রাহেল রাজিবের প্রেমের কবিতা: বাস্তবতার অভিজ্ঞান

মাঈন উদ্দিন আহমেদ
মাঈন উদ্দিন আহমেদ মাঈন উদ্দিন আহমেদ , কবি ও কথাশিল্পী
প্রকাশিত: ১২:৫৪ পিএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২২

‘লেন ভেদে গাড়ি চলে, জীবন চলে না
কেন চালাও!’
চরণ দুটি কবি রাহেল রাজিবের সূচিহীন ১৬৪ পৃষ্ঠার ‘প্রেমের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থের ‘দ্বৈরথ’ কবিতা থেকে নেওয়া। কবির জীবন দর্শন ও চিন্তার রূপরেখা সম্পর্কে প্রাথমিক পরিচয় এই চরণের মধ্যেই ফুটে ওঠে। কবির দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্ব প্রমাণে এ কাব্যগ্রন্থটিই যথেষ্ট। কবির চিন্তা-ভাবনা, প্রকাশে নতুনত্ব, শব্দের আয়োজন নিঃসন্দেহে কবিকে বিশেষভাবে আলাদা করে তুলবে।

রাহেল রাজিব বর্তমান সময়ের আলোচিত কবিদের মধ্যে অন্যতম। তার জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে দিনাজপুরে। শৈশব থেকেই পায়ে শর্ষে, ভ্রমণের অদম্য নেশা সাধ্যের বাইরে টেনে নিয়ে যায় প্রায়শ এবং এটিই তার একমাত্র শখ। কবিতা দিয়ে শুরু এখন সমান্তরালে গল্প ও গদ্য লিখছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, একই প্রতিষ্ঠানে ‘কথাসাহিত্যে ইতিহাস ও ভূগোল পারম্পর্য’ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা করেছেন। ঢাকায় থিতু, পড়াচ্ছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সংস্কৃতি অধ্যয়ন ও তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ে তার আগ্রহ অপার। ১৯৯৯ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘অবচেতন মনে আগুনের ছোঁয়া’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে তার উজ্জ্বল আত্মপ্রকাশ। এখন পর্যন্ত সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও তার অসংখ্য প্রবন্ধ, ছড়া, সম্পাদনা বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘জুঁইদি ও মাতাল প্রেমিক’ কাব্যগ্রন্থটি তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। পাঠক ও সমালোচক মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন তিনি।

‘প্রেমের কবিতা’ কাব্যগ্রন্থটি মূলত তার প্রেমের কবিতার সংকলন। কবির মনোজগতের ভাবনার দীপ্তি ফুটে ওঠে গ্রন্থের উৎসর্গে—‘পলাতক ও নির্বাসিত মুখগুলোকে’। হয়তো কবি নিজেই পলাতক এবং নির্বাসিত। রাহেল রাজিবের চিন্তায় প্রেম এবং আপন দর্শনে আবিস্কৃত বাস্তব অভিজ্ঞানের মিশেলে কাব্যগ্রন্থটি আয়োজিত হয়েছে।

মানুষ মাত্রই তো প্রেম কামুক এক উন্মাদ জীবন। যার নেতৃত্ব বহন করে কবিরা। তাদের সৃষ্টিতে ঘুরেফিরে চলে আসে প্রেমের আয়োজন। আসাটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত আবেগ, বাসনা ও জৈবিক চাহিদার এক নির্ভর আশ্রয় কে না চায়! জীবনব্যাপী সন্ধান চলে সেই কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়ের। কবি রাহেল রাজিব নিজেও এর ব্যতিক্রম নন। ‘আগুনে পুড়ে যাচ্ছে কাঁটাতার’ কবিতায় কবি বলেন—
‘গানে গানে সুরে সুরে গৌড় থেকে পুণ্ড্র নগরে, বাগদাদ থেকে আলেপ্পো শহরে, সিন্ধু থেকে নীল নদের তীরে মানুষ খুঁজে ফিরেছি শুধু একটু প্রেম নিবেদন করব বলে!’
অধিকাংশ মানুষই এই সন্ধানের সৈনিক। তবু কেউ সন্ধান পায়, কেউ বা পায় না। না পাওয়া শব্দের পথ ধরে জীবনে নেমে আসে হতাশার কালো শামিয়ানা। তবু থেমে থাকা জীবনের ধর্ম নয়। আশার বারুদ বুকে নিয়ে এগিয়ে চলে জীবন। চলতে চলতে হতাশার পথ পেরিয়ে একসময় দেখা মিলবে সফলতার। বিষয়টি ‘অনুসন্ধান’ কবিতায় তার ঢঙে বলেন—‘আশা সর্বদা সামনে এসে প্রণোদনা দেয়—এই তো আর একটু পথ। হাঁটলেই শেষ হবে। সব পথেই গলি থাকে, সব গলিই শেষ রাজপথে।’

