আনিস ফারদীনের গল্প: প্রত্যাবর্তন

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫৯ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২২

১.
আজ নীলার বিয়ে। ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে। সারা বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। পুরো বাড়ি সেজেছে বর্ণিল সাজে। নাচে-গানে একাকার। সব আত্মীয়-স্বজন এসেছে। ঢাকা থেকে কাজিনরাও এসে গেছে। যেন চাঁদের হাট বসেছে! সবাই খুব হাসি-খুশি।

বর এসে গেছে। নীলা বিষণ্ন মনে বসে আছে বিয়ের আসরে। এ বিয়েতে তার সায় নেই। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হচ্ছে। বাবার স্ট্রোকের কারণে বিয়েতে রাজি হয়েছে সে। না হলে কোনো কিছুই এ বিয়েতে রাজি করাতে পারতো না নীলাকে। সে তো ভালোবাসে স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল তার ইউনিভার্সিটির স্যার ছিলেন। নীলার চোখে জল গড়াচ্ছে। তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে পর করে দিয়েই অচেনা কাকে যেন বিয়ে করতে হচ্ছে।

ছেলেটিকে এখনো একবারের জন্যও দেখেনি নীলা। ছেলে সম্পর্কে জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পরিবারের সবার পছন্দ যেখানে; সেখানে তার কী করার আছে? মায়ের কাছে শুনেছে, ছেলে বনেদি ঘরের। বিদেশে পড়াশোনা করেছে। সামনে হয়তো সেখানেই স্থায়ী হবে। ওই ছেলের কোয়ালিফিকেশন আর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে এককথায় রাজি হয়ে যায় সবাই। রাজি ছিল না নীলা। কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাহিরে আসতে পারেনি। বাবা স্ট্রোক করে মৃত্যুশয্যায়। জুলফিকার মৃত্যুর আগে মেয়ে নীলার বিয়ে দিতে চান। তাই পারিবারের চাওয়াই এখন নীলার চাওয়া। তবে নীলার চোখে এখনো ভাসছে স্বপ্নীল স্যারের মুখ।

২.
স্বপ্নীলের সাথে নীলার প্রথম দেখা ইউনিভার্সিটির শ্যাডোতে। প্রথম যেদিন দেখা; সেদিন তিনি একটি বাইক নিয়ে এসেছিলেন ক্যাম্পাসে। প্রথম দেখাতেই কেন যেন ভালো লেগে যায়। ক্লিন সেভ, মেরুন কালারের স্লিভ শার্ট, চোখে চশমা। এ যেন পারফেক্ট জেন্টলম্যান। এককথায় সুদর্শন পুরুষ।

স্বপ্নীল ছিলেন ইংরেজি বিভাগের। নীলা ইকোনোমিকসের। প্রথমে নীলার মনে হয় স্বপ্নীল হয়তো কোনো বড় ভাই হবে। প্রায় সময়ই তাকে ফলো করতো নীলা। এভাবে বছরখানেক ফলো করার পর নীলা জানতে পারে, স্বপ্নীল তার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। তবে অন্য ডিপার্টমেন্টের। নীলা কথা বলার সুযোগ খুঁজতে থাকে। থার্ড ইয়ারে নীলাদের একটা নন-মেজর কোর্স আছে। সে ক্লাসটি নেওয়ার দায়িত্ব পান স্বপ্নীল। নীলার জন্য যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। নীলার মনে কত কিছু ভাসছে।

ক্লাস শুরু হয় নীলাদের। স্বপ্নীল প্রথম যেদিন ক্লাস করাতে আসেন, নীলা পুরো সময় মুগ্ধ হয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে। পড়ার চেয়ে নীলার মন যেন স্যারের দিকেই বেশি। এত সুন্দর করে পড়ান, সবাই যেন বুঁদ হয়ে যায় তার ক্লাসে। অমায়িক একজন মানুষ। এককথায় অসাধারণ।তার বাচনভঙ্গি, উপস্থাপনা, ফ্রেন্ডলি বিহেভিয়ার, শিক্ষার্থীদের বোঝানোর দক্ষতা যে কাউকে মুগ্ধ করে অনায়াসে।

আজকাল নীলার শুধু স্বপ্নীলের ক্লাসটাই করতে মন চায়। তিনি ক্লাসে এলে মনে হয় যেন খুব দ্রুত সময় শেষ হয়ে যায়। নীলা মনে মনে ভাবে, ইস! যদি ক্লাসে আরও একটু বেশি সময় ধরে পড়াতেন। স্বপ্নীলের কোর্সের সবগুলো পরীক্ষায় ভালো করে সে। এতে স্বপ্নীলের কাছেও সহজে পরিচিত হয়ে ওঠে। তার সাথে পড়াশোনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ আসে নীলার।

