শফিক আজিজের গল্প: বাঁশ

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৯ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪

উপবন ইন্টারসিটিতে সিলেট থেকে ঢাকা। এরপর সিল্কসিটি আন্তঃনগরে ভোরবেলা রাজশাহী পৌঁছাই কোনোরকম ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই। এবার মহানন্দা এক্সপ্রেসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে হবে। এ ট্রেন সম্পর্কে ধারণা পেতে এতদঞ্চলে বহুল কথিত একটি প্রচল-কথা এখানে বলা যেতে পারে। যে কেউ চলতি ট্রেন থেকে ধীরে-সুস্থে যে কোনা স্থানে নেমে প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্ন করে একটু পা চালিয়ে সামনে গেলেই আবার ট্রেনটি ধরতে পারবেন। তো, কচ্ছপ-গতির এ ট্রেনেই পৌনে এগারোটার দিকে কনসাট স্টেশনে পৌঁছে ব্যাগটি একপাশে রেখে, একটি চায়ের দোকানে বসে চায়ে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছি। বলা নেই-কওয়া নেই, হঠাৎ দৈত্যের মতো চেহারা আর একগাল হাসি নিয়ে কামা এসে সামনে দাঁড়ায়: হাঁরঘের ভাইজে জী! কখন আইছাসেন? কুনু খবর দ্যান্নিখো! উত্তরে আমাকে বিশেষ কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করে। কী আর করা, আমিও তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক শেষ করে ওর পেছনে পেছনে ছুটতে থাকি। একটু সামনেই ভ্যান স্টেশন; কামা এসেই একটি ভ্যানে চেপে বসে। ব্যাগটি একপাশে রেখে আমাকেও প্রায় টেনে তোলে। ভ্যানটি ছুটতে থাকে আমাদের গায়ের উদ্দেশ্যে, আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

কামা আমার চাচাতো ভাই। দেহটা অযথাই বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে—সে তুলনায় মগজ বাড়েনি। পড়াশোনা বিশেষ করেনি—টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। পারলে যেচে-পড়ে লোকের উপকার করে—স্বচ্ছল পরিবার—বাড়ির কেউ তেমন কিছু বলে না। পথে একটানা কথা বলে যাচ্ছে—এ কথা-সে কথা। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি এ পথেই একটি নদী; না, ভুল বলা হলো—এককালে নদী ছিল। এখন বলা যায় একটি খাল। মানুষের ক্রমাগত অত্যাচারে খালে পরিণত হয়ে নির্লজ্জের মতো এখনো টিকে আছে। শীতকালে শুকিয়ে যায়-বর্ষায় জলে টইটুম্বুর। খালের ওপর কাঠের একটি সাঁকো। সারাবছর লোকজন, ভ্যান, গবাদিপশু ইত্যাদি এ সাঁকো ধরেই পারাপার হয়। এখন শীতকাল। খালটির কাছে আসতেই দেখি কাঠের সাঁকোটি নেই—সেখানে নির্মাণ হচ্ছে কংক্রিটের পাকা ব্রিজ। বড় বড় খাম; ব্রিজের অর্ধেক অংশের খামের গার্ডারের ওপর জুড়ে বসে আছে কংক্রিটের স্ল্যাব। বাকি অংশের কাজও চলছে। আশেপাশে নির্মাণসামগ্রী, শ্রমিকদের অস্থায়ী আবাস; বিদ্যুৎ আনা হয়েছে—লোকজনে ভরপুর। কামা ও ভ্যানঅলার কথামতো নেমে দাঁড়ালাম। নির্মাণাধীন ব্রিজের পাশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী রাস্তা দিয়ে ভ্যানটি খালের এপারে উঠে গেলো। আমরাও সে রাস্তা ধরে ওপারে গিয়ে ভ্যানে চাপলাম। সাথে সাথেই আবার অন হলো কামার কথার রেডিও। এ কথা সে কথার মাঝে হঠাৎ সে বলে ওঠে: ভাইজান, শিউলির্যা অ্যাসাছে জী।
কোন শিউলি?
আঁরে, হাঁরঘের আজমত কাকার বেটি! কাকা-কাকি ছবাই অ্যাসাছে বে।
ঝাঁ করে হৃৎপিণ্ডটা যেন বন্ধ হয়ে গেলো—অনেকক্ষণ কোনো স্পন্দন পেলাম না। একটু পর অনুভব করলাম: ভুল, সেটি তো বন্ধ হয়-ইনি; বরং আরও জোরে লাফাচ্ছে, যেন এক্ষণি বুক থেকে লাফ দিয়ে গলা দিয়ে বের হয়ে আসবে। অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলাম। পরাজয়ের একটি গ্লানি আচ্ছন্ন করে ফেলে আমাকে। আশ্চর্য, আজ এ-পড়ন্ত বেলায় নিজেকে কেন পরাজিত মনে হচ্ছে! আমি বা শিউলি কেউ কখনো জয়-পরাজয় নিয়ে ভেবেছি বলে তো মনে হয় না। বরং ওর কাছে পরাজিত হওয়াটাই এককালে আমার কাছে ছিল আনন্দের; কাঙ্ক্ষিত।

