মোহাম্মদ রায়হানের গল্প: অলক্তক
মাছ নেই, খালি পোটলা উঠানে ফেলে দিয়েই তনুর বাবা হনহন করে ঘরে ঢুকে তনুর মাকে ডাকাডাকি করতে লাগল, ‘কইরে, কন্ডে গেলা তনুর মা, এমুই আইয়ো, আরে কন্ডে রে।’
উনুনে আগুন জ্বলে না, খড় কতগুলো উনুনে গুঁজে দিয়ে ধোয়া ছড়িয়েই তনুর মা জমির মিয়ার কাছে এসে বসলো। আমেনা বিবির চেহারায় ততক্ষণে গরমে ঘামে লাল হয়ে আছে। অস্থিরতা স্পষ্ট। চুলোয় বসানো ভাত অল্প আগুনেই এতক্ষণে রান্না শেষ। বিল থেকে তনুর বাবা এলে মাছ নিয়ে আসবে, সেই আশায় এখনো উনুনের আরেক পাশে জ্বাল দিতে পারছে না আমেনা বিবি। তনুর বাপের দিকে চেয়ে আমেনা বলে, ‘কই গো, কী মাছ হাইছো, কন্ডে রাখছো?’
হুনো আমেনা, গুরম খবর। মাছটাছ আইজ লাইগদো না, তনুর লাই ভালা একখান হোলার খোঁজ হাইছি, বুঝছনি।
এমন কত হোলাই তো আইছে গেছে, কই আর মাইয়াগার হোড়া কোয়াল।
আইচ্ছা হুনো, তনু কি অনও ওই সোনাইয়ের লগে দেয়া করে ক্যান?
‘মা মা’ শব্দে তনুর ডাক শোনা যাচ্ছে। দিন নাই, দুপুর নাই, বিলের পশ্চিমপাড়ে টংটং করে ঘুরে বেড়ায় তনু। সংসারে কাজকর্ম কমই করে। দুবছর আগে গ্রামের আড়ং থেকে একজোড়া আলতা আর কপাতা টিপ যে নিয়েছিল, তা পরেই নিয়ম করে একবার সকালে একবার বিকেলে বের হয়।
সেদিন দোকানদার জমির মিয়া বাড়িতে এসে আমেনা বিবিকে সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিল। সোনাইয়ের নৌকায় করে পদ্ম তুলতে দেখেছে তনুকে। আমেনা বিবির বোঝানোর শেষ নেই। মেয়েরে আমেনা কত বোঝালো, ‘দ্যাখ, এগান করিছ না, গরিব মাইন্না। রাইতে খাইলে বেয়াইন্নার খানা নাই। রাইত-বিরাইতে ছনের বেড়ার ফাঁকে দি মশা ঢুকে। ঘুম যাইতি হারছ না। বাপের টেয়া আছেনি? এগান কিয়া করছ?’
বিকেলের দিকে ওপারের আনন্দিপুর থেকে ছেলেপক্ষ এলো তনুকে দেখার জন্য। আশ্চর্য, মেয়েটা এখনো ঘরে নেই। তার রুটিনমাফিক চলে গেছে পশ্চিম পাড়ার বিলপাড়ে। এদিকে ছেলের মামা আর ছেলের মা এসে হাজির। ফিসফিস করে কথা বলছে একে অপরের সঙ্গে।
ও তনুর মা, এমুই আইয়্যেন না।
স্লামুলেকুম আপা।
বইয়েন, বইয়েন।
হুনেন আপা, বিয়া-শাদি ব্যাগ্গান আল্লার আতে। আল্লাহ যার লাই যেড়ে বান্দি রাইখছে, হেড়েই বিয়া অইবো। আন্নের মাইয়ার নামে বোহোত হুইনছি। আংগো হেতেন নাকি দেকছেও। কই, তনুরে লই আইয়্যেন না।
জ্বে আপা। আমার মাইয়াগা এক্কানা লাজুক। আইতো চায় না। এক্কানা সময় লাগের।
হে হে। মাইয়া মাইনসের লাজুক অন ভালা। লজ্জা অইলো মাইয়া মাইনসের ভালা গুণ। মাইয়া লাজুক না অইলে হিতি কিয়ের মাইয়া।
জ্বে আপা। এক্কানা বইয়েন। আইয়ের হিতি।
সন্ধ্যা কাছাকাছি। সূর্য পশ্চিমে হেলে ডুবতে শুরু করেছে। আশ্চর্য, আজ যেন বেলা দ্রুতই গড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন গড়াচ্ছে তনু-সোনাইর দিন। ক্লাস সিক্সে যখন তনু পড়তো, সোনাই আর তনু একসঙ্গে স্কুলে যেত। স্কুল ফিরতে তাদের বৃষ্টিতে ভেজার দিনের কথা এখনো মনে করে তারা।
