তপন বাগচী: বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায়
তপন বাগচী একাধারে কবি, গল্পকার, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও গবেষক। তার জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরের কদমবাড়ি গ্রামে। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী ও মা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। তার লোককবি বাবাকে নিয়ে এখন গবেষণা হচ্ছে। তপন বাগচীকে নিয়েও একাধিক গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। বাবার কাছ থেকেই হয়তো লেখালেখির অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকবেন তিনি। শিক্ষাজীবনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে পিএইচডি করেছেন বাংলাদেশের যাত্রাগানের ওপর। কিছুকাল সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বর্তমানে কর্মরত বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক হিসেবে।
নব্বই দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক ড. তপন বাগচী। তার প্রধানতম বিষয় নান্দনিকতা তথা শিল্পকলার নানা অনুষঙ্গ, মিথ ও সাহিত্য-ঐতিহ্য যে-পাত্রে পরিবেশিত হওয়ার যোগ্য, তেমন ক্ল্যাসিকধর্মী আঙ্গিকও তিনি বেছে নিয়েছেন। ছন্দ-অন্ত্যমিলসমৃদ্ধ গাঢ় উচ্চারণ তার কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।
কয়েকটি কবিতার কিছু পঙক্তি পাঠে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে আশা করি। তার উপমা, অলংকার, ব্যঞ্জনা পাঠকের অন্তরে গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে। কবির ভাষায়-
১.
চাঁচর চুলের মেয়ে গোপন ক্ষুধায়
চুম্বনের ঘ্রাণ মাখে মুখের ভূগোলে
চরকাবাজির স্রোতে ভেসে যাই একা
চকসা আকাশ থেকে অদৃশ্যের কোলে।
(চাঁদোয়া)
২.
তকমার লোভে কবি চিতায় না বুক
তেজী তিনি তথাগত লেখে তমসুক।
(তেজী)
৩.
প্রাণ যদি নদী হয় স্বচ্ছ কুশিয়ারা
ফেনিল সাগরে ছোটে অনন্ত মিছিল
কীর্তিনাশা বুক হবে শোণিতের ধারা
সুফলা যুবতী যেন ডাকাতিয়া বিল।
(দ্রোহ)
৪.
লিখলে ছাপা হবেই কোথাও
এত্তো কাগজ, বিশাল মাঠ
পাঠ বাড়ে না, কেবল বাড়ে
লেখক কবির আপন ঠাট।
(লিখুক, লিখতে দিন)
৫.
মধুমতী নদীর জলের মিষ্টিস্বাদ
এখনো রয়েছে কি না জানি না
কীর্তিনাশা তার নাম
সার্থক করেছে জানি অরে অরে
(সকল নদীর নাম গঙ্গ ছিলো)
৬.
ফুলবাড়িতে কালো কালো ফুল ফুটেছে
খানপুরে, ছোট বুকচি আর গোলাপপুরে ঘুরে
আমি দেখেছি সেইসব ফুলের গন্ধ ঝুলে আছে
(ছিলার মতো ফুল ফুটেছে)
৭.
যেখানে সুলভ সাক্ষী রাজপথ, মিছিলের মুখ;
অঙ্গীকারে মূর্ত হয় প্রাণের স্লোগান
পথের প্রাচীর গড়ি নির্বিকার, মানি না পণিনি
শুধু করি অনিকেত জীবনের গান
(কেতকী ও রাধাচূড়া)
এসব পঙক্তি পাঠে মনে হয়, জীবনের বিবিধ রং ছড়িয়ে আছে কবিতার দেওয়ালে। প্রেম, প্রকৃতি, মানুষ, ইতিহাস মিলেমিশে একাকার তার কবিতায়। কবিতা হয়ে ওঠে স্লোগান। কখনো কখনো সঞ্জীবনী শক্তির রূপ লাভ করে।
