ওবায়েদ আকাশের কবিতা: উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল ভাষা

আবু আফজাল সালেহ
আবু আফজাল সালেহ আবু আফজাল সালেহ , কবি ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত: ০৮:৪৩ এএম, ০৮ মে ২০২৩

ওবায়েদ আকাশের কবিতা রক্তজবার মতো স্পষ্ট উচ্চারণ, উজ্জ্বল ও প্রোজ্জ্বল ভাষা। তার চিন্তা যেন দ্বি-ফোকাল হিসেবে কাজ করে। মাছির মতো অন্তর্দৃষ্টি তার। কবিতায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাস্তবতার প্রয়োগ তো অতি চমৎকার। উড়ন্ত প্রজাপতির পাখা যেমন রং দোলায়, প্রতিবেশ করে বর্ণিল; তেমনই ওবায়েদ আকাশের কবিতার রং ছড়িয়েছে পাঠকসমাজে। বলা যায়, কবি কবিতার এমন বুননে সক্ষম হয়েছেন। ইতিহাস, ঐতিহ্যের মিথ ব্যবহার কবিতাকে করেছে আরও স্পষ্ট, করেছে আরও উজ্জ্বল।

কবি ওবায়েদ আকাশের উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (২০০৩), কুয়াশা উড়ালো যারা (২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (২০০৭) , বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (২০১০), রঙ করা দুঃখের তাঁবু (২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে ফিরে (কলকাতা, উদার আকাশ, ২০১৪), সর্বনামের সুখদুঃখ (২০১৯), পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর (২০২০), নির্জনতা শুয়ে আছে সমুদ্র প্রহরায় (২০২১) এবং কাগুজে দিন, কাগুজে রাত (২০২২)। তিনি অনুবাদেও দক্ষতা দেখিয়েছেন। ‘ফরাসি কবিতার একাল/ কথারা কোনোই প্রতিশ্রুতি বহন করে না’ (ফরাসি কবিতার অনুবাদ, ২০০৯,), ‘জাপানি প্রেমের কবিতা/ এমন কাউকে ভালবাস যে তোমাকে বাসে না’ (জাপানি প্রেমের কবিতা, ২০১৪) প্রকাশিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: পল ফায়ারাবেন্ড: একজন এনার্কিস্টের কথকতা

কবিতায় নান্দনিকতা আনয়ন করা দারুণ একটা গুণ। আমরা ওবায়েদ আকাশের কবিতায় দেখি নান্দনিকতার অপূর্ব দৃশ্যপট। সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে তার কবিতায়। আর এ সৌন্দর্য হচ্ছে টেস্ট ইনিংসের মতো ধ্রুপদী ও রোমাঞ্চকর। মনের জগতে প্রজাপতির মতো বর্ণিল। বর্ণিল দোল দেয়। চারপাশ থেকে, মনে ও বাইরে। চোখ ও মনে নির্মল নান্দনিক আবহ তৈরি করতে সক্ষম। আমাদের কথাগুলোই তিনি বলে যাচ্ছেন অবলীলায়—প্রেম, নাগরিক জীবন-হতাশা কিংবা বিজ্ঞানের। ভালো আধুনিক কবিতার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে এগুলো। দুটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না!
১.
যেখানে প্রকৃতি নিজেই সেখানে নেই
বরং মাটিতে নোয়ানো কৃত্রিম কিছু পরিত্যক্ত সার্কাসের ঘোড়া (শূন্যতা ও অস্থিরতা)
২.
এবার নতুন পুরনো সকল বিদ্যায়তনে শূন্যতাবিষয়ক কিছু
পাঠক্রম গ্রন্থভুক্ত করা অবশ্য জরুরি
যে-সকল শূন্যতা প্রতিদিন মানুষের চলাফেরায় সফরসঙ্গী হয়ে
কিংবা গৃহাভ্যন্তরে পারিবারিক সুহৃদজন হয়ে
একই বিছানায় শুয়ে মিলেমিশে গড়াগড়ি যেতে পারে। (শূন্যতা ও অস্থিরতা)

ওবায়েদ আকাশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ফলশ্রুতিতে কবিতার ব্যাপারে আন্তরিকতার সঙ্গে তত্ত্বীয় ও বাস্তব ধ্যান ও জ্ঞানের ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করি। তিনি ‘শীতের প্রকার’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি পুরস্কার ২০০৮’। ‘শালুক’ সম্পাদনার জন্য ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯’। সামগ্রিক কাজের জন্য লন্ডন থেকে ‘সংহতি বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১২’, কলকাতা থেকে সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘ঐহিক সম্মাননা পদক ২০১৬’ পেয়েছেন।