২.
শিউলি ও আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকি, কাছাকাছি বয়স, খেলার সাথী-সহপাঠী। ওর বাড়িতে আমার যাতায়াত, আমার বাড়িতে ওর। ছেলেবেলা থেকেই প্রচণ্ড একগুঁয়ে—জেদী; পরাজয় মানতেই পারে না। শিশুবেলা থেকেই ওর সাথে খেলতে গেলে ওকে হারানো যাবে না। হারলেই কেঁদে-কেটে অস্থির—নাকের পানি, চোখের পানি এক করে ফেলবে। কাঁদতে কাঁদতে এসে আমার মাকে নালিশ জানাবে, কাকি, নওশাদ হাঁমাকে হারিয়্যা দিয়্যাছে... অ্যাঁ অ্যাঁ...। আমিও বলে দিতাম, তুই হার্যাছিস তো হাঁমার কী? একথা শুনে ওর কান্না দ্বিগুণ বেড়ে যেতো। মা ওকে কোলে তুলে আদর করতো আর আমাকে কৃত্রিম ধমক লাগিয়ে বলতো, খবরদার কহছি, অকে আর হ্যাঁরাবি না বেটা!

বয়সে অনেক ছোট হলেও মায়ের ইঙ্গিত ও ইচ্ছা বুঝতে পারতাম। মায়ের কথামতো ওকে আর হারতে দিতাম না। খেলতে গিয়ে যদি দেখতাম ও হেরে যাচ্ছে তখন ইচ্ছে করেই আমি হেরে যেতাম; ও খুশি হতো। আমি হেরেই যেতাম, হেরেই যেতাম...। একসাথে বড় হই; এসএসসি পাস করি। আমি গিয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলাম।

ওদিকে আজমত চাচা ডিভি লটারি পেয়ে সপরিবারে আমেরিকা চলে গেলেন। শিউলি বা ওদের পরিবারের কারও সাথে এরপর আর যোগাযোগ হয়নি; হয়তো বা সম্ভবও ছিল না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খনিবিদ্যায় পড়া শেষে সিলেট গ্যাস প্ল্যান্টে কাজ নিয়ে চলে যাই। প্রায় ন’মাস পড় মাকে দেখার জন্যই বাড়িতে ফেরা।

৩.
বাড়িতে ফিরে গোসল-টোসল করে ফ্রেশ হয়ে মায়ের হাতের খাবার খাওয়ার পর ভ্রমণক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি প্রায় পাঁচটা বেজে গেছে। মা বলে, দ্যাখ্ কে অ্যাসাছে! তাকিয়ে দেখি মায়ের পেছনে শিউলি দাঁড়িয়ে। অনেক বড় হয়েছে। মুখে লাজুক হাসি।
কেমন আছিস রে দুষ্টু?
ভালো, তুই কেমন আছিস রে, পাজি?
মা মুখটিপে হেসে বলে, ওমাগ্গে, ছুরু হোয়্যা গেল তোরঘেঁর ছেল্যাব্যালার দুশ্টামি। বলে বাইরে চলে গেলো। কথায় কথায় জানা হলো, ও ওখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যানথ্রপোলজি পড়ে এখন ওটিতেই পড়ায়।