তার কবিতা প্রসঙ্গে কবি আবিদ আনোয়ার বলেছেন, ‘কবিতায় যে প্রসাদগুণ, ছড়ায় যে হাস্যরস ও ছন্দনৈপুণ্য, প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনায় যে বিশ্লেষণধর্মিতা, গবেষণায় যে অনুসন্ধিৎসা অভিনিবেশী পাঠকের কাম্য তার সবই রয়েছে তপন বাগচীর রচনাকর্মে। তাঁর প্রবেশলগ্নেই বাংলা একাডেমি, নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়েছে কবিতাবিষয়ক মূল্যবান আলোচনা ও জীবনীগ্রন্থ, লোকসংস্কৃতি (যাত্রা) ও চলচ্চিত্র বিষয়ে গবেষণা-অভিসন্দর্ভ এবং অনেক সম্পাদিত গ্রন্থ। যারা এ সম্পর্কে অবহিত তাঁরা দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করবেন সার্বিক বিবেচনায় তিনিই তাঁর প্রজন্মের শ্রেষ্ঠতম বহুমাত্রিক লেখক।’ (তপন বাগচীর কবিতা: অন্ধকারে আলোর ঝলক, চিন্তাসূত্র)
কবিতার পাশাপাশি বাংলা প্রবন্ধেও তপন বাগচী এক অনবদ্য নাম। তার আগ্রহের বিষয় বাংলা সাহিত্য, লোকসংস্কৃতি, লোকনাট্য, গণমাধ্যম, মুক্তিযুদ্ধ, আঞ্চলিক ইতিহাস, জীবনী প্রভৃতি। এ ছাড়া গল্প, কবিতা, ইতিহাস ও ছড়া নিয়ে প্রাবন্ধিকের নিজস্ব চিন্তা স্থান পেয়েছে তার লেখায়। তার প্রবন্ধে লালন শাহ, জসীম উদদীন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, হাসান হাফিজুর রহমান, ননী গোপাল সাহা, মোহাম্মদ রফিক, যোগেন মণ্ডল, নূহ-উল-আলম লেনিন, আহমাদ মাযহার, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিশিষ্টজনের প্রাসঙ্গিক আলোচনা স্থান পেয়েছে।
এমনকি তপন বাগচীর লেখা অনেক গান বিশিষ্ট গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর গেয়েছেন। মালালা ইউসুফজাই, সুচিত্রা সেন, নেলসন মেন্ডেলা, ভিক্টর হুগো, সৈয়দ শামসুল হক, ভাষা মতীন প্রমুখের জীবনভিত্তিক লেখা গান দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেলে পরিবেশন করেছেন ফকির আলমগীর। পাঠকের উদ্দেশে তার দুটি গান উদ্ধৃত করছি-
১.
আজকে তুমি আসবে বলে
দুয়ারখানি খুলে রাখি।
বুকের কাঁটা নিয়েছ তাই
চুলের কাঁটা তুলে রাখি॥
আসবে তুমি হাওয়ায় উড়ে
যতই তুমি থাক দূরে
সেই খুশিতে এমন নাচে
সব বিরহ ভুলে থাকি॥
আর দেব না দূরে যেতে
চাই সারাক্ষণ কাছে পেতে
তোমায় নিয়ে ভাসব বলে
নৌকাখানি কূলে রাখি॥
২.
কলঙ্ক অলঙ্কার লইয়া
এই গলায় পরাই।
সে আমার জীবন রে বন্ধু,
তারে আমি চাই।
পুড়ছি কালার রূপের ছটায়
লোকে যদি নিন্দা রটায়
লক্ষ্য থেকে আমায় হটায়
সাধ্য কারো নাই।
সামনে দেখি অথই সাগর
পারের মাঝি রসিক নাগর
আমার লাইগা রয় উজাগর,
ধন্য আমি তাই।
ভালবাসি- নাই সন্দেহ
সঁপেছি পায় এই মন দেহ
তপন ছাড়া অন্য কেহ,
জানতো না তো ভাই।
তপন বাগচীর গান প্রসঙ্গে ঝর্ণা মনি বলেছেন, ‘তার গান আমিত্বময়। গানের কলিতে খুঁজে পাওয়া যায় তাকে। তার ভাবনা স্বচ্ছ। বর্ণনার প্রয়োজনে যে শব্দ সামনে এসেছে তাকেই ধারণ করেছেন তার গীতিকাব্যে। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার পরিচিত মুখ তপন বাগচীর আধুনিক সময়ের লেখায় যেসব শব্দমালার ব্যবহার রয়েছে, তার প্রায় সবই অনায়াসে তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের দক্ষতায়। অন্ত্যমিলের দিকে তার ঝোঁকও লক্ষ্যণীয়। তিনি নিজেকে প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন গণ্ডিতে আটকে থাকতে চাননি। ফলে প্রতিনিয়ত তার ভাবনার জগতে নদীরপাড় ভাঙার মতো ভাবনা এসে উঁকি দিয়েছে। যা দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন গানের খাতার নিজস্ব বেলাভূমি। তবে সেই নির্মাণ কষ্টকল্পনার সমাহার নয়।’ (তপন বাগচীর গানের খাতা, জাগো নিউজ)
