রইস উদ্দিনের কালো ব্যানার
ফোরকান রাজু
কনকনগর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলতাফ উদ্দিন। বয়স চুয়ান্ন পার হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে আছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সাতশ। সহকারী শিক্ষক আছেন চৌদ্দজন। ছয়জন আছেন সিনিয়র শিক্ষক। চৌদ্দজন সহকারীর মধ্যে বাংলার শিক্ষক রইস উদ্দিন বয়সে সিনিয়র। এমনকি কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষকের চেয়েও সিনিয়র। কিন্তু চাকরি নিয়ে কোনো তদবির না করায় সহকারী শিক্ষকই রয়ে গেছেন। মুখভর্তি এক ইঞ্চি সমান দাঁড়ি। গোঁফও কম বড় নয়। সন্তান নেই। স্কুলের কাছাকাছি স্ত্রীকে নিয়েই টিনের একটা ঘরে থাকেন। প্রধান শিক্ষক আলতাফ উদ্দিন থাকেন বাগেরহাট সদরে। সেখান থেকে কনকনগরের দূরত্ব প্রায় সত্তর থেকে আশি কিলোমিটার। সকাল দশটার পরে কোনোদিন তিনি স্কুলে প্রবেশ করেননি। রইস উদ্দিনের বাসা থেকে স্কুলে আসতে পাঁচ মিনিট লাগলেও স্কুলের ঘণ্টা না শুনে কখনো বাড়ি থেকে বের হন না। এ নিয়ে হেডমাস্টার যে তাকে কত কথা শুনিয়েছেন তার হিসেব নেই। কোনো কোনো সহকর্মী তো তাকে ‘মিস্টার লেইট বাংলা’ বলে ডাকেন। এ নিয়ে রইস উদ্দিনের কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই। দাঁড়ির মধ্য থেকে বরফের ন্যায় সাদা দাঁতগুলো বের করে নিঃশব্দে হাসেন।
স্কুলের একটি অলিখিত নিয়ম আছে, প্রত্যেক শিক্ষক যে বেতন পাবেন; তার শতকরা দেড় ভাগ টাকা বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য দিতে হবে। স্কুলের সভাপতি তাফরির খান ও আলতাফ উদ্দিন এ নিয়ম তৈরি করেছেন। সভাপতির পকেটে যায় এর বড় ভাগটা আর বাকিটা হেডমাস্টারের পকেটে। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যানারগুলো ছাপানো হয় একটু অন্যরকম করে। যেমন ‘শুভ নববর্ষ’ এটুকু লেখা, বাংলা বা ইংরেজি সাল লেখা থাকে না। প্রত্যেক নববর্ষে এক ব্যানারেই চালিয়ে দেন। কিংবা এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা থাকে না ব্যাচের নাম। এভাবে জাতীয় সব দিবসেও একটি ব্যানার দিয়ে বছর পাঁচেক চালিয়ে দেন।
আলতাফ উদ্দিন টাকা পয়সার ব্যাপারে খুবই সাবধান। স্কুলের সহকর্মী দূরে থাক অফিস রুমের টিকটিকিটাও টের পায় না কত টাকা স্কুল থেকে সরিয়েছেন। স্কুলের ফুলের বাগান করার এক লাখ টাকা তো একাই গ্রাস করলেন। সভাপতিও জানলেন না। দুই বছর পর জানা গেল, ফুল বাগান নাকি সব কাদের মিয়ার ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। এ জন্য কাদের মিয়াকে একদিন স্কুলে ডাকা হলো। হেডমাস্টার তাকে দেড় হাজার টাকা দিয়ে বললেন, ‘বলবা ছাগলে গাছ খেয়েছে। ওর কি বোধ-বুদ্ধি আছে? মানুষ হলে তো আর খেত না।’ কাদের মিয়া টাকা পেয়ে হাসিমুখে স্কুল থেকে চলে গেল।
পথে রইস উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে কাদের, তোর ছাগলে নাকি ফুল বাগানের গাছ খাইছে?’
‘হ, ছাগলে তো লতা-পাতা-গাছ এগুলাই খায়।’
‘ছাগল কবে কিনলি?’
