আয়েশা সিদ্দিকার গল্প: পূর্ণতা

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:০৬ পিএম, ০৫ জানুয়ারি ২০২৪

বছরের শেষ মাস। আজ রবিবার। তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হলো গত শুক্রবার। না এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। ভাইভা বাকি আছে। আগামী শুক্রবার ভাইভা। হরতাল-অবরোধের কারণে পরীক্ষাগুলো বন্ধের তারিখে হয়, শুক্রবার ও শনিবার। ভাইভার পড়াশোনা নিয়ে তেমন চিন্তা-ভাবনা নেই। তাই পরীক্ষা শেষ করেই আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসা। বেড়াতে এলে এই এক ঝামেলা, সারাদিন বসে বসে থাকা। কাজ-টাজ নেই, অলস মস্তিষ্কে কত কিছু যে ঘুরে বেড়ায় তার হিসেব নেই।

আপাতত ভাবছি, ভাইভায় কী ড্রেস পরবো তা নিয়ে। ভাইভা প্রেজেন্টেশনে তো একটু ফরমাল সাজুগুজুর ব্যাপার থাকে। এ অবধি একবারও ভাইভায় শাড়ি পরিনি। শাড়ি পরতে আমি একদমই পারি না। এইবার অনেক আগে থেকেই ভেবে রেখেছি শাড়ি পরবো। সাদা রঙের শাড়ির সাথে পারপেল হিজাব। ভালোই লাগবে মনে হচ্ছে। আর কী কী প্রয়োজন ভাইভার জন্য! হাতে একটা কিছু পড়তে হবে। না হলে খালি খালি লাগবে। চুড়ি বা ব্রেসলেট পরবো! না এগুলো পরা যাবে না, ফরমাল লাগবে না এগুলোতে। ঘড়ি পরতে হবে। কিন্তু আমার তো ঘড়ি নেই। এক্সামে ভাইয়ের ঘড়ি নিয়ে গেছি। ওটা ছেলেদের ঘড়ি, অনেক বড়, ওটা মানাবে না। মানাবে এমন একটা ঘড়ি কিনতে হবে।

অনলাইনে দেখা যাক। অনলাইন থেকে তো কিনবো না আমি। ট্রাস্ট করতে পারি না। পরে দেখা যাবে পাটুয়াতলি থেকেই কিনবো। সে না হয় কিনবো, এখন দেখতে তো দোষ নেই। ফ্রি আছি যেহেতু। এই ভেবে অ্যাপ খুলে ফিমেল রিস্ট ওয়াচ লিখে সার্চ করে ঘড়ি দেখতে শুরু করলাম। এত এক্সপেন্সিভ সব প্রোডাক্ট। আমার যেগুলো পছন্দ সেগুলোই এক্সপেন্সিভ। আদতে ঘড়ি পরার অভ্যাস আমার নেই। এক্সাম এলে তাই কখনো ভাইয়েরটা কখনো আবার স্টুডেন্টেরটা দিয়ে চালিয়ে দিই। একটা ঘড়ি এত দাম দিয়ে কিনে ঘরে পরে থাকবে, তাও আমার ভালো লাগে না। কী যে করি! আবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি।

এসব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই একজন এসে বললো, ‘আপা দরজাটা আটকায় দেন।’ ভদ্রমহিলা হচ্ছেন এ বাসার টেম্পরারি হেল্পিং হ্যান্ড।
কিছুটা অবাক হয়ে বললাম, ‘ও আপনি! কাজ শেষ?’
সে তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিলো, ‘হ আপা।’
আমি কৌতূহলবশত তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন বাসায় যাবেন নাকি অন্য বাসায় কাজ আছে?’
সে একটু কাতর সুরে বললো, ‘না আপা, এহন অন্য বাসায় যামু। আজকে আমার মাইয়াডার বার্ষিক পরীক্ষার প্রথম দিন। কাজের জন্য লগে যাইতে পারলাম না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন ক্লাসে পড়ে মেয়ে?’
‘থ্রিতে পড়ে আপা, ফোরে উডবো কয়দিন পরে।’
‘মাশাআল্লাহ, ভালো তো।’ এবার ভদ্রমহিলার প্রতি আগ্রহ জাগলো আমার। এত কষ্ট করে উপার্জন করা টাকা দিয়ে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগলো। এরপর নিজে থেকেই তাকে বললাম, ‘মেয়ের বাবা তো যেতে পারতো মেয়ের সাথে স্কুলে।’

