো তাই বলে।
বউ চোখ নামিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে বলে, ‘হঠাৎ এত কার্টেসি মারছো কেন? বলো কী বাণী শোনোবে মোরে? কর্ণ পাতিয়া রহিয়াছি।’
কর্ণ পাতিয়া রহিয়া থাকিলেও বউয়ের চোখ একটা অনলাইন চেইন শপে। সাবু শপ। সেখানে এক্সক্লুসিভ কসমেটিক্স বিক্রি করা হয়। বউ প্রায়ই আনন্দ ও উত্তেজনার মিশেলে সেগুলোর গল্প করে আমার সাথে মাঝে মাঝে। আমি কিনতে বলি। তখনই বউয়ের মন খারাপ হযে যায়। বুঝতে পারি, সে আমাকে বোঝে। আমার সামর্থও বোঝে।
আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলি, ‘জানো, আজ সুপার শপে একজনকে দেখলাম ঠিক আমার মতো। আমরা যখন রিকশা থেকে নামলাম তখনই তাকে দেখেছিলাম গাড়ি থেকে নামতে। তারপর দেখলাম অনেক জিনিসপত্র কিনে বিল পে করে বের হতে। কাউন্টার কর্মীকে গিয়ে বললাম উনি কে চেনেন?’
বউয়ের চোখ মোবাইলের স্ক্রিন থেকে সরে এখন আমার মুখের দিকে, চোখের পাতা অপলক। আমি আরেকটু সাহস সঞ্চয় করে বলতে থাকি, ‘কাউন্টার কর্মীকে জিজ্ঞেস করায় সে পেমেন্টের স্লিপ দেখে বলল উনার নাম এমরান কবির।’
বউ ঝট করে বিছানা থেকে দ্রুত হেঁটে অন্য ঘরে যায়। সুগার মাপার যন্ত্র এনে খুলতে থাকে, ‘আসো তো কাছে। সুগার মাপি। সুগার তো মনে হয় লো হয়ে গেছে।’
স্ট্রিপ নেই। বউ চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘তোমাকে না গত সপ্তায় বললাম স্ট্রিপ আনতে! ভুলে যাও কেন। মন কিসে থাকে।’
সুগার মাপার যন্ত্র টেবিলে শব্দ করে রেখে রান্নাঘরে চলে যায় বউ। এক গ্লাস চিনির শরবত নিয়ে এসে বলে, ‘নাও গিলো।’
আমি নিঃশব্দে চিনির শরবত গিলতে থাকি। আজ বিকেলেই সুগার মেপেছি খাবার অন্তত চার ঘণ্টা পরে। ফোরটিন প্লাস। সুতরাং এখন সুগার লো হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এই কথা বলার মতো সাহস হয় না আমার। এক চুমুকে চিনির শরবত সাবাড় করে দিই।
তিন.
অনেকদিন পর বাড়ি যাই। ঘন ঘন বাড়ি গেলে খরচ হয় অনেক। সামলাতে পারি না। অথচ বাবা-মার জন্য মনটা সারাক্ষণই কাঁদে। বয়স হয়েছে তাদের। এই সময় বাবা-মার দিকে হাসি মুখে তাকালেও তারা সুখ বোধ করেন। এটুকুই তারা চান। এর বেশি কিছু না। আমি সেটাও দিতে পারি না।
আমরা যাবো বাড়িতে। এ সংবাদ পাওয়ার পরই বাবা-মার অপেক্ষার অন্ত থাকে না। কত ভালোবাসার আয়োজন থাকে!
বাবা বলেন, ‘তোমাদের খবর কী। কেমন আছো তোমরা।’
আমি বলি, ‘ভালো আছি আব্বা। আলহামদুলিল্লাহ।’
‘তোমার ফ্ল্যাটের খবর কী।’
আমরা কয়েকজন মিলে শেয়ারে জায়গা কিনে ঢাকার মোহাম্মাদপুরে সাত মসজিদ হাউজিংয়ে বিল্ডিং করছি।
আমি আব্বার সফেদ শুভ্র চেহারার দিকে তাকিয়ে বলি, ‘আব্বা, আমার ফ্ল্যাটের কাজ বন্ধ আছে। টাইলস আর ফিটিংসের টাকা দিতে পারছি না। ইনটেরিয়র ডেকোরেশনও করা হয়নি। অন্যদের কাজ কমপ্লিট হয়ে গেছে। কেউ কেউ ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। কেউ ভাড়া দিয়েছে।’
আব্বা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আমি পলকহীন চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকি! আব্বা এটা নিয়ে কথা বাড়ান না আর। আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার চাকরি কেমন চলছে।’
আমি বলি, ‘ভালো চলছে আব্বা। তবে পরপর দুইবার প্রোমোশন হলো না। একবার করোনার জন্য। পরেরবার একটা অভিযোগের জন্য। যেটা নিয়ে তদন্ত হয়ে গেছে। রায় হয়নি।’
আব্বা প্রসন্ন চিত্তে আবারও বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
এটা নিয়ে কেউ কথা বাড়াই না। বিব্রতকর বলে। একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমি চাকরি করি। সেখানে একজনের অপকর্মের দায় আমার ওপরও এসেছে। সেটা নিয়ে তদন্ত হয়েছে। কয়েকবার ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখী হয়েছি।
আমিও মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলি অন্য কারণে। ভাগ্যিস বউ নেই এখন। থাকলে সামনা সামনি কিছু বলতো না। পরে ভূমিকম্প হতো।
আব্বার সফেদ হয়ে যাওয়া চুল দাড়ি এবং সফেদ পাঞ্জাবির দিকে তাকাই। মুখের দিকে তাকাই। চোখের দিকে তাকাই। আব্বাকে দেবদূত মনে হয়। আব্বা কখনো ভুল বলতে পারেন না। কিন্তু...
