সময় কইবে কথা তাঁর

সাখাওয়াত হোসেন সুজন
সাখাওয়াত হোসেন সুজন সাখাওয়াত হোসেন সুজন
প্রকাশিত: ১১:৫৮ এএম, ২৫ জুলাই ২০২৩
ছবি : বাতিঘরের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

বয়সটা যখন আশি পেরিয়ে যায় তখন মেজাজটা হয় খিটখিটে। কাউকে আর ভালো লাগে না, কোনো কিছু ভালো লাগে না। কারও কথা শুনতে ভালো লাগে না। ৮০ পেরিয়েছে এমন সিনিয়র সিটিজেনের দেখাও সচরাচর মেলে না। তাই এই আচরণের সম্যক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরও দেখা মেলা দায়।কারো কারো এমন সৌভাগ্য হয়। নিজের দাদা-নানা, দাদি-নানি, বাবা-মা কিংবা অন্য কোনো আপনজনের প্রবীণ বয়সে যারা তাদের সান্নিধ্য পায় তারাই বুঝে তাদের মেজাজ-মর্জির ধরনটা কেমন! তাদের সামনে কতটা তটস্থ থাকতে হয়! এটা কেবল নিকটজনেরাই বুঝে এবং বুঝেশুনে চলে।

কিন্তু যদি এমন হয় ওই বয়সী একজনের কথা যেন অমৃতসুধা, তার সাথে ঘুরতে বেরিয়ে যেন নির্মল আনন্দের সন্ধান মেলে, যার কথার মধ্যে বিরক্তির লেশও মেলে না, সরাসরি তো আছেই এমনকি ডিজিটাল জামানায় ইউটিউব-ফেসবুকেও যার কথাগুলো অসংখ্য স্রোতাকে মুগ্ধ করে। যার কণ্ঠের শীতলতা শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষকে আকৃষ্ট করে। তাকে ভালো লাগে মানুষের, মানুষ তাকে ভালোবাসেও।

বলছিলাম মহাগুরু অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা। মহাগুরু এজন্যই আমাদের যারা গুরুজন তিনি তাদেরও গুরু। আমাদের যে শিক্ষকগণ অবসরে গেছেন তিনি তাদেরও শিক্ষক। অথচ আমাদের যাদের বয়স তার অর্ধেকেরও কম তার কথাও তিনি মনোযোগী হয়ে শোনেন। সেই কথাতেও যদি শেখার মতো কিছু পান নোট করে নেন! এ এক বিস্ময়!

আরও পড়ুন: আমাদের একজন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আছেন

সরলভাবেই বলা যায় আজ থেকে ২০০ বছর পর আমিতো থাকবোই না। আমার অর্জিত সম্পদ যে ভোগ করবে তাকেও আমি চিনবো না। তার মানে আমি চলে যাব এটাই সত্যি। যে মানুষটির স্মৃতিতে আমি লিখছি তিনিও একদিন চলে যাবেন এটাই নিয়তি। কালের পরিক্রমায় আমাকে হয়তো কেউই স্মরণ করবে না। কিন্তু আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে অবশ্যই স্মরণ করবে। একটা কর্মময় জীবনের জন্যই তিনি স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

বোটানিক্যাল গার্ডেনে স্যারের সঙ্গে-ছবি খালিদ সোহেল

বোটানিক্যাল গার্ডেনে স্যারের সঙ্গে-ছবি খালিদ সোহেল

যিনি অখণ্ড ভারতে জন্মে পাক-ভারতের সৃষ্টি দেখেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছেন বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞানের আলো বিলিয়েছেন। টেলিভিশনে মানুষের রুচিশীল মন ও মনন গঠনে কাজ করেছেন। সাহিত্য আন্দোলনে ছিলেন অগ্রগণ্য। তার এক ‘কণ্ঠস্বর’ ষাটের দশকে বাংলাদেশকে দিয়েছে অগণিত লেখক। পরিবেশ আন্দোলনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।

আরও পড়ুন: ৮২ নয় যেন ২৮

বর্তমানে দায়িত্বের প্রতি সৎ ও নিরপেক্ষ লোক যারা খুঁজেও পায় না তারা যেন ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’কে জেনে নেয়। নিরপেক্ষতা কী জিনিস, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা একজন মানুষ কীভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। দলপ্রেমিক কিন্তু দলকানা নয় এমন লোক কেমন হতে পারেন তার বাস্তব উদাহরণ এখনও জীবন্ত।

বর্তমানে দায়িত্বের প্রতি সৎ ও নিরপেক্ষ লোক যারা খুঁজেও পায় না তারা যেন ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’কে জেনে নেয়। নিরপেক্ষতা কী জিনিস, নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা একজন মানুষ কীভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে। দলপ্রেমিক কিন্তু দলকানা নয় এমন লোক কেমন হতে পারেন তার বাস্তব উদাহরণ এখনও জীবন্ত।

মানুষ ফেরেশতা নয়, তার ভুলত্রুটি থাকবেই। এজন্য মানুষকে অতিমানবের দরজা না দিয়ে তাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করলেই সমালোচনার জায়গাটা সংকীর্ণ হয়ে আসে। কর্মজীবন থেকে অবসরের পর আমাদের এখানে মানুষ সাধারণত বুড়িয়ে যায় এমনকি ফুরিয়েও যায়। কিন্তু সায়ীদ ফুরিয়ে যাননি। দু’ হাত ভরে জাতিকে দিয়েই গেছেন। অথচ তার আশপাশের কিছু স্বার্থপর মানুষকে দেখে কিংবা তার লেখার তিল পরিমাণ আলোচনার জায়গাকে তাল পরিমাণ সমালোচনার উৎস বানিয়ে ফেলা মানুষগুলো আর যাই হোক সুবিবেচক নয়।