আরও পড়ুন: স্টপ জেনোসাইড: জহির রায়হানের অনবদ্য সৃষ্টি

কবি ওবায়েদ আকাশের কবিতায় অলংকার, কিছু স্বাতন্ত্র্যগুণ, কিছু ব্যতিক্রম বিষয় উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরছি। ফরমালিনযুক্ত খাবার খেয়ে বা লোভে পড়ে চরিত্র ও বিশ্বাসে ভেজালযুক্ত হয়েছে। কবি ছেড়ে দেননি! বলেছেন—
এই প্রকার মনুষ্য-আতঙ্ক একদিন
মানুষের মৃত্যুকেও প্রতিরোধ করার শক্তি যোগাবে! (গোরখাদক)
আগেই বলেছি, নান্দনিকতা ওবায়েদ আকাশের কবিতায় অনন্য গুণ। একটি উদাহরণ দিই—
কিছু সময় বদলে দিয়ে
উড়ে যাবার সময় হয়েছে ঘুঙুরের? (ঘুঙুরের খেলা)
পরাবাস্তবতা বর্তমান কবিতায় একটি অনুষঙ্গ। ওবায়েদ আকাশের অনেক কবিতায় পরাবাস্তবতার সুর লক্ষ্য করা যায়। এ দাবি করা উল্লেখিত কবিতার শেষাংশে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বা সাম্প্রদায়িক অধৈর্যের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অনেক কবিতায় কবি কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা থেকে সমাজকে মুক্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। যেমন-
তার পাশের ডালা থেকে একটি কর্তিত কাতলের মাথা
আমার ব্যাগের ভেতর লাফিয়ে ঢুকে গেল। (রক্তের ধারা/পরাবাস্তবতা)
একাকী সময় বা বিপদের সময় শব্দও আপন বলে মনে হয়। ‘প্রতীকী’ কবিতায় আমরা এমনটাই দেখি—
অথচ রাত্রি হলে হৃৎপিণ্ডের উচ্চারণের চেয়ে
অধিক আপন হয়ে ওঠে ঘড়ির টিকটিক। (সময়)
‘অথচ শহরের স্তনবৃন্ত/ ভরা মৌসুমের আঙুরের বোঁটার মতো ঝরে পড়তে পারে’ (প্রশ্ন), ‘নিজের শরীরে ছুরি ঢুকিয়ে হত্যা করছে ভুল রাত্রির অন্ধকার দেহ’ (শিকার) ইত্যাদির মতো চিত্রকল্প, উপমা-উৎপ্রেক্ষা বা অলংকারের প্রয়োগে কবি ওবায়েদ আকাশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ‘ধূসর আকাশ’, ‘পুঁইশাক-পাটশাকের লাবণ্য’, ‘মা দেখো, এটা বাবার গন্ধ’, ‘তোমার দুয়ারে এখন আন্তর্জাতিক নন্দনতাত্ত্বিক’ ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ছোট ছোট চমৎকার চিত্রকল্প ব্যবহার কবির জাত চিনিয়েছেন ওবায়েদ আকাশ।

১৯৭৩ সালের ১৩ জুন কবি ওবায়েদ আকাশ রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুরে জন্মগ্রহণ করেন। নিজগ্রাম সুলতানপুর নিয়ে ‘পৃষ্ঠাজুড়ে সুলতানপুর’ কাব্যরচনা করেছেন। নিজের গ্রামসম্পর্কিত কবিতায় শিল্পগুণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। অতিরিক্ত আবেগ ঢেলে দেননি। নিয়ন্ত্রিত আবেগে কবিতা শৈলীতে উন্নীত করতে পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস। সঙ্গতকারণেই কবি ওবায়েদ আকাশকে নির্দ্বিধায় ‘সুলতানের কবি’ বলা যেতে পারে। এখন থেকে আমি এ উপাধি দিলাম। আমি মনে করি, এ উপাধি দেওয়া অতি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পড়বে না! সাহিত্য সমালোচনা থাকতেই পারে। তবে গঠনমূলক-আলোচনা থেকে উপসংহারে এ সারাংশ বেরিয়ে আসবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস ও আশা করি।

আরও পড়ুন: আবু আফজাল সালেহ: মননশীলতার পথিক

আধুনিক কবিতা মানুষ ও মানবতাকেই ঘিরে। ওবায়েদ আকাশের কবিতাও মানবতার কথাই বলে। অসাম্প্রদায়িকতার ইঙ্গিত রয়েছে তার কবিতায়। চলমান সমাজে প্রভাব বিস্তার করা ভালো কবিতার অন্যতম গুণ। এ ক্ষেত্রে মোটামুটি সফল বলে মনে করি। অলংকার প্রয়োগে বা শব্দচয়নে সুন্দর সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণ করা আধুনিক কবিতার প্রবণতা। টি এস এলিয়টের পর কবিতায় এ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। ওবায়েদ আকাশের কবিতায় অলংকারের ব্যবহার দেখার মতো, যার মাধ্যমে অপূর্ব চিত্রকল্প সৃষ্টি হয়েছে।

‘তোমাকে কিছু দিতে চাইলেই সেদিন/ বাড়িঘর থেকে ধোঁয়ার উৎসব চিরতরে বিলীন হয়ে যায়’ (তোমার এই দিনগুলো), ‘সঙ্গীতা পরম সঙ্গী ছিল বহুদিন/ নারকেলপাতার বাঁশি আর সোনালুপোকার/ হিম সবুজডানায়’ (সঙ্গীতাকে ভালবাসতাম)—কী নান্দনিকতায় ভরা কবিতা! কবিতা পড়ার সময় চারিদিকে যেন প্রজাপতি ওড়ে। টেস্ট ক্রিকেটের চতুর্থ ইনিংসের রোমাঞ্চের মতো কিংবা উত্তেজনার মতো ওবায়েদের কবিতা পড়তেও ক্রমশ রোমাঞ্চ বাড়ে।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।