৪.
শিউলির সাথে বৈকালিক ভ্রমণে বের হয়েছি নদীর ধারে, যেখানে ব্রিজ নির্মাণ হচ্ছে সেদিকটায়। শীতের বিকেল; চারদিকে কুয়াশা নেমে এসে প্রায় আঁধার ঘনিয়ে গেছে। লোকজন তেমন নেই, শ্রমিকেরা তাদের অস্থায়ী ডেরার বাইরে রাতের খাবার রান্না করছে; এতে একই সাথে তাদের আগুন পোহানোও হচ্ছে। এদিক-সেদিক বালি, রড, পাথর, সিমেন্ট, ক্র্যাশিং মেশিন, কংক্রিট মিক্সিং মেশিন—আরও কত কী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এসবের মধ্যেই লম্বা মোটা ধাতব একটি পাইপ দেখতে পেয়ে শিউলি দৌড়ে তার কাছে যায়। সেটি ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে একটি আজব প্রস্তাব করে; বলে, আয় একটা খেলা খেলি। তুই পাইপের এ-প্রান্তের ফাঁকে মুখ লাগিয়ে বলবি, আমি তোকে ভালোবাসি। আমি ও-প্রান্তে কান লাগিয়ে শুনবো। আবার আমি ও-পাশ থেকে মুখ লাগিয়ে একই কথা বলবো। তুই শুনবি এ-পাশ থেকে।

ওর এমন আজব খেলার প্রস্তাব পেয়ে আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। তখন এমন সব অদ্ভুত খেলা ও আবিষ্কার করতো আর আমাকে ইচ্ছে করেই হেরে যেতে হতো। আজকের খেলায় কোনো রূপ হারজিতের বালাই নেই দেখে আমি রাজি হই। শিউলি পাইপের ও-প্রান্তে কান লাগায়; আমি এ-প্রান্তের ফাঁকে মুখ লাগিয়ে জোরে বলে উঠি, আমি তোকে ভালোবাসি। কথাটি রিদমিক একটি গমগমে সুর তুলে ও-পাশে পেতে রাখা ওর ডান কানে গিয়ে পৌঁছায়। এবার আমি এ-পাশে কান লাগাই; ও-পাশ থেকে একই ভাবে একই কথা বলবে ও। আমি কান লাগিয়ে থাকি, কয়েক মুহূর্ত... কয়েক সেকেন্ড পাড় হয়ে যায়, কোনো শব্দ নেই। আরও সময় চলে যায়, নেই কোনো বাক্য... আরও আরও সময় কেটে যায় নেই সেই শাশ্বত ও বহুল উচ্চারিত কথাটি। পাইপ থেকে কান তুলে তাকাই ও-পাশটায়—ওর দিকে; দেখি দাঁড়িয়ে হাসছে ও।

এবার বুঝে ফেলি ওর চালাকি; ও ইচ্ছে করেই আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। আমাকে পরাজিত করেই ও খুশি বা খুশি হতে চায়; থাকতে চায় অপরাজেয়। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক সহপাঠীর বলা একটি কথা মনে পড়ে যায়। সে বলতো, পরাজয় মানেই বাঁশ। কথাটি মনে হতেই আমি হো হো করে হেসে উঠি। আমার এমন হাসিতে শিউলি অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে। তারপর সহসা দুজনেই নিশ্চুপ; চারদিকে সুনসান নীরবতা।

অচিরাৎ বিকট-ভীষণ একটি শব্দ; যেন বা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। মুহূর্তেই নির্মাণাধীন ব্রিজের ওদিকটায় ঘনকুয়াশা হঠাৎ যেন আরও ঘন হয়ে আসে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। প্রথমেই আর্তচিৎকার করে আমার দিকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে শিউলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শ্রমিকেরা মরণচিৎকারে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে। সাথে সাথেই গ্রামের প্রায় সকলে দৌড়ে, আতঙ্কে ছুটে আসে নদীর ধারে; ব্রিজের কাছে। দেখে, নির্মাণাধীন ব্রিজের স্ল্যাবের অংশটি ধসে পড়েছে। তারা আরও দেখে—ব্রিজটির খাম, গার্ডার আর স্ল্যাবে রডের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।