কবিতায় সাবলীল আবু আফজাল সালেহ

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৩

আবুল কালাম আজাদ

আবু আফজাল সালেহকে লেখার মাধ্যমেই চিনেছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার বিভিন্ন রকম লেখা পড়ে আসছি অনেকদিন ধরে। কবিতা, প্রবন্ধ ও সাহিত্য আলোচনা ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গঠনমূলক কলামও লিখে থাকেন। তার কলামগুলোতে থাকে দেশের বিভিন্ন সমস্যা, সমস্যার কারণ এবং সমস্যা সমাধানের যৌক্তিক উপায়। সবদিক বিবেচনা করে তাকে বহুমুখী প্রতিভাধর লেখক বলতে দ্বিধাবোধ করি না। তিনি নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। সাহিত্যের কঠিন অথচ শৈল্পিক পথ চলার দৃঢ় প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা তার ভেতর লক্ষ্যণীয়।

আবু আফজাল সালেহকে পেয়েছি ফেসবুক বন্ধুরূপে। ফেসবুকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার পর তাকে পাঠ করা আরও সহজ হয়ে ওঠে। কারণ পত্রিকার অনেক লেখা অনেক সময়ই নজরে আসতো না। এবার লেখাগুলোর লিংক পাওয়া সহজ হলো। তাকে আস্বাদ করতে থাকলাম আরও বেশি। এর মধ্যে ঢাকার একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি উদার ও বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ। আমাকে কাছে টেনে নেন। পাশাপাশি বসি। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কথা বলি, ছবি তুলি।

কারো যথেষ্ট পরিমাণ কবিতা না পড়ে তার কবিতা নিয়ে লিখতে যাওয়া সম্ভব নয়। এরই মাঝে হাতে এলো ১০৩ পৃষ্ঠার একটি পিডিএফ। তাতে কবিতা আছে প্রায় একশর ওপরে। কবিতাগুলো পড়ে ফেললাম অপার আগ্রহ নিয়ে। প্রথমেই তার একটা কবিতা পড়ে নেওয়া যাক—
ভয় পেলে হেরে যেতে হয়
ঢেউয়ের ভয় পেলে
নৌকা নিয়ে সমুদ্রে যেয়ো না।
বরং ভয় পেয়ো না
পেছন ফিরে তাকাবে না আর-
ঢেউয়ের পরেই জাগে নতুন জগত।
যে ভয় পায় সব সময় হেরে যায় সে
ভয় পেলে হেরে যেতে হয়।

খুবই সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষার কবিতা। গভীরতাও কম নয়। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে যে কোনো বৃহৎ কিছুতে সফল হতে হলে ভয়কে জয় করতে হবে। মনে ভয় রেখে কোনো মাঝির বা জেলের যেমন সমুদ্রে নৌকা ভাসানো ঠিক হবে না, তেমন কারো কোনো কাজেই হাত দেওয়া ঠিক হবে না। ভয় আরও অনেক কিছুকে। এরকম ভয়ের কারণে মুক্ত প্রাণের মানুষ মুক্তভাবে তাদের চিন্তা প্রকাশ করতে পারছেন না। চিন্তা-চেতনার বৈচিত্র্য আসছে না। চিন্তা-চেতনার দিক দিয়ে জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, সরল ভাষার ছোট্ট কবিতাটিও দিচ্ছে আমাদের গভীর দিক নির্দেশনা, দেখাচ্ছে সঠিক পথের দিশা।

আবু আফজাল সালেহ মূলত আধুনিক গদ্য কবিতাই লেখেন। তার কবিতার আলোচনায় যাওয়ার আগে গদ্য কবিতা সম্পর্কে দু’চারটা কথা বলে নিতে পারি। আমরা সাধারণভাবে জানি, গদ্য কবিতায় ছন্দ নেই। বাস্তবে তা নয়। গদ্য কবিতায় পদ্যের মতো অন্ত্যমিল না থাকলেও ছন্দ আছে। কবিতার যে প্রচলিত ছন্দ স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত—গদ্য কবিতায় তা নেই। চতুর্দশপদী, অমিত্রাক্ষর, মুক্তক ছন্দের যে বিবর্তন, সেই বিবর্তনের ধারায়ই চলে এসেছে গদ্য কবিতা। সুতরাং গদ্য কবিতার ছন্দ লেখার সময় কবি যেমন উপলব্ধি করেন, পড়ার সময় পাঠকও তেমন করেন। গদ্য কবিতা পাঠের সময় দোলা, ঢেউ উপলব্ধি করা যায়। এই দোলা বা ঢেউ যে কবিতা পাঠের সময় কণ্ঠে ও হৃদয়ে বেশি জাগে; সেই গদ্য কবিতা তত সার্থক। গদ্য কবিতার প্রতিটা লাইনের অন্তরালে এই ছন্দ বা ঢেউ নিহিত থাকে। তারপর গদ্য কবিতাকে আরও অলংকার পরানোর জন্য আছে উপমা, রূপক, চিত্রকল্প। একটা সার্থক গদ্য কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠক আনন্দ পাবেন, একটি লাইনের পর আরেক লাইনে যাওয়ার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যদি কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠক বিতৃষ্ণা বোধ করেন, তাহলে বুঝতে হবে সে গদ্য কবিতায় কিছু ঘাটতি রয়েছে।

