স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম সারথি এশিয়াটিক সোসাইটি
‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’ মৌলিক গবেষণা এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার অগ্রণী প্রতিষ্ঠান। ১৯৫২ সালে এশিয়ার মানুষের জীবন-কর্ম এবং প্রকৃতি বিষয়ে গবেষণায় আত্মনিয়োগে গবেষকদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ‘পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি’ নামে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পরের বছর প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি সাত দশক পার করেছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. জামিন মিয়া এবং হাসিবুল হাসান শান্ত—
জাগো নিউজ: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি সাত দশক পার করেছে। সুদীর্ঘ এ অগ্রযাত্রা সম্পর্কে জানতে চাই—
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: এশিয়ার মানুষ নিয়ে গবেষণার জন্য স্যার উইলিয়াম জোন্স ১৭৮৪ সালে কলকাতায় ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথমে এটি কলকাতায় থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় এর আদলে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। দিল্লি, মুম্বাই, শ্রীলঙ্কা এবং লন্ডনেও এটি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান আমলে ঢাকায়ও এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর এর নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’। জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশের শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ খ্যাত বাংলা পিডিয়া (১৪ খণ্ড), অঞ্চল সমীক্ষার ওপর রচিত গ্রন্থ বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণীকোষ (২৮ খণ্ড), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা (১২ খণ্ড) এবং মুক্তিযুদ্ধ কোষ (১০ খণ্ড) প্রকাশ করেছে।২০০৮ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত একটি প্রজেক্টের অধীনে সোসাইটি ১৮টি বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাস নিয়ে রচিত গ্রন্থটি। আপনি জেনে থাকবেন, আমাদের ৪৬টি ট্রাস্ট ফান্ড আছে।ফান্ডগুলোর অর্থায়নে প্রতি বছর গবেষণা বক্তৃতা আয়োজন, গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং বৃত্তি প্রদান করে গবেষণাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গবেষণার বিকল্প নেই। তাই বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিকে স্মার্ট বাংলাদেশের অন্যতম সারথি বলতে পারেন।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ খ্যাত ‘বাংলাপিডিয়া’ হালনাগাদ করা সম্পর্কে যদি বলতেন—
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: আমাদের এই জাতীয় জ্ঞানকোষ প্রকল্পটি একটি আলাদা ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে পরিচালিত একটা চলমান প্রকল্প। এর কার্যক্রম মূলত ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটি প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হচ্ছে।যেমন এ বছরের জুনে দুই বছরের হালনাগাদের কাজ শেষ হয়েছে। প্রায় ২ হাজারের বেশি নতুন ভুক্তি যুক্ত হচ্ছে। আমাদের অনেক এন্ট্রি আছে, যেটা বিভিন্ন সময়ে এটিকে হালনাগাদ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আপনাদের একটি উদাহরণ দিচ্ছি—মনে করুন, বাংলাদেশের একজন জাতীয় অধ্যাপক মারা গেছেন এবং নতুন অধ্যাপক নিয়োগ পেলেন। এ তথ্য আমাদের যুক্ত করতে হয়।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই
জাগো নিউজ: জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ২০১২ সালে ‘বঙ্গবন্ধু স্মারক বক্তৃতা ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করেছিলেন। এ ফান্ডের অধীনে কী কী কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: এ ফান্ডের অধীনে মূলত আমরা বক্তৃতার আয়োজন করি। এ ট্রাস্ট গঠনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক প্রতি বছর কমপক্ষে একটি বক্তৃতার আয়োজন করা। আমরা এ বছর আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সঞ্জয় কুমার ভরদোয়াজকে অতিথি করে বক্তৃতার আয়োজন করেছিলাম। শিরোনাম ছিলো ‘বঙ্গবন্ধু: এজ এ ওয়ার্ল্ড লিডার’। ট্রাস্ট ফান্ডগুলোর আহ্বায়ক সোসাইটির সেক্রেটারি। সে কারণে এসব আমাকেই দেখভাল করতে হয়।
জাগো নিউজ: সোসাইটির পাঠাগারে ২৩ হাজারের বেশি বই আছে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঠাগারের সঙ্গে সোসাইটির জার্নাল বিনিময় প্রোগ্রাম কার্যক্রম চালু আছে। এগুলো কীভাবে পরিচালনা করা হয়?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: বর্তমান কাউন্সিল দায়িত্ব নেওয়ার পরে এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরির ডিজিটালাইজেশনের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। লাইব্রেরিতে পুরোনো বই ছাড়াও অনেক দুর্লভ পাণ্ডুলিপি আছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২৬ হাজার গ্রন্থ আমরা সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশন করেছি। এটি খুব দ্রুত সবার জন্য উন্মুক্ত করতে পারবো বলে আশা রাখি। আর সোসাইটি একেবারে প্রথম থেকেই অন্য দেশের এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে প্রকাশনা বিনিময় করছে।গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রকাশনা বিনিময় হয়। বিশেষ করে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের সঙ্গে সোসাইটির একটি চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় উভয়পক্ষ পরস্পরকে প্রকাশনীর এক কপি করে ফ্রি দেবে। কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও আমাদের গবেষণা বিনিময় হয়।