কে জানে, এমন কোনো সুখের স্মৃতি স্মরণ করেই হয়তো তনু-সোনাই হেসে গড়াচ্ছে বিল পাড়ে। ঘাটে সোনাইয়ের ছোট্ট নৌকাটি বাঁধা। বৈঠা তনু-সোনাইয়ের মাঝখানে রাখা। হঠাৎ টের পেলো তনুর বাবা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসছে। সোনাই এমন ভঙ্গিতে নৌকায় উঠে পড়লো, যেন তনুকে চেনেই না। তনুর বাবার আগমনে যতটা অস্থিরতা স্পষ্ট ছিল, তনুর সাথে কথা বলতে ততটা অস্থিরতা দেখায়নি। ‘এগ্গান চল মা, সন্ধ্যা হই গেছে, তোরে আইজ ছেলেপক্ষ দেখপার আইসপে।’ কোনো কথা না বাড়িয়েই বাড়িতে ফিরলো বাপ-মেয়ে।
তনুর কপালে একটা লাল টিপ আর পায়ে আলতা লাগানোই ছিল। আলাদা করে সাজানো ছাড়াই ভারি মিষ্টি মেয়ে তনু। চুলের যত্ন আছে বেশ। ক্ষেতের সরিষা দিয়ে বানানো তেল দিয়েই আমেনা বিবি চুলের যত্ন নেওয়া শিখিয়েছেন ছোটবেলা থেকে। ফর্সা চেহারা, চোখগুলো হরিণের চোখের মতো, পায়ে নিজের বানানো পুঁতির নূপুর। এই তনুর সাজ। প্রথম দেখায় যে কেউ হয়তো তার সৌন্দর্যের প্রেমে পড়বে। তনু হয়তো মনে মনে ভাবছে, আচ্ছা ওপারের বর কি তাকে পছন্দ করবে? চুলে বিদেশি তেলের ঘ্রাণ খুঁজতে গিয়ে যদি সরিষার তেলের গন্ধ পায়, তার কেমন লাগবে। মুখে কখনো ক্রিম দেয়নি তনু। নতুন বরের দেওয়া বিদেশি ক্রিমে তনুর ত্বক আরও ফর্সা হয়ে যাবে! আচ্ছা, আনন্দিপুরের লোকটি কি তনুকে নৌকায় ভাসাবে? পদ্ম তুলবে তাকে নিয়ে? নাকি আধুনিক যন্ত্রের শহরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে! ভাবতে ভাবতে টুক করে হাতের ওপর চার ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তে তনুর মনে পড়লো তার সোনাইয়ের কথা। আশ্চর্য, তার তো সোনাই আছে। কিন্তু হাতে আংটি কেন! কী হচ্ছে তার সাথে!
‘হুন তনু, সামনের শুক্রবার তোর বিয়া। দিন আছে আর চাইর আন। কোনোদিকে ঠ্যাং বালাবি না’। তনুর মায়ের কঠোর নির্দেশ। ভ্রূ কুচকে তনু ভাবতে লাগলো, তার মা হঠাৎ এমন কঠোর কেন? আগে তো কখনো এভাবে বলেনি। তনুকে কেউ জিজ্ঞেস করতে আসেনি ছেলে পছন্দ হয়েছে কি না, বিয়ে তুই করবি কি না। তনু খুব করে চায়, কেউ একজন এসেই তাকে এ অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে যাক। দম বন্ধ লাগছে তনুর। তিন দিনে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তনু। আচ্ছা, তার সোনাইয়ের কী হবে!
বৃহস্পতিবার দুপুর। তনুর বাবা গঞ্জে। মা আমেনা বিবি গেছে প্রতিবেশী জরিনা বিবির বাড়িতে। জরিনা বিবির সাথে আবার তনুর মায়ের ভারী খাতির। সুখে-দুঃখের সই। মেয়ের বিয়ে, এ সুসময়ে সইয়ের বাড়িতে হাসিমুখে দাওয়াত দেওয়ার কাজ সারতেই বোধহয় সে ঘরে উঠেছে।
বাড়ি খাঁ-খাঁ করছে। অন্য সময়ের থেকে বাড়ির আঙিনা বেশ পরিপাটি। ঘর, ভিটা আর বাড়ির আঙিনা বলে দিচ্ছে বাড়িতে অতিথি আসছে। ঘরের সদর দরজায় তনু দাঁড়িয়ে। আজ চুল আঁচড়ায়নি। ব্লাউজ ছাড়া মায়ের পুরাতন একটি শাড়ি পরা। তনু দেখছে না, ঝাপসা দেখছে। বুঝতে পারছে না তনুর সামনের সব বারবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কেন। মিনিট পাঁচেক আগে দেওয়া নখপালিশের ওপর চোখের জলের ফোঁটা পড়ে পায়ের আঙুল লাল হয়ে গেছে। তনু বুঝতে পারছে, তার কোনো কারণে মন পুড়ছে, কষ্ট হচ্ছে। ভেবে পাচ্ছে না কিসের জ্বালা, কিসের টান!