আব্বা একটু থেমে বলেন, ‘আমাদের কিছু জায়গা জমি আছে। কোনো কাজে আসছে না। কিছু গাছ গাছালি আছে। ওগুলো বিক্রি করে ফ্ল্যাটের কাজটা সম্পূর্ণ করো।’
আমি স্পষ্ট করে ততধিক দৃঢ়তার সাথে বলি, ‘না আব্বা। এই কাজ আমি করতে পারবো না।’
আব্বা পাল্টা যুক্তি দেখান, ‘দেখো এগুলো তো প্রয়োজনেই তুমি ব্যবহার করছো। নষ্ট তো আর করছো না। আর এগুলো তো তোমাদের জন্যই।’
আমি বলি, ‘তবুও না আব্বা। আমি পারবো না। একটা ব্যবস্থা হবেই আমার।’
আব্বার ঠোঁটে একটি সূক্ষ্ন হাসির রেখা ফুটে ওঠে। আবারও বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আব্বা পৈতৃক সূত্রে যৎসামান্য জমি পেয়েছেন। শিক্ষকতা করেছেন মূলত। শিক্ষকতার চাকরি করেননি। জীবনে যে কী পরিমাণ কষ্ট করেছেন তা বাস্তব মনে হবে না। মনে হবে রূপকথা। জীবনে অনেক গাছ লাগিয়েছেন। নিজের জায়গায়। অন্যের জায়গায়। রাস্তার ধারে। জীবনের কারো কোনো ক্ষতি করেছেন সে-কথা স্বয়ং ফেরেশতাও বলতে পারবে না। আব্বার কাছে প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন। দোয়া নিতে, দেখা করতে, কারণে অকারণে। কিছু না হলেও একটু কথা বলতে।
আব্বা আচমকা জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার একজন বন্ধু ছিল না, হাদিউল নাম?’
‘জি আব্বা।’
‘ওর খবর কী। তুমিও থাকো না এখানে। তোমার বন্ধুরা কেউ আসে না আর।’
‘আব্বা হাদিউল জেলে আছে।’
আব্বা কিছু বলে না। অপলক চেয়ে থাকেন। আমি বলি, ‘দুদকের একটা মামলায় হাদিউল জেলে আছে। তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’
আব্বা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
আমার বন্ধু হাদিউল একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে খুব ছোট চাকরি করে। কিন্তু তার জৌলুসের শেষ নেই। খুব অল্প বয়সে বাড়ি গাড়ি করে ফেলে। অনেক টাকা পয়সা, জায়গা জমি। বছরে বছরে গাড়ি পাল্টায়। একদিন আমি আব্বাকে হাদিউলের জৌলুসের কথা বলেছিলাম। আব্বা দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘সব অর্থহীন। একদিন বুঝবে।’
আব্বা এতটাই দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বলেছিলেন যে আমি আর কথা বলিনি। যা বোঝার বুঝে গেছি।
চার.
কর্মস্থলে ফিরে আসি। বিকেলে একটা মেইল আসে। আমাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অচিরেই স্থগিতকৃত আমার সকল প্রাপ্য আমাকে দিয়ে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। অফিসে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। মিষ্টি খাওয়া হয়। সবাই খুব খুশি। খুশি হয় কয়েকটা কারণে। এক, আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। দুই, ন্যায়বিচারের অস্তিত্ব আমাদের অফিস সংরক্ষণ ও সম্মান করে। তিন, আমার মতো অফিসার শাস্তি পেলে খুবই খারাপ উদাহরণ হয়ে যেত।
পরের দিন আরেকটি চিঠি পাই। আমার বকেয়া প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে। সাথে স্থগিতকৃত বোনাস। এবং একটি অতিরিক্ত বোনাস পুরস্কার হিসেবে।
পাঁচ.
