বাংলাদেশের নতুন দিনের কবিতা

আবু আফজাল সালেহ
আবু আফজাল সালেহ আবু আফজাল সালেহ , কবি ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত: ১২:৫০ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২৪

কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের সুন্দর ও বিশেষায়িত চরিত্রের একটি মাধ্যম। যেখানে কবি সর্বোচ্চ যুতসই ও অর্থবোধক কিংবা সুন্দর শব্দাবলি নিয়ে খেলা করেন, সৌধ নির্মাণ করেন। একটি পঙক্তি নিয়ে যেমন একটি স্তবক হতে পারে আবার একাধিক পঙক্তির স্তবক সচরাচর দেখা যায়। যেভাবেই হোক এক বা একাধিক রস উৎপাদন করতে পারাই কবিতার মাহাত্ম্য। এই রসই হচ্ছে কবিতা ও সাহিত্যের আত্মা। রসের নিয়ন্ত্রিত প্রাচুর্যের ওপর কবিতার সফলতা নির্ভর করে। এরপর অলংকার দিয়ে বা ছন্দ ঠিক রেখে কবিতার রূপ দিতে হয় কবিকে। অলংকার আবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করতে হবে। কম বা অতিরঞ্জিত অলংকার ব্যবহার কবিতাকে নষ্ট করে দিতে পারে।

ছোট্ট এক অবকাঠামোয় ইতিবাচক এক বা একাধিক বার্তা পৌঁছানোর কঠিন দায়িত্বটা কবিতা নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। বাড়তি হিসাবে পাঠককে আনন্দ দিতে ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করে থাকে। কিছু শব্দের সাহিত্য এই কবিতা। তাই তো জনপ্রিয় এক মাধ্যম। বলে রাখি, সবচেয়ে পুরাতন মাধ্যম। সেই চর্যাপদ থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা কবিতার যাত্রা শুরু। তারপর বহু বাঁক পেরিয়ে আজকের কবিতার এই সৌন্দর্য বা শরীর। কবির টোন বা স্বর পাঠকের হৃদয়ে ঠাঁই নেয়। সফল কবিতা হৃদয় নাড়িয়ে দেয়, নিজের আবেগ বলেই মনে হয়। শক্তিশালী এক বা একাধিক চিত্রকল্প সৃষ্টি করে। যথার্থ অলংকারে কবির বক্তব্যকে স্পষ্ট করে তোলে।

কবিতা হতে পারে প্রতীক ব্যবহারে। প্রতীকী কবিতা উন্নতমানের চিত্রকল্প। সমাজের অসুস্থতা ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে কবিতা হতে পারে সর্বোচ্চ হাতিয়ার। এ ক্ষেত্রে স্যাটায়ার কবিতা হতে পারে উৎকৃষ্ট মাধ্যম। ইতিহাস-ঐতিহ্য, মিথ, ভূগোল, পূর্বতন সভ্যতার সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনির ইঙ্গিত করে সতর্কতা বা উৎসাহ দেওয়ার কাজটি কবি কবিতার মাধ্যমে সহজেই করতে পারেন। নগর, প্রেম, বিশ্বযুদ্ধ, বিভিন্ন তন্ত্র, বিশ্বায়ন বা প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্বকবিতা। এগুলোর বাইরে ভাষা-আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়াদি, গণতন্ত্র, স্বৈরাচার ব্যবস্থা বাংলাদেশের কবিতার বিষয়াদি। এসব মানস ও বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের কবিতা এগিয়ে চলেছে। তবে গতি কেমন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে।

নতুন স্বর নির্মাণ বা সৃষ্টি করার কাজই কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তেমন সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। আল মাহমুদ বা শামসুর রাহমানসহ কয়েকজন এ ক্ষেত্রে সফল হলেও তাদের ছাড়িয়ে নতুন টোন সৃষ্টি করতে পেরেছেন কেউ? হয়তো পেরেছেন সামান্যই। ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছি বলেই আমি মনে করি। সমসাময়িক অনেকেই ঝলক দেখিয়ে নিভে যাচ্ছেন। গোষ্ঠীতন্ত্রের চর্চা, সিন্ডিকেট, ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ, অনিরপেক্ষতা, পুরস্কার-পদকের লোভ ইত্যাদি নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানও তার যথার্থ দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নিজের বলয় সৃষ্টি করি ‘আমরা-আমরাই’ গোষ্ঠী সৃষ্টি করতে অব্যাহত চেষ্টা করছে।

