কবিতায় বসন্তের রূপ
অলোক আচার্য
প্রকৃতিতে জড়তার ঋতু হলো শীত। মাঘ মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেই প্রকৃতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আড়মোড়া ভেঙে সব জেগে ওঠে। বাতাসে ফাগুনের সুর ভেসে আসে। আম গাছের শাখার কোনো কোনো ডাল থেকে দু’চারটি মুকুল বেরিয়ে আসে। এই সময় চলে শীত-গরমের লুকোচুরি। শীত যেন বিদায় নিতে চায় না। আবার বসন্ত যেন দ্বারে অপেক্ষা করে। কবির ভাষায়, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে/আজি খুলিয়ো হুদয়দল খুলিয়ো/আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো/এই সংগীত মুখরিত গগনে/তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাই আমাদের মনে করিয়ে দিতে যথেষ্ট যে, শীত পেরিয়ে এখন বসন্ত দ্বারে। আকাশে-বাতাসে তারই ছোঁয়া লেগেছে। প্রকৃতিতে প্রাণ জেগেছে। শীতে যত আড়ষ্ট দল ছিল; সব আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। পৃথিবী পেয়েছে নতুন প্রাণ।
হয়তো বা সব ফুল এখনো ফোটেনি, হয়তো সব কোকিল এখনো ডাকেনি, হয়তো কোনো প্রেমিক হৃদয় আজও তার প্রেমিকাকে খুঁজে পায়নি। তবুও সময়ের পরিক্রমায়, কালের নিয়মে বসন্ত এসেছে ধরায়। সত্যিই তো, বসন্ত এলে তো আর অপেক্ষা করতে হয় না। কোথায় ফুল ফুটেছে আর কোথায় ফোটেনি। বসন্ত! বাঙালির প্রেম আর আবেগের নাম। ঋতুর হিসেবে সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় প্রকৃতিতে। তার আগের ঋতু শীত। শীতের হিম হিম জড়তায় মানুষ আর প্রকৃতি যখন জবুথবু হয়ে থাকে, গাছপালা, আকাশ, মাঠ-ঘাট যখন কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে; তখন বসন্তের আগমনে সবকিছু জেগে ওঠে। নতুন করে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পায় সবাই। হতে পারে এ কারণেই বসন্তের এত জয়গান। শুরু হয় বসন্তের গুণগান। এমন মোহময় রূপ বাংলায় কেবল বসন্তেই আসে। বারবার বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বসন্তের গুণগানে মেতে উঠি।
আরও পড়ুন: ফকির ইলিয়াস: কবিতার আধুনিক কারিগর
বাংলায় বসন্তকে ঋতুরাজ বলা হয়। রং, রূপ আর প্রাচুর্যে অন্য সব ঋতু থেকে আলাদা হওয়ার কারণেই বসন্ত ঋতুরাজ। আর সব ঋতুর চেয়ে বসন্ত একটু আলাদা, একটু আদুরে। বসন্তের রং, রূপ অন্য ঋতুর চেয়ে ভিন্ন। লাল টকটকে পলাশ, শিমুল প্রকৃতিতে যেন আগুন ঝরায়। বসন্ত আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির অভূত পরিবর্তন ঘটে। ঢেকে থাকা ফুলের রেণু জেগে ওঠে। ফুলের ঘ্রাণে ছুটে আসে পাখিরা। গায়কের কণ্ঠে সুর ওঠে। সে সুর ছড়িয়ে পড়ে আমাদের প্রাণে। প্রাণ খুলে গেয়ে উঠি, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে...’। কবির কবিতায় বসন্তের গুণগান হয়। বাংলা সাহিত্য ও গানে বসন্ত বন্দনা হয়েছে বহুবার। প্রায় সব খ্যাত কবিই তাদের কবিতায় বসন্তের বন্দনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতা ও গানে বারবার বসন্ত ঋতুর প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।’ বসন্তের আগমনে প্রকৃতির অধীর আগ্রহের অবসান হয়। এ চঞ্চলতা শীতের জড়তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া। এ চঞ্চলতা কাউকে কাছে পাওয়ার। প্রকৃতির মিলনমেলায় ভালোবাসার পাখিরাও গান গেয়ে ওঠে। কোনো এক গাছের ডালে বসে কোকিল তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল স্বরে ডাকতে থাকে। কোকিলের ডাকে সাড়া দিয়ে হয়তো কোনো সাথীবিহীন কোকিলাও ছুটে আসে তার কাছে।