কিছু না বুঝেই ছুটে গেল পশ্চিমপাড়ার বিল পাড়ে। আজ বিলে অদ্ভুত সুন্দর পদ্ম ফুটে আছে। কিন্তু না, তনু তো পদ্ম তুলতে আসেনি। তনু ভাবে, ওই যে, দূরে নৌকা দেখছে; তাতেই তার সোনাই আসছে। সোনাই তাকে নিয়ে যাবে বহুদূর। সূর্য পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। কিন্তু সোনাই আর এলো না। তবুও তনু কিসের টানে যেন বসেই আছে পাড়ে।
পরদিন শুরু হলো তনুর বিয়ের আয়োজন। চোখে কাজল দেওয়া যাচ্ছে না। বারবার ভিজে যাচ্ছে। চোখের জলে চেহারায় কালো ছোপ পড়ে আছে। আলতার দুটো শিশি তনু আগেই পাশে রেখে দিয়েছে। বরযাত্রীর পাঠানো কসমেটিক্সে তো আলতা ছিল, তবুও এই দুই শিশি আলতায় কি পা লাল করবে তনু! না, তনুর পা পরিষ্কার। কপালে সেই পুরোনো টিপের পাতা থেকেই একটা টিপ লাগিয়ে দেয়।
বাইরে প্রবল শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এ শোরগোল তনু গায়ে মাখছে না। কারণ তার অন্তরাত্মায় বহু সোনাই ভিড় করে আছে এখন। সোনাই যেন বলছে, ‘তনু, তুমি আসবে আমার কাছে? তনু যেও না, একবার আমার নৌকায় ভাসবে? আমরা নৌকায় ভাসবো, আর এ পারে আসবো না কখনোই।’
হঠাৎ তনু ছুটে গেল সেই বিলের পাড়ে। চোখ ছলছল করছে। বিল পাড়ে কি সোনাই এসেছিল, ডেকেছিল তনুকে! নাকি সোনাই কখনোই আসবে না। নানা প্রশ্ন জাগে মনে। তনুর হাতে আলতার শিশিগুলো ছিল। আলতা আর টিপ মূলত আড়ং থেকে সোনাইই কিনে দিয়েছিল। সোনাইয়ের দেওয়া আলতা আর টিপ কপালে দিয়ে বউ সাজবে তনু। না এই বউ সোনাইয়ের না। সোনাইয়ের যত্নে গড়া প্রেম একটু পরেই অন্যের হতে চলেছে। তবুও সোনাই আসবে, সে আশায় বিল পাড়ে নতুন বউ।
বারবার তনুর চোখ ভিজে যাচ্ছে। তনু শুনেছে, বিয়ের দিন কাঁদতে নেই, অমঙ্গল হয়। অমঙ্গল হয়ে যদি বিয়েটা ভেঙে যায়! ভাবতে ভাবতেই অনেক বেলা গড়িয়েছে। সোনাইয়ের আর আসা হয় না। তনু ভাবে, তার হাতের আলতার শিশিগুলো বিষের শিশি হলো না কেন! ঝাপসা চোখেই শিশিগুলোর মুখ খোলে। শিশির ভেতর কি সোনাইয়ের ভালোবাসা, না রক্ত! মুখ খুলে জলে ঢেলে দিচ্ছে তনু। মনে হচ্ছে আত্মায় বন্দি পাখিকে মুক্ত করে দিচ্ছে। ভালোবাসাকে মুক্ত করছে।
বিলের পানি লাল রঙে ভরে গেছে। আশ্চর্য! এত গাঢ় রং। দুটো আলতায় কি বিল লাল হয়ে যাচ্ছে! হঠাৎ একটি ঢেউ আলতা মেশানো পানিকে মিশিয়ে দিয়েছে। আর রেশ নেই। তনুর মনে সোনাইয়ের মায়া ক্ষণিকেই কেটে গেছে। বিলে আলতার রং যেমন ক্ষণিকেই মিলিয়ে গেছে। তনুর চোখ শুকিয়ে গেছে। সোনাইকে ক্ষণিকেই পর করে বাড়ির দিকে ছুটলো তনু। কাঁচের দুটো খালি শিশি সেখানেই পড়ে রইলো। একটু পরই একটি ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে তীরে...
এসইউ/জেআইএম