সেই মেয়েটি

সাজেদুর আবেদীন শান্ত
সাজেদুর আবেদীন শান্ত সাজেদুর আবেদীন শান্ত , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৩:২৮ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২২

রাত দুটো। এক মেয়ে আবদার করল তাকে গল্প শোনাতে হবে। গল্পটা আবার যেনতেন গল্প নয়। বাচ্চা বাচ্চা টাইপের রূপকথার গল্প। আমি তো গল্পই বলতে জানি না। বাচ্চা বাচ্চা টাইপের গল্প আবার কীভাবে বলব? এসব ভাবতে ভাবতে ভোর পাঁচটা বেজে গেল। কিন্তু কোনো গল্পই মাথায় আসছে না। আমাকে দিয়ে আর যা-ই হোক, এই বাচ্চা টাইপের রূপকথার গল্প লেখা হবে না। তার চেয়ে বরং চলুন তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের গল্পটাই বলি।

ডিসেম্বর পঁচিশ কি ছাব্বিশ তারিখ, সঠিক মনে নেই। শীতের সময়। আমার এক নিকটাত্মীয়ের বিয়ে। দাওয়াত দিয়েছে পরিবারসহ। বিয়ে বাড়িতে আমার যেতে তেমন একটা ভালো লাগে না। কেন ভালো লাগে না তা আমিও জানি না। তবে এ বিয়েতে যেতেই হবে, খুবই নিকটাত্মীয়। তাই বিয়ের একদিন আগেই পরিবারের সবাই মিলে গেলাম। বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হওয়ার কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম, বিয়ে উপলক্ষে সাউন্ড বক্সে জোরালো শব্দে গান বাজছে। গান আমার প্রিয়। অবসরে গান শুনতে খুব ভালো লাগে। তাই যেখানে গান বাজছে, তার কাছে গিয়ে একটি চেয়ারে বসলাম। তখন বক্সে বাজছে ‘প্রেম রতন ধারকানে’ গানটি। আশেপাশে জড় হয়েছে বেশকিছু ছেলে-মেয়ে। আর তার মধ্যে গানের তালে তালে নাচছে একটি মেয়ে।

মেয়েটি শ্যাম বর্ণের। লম্বা দীঘল কালো চুল, টানা হরিণীর মতো চোখ। সব মিলিয়ে অসম্ভব সুন্দর মেয়েটি। আমি চেয়ারে বসে তার নাচ দেখছিলাম। খুবই মনোমুগ্ধকর নাচছিল মেয়েটি। এমনকি বিরহের গানের সঙ্গেও নাচছে সে। ব্যাপারটা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগল। বিরহের গানের সাথে নাচা ভালো। এ ক্ষেত্রে মনের অবস্থা সাম্য অবস্থায় থাকে। মনে এক সাথে সুখ-দুঃখ বিরাজ করে।

নাচতে নাচতে হটাৎ মেয়েটি আমার হাত ধরে আচমকা টান দিয়ে দাঁড় করালো। বলল, ‘নাচবেন আমার সাথে?’
আমি আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ আমি কখনোই নাচিনি, নাচতে পারি না। আমি বললাম, ‘আমি তো নাচতে পারি না!’
উত্তরে সে বলল, ‘পারেন না তো কী হইছে? আমি শিখিয়ে দেবো।’
‘থাক। আরেক দিন শিখবো। আপনার এমন সুন্দর নাচের সাথে আমার নাচ খুবই খারাপ দেখাবে। আমি তা চাই না। আপনি নাচেন, আমি দেখি।’
‘আহ! আপনি না, বলুন তুমি। আমি আপনার ছোট। মেবি দুই কি এক বছরের। আপনি অনিকের বড় মামার ছেলে, মানে আমারও বড় মামার ছেলে। আমি অনিকের চাচাতো বোন।’

আমি তাকে কখনও দেখিনি, চিনিও না। কিন্তু সে এক দেখাতেই চিনলো! ভাবতে লাগলাম। পরে তার সঙ্গে বসে অবশ্য অনেক গল্পই করলাম। সেদিন আর তার নাচ দেখা হলো না।

বিয়ের দিন। বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সে-ও নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেদিন তার সাথে আর কথা হয়নি। কথা হলো পরের দিন বরের বাড়িতে গিয়ে।

বরের বাড়িতে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে সবাই রেডি হওয়ার ফাঁকে আমরা কয়েকজন কাজিন মিলে ঘুরতে গেলাম কাছের এক ব্রিজের কাছে। সে-ও গেল। আশেপাশে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরলাম। হঠাৎ ছবি তোলায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি আর সে খানিকটা দূরে গিয়ে গল্প করছি আর ঘুরছি।

আমার ব্লেজারের পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটি সিটি গোল্ড বা এই টাইপের একটি আংটি। মনে পড়ল, আংটিটি আমার এক বান্ধবীর। তার কাছ থেকে দুষ্টুমি করে নিয়েছিলাম। পরে ফেরত দিতে মনে নেই।

সেই আংটিটি হাতে নিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু গেড়ে মেয়েটির সামনে বসে তার হাতের আঙুল ধরে বললাম, ‘ভবিষ্যৎ বলে কিচ্ছু নেই। ভবিষ্যৎ শুধুই মরীচিকা। যা করার এখনই করতে হবে, যা বলার এখনই বলতে হবে। তুমি কি আমার আনমনা মনের দায়িত্ব নিতে পারবে?’

সে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো এক মুহূর্তের জন্য সে তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। সে আমার হাত টেনে ধরে দাঁড় করালো। তারপর কিছু না বলে ক্ষীপ্রগতিতে ফিরে গেল বাসায়।

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকটা লজ্জা পেয়ে ভাবতে লাগলাম, ইস! আমি এ কী করলাম। আমার সাথে কী হচ্ছে এসব, বুঝতে পারছি না।

আমিও সেখান থেকে চলে এলাম বাসায়। মেয়েটির সাথে আর কোনো কথা বা যোগাযোগ হয়নি।

প্রায় পাঁচ বছর পর ফেসবুকের কল্যাণে মেয়েটির আইডি পেলাম। এখন নিয়মিত কথা হয় মেয়েটির সাথে। সেই মেয়েটিই হঠাৎ আবদার করল, সে বাচ্চা বাচ্চা টাইপের রূপকথার গল্প শুনবে। কিন্তু আমি তাকে এই টাইপের গল্প শোনাতে আজ পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম। ঠিক সেদিনের মতো।

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আজও আমি ব্যর্থ।’

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।