‘কাজলা দিদি’র অন্তরালে যতীন্দ্রমোহন বাগচী

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৪৪ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০২২

মো. আমিনুল হক

আবুল মনসুর আহমদ যেমন আদুভাইয়ের অন্তরালে পড়েছেন; ঠিক তেমনই কাজলা দিদির অন্তরালে পড়েছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী। ব্যক্তিমানবের চেয়ে সৃষ্টকর্মের পরিচয়টাই মুখ্য হয়েছে এমন নজির বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। এ ক্ষেত্রে ‘কবিতা মুকুল’ কাব্যের কবি কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটিও স্মরণ করতে হয়।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী রচিত লেখা, রেখা, অপরাজিতা, মহাভারতী প্রভৃতি গ্রন্থ সাহিত্য-সমঝদারের নিকট সমাদৃত; কিন্তু জনসাধারণের কাছে ‘কাজলা দিদি’ খুবই পরিচিত। কাজলা দিদি চরিত্রটি এখন আর নিছক বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়; কেননা কাজলা দিদি নামটি কবিতার পাশাপাশি গানেও সমতালে শোনা যায়। তদুপরি আমাদের প্রাত্যহিক কথা-বার্তায় এবং ছবি-নাটকেও কাজলা দিদি প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে। কাজলা দিদি কবিতায় বাঙালি জীবনের সুখ-দুঃখ ও বাংলার পল্লি-প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনায় যতীন্দ্রমোহন বাগচী আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। কবিতাটির প্রথম শব্দযুগল ‘বাঁশবাগান’ প্রকৃতির উপকরণ দিয়ে শুরু হয়েছে। কবিতাটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের অন্তরে দোলা দেয়—পাঠককে ভাবায়, কাঁদায়! বিশেষত কাজলা দিদি কবিতার প্রথম দু’চরণ আজও মানুষের অন্তরে গ্রথিত রয়েছে:
বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই
মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?

এই আবেদন কি কখনও মুছবার! কাগজ থেকে মুছে গেলেও মানুষের অন্তর থেকে মুছে যেতে পারে না। ছোট্ট শিশুটির বড় বোন তথা দিদির নাম কাজলা। যখন প্রকৃতিতে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, আকাশে চাঁদ ওঠে; তখন শিশুটি দিদির কাছে শোলক শুনত। একসঙ্গে খাবার খেতো। খেলার পুতুলের বিয়ে দিয়ে দিতো কাজলা দিদি। অর্থাৎ কাজলা দিদি ছিল শিশুটির সারাক্ষণের সাথী। কিন্তু সহসা দিদিকে কাছে না পেয়ে সে মাকে বার বার শুধায়—দিদি কই গেছে, কবে আসবে? মা এই জটিল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন। ‘কবর’ কবিতায় যেমন বৃদ্ধ দাদু নাতনিকে বলেছিলেন:
তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,
সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে!

বৃদ্ধ দাদুর সঙ্গে কাজলা দিদির মায়ের সাযুজ্য লক্ষ্যণীয়। মায়ের চাপাকান্নার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে অপত্য স্নেহ। কাজলা দিদি যে চিরদিনের জন্য চলে গেছে শিশুটি তা জানে না, বোঝে না। মৃত্যু সম্পর্কে তখনও তার কোনো ধারণা হয়নি। সে ভাবছে কাজলা দিদি আবার আসবে। তাই আমরা দেখি:
ভুঁইচাঁপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল;
ডালিম গাছের ডালের ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
দিস না তারে উড়িয়ে মা গো, ছিঁড়তে গিয়ে ফল;
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবে কী মা বল!

ছোট্ট শিশুটি তার দিদিকে খুবই ভালোবাসত। দিদিকে কাছে না পেয়ে তার সমস্ত আনন্দই যেন মাটি হয়ে যায়। এখন বলা যায় তামাম মনুষ্যজাতির ভালোবাসার মূর্তপ্রতীক কাজলা দিদি। যতীন্দ্রমোহন বাগচী যেন আমাদের সবার অন্তরের বাণীই ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতাটিতে। তাই যুগ যুগ ধরে কাজলা দিদি এতই জনপ্রিয় জনসাধারণের কাছে। এত বছর পরেও কাজলা দিদির আবেদন কমেনি বরং বেড়েছে বলেই মনে হয়। কাজলা দিদি চরিত্রটি যেন আমাদের ঘরে ঘরে বিদ্যমান। উৎসুক শিশুটির প্রশ্নের মাধ্যমে যেমন কবিতাটি শুরু হয়েছে তেমনি সমাপ্তিও ঘটেছে উৎসুক প্রশ্নের মাধ্যমেই। রাত হলো যে, মাগো আমার কাজলা দিদি কই? এর উত্তর কোথাও নেই! আমাদের বিশ্বাস, যতদিন সাহিত্যের মর্যাদা থাকবে; ততদিন কাজলা দিদি কবিতাটি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন থাকবে।