এরপর যা শুনলাম, সেটা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভদ্রমহিলা বললেন,
‘মেয়ের বাপের কতা তুললেন আপা, আমার বিয়ার এক বছর পরে গ্রামের বাড়ি থেইকা ঢাকা আইতেছিলাম। বাস আর বড় মালের ট্রাক অ্যাক্সিডেন্টে অর বাপের বাম হাতটা কনুই থেইকা কাটা পইড়া যায়।’
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবাক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে তার মতো বলতে থাকলো, ‘অর বাপে ভালো একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতো। ভালো বেতনও পাইতো। আমার ভাইরা অনেক আগে থেইকাই বিদেশে থাকে, টাকা-পয়সা ভালোই। আমি তাগো এক বইন। দেইখা-শুইনা ভালো ঘরেই বিয়া দিছিলো। অর বাপের অ্যাক্সিডেন্টের পরে আমার ভাইরা চাইছিলো আমারে বাড়ি নিয়া যাইতে। আবার বিয়া দিতে। আমি এডা কেম্নে করি আপা কন! আমার মত আছিল না। মায় আমার পক্ষ নিছিলো। মায় কইছে, মা, আল্লাহ চাইছে তাই এইরকম হইছে। ধর এইটা তোমার লগে হইতো যদি, আমার কোনো পোলার লগে হইতো যদি? আল্লাহ তোমার ভাগ্য এইরকম রাখছে, আল্লাহর দান অস্বীকার কইরো না মা। আমার মায় অনেক ধার্মিক।’

এসব যা-ই শুনছি, এখনো আমার মাথায় ঘুরছে, একটা হাত কাটা পড়ে গেছে। আমার সেটাই কৌতূহল এখনো। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা হাতটা লাগানোর চেষ্টা করেনি ডাক্তাররা?’
‘সেইদিন কী হইছিলো জানেন আপা, হাতটা কনুইয়ের চামড়ার লগে লাইগা আছিল। কে যেন চামড়াটা ছিইড়া হাতটা আলাদা কইরা পাশে রাইখা দিছিলো। সব আমার সামনেই হইছে। রক্তে ভাইসা যাইতেছিল, আমি কিছু করতে পারতেছিলাম না, আমার বোধ-বুদ্ধি সব হারায়া গেছিল। সব দেখতাছিলাম, কিন্তু তারে গিয়া ধরনেরও শক্তি পাইতেছিলাম না, কিছু কওয়ারও শক্তি পাইতেছিলাম না। তারপর পুলিশ কেস হইলো, ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করাইলো। ওরে নিয়া একটা মেডিকেল বোর্ড বসছিলো। হাতটা যদি লাগাইয়া দিতো, তাইলে নাকি কনুইয়ের উপরের দিকে পচন ধরতো। ডাক্তারে কইলো যদি হাতটা একটুখানিও লাগানো থাকতো তাইলে নাকি একটা সম্ভাবনা থাকতো। আপা সেদিন যদি আমি বাধা দিতে পারতাম, তাইলে হয়তো আমার জামাইর হাতটা আজকে থাকতো।’

