মীনা সাহার গুচ্ছ কবিতা
ধ্রুবসত্য
মানব জীবন সে তো অনন্ত পথের যাত্রা
আপনা থেকেই মনের ভেতর এক বৃক্ষ জন্ম নেয়
শাখা-প্রশাখা ছড়ায়, ধীরে ধীরে তা মহীরুহ হয়ে ওঠে
ছায়া বিস্তার করে জীবনজুড়ে
জন্ম নেয় কর্মবৃক্ষ-ধ্যানবৃক্ষ-জ্ঞানবৃক্ষের
বর্ণময় মানুষের জীবন কেবলই কর্মধারায় স্নাত
লোভ-লালসার দ্বন্দ্ব গোলক ধাঁধার পৃথিবী
ট্রেনের এক কামরা থেকে আরেক কামরা
এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে শুধুই ছুটিয়ে মারে
মনের ভেতর যে বৃক্ষ আপনা থেকেই
জন্ম নিয়েছিল একদিন
পরিচর্চার অভাবে সেও যায় শুকিয়ে
হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে পাতা, ডালপালা যায় মরে
জীবন সমুদ্র মহা মিছিলের ডাক
পথচলা আর পথচলা
সমুদ্রের অনন্ত ঢেউ রাশি একের পর এক অম্বুবিম্ব কিনারে কিনারে
সব শেষে একমাত্র প্রতীক্ষা সেই জীবন সত্যের
সেই তো জীবনের অনিবার্য ধ্রুবতারা
****
নির্জনতা
এত ভিড়ের মাঝেও কোনো এক নির্জনতা মন ছুঁয়ে যায়
চারপাশের কৌতুক-কোলাহল-যানজট সব ভেদ করে
সমস্ত আত্মার সাথে অঙ্গীভূত হতে হতে মিশে যায় দেহে
অনন্ত সে যাত্রাপথে হেঁটে হেঁটে প্রতিদিন অগণিত স্তব
লিখে চলা ক্লান্তিহীন পারাবারে অন্তরঙ্গ আকাঙ্ক্ষার সারি
সভ্যতার যাবতীয় বাগযন্ত্র ভেদ করে আত্মমগ্ন হয়
সুরে সুরে ভরে ওঠে চরাচর-মনভূমি-গহীন অরণ্য
ছন্দে-ছন্দে তাল-লয়ে বেজে ওঠে ধ্বনি ওঠে গান সুষুপ্তির
একাকী নির্জন দ্বীপে অন্তরঙ্গ সময়ের কথা–খুনসুটি
অনর্গল তরঙ্গীত ঢেউ দুলে দুলে ওঠে ভিজিয়ে দেয় সে
দিগন্ত... এই নির্জন দ্বীপবাসী নীড়ে শুধু সৃষ্টিতে-সৃষ্টিতে
কবিতার কথাকলি প্রেমময় স্বপ্নকথা রচিত উদ্যানে
আমারই একান্ত সে স্বর হয়ে বিশ্বময় হয়ে ওঠো তুমি
এত বিষণ্নতা তবু মনজুড়ে থেকে যাও স্বপ্নরঙে মিশে
এসো নির্জনতা এসো... এটুকুই রয়ে যাবে একান্ত আমার...
এত ভিড়... তবু একা... নই একা... মিশে থাকা নিভৃত সে নীড়ে।।
****
মর্মশিল্প
মনে মনে কখন যেন গেঁথে ফেলেছি
তোমাকে নিয়ে অলঙ্ঘনীয় মর্মশিল্প
জীবন্মৃতের আবাস ভূমিতে দাঁড়িয়ে দেখি
আধুনিক বিশ্বায়নের ক্রুশকাঠের ইস্তাহার
কালের ভাষা যখন জলপ্রপাত হয়ে ওঠে
তোমার মুখমণ্ডল কারুশিল্পের রূপ নেয়
রোজগারের ধান্দায় মশগুল মানুষ
সৃষ্টি সুখের নিজস্বতা হারিয়ে মেতে ওঠে কৃত্রিমতায়
ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠি
ডিজিটাল স্বপ্নের দুনিয়া
ইউনিক সৃষ্টির আনন্দে উদ্বেল যখন
বিশ্বায়নের মঞ্চে সংযোজিত হয়
করতলগত স্বাধীনতা
চিরাচরিত সৃষ্টির আনন্দ মুছে
কর্পোরেট অবসাদ
মহাব্যাধির মত জাপটে ধরে
পৃথিবীর সমগ্র কাব্য ভাষ্যে ভেসে ওঠে
তোমারই অভিমান ভরা মুখ
আমাদের অক্ষমতায় বার বার উচ্চারিত শব্দলোক
জীবনবীণার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে গোপন আঘাত করে চলে
শিক্ষাহীনতার জগদ্দল পাথর জাপটে ধরে আষ্টেপৃষ্টে
ন্যায়-অন্যায়ের বোধ ভুলে ভেসে যায় সভ্যতার ঝুলকালি মেশানো বহমান স্রোতে
সময়ের হুজুগ কেটে গেলে সময় যখন থমকে দাঁড়ায়
আত্ম জিজ্ঞাসা... অসংখ্য প্রশ্ন-উত্তর...
কালের সমাধি খুঁড়ে বেরিয়ে পড়ে জীর্ণ কঙ্কাল... অগণিত ভুলের জগদ্দল পাহাড়
আর তখনই তোমার সৃষ্টিতে ওঠে মহাসমুদ্রের অগণিত ঢেউ... আর ঢেউ
ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় যুগের যত কালিমা-জঞ্জাল
আর তত তুমি উজ্জ্বল হয়ে ওঠো মনের মণিকোঠায়
তাই তো, মনে মনে গেঁথে ফেলেছি
তোমাকে নিয়ে অলঙ্ঘনীয় এক মর্মশিল্প...
এসইউ/জেআইএম