আরও পড়ুন: কবিতা লিখতে না পারার দীর্ঘশ্বাসে ‘অক্ষম গদ্য’

আশির পর তার চারটি জন্মদিন চলে যেতে দেখছি কিন্তু তার কর্মময় জীবন থেমে নেই। মাস খানেক আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে কথায় কথায় জানলাম তিনি লাইব্রেরি থেকে এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা নিয়েছেন পড়ার জন্য। অতি সম্প্রতিই তাকে উচ্চতর পাঠচক্রের বন্ধুদের সঙ্গে ইয়ুভাল নোয়াহ হারারির ‘স্যাপিয়েন্স’ বইটা পড়তে দেখলাম। তরুণদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি পড়েই চলেন। এক্ষেত্রে তার আগ্রহের অন্ত নেই।

যিনি অখণ্ড ভারতে জন্মে পাক-ভারতের সৃষ্টি দেখেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছেন বোধ ও বুদ্ধি দিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞানের আলো বিলিয়েছেন। টেলিভিশনে মানুষের রুচিশীল মন ও মনন গঠনে কাজ করেছেন। সাহিত্য আন্দোলনে ছিলেন অগ্রগণ্য। তার এক ‘কণ্ঠস্বর’ ষাটের দশকে বাংলাদেশকে দিয়েছে অগণিত লেখক। পরিবেশ আন্দোলনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন।

আবার লেখার কাজও থেমে নেই। তার লেখা বই নিয়ে যখন তারই উপস্থিতিতে তরুণরা আলোচনা করেন তখন তিনিও বসে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা শুনেন। নিজের লেখা নিয়ে অকপটেই স্বীকার করেন; লেখক হিসেবে জীবন-যাপনই করা হয়ে ওঠেনি। তাই লেখাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্তত আট থেকে দশবার এডিট করতে হয়।তিনি নাকি নিজের রচনাবলি পর্যন্ত পুনরায় এডিট করেছেন। এমন ধৈর্যও খুব কম মানুষের আছে। আর নিজেকে নিজে পড়ে শুধরে নেওয়ার সৌভাগ্যও সবার নিশ্চয়ই হয় না!

আমার এক ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ একদিন প্রশ্ন করলেন, ওখানে (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র) আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে কী শেখেন? আমি অকপটে বললাম, ড্রাইভিং। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বললাম, সায়ীদ স্যারকে আশির বেশি বয়সে যেদিন একা গাড়ি চালাতে দেখেছি সেদিনই সংকল্প করেছিলাম আমিও শিখবো। আর শিখেছি, ড্রাইভিং লাইসেন্সও করেছি।যদিও আমার গাড়ি-ঘোড়া কিছুই নেই!

আরও পড়ুন: সাহিত্যে প্রতিযোগিতা

যাহোক বাংলাদেশে বড় মানুষের সংখ্যাটা যেমন অল্প তেমনি তাদের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্যটাও বিরল।একঝাঁক স্বার্থপর মানুষ তাদের ঘিরে রাখে। যার ফলে তাদের কাছে যাওয়ার সৌভাগ্যটাও হয় না সাধারণের। কিছুটা ব্যতিক্রম আমাদের সায়ীদ স্যার, বই পড়ার আগ্রহ থাকলে সহজেই তার কাছাকাছি যাওয়া যায়।যারা তাকে ঘিরে রাখেন তারাও আটকে রাখতে পারেন না।

তার এই প্রচেষ্টার ফলেই হয়তো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কোনো বাঙালি সন্তান নিজে জ্বলে উঠে জাতিকে আলোকিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। কালের সে নায়ক যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্যারের পাশে নানা স্বার্থে ঘুরঘুর করে তাদের মধ্য থেকে নাও হতে পারে।এই সত্যটা অকপটে বললাম এই সাহস নিয়েই যে, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এই কারণেই আলোকিত মানুষ গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ বইকে গোটা দেশে ছড়িয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি ক’রে, মানুষ কর নি।’ সেই বাঙালিদের মধ্যে সীমবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে কিছু লোক মানুষ হন। তাদেরই একজন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। যিনি ধীরে ধীরে গড়েছেন এক কর্মময় জীবনের ইতিহাস। ইতিহাস একদিন সে সাক্ষ্য দেবে। একটা লম্বা জীবন যিনি একটি জাতির মনন গঠনের প্রচেষ্টায় কাটিয়ে দিলেন।তার এই প্রচেষ্টার ফলেই হয়তো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কোনো বাঙালি সন্তান নিজে জ্বলে উঠে জাতিকে আলোকিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

কালের সে নায়ক যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি স্যারের পাশে নানা স্বার্থে ঘুরঘুর করে তাদের মধ্য থেকে নাও হতে পারে। এই সত্যটা অকপটে বললাম এই সাহস নিয়েই যে, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এই কারণেই আলোকিত মানুষ গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ বইকে গোটা দেশে ছড়িয়েছেন। সারা দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি ও ছোট ছোট পাঠাগারগুলো এই মতের পক্ষেই সুদৃঢ় সাক্ষ্য দেয়। মানুষ অবশ্যই তার স্বপ্নের সমান বড়। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদও তার স্বপ্নের সমানই বড়। কাজ তাকে ইতিহাসে আরও বড় করে তুলবে এ আশা করাই যায়। সময় কইবে কথা তাঁর।

লেখক: সাংবাদিক

এসএইচএস/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।