নীলা কথা বলে আর মুগ্ধ হয়। স্বপ্নীলও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিলেন। এ যাবৎকালে ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে সর্বোচ্চ সিজিপিএ ছিল তার। শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছেন বছর দুয়েক হলো। এখনো নীলার স্পষ্ট মনে পড়ে, সেই পহেলা বৈশাখের কথা। স্যার সেদিন তাদের সেকশনের সবাইকে ট্রিট দিয়েছিলেন। সব শিক্ষার্থী মুগ্ধ। তা ছাড়া অনেকগুলো সামাজিক সংগঠনের সাথেও যুক্ত স্যার। কিছুদিন আগে পত্রিকায় নিউজ হয় স্যারকে নিয়ে। স্যারের একটি চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে গরিব, অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা হয়। স্যার প্রতিমাসের প্রাপ্ত বেতনের অর্ধেক দিয়ে দেন এ ফান্ডে। বাকি আরও অনেকের কাছ থেকে ফান্ড কালেক্ট করেন। এরইমধ্যে ক্যাম্পাসে মানবিক শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। স্যার এখন প্রায় সবার কাছেই জনপ্রিয়। এত অল্প সময়ে এমন জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ খুব কম স্যারই পেয়ে থাকেন।

সময় যায়, আর স্বপ্নীলের প্রতি নীলার মুগ্ধতা বেড়ে আকাশচুম্বী হতে থাকে। নীলা মনে মনে ভালোবেসে ফেলে স্বপ্নীলকে। নীলা মনে-প্রাণে চায়, তিনি তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠুক। তার হাত ধরে জীবনে শেষ সূর্যাস্ত দেখতে চান নীলা। স্বপ্নীল নিজেও জানতেন, নীলা তাকে খুব পছন্দ করে। নীলার আচার-আচরণে টের পান কিছুটা। কিন্তু নীলাকে বুঝতে দেন না।

৩.
একদিন কৃষ্ণচূড়া ফোটা কোকিল ডাকা বসন্তের মন-মাতানো বিকেলে ক্লাস শেষে নীলা প্রপোজ করে স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল কিছুই বলেন না। চলে যান। উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে নীলা। স্বপ্নীল কী উত্তর দেন, তার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে নীলা। কিন্তু নীলাকে হতাশ করেন স্বপ্নীল স্যার। কারণ একদিন নীলা হঠাৎ শুনতে পায় স্বপ্নীল দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আর আসবেন না দেশে।

নীলা কান্নায় ভেঙে পড়ে। কিছু ভালো লাগে না তার। ক্যাম্পাসে গেলে নীলা শুধু স্বপ্নীলকে খুঁজে বেড়ায়। নীলা যে স্যারের প্রেমে দেওয়ানা এবং হাবুডুবু খাচ্ছে, ইতোমধ্যে ক্লাসের অনেকেই জেনে গেছে। সবাই নীলাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এতে অবশ্য নীলার কিছু যায়-আসে না। নীলা শুধু স্যারকেই ভালোবাসে। এর বাইরে আর কিছু ভাবতে পারে না নীলা। তার বিশ্বাস, স্বপ্নীলই হবে তার বাকি জীবনের আশার আলো, স্বপ্নের হাতছানি।

স্বপ্নীল পিএইচডি করছে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে। তিন বছর হতে চলেছে। আর এক বছর পর দেশে ফিরবে স্বপ্নীল। তবে নীলার সাথে যোগাযোগ নেই এ তিন বছর। নীলার পড়াশোনা শেষ হয়েছে বছর খানেক হলো। এখনো সরাসরি যোগাযোগ নেই। স্বপ্নীল যে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করতেন, তাও ডিঅ্যাক্টিভ করে রেখেছে বিদেশে গিয়ে। নীলা অনেক চেষ্টা করেছে, অন্তত একটি বারের জন্য হলেও কথা বলতে। কিন্তু পারেনি। স্বপ্নীলের পথ চেয়ে অপেক্ষা করে। দেখা হয় না। মাঝে মধ্যে ক্যাম্পাসে গিয়ে খোঁজ নেয়। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারে না। নীলার দৃঢ় বিশ্বাস, স্বপ্নীলের সাথে তার আবার দেখা হবেই। নীলা আশা ছাড়ে না। মনে মনে ভাবে, দেখা হলে আচ্ছামতো বকা দেবে। জানতে চাইবে, কেন এমনভাবে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিল। কান্না আসে নীলার।

৪.
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। নীলা সাদা কালারের মাইক্রোতে। সাথে বর বসা। নীলা সারাদিনের ধকলে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় আছে। চোখে ঘুমের রেশ।

গাড়ি এগিয়ে চলছে। জানালা খুলতেই শীতের ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস কিছুটা এসে লাগছে নীলার চোখেমুখে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গাড়ি পৌঁছে যায় নীলার শ্বশুরালয়ে। এ এলাকায় আগে কখনো আসেনি সে। চারপাশে দোতলা টিনের ঘর। তবে কারুকার্য খচিত। একই সাথে গ্রাম এবং শহরের মিশেল। অবশ্য বরের বাড়ি পাঁচতলা ফাউন্ডেশন করা বিল্ডিং। বিল্ডিং দেখে বোঝা যায়, এ এলাকায় তারা আর্থিকভাবে অন্যদের চেয়ে অবস্থাপন্ন। এতক্ষণ সেরোয়ানি পরে যে লোকটি তার পাশে বসা ছিল, লোকটি যেন হারিয়ে গেছে।

