রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শনের সীমানা: শেষ পর্ব

সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার
সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার , লেখক
প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

অতি তরুণ বয়স থেকেই রবীন্দ্র ভাবনায় স্বদেশ চেতনা জাগে। বাংলা ১২৭৩ এর চৈত্র সংক্রান্তিতে রবীন্দ্র পরিবারের নেতৃত্বে হিন্দুমেলা বলে একটা মেলার আয়োজন করা হয়। ওই মেলায় রবীন্দ্রনাথের দাদা গান লিখলেন, “মিলে সবে ভারত সন্তান”। এই মেলায় দেশাত্মবোধক গান, স্তবগান, ব্যয়াম পদ্ধতি ইত্যাদির অয়োজন করা হয়। ওই সময় কিশোর রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখলেন ১৮৭৭ সালে। এ ছাড়া তিনি আরও লিখলেন ‘হিন্দুমেলায় উপহার’। হিন্দুমেলার নেপথ্যে ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। (রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদী। ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী রাজনারায়ণ মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। রাজনারায়ণ বসু বিধবা বিবাহের পক্ষে সমাজ সচেতনতায় অংশ নেন) কিন্তু একজন অখ্যাত তরুণের লেখা খুব বেশি ইংরেজ-প্রতিক্রিয়া আসেনি। তাঁর নিজের কথায়, “টাইমস পত্রেও কোনো পত্র লেখক এই বালকের ধৃষ্টতার প্রতি শাসনকর্তাদের ওদাসীন্যের উল্লেখ করিয়া ব্রিটিশ রাজত্বের সাহিত্য সম্বন্ধে গভীর নৈরাশ্য প্রকাশ করিয়া অত্যুষ্ণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস প্রকাশ করেন নাই”। (জীবন স্মৃতি, ৯ম, ৪৯৭)।

১৮৮৩ লেখা প্রভাত উৎসবের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমাজ জীবনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তখন তিনি সবে ২২। তিনি লিখলেন,
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি
প্রভাত হল যেই কী জানি হল একি
আকাশ-পানে চাই কী জানি কারে দেখি।।
... ... ...
ওঠো হে ওঠো রবি, আমারে তুলে লও
অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও।
আকাশ পারাবারে বুঝি হে পার হবে—
আমারে লও তবে, আমারে লও তবে।।
জীবনস্মৃতিতে তিনি এর একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি লিখেছেন, “সামান্য কিছু কাজ করিবার সময়ে মানুষের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে যে-গতিবৈচিত্র প্রকাশিত হয় তাহা আগে কখনো লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই—এখন মুহূর্তে মুহূর্তে সমস্ত মানবদেহের চলনের সঙ্গীত আমাকে মুগ্ধ করিল। এ-সমস্তকে আমি স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতাম না, একটা সমষ্টিকে দেখিতাম। এই মুহূর্তেই পৃথিবীর সর্বত্রই নানা লোকালয়ে, নানা কাজে, নানা আবশ্যকে কোটি কোটি মানব চঞ্চল হইয়া উঠিতেছে- সেই ধরণীব্যাপী সমগ্র মানবের দেহ চাঞ্চল্যকে সুবৃহৎভাবে এক করিয়া দেখিয়া আমি একটি মহাসৌন্দর্যনৃত্যের আভাস পাইতাম”। (জীবনস্মৃতি, ৯ম, ৫৩১)।