জাগো নিউজ: সাধারণ পাঠকদের জন্য সোসাইটির পাঠাগারে বইপড়ার সুযোগ আছে?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: হ্যাঁ। সাধারণ পাঠকদেরও সুযোগ আছে। অনুমতি নিয়ে যে কেউই পড়তে পারেন। তবে লাইব্রেরিটা খুব বেশি বড় না হওয়ায় কয়েকদিনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়। সুতরাং এটি মূলত গবেষকদের জন্য, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। তারপরও যারা মাস্টার্স লেভেলের শিক্ষার্থী এবং যাদের সত্যিকার অর্থেই লাইব্রেরি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়, তাদের সোসাইটি সে অনুমতি দেয়।
জাগো নিউজ: প্রতি বছরই বইমেলায় এশিয়াটিক সোসাইটির একটি স্টল থাকে। এর কার্যক্রম সম্পর্কে বলবেন কি?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: আমাদের প্রকাশনার বই সারাবছরই বিক্রি হয়। তারপরও একুশে বইমেলা সোসাইটির বই বিক্রির উপযুক্ত সময়। অধিকাংশ বই বলতে গেলে বইমেলাতেই বিক্রি হয়। মেলা উপলক্ষে প্রচুর পাঠক আসায় সাধারণ ক্রেতাদের কাছে আমরা খুব সহজেই বই পৌঁছে দিতে পারি। এ কারণে সোসাইটির বেশ বড় একটি স্টল বাংলা একাডেমিতে দেখে থাকবেন।
আরও পড়ুন: মুঠোফোনের কাব্য: কবিতার ভিন্ন আঙ্গিক
জাগো নিউজ: শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জন্য ৩৫০০ বর্গফুট আয়তনের স্থায়ী আর্ট গ্যালারি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি দেশি-বিদেশি সুপ্রসিদ্ধ শিল্পীর শিল্পকর্ম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করে। এর কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা করা হয়?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: এর তত্ত্বাবধায়ন করার জন্য সোসাইটির একটি কমিটি আছে। এ কমিটির মাধ্যমে আর্ট গ্যালারি পরিচালিত হয়। আমরা দেশি বা বিদেশি শিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শন বা কখনো কখনো গ্রুপ প্রদর্শনের আয়োজন করি। এ প্রদর্শনী বিশেষ করে শীতকালে হয়ে থাকে। কার্যক্রমটি নিয়মিতভাবেই এশিয়াটিক সোসাইটিতে পরিচালনা করা হয়।
জাগো নিউজ: বিদেশি গবেষকদের মঞ্জুরি ও সহায়তার পাশাপাশি গ্রন্থাগার ব্যবহার ও আবাসনসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। এখানে আবাসন সুবিধা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রমে বিদেশি গবেষকদের কেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: সোসাইটিতে প্রায় সারাবছরই কোনো না কোনো বক্তৃতা, স্পেশ্যাল লেকচার এবং ট্রাস্ট ফান্ড বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। তবে গত ৩ বছর যাবৎ ব্যাংকের মুনাফা কমে গেছে। এ কারণে আমাদের আয় কমে গেছে। সে ক্ষেত্রে কিছুসংখ্যক বিদেশির খরচ বহন করা হয়। প্রতি বছর কিছুসংখ্যক বিদেশিকে এখানে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিয়ে আসি। যেমন আমাদের সময়ে বেশ কয়েকজন বিদেশি স্কলার এসেছেন। ইউরোপ বিশেষ করে ভারত থেকে বেশি গবেষক আসেন। গবেষক আশীষ নন্দীর চলতি মাসের শেষের দিকে আসার কথা আছে।
জাগো নিউজ: ঢাকার নায়েবে নাজিমদের স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনায় অপ্রতুল প্রত্নসামগ্রী নিয়ে সোসাইটির একটি জাদুঘর আছে।নায়েবে নাজিমদের প্রত্নবস্তু অন্য কোনো জাদুঘর বা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে সংগ্রহ করতে সোসাইটি কতটা মনোযোগী?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: সোসাইটি নায়েবে নাজিমদের প্রাসাদের দেউড়িটিকে সংস্কার করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, জাদুঘরটা হলো নায়েবে নাজিমদের প্রবেশের গেইট অর্থাৎ তোরণ। বর্তমানে প্রাসাদের অস্তিত্ব নেই। এই তোরণ মূলত সৈনিকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে তারা পাহারা দিতেন। প্রত্নবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে সোসাইটি এটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছে। ঢাকা ও কলকাতা থেকেও নায়েবে নাজিমদের প্রত্নবস্তু সোসাইটি সংগ্রহ করেছে। মুঘল আমলের শেষের দিকের প্রত্নবস্তু যতটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে; ততটুকু প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হৃদয়বান ব্যক্তিদের কাছে উদাত্ত আহ্বান থাকবে, তারা যদি জাদুঘরের জন্য প্রত্নবস্তু দেন; তাহলে সোসাইটি সেগুলোকে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করবে। তারপরও কেউ যদি বিক্রি করতে চান, সোসাইটির সামর্থ অনুসারে সংশ্লিষ্টজনকে পুরস্কৃত করা হবে।
জাগো নিউজ: পদাধিকার বলে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে সোসাইটির প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কতটা সুদৃষ্টি আছে?
ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তবে আমাদের সোসাইটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। সোসাইটির মোট বাজেট সরকার আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেয়। সেই অর্থ সোসাইটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় করা হয়। সোসাইটির নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ স্বেচ্ছাসেবামূলক দায়িত্ব পালন করেন। বার্ষিক বাজেট ব্যয় ছাড়াও সোসাইটি অনেক প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব প্রকল্পে মূলত সরকারই অর্থের জোগান দেয়। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও অনেক সময় গবেষণামূলক কর্মে অর্থের জোগান দিয়ে সোসাইটির কাজকে গতিশীল করে।
এসইউ/জেআইএম