‘স্কুলে ফুল বাগান করার দুদিন আগেই কিনছি, স্যার। ফুলে ছিল বিষ। ওটা খেয়েই তো মরে গেল।’
‘হেড স্যারের ফুল বাগান আর তোর ছাগল, কোনোটাই দেখার সৌভাগ্য হলো না আমার। যাই বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কাপ চা খেয়ে আসি। তোর ছাগলটা থাকলে দুধ নেওয়া যেত। ছাগলের খাঁটি দুধের চা কখনো খাইনি, খাওয়ার খুব ইচ্ছা।’
রইস উদ্দিন কড়া লিকারে তেতো এক কাপ রং চা খেয়ে রাস্তা পার হতে গেলেন। হঠাৎ সিমেন্ট বোঝাই নীল রঙের একটি ট্রাক তার ওপর দিয়ে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই লোক জমা হলো। ট্রাকটির পেছনে কয়েকজন দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠলো। ততক্ষণে রইস উদ্দিনের আত্মা কনকনগর স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে। নিথর দেহটা কয়েকটা খণ্ডে পড়ে রইলো। বামহাতের কালো বেল্টের ঘড়িটার ঘণ্টা ও মিনিটের কাটা কোথায় উড়ে গেছে খবর নেই।
পরদিন স্কুলে রইস উদ্দিনকে নিয়ে সবার মুখে মুখে আলোচনা হলো। স্কুলের ঘণ্টার পর আজ আর দেরি করে আসেনি রইস উদ্দিন। সপ্তম শ্রেণির বাংলা ক্লাস নিলেন গণিতের স্যার রমেশবাবু। হেড স্যার স্কুল শেষে কনকনগর বাসস্ট্যান্ডে এলেন।এখান থেকে বাগেরহাটের বাসে উঠবেন। রাস্তায় রইস উদ্দিনের রক্ত এখনো লেগে আছে। টিকিট কেটে বাসে উঠে সিটে বসলেন। পাশের সিটে কেউ নেই। একটু আরাম-আয়েশ করেই সিটে বসলেন। দুপুরের করা রোদে বাস চলায় হিম বাতাস রোদের উষ্ণতা নিয়ে গায়ে লাগছে।
‘স্যার, কোথায় যাচ্ছেন?’
‘বাসায় যাচ্ছি।’ চোখ বন্ধ করেই আলতাফ উদ্দিন উত্তর দিলেন।
‘আমি যে মারা গেলাম স্যার। স্কুলে একটা ব্যানার টাঙ্গালেন না তো আজ! ‘আমরা গভীর শোকাহত’ বড় করে একটা কালো ব্যানার স্কুল গেটে লাগাবেন, স্যার?’
‘আপনি এখানে? আপনি তো কাল মারা গেলেন। এখানে এলেন কিভাবে?’
‘স্যার আমি তো আজকেও স্কুলে ঘণ্টা দেওয়ার পরেই আসছি। দেখেননি?’
‘মরা মানুষ কিভাবে স্কুলে আসে?’
‘স্যার, ব্যানার দেখতে আসছিলাম। এই ব্যানার প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা নাম দিয়ে বানাতে হয়। কনকনগর বাজারের মেসার্স বাংলা প্রেসে ভালো ব্যানার বানানো হয়। ওখানে একটা ব্যানার অর্ডার দিন স্যার।’
গাড়ির হেলপার ‘বাগেরহাট আসছে, সবাই নামেন’ বলে চিল্লাতে লাগলো। আলতাফ উদ্দিনের ঘুমভাব কেটে গেল। দুই চোখ অনামিকা আঙুল দিয়ে ডলতে ডলতে বাস থেকে নামলেন। নিচে নেমে বাসের দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রইস সাহেব কখন নামবেন, তা দেখার জন্য। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন। ‘রইস উদ্দিন সাহেব কি আমার পাশের সিটে ছিলেন?’ মনে মনে ভাবতে লাগলেন।
পরদিন স্কুলে এসে জরুরি মিটিং ডাকলেন। সব শিক্ষক, সভাপতি উপস্থিত। আলতাফ উদ্দিন প্রস্তাব করলেন রইস উদ্দিন সাহেবের অকালমৃত্যুতে স্কুলের পক্ষ থেকে দোয়া অনুষ্ঠান করা হবে। আর একটা কালো ব্যানার বানানো হবে। ব্যানারে কী লেখা থাকবে সেটিও নিজে বলে দিলেন। সভাপতি তাফরির খান মনে মনে বিরোধিতা করলেও সবার সামনে দোয়া ও ব্যানার বানানোর সম্মতি দিলেন।
স্কুলের সামনের ফটকে ঝুলছে কালো ব্যানার। ‘সহকারী শিক্ষক রইস উদ্দিন স্যারের অকালমৃত্যুতে আমরা কনকনগর হাই স্কুলের পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’ হেড স্যার স্কুলে ঢোকার সময় ব্যানারের দিকে তাকিয়ে লেখাগুলো পড়তে লাগলেন। পাশে এসে দাঁড়ালেন রইস উদ্দিন। ‘স্যার, ব্যানার সুন্দর লাগছে না? কালো কয়লা রঙের ব্যানার। আমার নামও আছে। এটা তো আর অন্য কারো কাজে আসবে না। মেসার্স বাংলা প্লেসে আপনার নামে একটা ব্যানার বানাতে দিন স্যার। আপনার কি আমার মতো অকালমৃত্যু হবে, না কালমৃত্যু হবে স্যার? কোনটা লিখবেন?’
এসময় স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী ব্যানার দেখতে ভিড় জমালো।
এসইউ/এএসএম