ছোটবেলার বৈশাখী মেলার স্মৃতি
প্রায় দেড় যুগের এই জীবনে বৈশাখী মেলায় গিয়েছি মাত্র একবার। আরও আট বছর আগে। ২০১৩ সালে। তখন আমার মধ্যে দশের দুরন্তপনা। বৈশাখী মেলার জন্য স্কুল থেকে পেয়েছিলাম তিনদিনের ছুটি। আমরা তো খুশিতে কুটিকুটি। দশ-বারোদিন আগে থেকেই টার্গেট এবার মেলায় যাবোই যাবো। টাকা জোগাড়ের কাজ শুরু সেদিন থেকেই। টুকটাক টুকটাক করে কিছু জমানোও হলো।
বৈশাখের প্রথম সকালজুড়েই আকাশ মেঘলা ও থমথমে ভাব। কখন আবার ঝড় আসে এই হলো ভয়! ছোটবেলায় ঝড়কে খুব ভয় পেতাম। বেশি চিন্তিত হতাম আমাদের বৃহদাকৃতিক লক্করঝক্কর ঘরের কথা ভেবে। কখন আবার বাতাসে চাল উড়ে যায় কিংবা খুঁটি পড়ে ধসে, এই দুশ্চিন্তা!
সেদিন সকালে ঝড় হলো না। বৃষ্টি হলো কোনোরকম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝকঝকে আকাশের মনোরম প্রদর্শনী। মেঘমুক্ত গ্রীষ্মে সূর্যের তাপ তো বোঝা-ই যায়। নতুন করে কী আর বলব! পিঠ পুড়ে যায় এমন। পিঠ পুড়লে পুড়ুক, মেলায় যাবো তো যাবোই। একগুঁয়ে মানুষ আমি। যাওয়ার আগে আব্বাকে বলামাত্রই কিছু টাকা দিলেন।
দুপুরের ভাত খেয়েই দে দৌড়। সকালে মেঘ না থাকলে তখনই যেতাম। মেলায় যাওয়ার দল জুটে গেল। কে কে সঙ্গে গিয়েছিল, তা ঠিক মনে নেই। আড়িয়াল খাঁর তীরঘেঁষে প্রায় আধ ঘণ্টা হাঁটার পরে মেলায় পৌঁছে গেলাম। খাসেরহাটজুড়ে রমরমা পরিবেশ। নানারকম শব্দ দূর থেকেই শোনা যায়। খাসেরহাট আয়তনে যথেষ্ট বড়। মেলা বসতো মাত্র একটি টল ঘরে। রবি কুণ্ডুর দোকানের সামনের টল ঘর। অর্থাৎ যেখানে হাটের একমাত্র মন্দির, সেখানে।
আরও পড়ুন: পহেলা বৈশাখ আজ
কত মানুষ! পা ফেলার জায়গা নেই। এত ঠেলাঠেলি, বাপ রে! খুব ছোটবেলায় গান শুনতাম, ‘মেলায় যাই রে, ঠেলা খাই রে’। সেদিন পেলাম বাস্তব অভিজ্ঞতা। ভিড়ের মধ্যেও সব দোকান ঘুরলাম। খেলনা জাতীয় যা কিছু আছে, প্রায় সবই পাওয়া যেতো। মাটির জিনিস আরও কত কী!
কী কী কিনবো, তা বাড়ি থেকেই নির্ধারণ করা ছিল। আম কেটে খাওয়ার জন্য চাকু কিনবো নিশ্চিত। কিনলাম। কত দাম নিলো? মনে নেই! বিশ হতে পারে। মাটির তৈরি একটি সাদা হাঁস কিনলাম। সঙ্গে বাঁশের তৈরি একঝুড়ি প্লাস্টিকের ডিম। মাটির ঘোড়া কিনলাম একটি। কাঁচের ঘর দেখে আর থাকতে পারলাম না। সত্তর-আশি টাকার মতো গেলো ওটার পেছনে। এরপরে কিনলাম একজোড়া চুম্বক। সর্বশেষ বন্দুক। মাস্তানি করবো। বাড়িতে চোর-পুলিশ খেলার সময় কাজে লাগবে। হাতে একটা বন্দুক থাকলে ভালোই জোশ আসে।
এসব করতে করতে আসর ওয়াক্ত পেরিয়ে গেল। খেয়াল করলাম আকাশ আবারও গম্ভীর! এবার কি তবে ঝড় ছাড়বে! দ্রুত বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। জোরে হাঁটো জোরে। কানুরগাঁও আসতেই জোরে বাতাস বইতে শুরু করলো, ধুলোবালি চোখে এসে ঠাঁই পেতে চায়। মেঘের আড়ালে সূর্য, তাই বেশ অন্ধকার চারদিক।
কানুরগাঁও আমাদের বাড়ি থেকে ভালোই দূর। আঠারো-বিশ মিনিট। ঝড়ের আগে বাড়ি আমাকে যেতেই হবে। ঝড়ে যদি ঘরের দক্ষিণ পাশের বেড়া উড়িয়ে নিয়ে যায়! আমি থাকলেও তো আব্বা-মায়ের সঙ্গে বেড়ায় বাঁধা দড়িটাকে আঁট করে ধরতে পারব। ছোট বল তবে মনের জোর বড় ব্যাপার। এদিকে বাতাস যতো বাড়ে, আমার দৌড়ের গতিও ততই বাড়ে। সমানুপাতিক হারে।
আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের একাল-সেকাল: প্রবন্ধগ্রন্থের আনন্দপঠন
পথে পথে আম গাছের নিচে কত আম দেখলাম, একটাও ধরলাম না। ওদিকে হয়তো আমাদের গাছের নিচে অন্য লোকের ভিড়। ওসব ভাবার সময় কই? দৌড়িয়েই কূল পাই না। আবার হয়তো বাড়িতে মা আমায় নিয়ে আছেন দুশ্চিন্তার মধ্যে।
ঝড়ের সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় সেদিন আমিই প্রথম হলাম। ঘরে প্রবেশের পরই বাতাসের গতি গেলো কমে। কমতে কমতে একসময় শেষ হয়ে গেলো। তবে কী আমাকে দৌড়ানোর জন্যই এ আয়োজন! পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক; তখন মেলায় কেনা জিনিসগুলো আপুকে দেখালাম। ডিমসহ হাঁস আর ঘোড়া দিলাম তাকে। কাঁচের ঘরটা আমি নিলাম। একটুকরো কাগজে আমার নাম লিখে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। যেন আমার ঘর, আমিই ওটার মালিক। সেগুলো এখনো ঘরে আছে। অক্ষত। হাঁসের ডিম এখনো ফোটেনি। কবে ফুটবে কে জানে!
মেলা থেকে কোনো বাঁশি আমি কিনিনি। ওই প্যাঁ-পুঁ ভালো লাগে না। এই তো দু’বছর আগেও বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেলো ওই প্যাঁ-পুঁ, ঘ্যাঁ-ঘুঁ শুনে। বিরতিহীন শব্দ। এখন বাজাচ্ছে মতি তো আরেকটু পরে মামুন। আবার সাইফুল আর আশ্রাফুল। সবচেয়ে কাছ থেকে বাজাচ্ছে মিম। বিরক্ত লাগলেও বাধা দিতাম না কাউকে। অন্যরা আনন্দে থাকলে আমার ক্ষতি কী!
এসইউ/এএসএম