আব্বার হাতে লেখা একটা চিঠি পাই কয়েকদিন পর। হাতে লেখা চিঠির অস্তিত্বই তো বিলিন হয়ে গেছে। চিঠিটা পেয়ে বুকে চেপে ধরি। নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিই। শৈশবে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়ার সময়কার আনন্দ বয়ে যায়। চিঠির ভাঁজ খুলি।
মাঝারি সাইজের অক্ষরে অক্ষরে লেখা। নীল কালি। প্রশ্ন জাগে আব্বা নীল কালিতে লিখলেন কেন? আমি পছন্দ করি সে-জন্য? আব্বার একটা পকেট ডায়েরি ছিল। সেটাও নীল কালিতে লেখা। পাইলট কলমে। আমরা সে-ডায়েরি মাঝে মাঝে পড়তাম। আমাদের ভাই বোনদের জন্ম তারিখ লেখা ছিল সেখানে। ডায়েরিটা যে কোথায় আছে? আব্বার চিঠি পেয়ে ডায়েরিটার কথা মনে পড়ে গেল।
ইমরান,
দোয়া নিও। তোমরা কেমন আছো? আশা করি ভালো। তোমাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই সে-জন্য এ চিঠি লেখা।
মাঝে মাঝে নিজের আয়নায় নিজেকে পরখ করতে হয়। এ আয়না বিমূর্ত। পরখ করতে হলে এ আয়নাটা প্রথমে পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। তোমার মলিনতা এবং সজীবতা এখানে ধরা পড়বে। আর বস্তুগত আয়নায় নিজেকে দেখতে হলেও পরিচ্ছন্নতা জরুরি। এই পরিচ্ছন্নতা যতটা না আয়নার তার চেয়ে বেশি ব্যক্তির। যা হোক, আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো।
মানুষ সুখ প্রত্যাশী এবং কল্পনাপ্রবণ। দুটোই অসীম। এবং বাটখাড়াহীন, অপরিমাপ্য। এজন্য যখন তুমি নিজেকে অসুখী এবং বঞ্চিত মনে করবে; তখন অন্যের সফলতার মাঝে নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে ইচ্ছে করবে। তাতে অবচেতন মনে তৈরি হওয়া ওই ঘোর তোমাকে ভ্রম এবং বিভ্রমের মাঝে ফেলতে পারে। তাতে তোমার কাঙ্ক্ষা আপাত অন্য সফল ব্যক্তির মধ্যে নিহিত হয়ে তার ভেতরে তোমার নিজের চেহারা দেখা যেতে পারে। ওই কাঙ্ক্ষাটাকে হত্যা করা জরুরি।
তোমার ব্যর্থতার খবরে, সাফল্যের খবরে আমি আলহামদুলিল্লাহ বলেছি। তুমি দুঃখ পাওনি জানি, কিন্তু একটু হলেও বিব্রত হয়েছো। শোনো, বর্তমানকে মেনে নেওয়াটাই হলো একজন সার্থক মানুষের লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য। কারণ বর্তমানকে মেনে নিলে বর্তমানটা ভালো থাকে, ভবিষ্যৎটা তাতে ভালো হয়।
আবারো দোয়া নিও।
তোমার আব্বা।
ছয়.
চোখ-মুখ ভিজে গেছে অশ্রুধারায়। প্রশান্তি নেমে এসেছে হৃদয়জুড়ে। আব্বার সারাজীবনের দর্শন এবং জীবন প্রণালির সার-সংক্ষেপ অতি অল্প কথায় জানিয়েছেন। আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। সুপার শপে কেন আমি আমার চেহারার মতো আরেকজনকে দেখেছিলাম সে-উত্তর যেমন পেয়েছি; তেমনি পেয়েছি সুসংবাদ বা দুঃসংবাদে আলহামদুলিল্লাহ তথা মেনে নেওয়ার যথার্থ কারণ ও ব্যাখ্যা। আমি আসলে সুপার শপে আমার নিজের প্রত্যাশিত সাফল্যের ছবিটা অন্যের মাঝে দেখেছিলাম। চিঠিটা ভাঁজ করে বুক পকেটে রাখি।
বাসায় ফিরে বউয়ের হাতে চিঠিটা দিয়ে বলি, ‘খুব যত্ন করে রেখে দাও।’
বউ বলে, ‘কী এটা।’
আমি বলি, ‘মহাজীবনের পাঠ, আমাদের মহাকাল, আমাদের আয়না।’
এসইউ/জেআইএম