গাড়ি ঘিরে অনেক জটলা বেঁধে আছে। সবাই এসেছে নতুন বউ দেখতে। নীলার শ্বশুরবাড়ির লোকজন যাবতীয় নিয়মকানুন সেরে বরণ করে নেয়। ছোট ছোট বাচ্চারা একটু আগে নীলার সাথে দেখা করে গেছে। অনেকগুলো চকলেট দিয়ে গেছে নীলাকে। নীলারও ভীষণ পছন্দ এ চকলেট।

বিকেল ঘনিয়ে রাত হয়ে আসছে। ঘড়িতে নয়টা বেজে আটচল্লিশ মিনিট। কিন্তু কারও কোনো দেখা নেই। তার ঘর নানা রকম ফুল আর বেলুন দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। একা ঘরে বসে আছে। যাক ভালোই হলো, এভাবে যদি পুরো রাত পার করে দেওয়া যায়, তাহলে নতুন মানুষটার সাথে দেখা হবে না। না হলেই ভালো। নতুন মানুষ। কী বলে, কী করে বসে বলা তো যায় না। ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে। এখনো স্বপ্নীল তার মজ্জা-মগজে ভর করে আছে। কী করবে নীলা, ভেবে পায় না। বুক চিড়ে কান্না আসে। খুব অসহায় বোধ হচ্ছে এখন। কাউকে কিছু বলারও নেই।

বাসর ঘরে মুখ ভার করে বসে আছে নীলা। চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি। এ বিরক্তি যেন শেষ হওয়ার নয়। নীলা ভাবছে, কী হলো তার সাথে!

৫.
নীলার ভাবনায় হঠাৎ করে ছেদ পড়ে। কে যেন দরজা খুলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নীলার ভয় হচ্ছে।

অপরিচিত এ মানুষটির সাথেই সারাজীবন কাটাতে হবে! ভালো লাগছে না। সে তো ভালোবাসে স্বপ্নীলকে। তার অন্তরজুড়ে আছে সেই মানুষটি। ভালোবাসবে একজনকে আর সংসার করবে অন্যজনের সাথে। এ কেমন নিষ্ঠুরতা। নিজেও স্বপ্নীলকে পায়নি। আবার অন্য একজন মানুষকেও ঠকানো হচ্ছে। অথচ তার পরিবার বুঝতে চায়নি। এ এক নিদারুণ কষ্ট। মন পড়ে থাকবে ওই স্বপ্নীলের বন্দরে। আর দেহ কোনো খাঁচায় যেন বন্দি। মন থাকবে শূন্যে, দেহ থাকবে অন্যের কব্জায়, অন্যের দখলে।

পেছন থেকে কে যেন নীলা বলে ডাক দেয়। পরিচিত কণ্ঠ মনে হচ্ছে। পেছনে ফিরতেই হতবাক নীলা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। কীভাবে সম্ভব। স্বপ্ন দেখছে না তো! নিজের হাতে চিমটি কাটে নীলা। ঠিকই তো মনে হচ্ছে। এত সত্যিই স্বপ্নীল।

বিয়ের যাবতীয় দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় পরিবারকে দিয়ে করিয়েছিল স্বপ্নীল। দুই পরিবার এক হয়ে কথা এগিয়ে নেয়। স্বপ্নীল দেশে ফিরলেই বিয়ে হবে। স্বপ্নীল একটি ফেক অ্যাকাউন্টের মাধমে নীলার খোঁজ-খবর নেয়! নীলার ক্লাসমেট শান্তর সাথে প্রায়ই কথা হয়। শান্ত ছিল তাদের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ। সে সবার খবরই জানতো। স্বপ্নীল স্যার নীলার বিষয়ে সব খোঁজ পেয়ে যেতেন খুব সহজে। শান্তও কখনো এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি নীলাকে।

নীলা দেখতে পায়, তার স্বপ্নীল স্যার হাসিমুখে গোলাপ হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সাথে একটি চিঠি। চিঠিটি নীলার পরিচিত মনে হয়। এ চিঠি নীলারই দেওয়া। যেদিন প্রপোজ করেছিল নীলা; সেদিন স্বপ্নীল স্যারের হাতে দিয়েছিল।

‘আমায় তুমি ভালোবাসবে? আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ বলে গোলাপের স্টিকটি নীলার দিকে এগিয়ে দেয় স্বপ্নীল।
নীলার দু’চোখে জল। কান্নারা যেন বাসা বেঁধেছে নীলার চোখে। এ কান্না সুখের, আনন্দের। হাজার স্বপ্ন সত্যি হওয়ার। কল্পনাকে বাস্তব ফ্রেমে বাঁধার। নীলা ঝাপটে ধরে স্বপ্নীলকে। অনবরত কেঁদে চলেছে সে। স্বপ্নীল এক হাত রাখে নীলার পিঠে, অন্য হাত নীলার মাথায়। আলতো করে চুমু খায় নীলার কপালে। দুজনের চোখেই এবার জল। এ জল স্বপ্নপূরণের। বিশ্বাসের, সম্মিলনের আর বিজয়ের।

এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।