সাহিত্যের একনিষ্ঠ নিবেদিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। অনুবাদ ক্ষেত্রে আমরা এখনো নাবালক বা শিশু। অথচ এ ক্ষেত্রের উন্নতি বা শক্তিশালী করা ছাড়া বিশ্বসাহিত্যে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। লিটল ম্যাগ হিসাবে কয়টি দাঁড়াতে পারছে? বেশিরভাগই সাহিত্যপত্রিকায় রূপ নিচ্ছে। রেনেসাঁস তো দূরের কথা, সাহিত্যবিষয়ক একটিও সফল আন্দোলন বাংলাদেশ করতে পারেনি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা থেকেও আমরা অনেক পিছিয়ে। অথচ সময়ে সময়ে অনেক প্রতিভাবান কবি দেখা যায়। উপযুক্ত ও ইতিবাচক পরিবেশ না পেয়ে হারিয়ে যান! এ ব্যর্থতা রাষ্ট্রের পাশাপাশি সাহিত্যসেবী সবার। তবে যখন কোনো কোনো কবি লেখেন—
১.
আরোহী উপত্যকা, চক্রবর্ণ। কর্ণচোরা উট।
পা খুলে উদ্যম ছড়িয়ে পরপর সরসর...
তোমার বাদাম পেলাম, আঙুলও
সোনালি আঁশ খুলছি
খুলছি
হাঁটছি
চাটছি
একটি বীজ খসে উড়ুক্ক গেল।…
(উল্লম্বী, অরবিন্দ চক্রবর্তী)

২.
যে তোমাকে বাসে, তার হৃদয় শুয়োরের চামড়া;
সে ঘুমায়, তার রাত্রিও শুয়োরের চামড়া;
দিনের অনেক প্রহরী হয়ে সেও একা; মদ চায় না, বা যোনির গন্ধ; তাকে তার নিরাকার জলপথ দেবে; জল পেলে জলচর ও নৌকা ছড়াবে ডিম;
দূরের যাত্রীদের ছপ ছপ ছপ বৈঠা শুয়োরের চামড়ার ভেতর জাগে;
দিনের শুরুতে সে নিজেকে খুলে রাখে রাতের অন্ধকারে পরবে বলে; আর বোতামগুলো
ছয়টি শুয়োর হয়ে সারাদিন ঘোৎ ঘোৎ করে;
(বোতাম, জাহিদ সোহাগ)

৩.
এক অস্থির লাবণ্যে আমরা হারালাম মুঠোমুঠো পথ
গাঁয়ের আলপথ
ভুলে গেলাম সুবর্ণচর ও সন্ধ্যা।
তখন অস্তরাগের মঞ্জুরী
কেমন পেখম মেলে নাচতে থাকে
দৃষ্টিহীন শীতে।
তবু শীতার্ত ডানা মেলে
উড়ে যায় গাঙচিল
আকাশে আকাশে মেঘে মেঘে।
(একজন গাঙচিল, আরিফুল হাসান)

৪.
দেবলীনার চুলের গন্ধ ব্যক্তিগত ছিল না,
অথচ এদিক ওদিক হলেই চুলকাঁটা খুলে যায় ওর,
হাওয়ায় ওড়ে দর্পিত যোদ্ধা যেমন,
রহস্যময় হাসে জাফরানীগন্ধ।
পনেরো বিশ বছর বয়সে ও আমার বোনের বন্ধু,
বাড়ি আসা যাওয়ার যথেষ্ট কারণের মধ্যে সাধারণ একটা কারণ—নোটস্, ফাগুন, বর্ষা, শরত বসন্ত—
ওরা বৃষ্টি-তোলপাড়-কলকল
ওরা সেতার, ওরা ধূম্রজাল
ভিজিয়ে, ভাসিয়ে কর্ণিশে দাঁড়াতো
অযথাই চুলকাঁটা থেকে খসে পড়তো জাফরান,
দেবলীনা অনুমানও করতে পারেনি কোনদিন—
এই ধূ-ধূ মাঠ বন্দী করেছে সেই গন্ধ।
(দেবলীনাকে বলা হয়নি, রওশন রুবী)

৫.
কবির হাতে যেন জলের অক্টোপাস, নক্ষত্রের নৃত্যকলা
সেই সব রহস্যের চোখ জানালায় ভিড় করে...
বাতাসের বোতাম ছিঁড়ে অজস্র পাপিরাস ওড়ে
কালির প্রলেপ ভাসে ধূসর খাতায়—
ওড়ে মন, পোড়ে দেহ, সূর্যের জোয়ারে ভেসে ভেসে...
রহস্যের রেলিং বেয়ে বেঁচে থাকে কবি
স্বপ্ন ভেঙে ভেঙে, ঢেউ ভেঙে ভেঙে...
কলমের অন্তরালে কবির অস্তিত্ব—
হৃদয়ের হাত, কবির ক্যানভাস।
(কবির ক্যানিভাস, রনি অধিকারী)

…তখন আশাবাদী হতেই হয়। আমি আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশের এখনকার কবিতা বহুদূর যাচ্ছে বলেই মনে করি। কী সুন্দর চিত্রকল্প! কী সুন্দর আবেগ! কী সুন্দর বার্তা! শুধু অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। অনুকূল পরিবেশ পেলেই মুক্ত আকাশে উড়বে এই যুগের কবিতা।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।