অযত্নে মলিন ‘রামমোহন গণপাঠাগার’, আইনি বাধায় সংস্কারকাজ
রাজধানীর সদরঘাট ফুটওভার ব্রিজ থেকে একটু সামনে এগোলেই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেখান থেকে আরও কিছুটা সামনে গিয়ে ডানে মোড় নিলে ব্রাহ্মসমাজের মন্দির। তারই পাশে জরাজীর্ণ এক বহুবর্ষী দালান। হলুদরঙা ঐতিহ্যবাহী সে দালানেই উনিশ শতকের শেষভাগে স্থাপিত হয়েছিল ‘রামমোহন গণপাঠাগার’। অযত্ন আর অবহেলায় একসময়ের সেই জৌলুস নেই এখন। পাঠাগারে ঢুকে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতেই মনে হলো, বহুদিন কোনো পাঠকের স্পর্শ পায়নি সেখানকার বইগুলো। প্রাচীন এ গণগ্রন্থাগারটি এখন কেবলই যেন কালের সাক্ষী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ ভবনের দেয়ালে আগাছার রাজত্ব। সর্বশক্তি দিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে নিজেকে আটকে রেখেছে প্রকাণ্ড এক বটগাছ। পাঠাগারের দরজায় তালা ঝুলানো। নেই কোনো চাকচিক্য, সবখানে জীর্ণতার ছাপ। পাঠাগারের ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে দরজা খুলে দেন দারোয়ান। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, সবকিছু অগোছালো ও নোংরা। সংকীর্ণ এক জায়গায় রাখা আছে পাঠাগারের বইগুলো। সেগুলোতেও জমেছে ধুলোর আস্তরণ। একসময়ের সমৃদ্ধ এ পাঠাগারটিতে খুব অল্প সংখ্যক বই এখন অবশিষ্ট রয়েছে। জানা গেছে, বহুদিন পাঠাগারে আনা হয় না নতুন বই। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যে বইগুলো আছে সেগুলোও ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: পাঠাগারের সুফল পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
দেড়শো বছরের পুরোনো এ পাঠাগারটিতে তখনকার সময়ের ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক পাখা, কাঁসার থালা-বাটি, টি-টেবিল, টেবিল, প্রদীপ, রাজকীয় পালঙ্কসহ অন্যান্য আসবাবপত্র সংরক্ষিত আছে। তবে এখন আর আগের মতো জ্ঞানপিপাসু মানুষের তেমন দেখা মেলে না সেখানে। কালেভদ্রে উৎসুক দু-চারজন গবেষক বা পর্যটক আসেন পাঠাগারটির ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা অনুসন্ধানে।
জানা যায়, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যাত্রা শুরু করা ব্রাহ্মসমাজের এ পাঠাগারে এসময় বাংলার বহু বিদ্যার্থী ও মনীষীর পদচারণা ছিল। নিয়মিত যাতায়াত ছিল কবি-সাহিত্যিক, সমাজ হিতৈষীদের। এমনকি সেখানে পায়ের চিহ্ন ছিল সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিদ্যান মানুষদের। ১৮৯৮ সালে ঢাকায় এসে রবীন্দ্রনাথ যে তিনটি দর্শনীয় স্থানের কথা বলেছিলেন, এরমধ্যে রামমোহন গণপাঠাগারটিও ছিল।
সংস্কৃত থেকে শুরু করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার দুষ্প্রাপ্য বহু বইয়ের সংগ্রহশালা হিসেবে পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের এ গণপাঠাগারের সুখ্যাতি ছিল। ঐতিহ্যবাহী দেশের প্রথম এ গণপাঠাগারটি এখন পাঠকশূন্যতায় প্রাণহীন। বইয়ের প্রচ্ছদগুলো ঢেকে দিয়েছে মাকড়সার জাল। ধুলোয় মলিন ভেতরের পরিবেশ।
আরও পড়ুন: কেমন চলছে পলান সরকারের রেখে যাওয়া পাঠাগার