এবার কবি আবু আফজাল সালেহের কবিতার সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ উল্লেখ করে দেখি—
নদী ভাঙে আর আমার ছিঁড়ে যায় স্বপ্ন।
আশার বসতি, ছেলের স্কুল
মেয়ের গয়নাগাটি, কানের দুল।
আর বউয়ের সাজানো ঝুমকোজবার বাগান।
নিজের বাগানের জবা ফুল
খোঁপায় দিতে পারবে না আর!
নদী ভাঙে আর নিয়ে যায়
আমার সংসার, আমার ভালোবাসা।
সম্রাট শাহজাহানের যমুনা গড়ে দিয়েছিল সৌধ।
শাহজাহানের যমুনা আর আমার যমুনা বিস্তর ফারাক।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে অতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নদী। নদী মানুষের সুখের কারণ। আবার অনেক সময় নদী হয়ে পড়ে নির্দয়, নিষ্ঠুর। উত্তাল নদী মানুষের ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তি ভাসিয়ে নিয়ে যায়, মানুষকে করে নিঃস্ব, অসহায়। নদীভাঙনের যন্ত্রণা যে কতটা কঠিন তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। নদীভাঙন কবলিত এরকম একজন অসহায় মানুষের কষ্ট এ কবিতায় সহজ ও সাবলীলভাবে ছন্দবদ্ধ করা হয়েছে। একটা মানুষের স্বপ্ন কী থাকে? ছেলে-মেয়ে আর তার স্থাবর-অস্থাবর কিছু জিনিসকে ঘিরেই তো মানুষের স্বপ্ন আবর্তিত হয়। যখন মেয়ের গয়নাগাটি, ছেলের স্কুল, স্ত্রীর ঝুমকোজবার বাগান নদীর অতল গর্ভে বিলীন হয়; তখন তার স্বপ্ন আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। কবিতার শেষ লাইনটা দিয়ে কষ্টের তীব্রতা স্পষ্ট করা হয়েছে—‘শাহজাহানের যমুনা আর আমার যমুনার বিস্তর ফারাক’।

আবার ‘ইতিহাস’ কবিতায় তিনি বলেছেন—
স্রোতের বিপরীতে চলা যায় না।
ইতিহাস কিন্তু সরল
তার আর সরলীকরণ চলে না!
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সরল অংকে
ফলাফল শূন্যও হয়।
সেটা জেনে রেখো
ইতিহাস নিষ্ঠুর
বিদ্রুপ আর হিংসাত্মক হাসি
অমলিন নয়
এজিদ মীর জাফর একটি গালিমাত্র!
ইতিহাস যে কাউকে ক্ষমা করে না, সেই সত্যটিই উঠে এসেছে উল্লিখিত কবিতায়। সব জয় জয় নয় আবার সব পরাজয়ও পরাজয় নয়। মানুষের হৃদয়ে যিনি ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন; তিনিই তো সত্যিকারে বিজয়ী। একদিন মীর জাফরের কূটকৌশলের কাছে পলাশীর প্রান্তরে পরাজিত হয়েছিলেন বাংলা-বিহার-উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ। কিন্তু মীর জাফরের সেই বিজয় সত্যিকারের বিজয় ছিল না। আজ মানুষের হৃদয়ে সিরাজ ভালোবাসার নবাব হয়ে বসে আছেন আর মীর জাফর আছেন ঘৃণার আসনে। ইতিহাস তাকে ঠিকই পরাজিত করেছে। ইতিহাসের এই চরম বাস্তবতা নিয়ে কবিতাটি লিখেছেন কবি।

খুব সহজ বিষয় নিয়েও তিনি কাব্য করেছেন অনায়াসে। কবি বলেছেন—‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে/সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ সহজ কথা সহজ করে বলা অনেক কঠিন, যদি বলতে হয় কবিতার মতো একটা উঁচু মানের শিল্পমাধ্যমে, তাহলে তা তো আরও কঠিন হয়ে যায়। আবু আফজাল সালেহ কাজটি বেশ দক্ষতার সাথেই করতে পেরেছেন—
১.
এই যে মনমাধুরী, শোনো, উত্তর দাও
উদার আকাশের নিচে একাই থাকবে?
কাছে গেলে কী খুব ক্ষতি হবে তোমার?
খুব কাছে গেলে খুব রাগ করবে?
২.
বৃষ্টিভেজা গোলাপ,
ফুলের চুম্বনে প্রতিটি ফোঁটা
কোমল, সরল, আবেগপূর্ণ
আমাকে আনন্দে আপ্লুত করছে।
৩.
যখন তাকে দেখলাম
আমার মুখ আলোকিত হলো
তার আলোয়।
স্বর্গগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে তার মুখে।

এরকমই হৃদয়ে ছন্দের মাদকতা জাগানো কবিতার কবি আবু আফজাল সালেহ। তবে কেউই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নন। কেউই শতভাগ যথার্থ নন। সেসব সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতার সম্পর্কে কিছু বলা মানে তাকে শুধরে দেওয়া। তার চলার পথ, তার কর্মপ্রচেষ্টাকে আরও জোড়ালো করা। তাই বলবো, আবু আফজাল সালেহের কবিতা অনেক সময়ই অতি সরলীকরণ দোষে দুষ্ট। ইচ্ছে করলেই কবিতাকে অনেক ক্ষেত্রে সরল করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই তার কবিতা উপমা বা চিত্রকল্পের দুর্বলতা লক্ষ্যণীয়। ঢেউয়ের দোলার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে কোনো কোনো কবিতায়।

তবে সাধনার কোনো শেষ নেই, কোনো বিকল্প নেই। এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আবু আফজাল সালেহ সাহিত্যের, বিশেষ করে কবিতার একনিষ্ঠ সাধক। তার আছে অপার পাঠতৃষ্ণা। সে হিসেবে তিনি ক্রমান্বয়ে নিজেকে অতিক্রম করে যাবেন। বাংলা সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য—তাকে পাঠ করার পর এটাই আমার উপলব্ধি।

লেখক: কথাশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।