কথাগুলো বলতে বলতে নিজের অজান্তেই ভদ্রমহিলার গাল বেয়ে পানি ফ্লোরে পড়ছে, সেদিকে যেন খেয়ালই নেই তার। একটু শেয়ার করে কিছুটা হলেও হালকা লাগছে তার। আমার তা-ই মনে হচ্ছে। কিন্তু এসব পরিস্থিতিতে কী বলে সান্ত্বনা দিতে হয়, তা জানা নেই আমার। আমার মন প্রচণ্ডভাবে চাইছে তাকে শান্ত করতে। কিছু হলেও সান্ত্বনার কথা বলতে। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি তাকে বললাম, ‘আল্লাহ আপনার পরীক্ষা নিচ্ছে। সব সময় আল্লাহর সিদ্ধান্ত স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া উচিত আমাদের। আপনি অনেক ধৈর্যশীল। এর প্রতিদান একদিন পাবেন নিশ্চয়ই। আল্লাহ সব ঠিক করে দেবেন। তারপর এখন সংসারের খরচ কীভাবে চলছে?’
‘এই যে সারাদিন বাসায় বাসায় ঘুরে কাজ করি। বারো-তেরো হাজার আসে প্রতি মাসে। জামাই একটা জায়গায় বসে লেখার কাজ পাইছে। সকাল থেকে বিকাল অবধি থাকে ওইখানে। পাঁচ হাজার দেয়। এক রুমের একটা বাসায় থাকি, অনেক খরচ আপা। বাসা ভাড়াই সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। মেয়ের স্কুলের খরচ, সবকিছু এই আয়ের মধ্য দিয়েই চলে। শহরে তো বুঝেন আপা, পানিডাও কিইনা খাইতে হয়। মাঝেমধ্যে হিমশিম খাইতে হয়। তখন ভাইদের কাছে চাই। ভাইরা অনেক সাহায্য করে।’
‘বাহ ভালোই তো। আপনার স্বামীর বাড়ির কেউ সাহায্য করেন না?’
‘না আপা, আমার দেবর পুলিশ, ভাশুর সোনালি ব্যাংকের বড় অফিসার। তাগো লগে কথা কইতে ফোন দিলেও ধরে না ঠিকমতো। মনে করে টাকার জন্য ফোন দিই। তাই যোগাযোগ নাই অতো। শ্বশুর-শাশুড়ি নাই তো। ননদের লগে কথা হয় প্রায়ই। ননদ আবার তার ভাইজিরে অনেক ভালো জানে।’
এরপর সে তাড়াহুড়োর ভাষায় বললো, ‘আচ্ছা আপা যাই এহন। দোয়া কইরেন। মাইয়াডারে যেন অনেক বড় কিছু বানাইতে পারি পড়ালেখা শিখাইয়া। আরেক বাসায় যাইতে হইবো এহন।’

বাকরুদ্ধ আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার ঠুনকো সান্ত্বনার প্রয়োজন তার নেই। সে যথেষ্ট স্ট্রং। আমি যা শুনেই শিউরে উঠেছি, সে তা ফেস করেছে এবং উঠে দাঁড়িয়েছে। শক্ত মনে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। স্বামীর পাশে থেকে তার জীবনের অপূর্ণতা দূর করেছে। ক’জনই বা পারে এইভাবে কারোর জীবনের পূর্ণতা হতে! এখনো সংগ্রাম করছে প্রতিদিন। হয়তো পরিস্থিতিই মানুষকে স্ট্রং করে গড়ে তোলে। ভদ্রমহিলার স্বামীর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, সংসারের প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি পদে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়ার এ গল্প আমাকে নতুন করে শক্তি দিয়ে গেলো। আমি ভালোবাসার সংজ্ঞা জানি না। আজকে আমার মন বলছে, এটাই হয়তো ভালোবাসা। সব পরিস্থিতিতে সঙ্গীর পাশে থাকা, কখনো ছেড়ে না যাওয়া। দশ মিনিটের এ কথোপকথন আমাকে কতোগুলো শিক্ষা দিয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা সত্যিই সার্থক, কারোও জীবনের পূর্ণতা হতে পেরেছেন তিনি।

এখন আমার না পাওয়াগুলোকে বড্ড ঠুনকো মনে হচ্ছে। এমন অনেক পরিপূর্ণতা আমার আছে; যেগুলোর অভাবে মানুষের জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। তবুও আমরা হতাশ। কারণ আমরা পাওয়াগুলো থেকে না পাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত। এই যে, আমি মানানসই ঘড়ি কিনতে ব্যস্ত। অথচ কারোর ঘড়ি পরার সেই হাতটাই নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।