১৮৯০ সালের পর রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই উত্তর বাংলায় জমিদারি দেখাশোনার কাজে আসতেন। তিনি কটকেও যেতেন একই কাজে। এসময়ের রাজশাহীর বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেট থেকে জানা যায়, সেখানকার জমিদারির কাজের সাথে সাথে শিক্ষা প্রসারে দারুণ এক ভূমিকা রাখেন তিনি। বাৎসরিক ১২৫০ টাকা অনুদান দেওয়ার সাথে সাথে দুস্থ ও অন্ধদের জন্য তিনি ২৫০ টাকা করে দিতেন। ওই সময়ে তিনি একটা কৃষি ব্যাংক স্থাপন করে দরিদ্র মানুষকে ঋণের ব্যবস্থা করতেন। কবির বন্ধুদের কাছ থেকে মূলত টাকা সংগ্রহ করে তিনি এই ব্যাংক চালাতেন। ব্যাংকের মূলধন থেকে প্রায় ৯০ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হতো। (The Political Philosophy of Tagore, p.6.)। জমিদারির সুবাদে পূর্ববাংলার অতি সাধারণ মানুষের সাথে তাঁর যোগাযোগ ও তাদের জানার সুযোগ তৈরি হয়। “স্ত্রী-মজুর” নামে ওই সময়ে লেখা তাঁর এক ছোট্ট প্রবন্ধ ভীষণ সাড়া ফেলে। তিনি লিখছেন, “...স্ত্রীলোক এবং বালকও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সহিত দলে দলে মজুরী কার্যে প্রবৃত্ত হইতেছে। কিন্তু কেবল কলের কাজ দেখিলেই চলিবে না, সমাজের উপরেও উহার ফলাফল আছে”। (স্ত্রী-মজুর, ১৭ খণ্ড, ৭৩৭ )। অনেকেই মনে করেন, সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর এই চেতনা, ভাগোন্নয়নে সাহায্যের প্রচেষ্টাতেই তিনি অন্যান্যদের থেকে আলাদা। চিত্রা কাব্যে ১৮৯৪ সালে লেখা তাঁর সাড়া জাগানো কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’ রবীন্দ্র চিন্তার এক নতুন প্যারাডাইম। তিনি লিখছেন,
ওরে, তুই ওঠ আজি।
আগুন লেগেছে কোথা! কার শঙ্খ উঠিয়াছে বাজি
জাগাতে জগত-জনে! কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে
শূন্যতল! কোন অন্ধ কারা-মাঝে জর্জর বন্ধনে
অনাথিনী মাগিছে সহায়!
... ...
কী গাহিবে, কী শুনাবে! বলো, মিথ্যা আপনার সুখ
মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ
বৃহৎ জগত হতে, সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে।
মহাজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে সত্যেরে করিয়া ধ্রুব তারা।

রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন অন্তরের একান্তে ব্যক্তির মাঝে যে মুক্ত চেতনা লুকিয়ে থাকে এবং তা যখন বিশ্বযোগের দিকে ধাবিত হয় সেটাই দর্শন। আর রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে সেগুলোকে শুধু উপলব্ধি করাই নয় সেই উপলব্ধ চেতনা যখন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যন্ত্রে প্রয়োগ করা হয় সেটা। কাজেই সুনির্দিষ্ট আধ্যাত্মবোধের মধ্য দিয়ে নিজের কর্ম ও চিন্তার মাধ্যমে সহজাত শক্তি প্রকাশ করার ভেতর সে তার অর্থ খুঁজে পায়। প্রতিটি মানুষের আছে অসম্ভব এক ব্যক্তি শক্তি, আছে নিজস্বতা আছে নিজস্ব মূল্য। ভাববাদ ও বস্তুবাদের ভেতর যে অনতিক্রম্য দেওয়াল আছে সেটা কিন্তু রবীন্দ্র চিন্তায় অনেকটাই প্রশমিত হয়ে এসেছে। ভাববাদ যে একান্ত ব্যক্তিক চেতনার পরিস্ফুটন সেটা থেকে রবীন্দ্রনাথ মুক্ত হয়ে একজন ইউটিলিটারিইয়ান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। অর্থাৎ নিজেকে বৃহতের মাঝে সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন। যতটুকু একজন নিজেকে সম্প্রসারণ করতে পেরেছেন তিনি ততটুকুই সার্থক। এখানেই তাঁর রাজনৈতিক বিশেষত্ব। বৈপরীত্য বা সংঘাত হচ্ছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। কিন্তু সমস্ত পরিবর্তনই উন্নয়ন নয় বলে তিনি মনে করতেন। কিন্তু যে পরিবর্তন উন্নয়নের পথে নিয়ে যায় তার মানদণ্ড ঠিক করা আবশ্যক। আর এই মানদণ্ডটা ঠিক করে দেয় মানুষের একান্ত ভাবাশ্রিত চৈতন্য। অর্থাৎ শরীর ও মনের মাঝে যখন একটা নিবিড় ঐক্য গড়ে ওঠে তখন এই বোধ সম্প্রসারিত হয়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্র দর্শনের সাথে সমাজবাদী চিন্তার একটা ফারাক আছে বৈ কি। স্বাধীন, মুক্ত, নিজস্ব বিবেক ও আত্মশক্তি দিয়ে নিখিল বিশ্বকে বিবেচনায় আনতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তৎপর, তাই তো তাঁর কাছে “ইন্ডিভিউজাল কনসাইন্স” ছিল সবার ওপরে। অনেকে মনে করেন মার্কসবাদী চিন্তার থেকে তিনি ছিলেন খুব আলাদা। (Political Philosophy of Tagore, 11)। কার্ল মার্কসের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দর্শন যেখানে সমাজের ‘গ্রুপ রেশনালিটির’ ওপর ভর করে বিস্তৃত হয়েছে; রবীন্দ্রনাথের অর্থ-দর্শন সেখানে বিকশিত হতে চেয়েছে নিজের ঘর থেকে অর্থাৎ আপন গৃহই হচ্ছে বিকাশের আত্মশক্তি। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদী দর্শন থেকে সম্ভবত তাঁর চিন্তার দূরত্ব ছিল অনেক, যেমনটি লিখছেন শচিন সেন, “The ideals of social determinism, freedom as the recognition of necessity, morality as a class-morality, as propounded by Marxists, didn’t influence Tagore’s thought” (p. 22)। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া ভ্রমণকালে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা কিন্তু প্রবল। তিনি লিখছেন, “রাশিয়ার সমস্ত দেশ-প্রদেশকে জাতি-উপজাতিকে সক্ষম ও শিক্ষিত করে গড়ে তোলবার জন্যে এতো বড়ো সর্বব্যাপী অসামান্য অক্লান্ত উদ্যোগ আমাদের মতো ব্রিটিশ সাবজেক্টের সুদূর কল্পনার অতীত। এতোটা দূর পর্যন্ত করে তোলা যে সম্ভব, এখানে আসার আগে কখনো আমি তা মনেও করতে পারিনি। কেননা, শিশুকাল থেকে আমরা যে ‘ল অ্যাণ্ড অর্ডার’ এর আবহাওয়ার মানুষ সেখানে এর কাছে পৌঁছাতে পারে এমন দৃষ্টান্ত দেখি নি”। (রাশিয়ার চিঠি, পৃ ৪২)।