তিনি লোকজ যাত্রাগান ও তার শিল্প উপযোগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। যাত্রাগানে মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ ফুটিয়ে তুলেছেন। যাত্রাগানে নারীর অংশগ্রহণ ও উপস্থাপন কৌশল নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন। প্রবাদ-প্রবচনে লোকজ্ঞান ও নারী প্রসঙ্গ নিয়ে তার আলোচনা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পূর্বাঞ্চলীয় বাউলগানের ধারা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে অকপটে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন রাধারমন এবং শাহ আবদুল করিমের গান নিয়ে। চলচ্চিত্রে লোকজ জীবনের অন্বেষা ফুটে উঠেছে তার প্রবন্ধে। কথা বলেছেন দলিত সম্প্রদায় নিয়েও।
যাত্রাগান প্রসঙ্গে ড. মিল্টন বিশ্বাস বলেছেন, ‘আবিষ্কার করেছেন লোকসংস্কৃতির অজানা অনেক তথ্য। বর্তমান সভ্যতায় অবেহেলিত যাত্রাশিল্প নিয়ে দীর্ঘ গবেষণায় আদ্যোপান্ত ওই শিল্পসম্পৃক্ত মানুষের সামগ্রিক সংকট তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। যাত্রাগানে নারীর অংশগ্রহণ ও উপস্থাপন কৌশল নিয়েও তার নিবিড় পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কবি তপন বাগচীর ‘যাত্রাকাহিনী’ সিরিজ বিশ্লেষণের সময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মঞ্জরী অপেরা’ উপন্যাসের কাহিনির কথা মনে পড়ছে। তবে যাত্রা’কে কেন্দ্র করে তপন বাগচীর অনুভাবনার গভীরতা ভিন্ন, উদ্ভাসনও স্বতন্ত্র। তার ‘নির্বাচিত ১০০ কবিতা’য় সংকলিত ‘যাত্রাকাহিনী’ সিরিজ কবিতাগুলো সত্যিই পাঠককে নাড়া দিতে সক্ষম।’ (তপন বাগচীর কবিতায় ‘যাত্রা’ প্রসঙ্গ, মানবকণ্ঠ)
ছড়া সাহিত্যেও তপন বাগচী সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিয়মিত পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে তার ছড়া। সব শ্রেণির পাঠকের জন্যই ছড়া লিখছেন তিনি। শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাই তার ছড়া পাঠে মুগ্ধ হন। ‘রবি ঠাকুর’ শিরোনামে তার লেখা একটি ছড়া পাঠ করা যাক-
‘বাঙালি আজ বিশ্বসভায়
মর্যাদা পায় বড়
বিশ্বগ্রামের মাঝখানে সে
তুলতে পারে ঘরও।
আজ বাঙালি গর্ব করে
ফোলায় বুকের ছাতি
অনাদি সেই কালের ধারায়
নন্দিত এক জাতি।
গরিব হলেও অভাব তো নেই
বাঙালিদের মনে
কারণ রবি ঠাকুর আছেন
সকল ঘরের কোণে।’
সহজ, সরল ও সাবলীল ভাষায় তিনি মনের কথা পৌঁছে দেন শ্রোতার কানে কানে। এক অসাধারণ অনুভূতিতে জাগ্রত রাখেন হৃদয়মন্দির। তার গানের সুরের মুর্ছনায় সংগীতের ঝংকারে আলোড়িত হয়ে ওঠে চারিদিক।
সুতরাং কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, গান এবং ছড়া সাহিত্যে অন্য এক সব্যসাচীর সন্ধান পাই আমরা। তিনি বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল এক অধ্যায়। তিনি যতদিন আমাদের মাঝে থাকবেন; ততদিন আমরা আরও বেশি বেশি সাহিত্যরসদ সংগ্রহ করতে পারব। পুরোটা সময়জুড়ে সাহিত্যচর্চায় নিমজ্জিত মানুষটির বয়স যদিও ধর্তব্য নয়। বয়স হোক একটি সংখ্যামাত্র। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্মে। চির জাগরুক থাকবেন আমাদের মর্মে। তিনি চির তরুণ, চির জাগ্রত, চির বিরাজিত হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। তার আগামীর পথচলা হোক আরও মসৃণ। শুভ কামনা সব সময়।
এসইউ/এমএস