দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণুর কবিতা
জীবনের খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য
এক.
জীবনের খণ্ডিত পাণ্ডুলিপি
তোমরা টাকা জমাতে চাও? জমাও।
আমি মানুষ জমাতে চাই, মানুষ।
তোমরা খ্যাতি কুড়াতে চাও? কুড়াও।
আমি ফলবান বৃক্ষের মতো নত মানুষের পদস্পর্শ চাই।
তোমরা দীর্ঘায়ু হতে চাও? হও।
আমি উৎকৃষ্ট শিল্পের জন্য বেদনাই চাই।
তোমরা সুখের কথা আড়ম্বর করে বলতে চাও? বলো।
আমি দুঃখের চাষবাসই করে যেতে চাই।
তোমরা ক্ষমতার দণ্ডধারী হতে চাও? হও।
আমি জীবনের উঠোনে জীবন বিলিয়ে প্রাণের উর্বরতা চাই।
তোমরা স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চাও? ওঠো।
আমি আত্মায় আত্মায় ডুবে যেতে চাই বলেই শিখিনি সাঁতার।
তোমরা কি জানো গাছের মগডালে কিংবা ক্ষমতার চূড়ায় উঠলেও
নিচে কিন্তু নামতেই হবে কোনো একবেলায়।
দুই.
বিপন্ন মানবতার প্রলম্বিত ছায়া
বেদনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা
সেই আয়নাল কুর্দির কথা কি সভ্যতা-মানবতা মনে রেখেছে
যে বালিতে মুখ গুঁজে সুমদ্রতীরে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেছিল?
‘আমার সন্তানেরা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু।
ওরা প্রতিদিন আমার ঘুম ভাঙাত
খেলা করত আমার সঙ্গে
এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে?
এ সবকিছুই হারিয়ে গেছে।’
সিরীয় শিশু আয়নালের বাবা আবদুল্লাহ কুর্দির
শোকার্ত ওই উচ্চারণও কি
কথিত মানবিক বিশ্ব মনে রেখেছে?
তুরস্কের সৈকতে লাল শার্ট, হাফ প্যান্ট পরা
নিথর আয়নাল কিছু বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিলো
অভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপের নির্লিপ্ত নেতাদের
শেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙালেও এরই মধ্যে
আয়নালের ভাই গালিব আর তার মা রেহানাসহ
গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার প্রায় আড়াই হাজার মানুষের প্রাণ
ভূমধ্যসাগরে চিরতরে ডুবে গিয়েছিলো!
তুর্কি আলোকচিত্র সাংবাদিক নিলুফার দেমি বলেছিলেন,
‘যখন বুঝতে পারলাম ছেলেটাকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই নেই
মনে হলো, ওর ছবি তুলি; বেদনাদায়ক ঘটনাটা দেখুক সবাই
আশা করি, এই ছবি যে ধাক্কা দিয়েছে
তা চলমান সংকট সমাধানে সহায়ক হবে।’
বালু দিয়ে আয়নালের ভাস্কর্য বানিয়ে এর মর্মস্পর্শিতার
প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন ভারতীয় শিল্পী সুদর্শন পট্টনায়েক।
ভাস্কর্যের পাশে তিনি লিখেছিলেন,
‘ভেসে যাওয়া মানবতা... লজ্জা লজ্জা লজ্জা’।
আলোকচিত্র সাংবাদিক দেমি, ভাস্কর পট্টনায়েক
তোমাদের সেই বেদনাকাতর আবেদন
মেরুকরণের বিশ্বে ভূ-রাজনীতির সমীকরণের বৃত্ত ভেদ করে না
গাজায় চরম মানবিক বিপর্যয়েও পরাশক্তির ভোঁতা বিবেক জাগে না
ইসরায়েলের জিঘাংসায় হাজার হাজার শিশু জন্মসনদের আগেই
মৃত্যুসনদ নিয়ে ফের প্রশ্ন রেখেছে, এই কি সভ্যতার উৎকর্ষ আলো!
যুদ্ধ নয় শান্তি চাই- শান্তিপ্রিয়দের এই চিৎকার কে শোনে
রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও বিশ্বের কত দেশেই
বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানবতার প্রলম্বিত ছায়া!
তিন.
বিরহী সরোদ
ক্ষয়ে ক্ষয়ে অক্ষয় হতে গিয়ে
পাথর সময়ের তিরবিদ্ধ হয়েছি
দহনের রঙ কী কিংবা অনুতাপের অনুভূতি
এমন প্রশ্নে বুকের ভেতর আকাশ ভেঙে পড়েছে বারবার।
কষ্টকে যত্নে রাখি, কী ভীষণ আকুলতায়
অসুখের মাঝেও নিত্যসুখ খুঁজি
পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে শুধুই বেদনার সংসার
নোনা জলের প্লাবনে সিক্ত দীর্ঘশ্বাস।
প্রাণের জন্য প্রাণ দেওয়া কঠিন কিছু নয়
বরং প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রাণ খুঁজে পাওয়াই কঠিন
আনন্দের গোপন উৎস খুঁজতে গিয়ে
জন্মান্ধের কাতরতা নিয়ে ফিরে এসেছি।
কেবলই স্বপ্নের দুকূল ভাঙে দুঃস্বপ্ন
হৃদয় গহিন তলে শুধুই যেন বিষবাষ্প
ঋণাত্মক থেকে ধনাত্মক হতে গিয়ে পৌঁছেছি শূন্যে
তরমুজের ফালির মতো এক চিলতে রোদ্দুরের আকাঙ্ক্ষায় বয়স বাড়ে।
চারদিকে অবসাদের দেয়াল
শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বঞ্চনার কালো দাগ
আগুনের ঘ্রাণ নিয়ে বেঁচে আছি বহুকাল
তুমি যাও, এবার মৃত্তিকায় ডুব দেব।
ইচ্ছেগুলো বিনাশীদের হাওয়ায় উড়ে যায়
নিঃশব্দ-নির্জনে কাঁদে বিরহী সরোদ
জানতে বড় সাধ জাগে, বড় সাধ
নিজেকে কতটা শূন্য করে অন্যকে পূর্ণ করা যায়?
এইচআর/জেআইএম