কবির ‘অন্ধবধূ’ কবিতাটি পাঠ্যবইয়ে থাকার দরুণ শিক্ষার্থীদের নিকট পরিচিত; কিন্তু কাজলা দিদির তুমুল জনপ্রিয়তার কাছে অন্যান্য সৃষ্টি ম্রিয়মান মনে হয়। এ ধরনের রচনার জন্যই শিক্ষিত-অশিক্ষিত পূর্বাপর জনগণের কাছে সাহিত্য এত আদরণীয়। অর্থাৎ জনসাধারণ সাহিত্যের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত।

কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয়, কাজলা দিদি কবিতার কবির নাম অনেকেই বলতে পারেন না। মনে তখনই ক্ষোভ জাগে; যখন শিক্ষিত সমাজের মানুষ কাজলা দিদির কবির নাম জানেন না—কী দুর্দৈব!

মানুষ যেমন সন্তানকে অপত্য স্নেহে লালন-পালন করেন; তেমনি কবি-সাহিত্যিকরাও স্বীয় সৃষ্টকর্মকে অপত্য স্নেহ করে থাকেন। সন্তান সুখে-শান্তিতে থাকলে মা-বাবা মর্ত্যলোকেই স্বর্গীয় সুখ অনুভব করেন; অপরদিকে কবির সৃষ্টকর্ম যদি মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় তবে কবি-শিল্পীরাও মনতুষ্ট হন। তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘আত্মপ্রকাশের কামনা’ মানুষের সাহিত্যসৃষ্টির অন্যতম উৎস। আত্মপ্রকাশ করেন আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য। নিজের নাম অন্যের কানে ধ্বনিত হলে শিল্পীরা গৌরবান্বিত হন। তাই সৃষ্টি দেখে বিমোহিত হওয়ার পাশাপাশি স্রষ্টাকেও জানতে হবে আমাদের। শিকড় না থাকলে বিশাল মহীরুহ মাটিতে দাঁড়াতে পারে না। ফুল-ফল নেব শুধু গাছের পরিচর্যা করব না—এর চেয়ে পাষণ্ড আর কী হতে পারে! এখানে শিল্পীর পরিচর্যা করা মানে শিল্পের পাশাপাশি শিল্পীর নামটাও জানা অপরিহার্য। শিল্পই শিল্পীর সম্পদ। শিল্প থেকে শিল্পীকে আলাদা করা যায় না। হয়তো নিথর দেহ সৃষ্টকর্মে আমরা দেখতে পাই না; কিন্তু গভীরভাবে উপলব্ধি করলে অনুধাবন করতে অসুবিধা হবে না যে, শিল্পীর অন্তর পড়ে থাকে শিল্পে অর্থাৎ শিল্প ও শিল্পী এক অভিন্ন সত্তা। বাহ্যজগতে সৃষ্টি দেখেও আমরা স্রষ্টাকে ভুলে যেতে বসেছি। শিল্পের জগতেও তাই।

কাজলা দিদি মানুষের অন্তরে বিদ্যমান কিন্তু যতীন্দ্রমোহন বাগচী তদর্থে অনুপস্থিত। আমাদের এই সামাজিক সংকট নিরসন করতে হলে আগে শিক্ষিত সমাজকে সচেতন হতে হবে। সাহিত্যের কেবল রুই, কাতলা, বোয়াল ধরে বসে থাকলেই চলবে না; শিং, মাগুর, টেংরা, পুঁটির গুরুত্বও অনুধাবন করা চাই। তাই গল্পের আসরে, সাহিত্যের আড্ডায়, গানের তালে, কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায়, দলবদ্ধ পড়ায়, শ্রেণিকক্ষে অবসর সময়ে, বন্ধু-সভায়, স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠচক্রের মাধ্যমে এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। আর তা যদি সম্ভব হয়, তবেই সাহিত্য-শিল্পীর প্রতি বৈষম্য দূরীভুত হয়ে শিল্পের পাশাপাশি শিল্পীর নামটাও মানুষের অন্তরে স্থায়ী আসন লাভ করবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।