না পাওয়ার চেয়ে আরও বিষময় বিষয় হলো পেয়েও হারিয়ে ফেলা। অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। পেয়ে হারিয়ে ফেলার কষ্ট অসহনীয়। প্রেম হারিয়ে ফেলাও মারাত্মক বেদনায় মোড়া। প্রেম হারিয়ে গেলেও রয়ে যায় স্মৃতি। স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় সারাটি জীবন। তার মুখের আদল, মুখের কথা, হাসি, নাকের গড়ন, একত্রে কাটানো স্বর্গীয় মুহূর্তগুলো স্মৃতির উপজীব্য বিষয়। পুরোনো প্রেমের চিঠিগুলো যেন স্মৃতি জাগানোর রাজা। বহু বছর পরেও চোখের সামনে খুলে ধরলে স্পষ্ট ভেসে ওঠে পুরোনো কিন্তু জীবিত সেসব মধুময় অতীত। ‘ঈর্ষায় সমনাম’ কবিতায় পাই—‘প্রশ্নবিদ্ধ আমাদের প্রণয় সিংহাসন—তবু পুরনো প্রেমের চিঠিগুলো নীরবে সাক্ষ্য দেয়। গুমরে ওঠা কান্নায় জানান দেয়, আমিও ছিলাম পুরনো দলিলের বাক্সে, খুলে মেলে নাও বারবার চোখের সামনে।’
একই ভাবধারার খোঁজ মেলে ‘ক্যানভাস’ কবিতায়—‘গলি পথরেখা জুড়ে থাকে না উত্তাপ। তুমি হেঁটে গেছো যতদূরে— সেদিকেই তাকিয়ে ছিল ক্যামেরার চোখ’। সব কিছুতেই লেগে থাকে তার অবয়ব। বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড উপেক্ষা করে শুধু প্রিয় মানুষটির কথা অনুভূত হয়। বিশাল দৃষ্টিসীমা জুড়ে শুধু ভেসে ওঠে সেই অমলিন চেনা মুখ। ‘জুঁইদি ও মাতাল প্রেমিক-১২’ কবিতায় কবি প্রকাশ করেন—
‘এত বড় আকাশ এত তারার মেলা!
জুঁই,
তবু তোর শরীরটাই ছুঁই!’

কাব্যগ্রন্থটিতে প্রেম বাদেও স্থান পেয়েছে কবির বাস্তব দর্শনের নমুনা ও সাহসী প্রকাশ। পৃথিবীর কোনো সংগঠনই কাউকে বাঁচিয়ে রাখে না। মূলত সবাই চলে নিজের পিঠ বাঁচিয়ে। তাই নিজের টিকে থাকার কৌশলটা একান্ত ব্যক্তিগত। ‘পক্ষ-প্রতিপক্ষ’ কবিতায় পাই—‘জাতিসংঘ কাউকে বাঁচায়নি, জাতিসংঘ কাউকে বাঁচায় না! ক্ষমতার নাগপাশ বুঝে কথা ঢিল ছুঁড়ে প্রতিপক্ষে নরম মাটিতে। মহাসচিবগণ! যুদ্ধের বাজারে আপনাদের বেশ কদর।’

‘কাকতাড়ুয়াদের গোপন গ্রামের কাব্যকথা’ কবিতা থেকে বলা যায়—
‘ব্যাকগ্রাউন্ডকে কখনও ইগনোর করা যায় না,
সেটা জীবনেই হোক কিংবা ছবিতেই হোক।’
এই কাব্যকথার মাধ্যমে কবি আমাদের এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। মূলত, অতীত হলো আমাদের বর্তমানের ভিত। যা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।
কিংবা যখন বলেন—
‘আমি আছি বলেই সে নেই, সে আছে বলেই আমিও নেই।
শূন্যতা উপস্থিতির চূড়ান্ত মাপকাঠি।’
দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না মানুষ। প্রকৃতপক্ষে কোনো কিছুর অভাব তখনই পরিলক্ষিত হয়, যখন সেই জিনিসটাকে আমরা হারিয়ে ফেলি।
অন্যত্র বলেছেন—
‘কাঁটাতার ভূমিকে পৃথক করে, ভূমিপুত্রদের নয়!’
সত্যি বলতে, মানচিত্রের ছক কেটে, কাঁটাতার টাঙিয়ে দুটি দেশকে পৃথক করা গেলেও মানুষে মানুষে পৃথক করা যায় না।

এরকম আরও কিছু দুর্দান্ত বাস্তব অভিজ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায় গ্রন্থটির ‘অভিজ্ঞান’ কবিতায়—
১. কখনো কখনো চোখের জলেও স্রোত থাকে, সাঁতার জানাটা জরুরি।
২. দেয়ালে পিঠ ঠেকলে দেয়ালের খসখস ভাবটা অনুভব করা যায়।
৩. মৌনতা এক ভণিতার নাম! খুঁজে পাই অতীতের অভিধানে!

পুরো কাব্যগ্রন্থটি তথাকথিত কবিতার নিয়ম-কানুনকে পাশ কাটিয়ে এক অভিনব প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ। ছন্দ-মাত্রা আর অন্ত্যমিলের খেলা না থাকলেও পাঠক বইটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকবেন বলে আমার ধারণা। গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আশা করছি।

বইয়ের নাম: প্রেমের কবিতা
কবির নাম: রাহেল রাজিব
ধরন: কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশনী: অনার্য পাবলিকেশন্স লিমিটেড
প্রচ্ছদ: ফয়সাল লিপু
প্রকাশকাল: ২৩ অক্টোবর ২০২১
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।