রামমোহন গণগ্রন্থাগারটির ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ভবনটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। তবে ভবনটির স্মৃতি ধরে রাখার স্বার্থে ব্রাহ্মসমাজের তৎকালীন আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমান্দার ২০০৫ সালে উচ্চ আদালতে রিট করে ভবনটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আবেদন করেন। ভবনটি রক্ষার্থে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। তবে বিশেষ কোনো গঠনশৈলীতে তৈরি না হওয়ায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০০৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনটি পুরাকীর্তি আইনের আওতায় পড়ে না। এরপর ঢাকার অবিভক্ত সিটি করপোরেশন রাজউকের ৯৩টি স্থাপনার তালিকায় ভবনটির নাম আছে বলে উল্লেখ করে রাজউকের অনুমোদন ব্যতীত ভবনটির পুনর্নির্মাণ ও অপসারণে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ব্রাহ্মসমাজ ও রামমোহন গণপাঠাগারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবি জাগো নিউজকে বলেন, ব্রাহ্মসমাজ সবার জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ চাইলেই যে কোনো সময় এখানে আসতে পারেন এবং পাঠাগার থেকে বই পড়তে পারেন। অনেকে মনে করেন পাঠাগারে ঐতিহাসিক অনেক বই আছে। কিন্তু বর্তমানে সংগ্রহের পরিমাণ খুবই কম। অল্প কিছু বই অবশিষ্ট আছে সেখানে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা পাঠাগারটির বহু বই লুটপাট ও ধ্বংস করেছে। আমরা পাঠাগারটির অতীতের গৌরব ফেরাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, এখানে একাডেমিক কাজে কিছু শিক্ষার্থীর যাওয়া-আসা আছে। মাঝেমধ্যে গবেষকদেরও দেখা মেলে। গত মাসেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৬-৭ জন শিক্ষার্থী পাঠাগারটি ঘুরে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চলমান রাখতে সময়-ব্যয় বৃদ্ধি
‘আমরা তিন পুরুষ ধরে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে জড়িত। নিজ হাতে এটির তদারকি করছি। পাঠাগারের মূল ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু আইনি জটিলতা থাকায় নতুন ভবন নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাঠাগারটি সম্প্রসারণ ও সংস্কারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। সরকার সহায়তা করলে সেখানে একটি সেমিনার কক্ষ ও গবেষণাকেন্দ্র করার পরিকল্পনা রয়েছে’- বলেন রণবীর পাল রবি।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৮৭১ সালে ঢাকার নাট্য আন্দোলনের অন্যতম সূচনাকারী ব্যক্তিত্ব অভয় চন্দ্র দাসের উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজের পাশাপাশি একটি পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা ও সমাজ সংস্কারের পুরোধা ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের নামানুসারে পাঠাগারটির নামকরণ করা হয় ‘রামমোহন গণপাঠাগার’। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ভাষার দুর্লভ গ্রন্থের সংগ্রহশালায় পরিণত হয় পাঠাগারটি।
আরও পড়ুন: পাঠক কমছে সাতক্ষীরা সরকারি গণগ্রন্থাগারে
তৎকালীন সময়ে বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা এ ভূমিতে পাঠাগারটির নির্মাণ ও সম্প্রসারণে লর্ড কারমাইকেল, গিরিজানাথ রায়, মোহিনীমোহন দাস, কৃষ্ণগোবিদ গুপ্ত, বরদার মহারাজা ও কোচিনের মহারাজা, পি. সি. সেন, সুরেশচন্দ্র সিংহ প্রমুখের অবদান উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকসেনাদের নারকীয়তায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জ্ঞানের এ বাতিঘরটি। অনেকাংশে ধ্বংস করে দেওয়া হয় দুর্লভ ও অমূল্য বহু পুস্তক। অবাধে চালানো হয় লুটপাট। পরবর্তীকালে বহু গ্রন্থের কোনো হদিস মেলেনি। তবে এ গণপাঠাগারটিতে এখনো প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য কিছু গ্রন্থ অবশিষ্ট রয়েছে বলে জানা গেছে। নেই শুধু সেসব বইয়ের যোগ্য পাঠকের দেখা। নেই শুধু পাঠাগারটি নবরূপে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ।
এমকেআর/এএসএম