বসন্ত নিয়ে কেবল কবিগুরুই মাতামাতি করেননি। মেতেছেন বহু কবি। কবি সুফিয়া কামাল তার ‘বাসন্তী’ কবিতায় বসন্তের আগমনে যে পরিপূর্ণতার পরিবর্তন হয়, তা-ই ফুটিয়ে তুলেছেন। কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার এ বনের পথে/কাননে ফুল ফোটাতে/ভুলে কেউ করতো না-গো/কোনদিন আসা যাওয়া/...সেদিন ফাগুন প্রাতে/অরুণের উদয় সাথে/সহসা দিল দেখা/উদাসী দখিন হাওয়া।’ যে পথে কেউ কোনোদিন আসেনি, ফুল ফোটেনি। তো সে হোক বনে অথবা মনে ফাগুনের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই সে পথ ফুলে ফুলে ভরে উঠতে থাকে। এই তো বসন্তের স্বকীয়তা। এখানেই সে ঋতুরাজ।
আরও পড়ুন: যে কোনো পুরস্কার আনন্দ-প্রাণসঞ্চারি: সেলিনা শেলী
কবি নির্মলেন্দু গুণও লঘুচালে বসন্তের রূপের বন্দনা করেছেন তার ‘বসন্ত বন্দনা’ কবিতার মাধ্যমে। কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘হয়তো ফোটেনি ফুল রবীন্দ্রসঙ্গীতে যত আছে/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে/বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি/তবুও ফুটেছে জবা,-দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত পথিক।’ বসন্ত কেবল বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের মনেই প্রভাব বিস্তার করেনি। বসন্ত শীতপ্রধান দেশেও তার রূপ দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছে। সে প্রভাব বাঙালির চেয়েও তীব্র। কারণ মনে হয়, শীত যেখানে যত তীব্র; বসন্তের অনুভূতি সেখানে তত তীব্র। শীতপ্রধান দেশে বসন্ত তাই জড়তা থেকে মুক্তির সময়কাল। সঙ্গে উচ্ছাস আর প্রাণচাঞ্চল্য তো আছেই। রবার্ট্র ফ্রস্ট তার ‘এ প্রেয়ার ইন স্প্রিং’ কবিতায় বসন্তের কাছে প্রার্থনা করেছেন, ‘তুমি আমাদের পুষ্পের আনন্দ দাও, তুমি আমাদের ভালোবাসা দাও, ভালোবাসার চেয়ে ভালো কিছুই হয় না।’ আবার উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার প্রাক-বসন্তে কবিতায় বলছেন, ‘বসন্ত আসে স্বয়ং স্বর্গ থেকে, প্রকৃতি পবিত্রতায় পুষ্পিত হয় অতএব এখন শোক করবার সময় নয়।’
একটি বিষয় তো স্পষ্ট, বসন্ত মানে প্রকৃতির নির্মল প্রকাশ। বসন্ত মানে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলা। বসন্ত মানে পবিত্রতা। বসন্ত কি তবে প্রেমের দূত। প্রেম মানে চির বন্ধন, এক আত্মিক আনন্দ। চিরকাল দরিদ্রতা আর নিঝুম মনের অধিকারী জীবনানন্দের মনেও দোলা দিয়েছে বসন্ত। তিনি তার ‘সবিতা’ কবিতায় বসন্তকে তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘বসন্তের রাতে, যেমন দেখি.../সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি/মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে/ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি/তাহাদের সাথে/সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন...’। মোট কথা বসন্ত বন্দনার কোনো শেষ নেই বাংলার লেখক-কবিদের। বাস্তবিক পক্ষে বাংলার মানুষই যে বসন্ত পাগল।
আরও পড়ুন: একাত্তরের ডায়েরী: কাব্য ও ভাষাশৈলীর সমতল ভূমি
একটি ফুল, বাসন্তি শাড়ি, প্রেমিকের হাত, শিমুলের রং সব মিলিয়ে এ এক অন্য প্রকৃতি। বসন্তে প্রকৃতি যেমন মানুষকে সাজায়; তেমনি নিজেও সাজে। বসন্ত এলে নিসর্গে যেমন নির্মেঘ রোদ্দুর জেগে ওঠে, সিন্ধু বাতাসের পরশে সকাল সন্ধ্যা দেহে দেহে হিল্লোলে লাগে মিষ্টি দোলা; তেমনি কবিতার পূর্বের সব যাতনা ভুলে নতুন করে কবিতায় মগ্ন হয়। সে যেন তখন এক সদ্য যৌবনা তরুণী। কোনো তরুণের অপেক্ষায় প্রতি বছর পালা করে আমাদের মাঝে আসে। অথবা এমন হতে পারে, প্রতি বছর কোনো অতৃপ্ত মনকে তৃপ্ত করার জন্যই পালা করে প্রকৃতিতে হাজির হয়। বসন্তের মাঝে এই প্রাণের হিল্লোল, এই উন্মাতাল সুর এসব কি কবির চোখ এড়াতে পারে? তাই বসন্তকে নিয়ে কখনো গান, কখনো কবিতা লেখা হয়েছে যুগে যুগে। বৃক্ষপ্রেমিক কবিগুরু বারবার প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ ঋতু, প্রকৃতির রানিকে চিনছেন আপন ঢঙে। উন্মাতাল করা, আবেগে ভাসিয়ে দেওয়া ঋতু বসন্তের আগমনের প্রতীক্ষায় থাকে এই পৃথিবী!
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/জেআইএম