একটা কথা সুস্পষ্ট যে, রবীন্দ্রচিন্তার মাঝে ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা বা সাব্জেক্টিভিজম প্রবল প্রভাব লক্ষ্যণীয়। ব্যক্তি ও সমাজ- এই দ্বন্দ্ব চিরকালের। কে কার ওপর প্রভাব রাখে এই নিয়ে সমাজ দার্শনিকরা সাংঘাতিক ভাবে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথের অবস্থান চিরকালীন ভাববাদী দার্শনিকের দলে এবং অবশ্যই সেটা সামাজিক নিয়ন্ত্রণবাদের বিরুদ্ধে। এর বিশেষ কারণ হিসেবে ড. শচিন মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের ওপর উপনিষদ, গৌতম বুদ্ধ, কবির, নানক, বৈষ্ণববাদ, বাউলমত ও ইউরোপের উদারতান্ত্রিক মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার সাংঘাতিক প্রভাব আছে। (প্রাগুক্ত, ১১)। ১৯১৩ সালে ‘সাধনা’য় কবি আত্মকথায় বলছেন, “লেখক (নিজে) এমন একটা পরিবারে বেড়ে উঠেছিল যেখানে উপনিষদ থেকে মন্ত্র উচ্চারণ ছিল প্রতিদিনের নিত্য ঘটনা”। তাঁর পিতা অত্যন্ত নিষ্ঠাবান হওয়ার সুবাদে জীবনের দীর্ঘ সময় ঈশ্বর উপাসনায় নিজেকে ব্যাপৃত করেছিলেন। তিনি বারবার স্বীকার করেছেন শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা পরিবেশ তাঁকে শিখিয়েছে কীভাবে নিজের অসীম সম্ভাবনাকে বিশ্বভূমির সাথে একত্র করে তুলতে হয়; কীভাবে নিজের স্বাধীন কল্পনাকে সাহিত্যের গভীর অঙ্গনে প্রবেশ করাতে হয়, এবং সাথে সাথে স্বাধীন আত্মাকে বৃহৎ সামাজিক পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য করে গড়ে নিতে হয়। এখানেই তাঁর এক থেকে বহুর দিকে নির্গমন, একক থেকে বহুত্বের মাঝে নিজেকে প্রসারিত করার বিপুল উদ্যোগ। তিনি বাংলা ১৩৩৪ সালের ‘বৃহত্তর ভারত’ প্রবন্ধে বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন, “বর্বরজাতীয় মানুষের প্রধান লক্ষণ এই যে, তার আত্মবোধ সংকীর্ণসীমাবদ্ধ। তার চৈতন্যের আলো উপস্থিত কাল ও বর্তমান অবস্থার ঘেরটুকুকেই আলোচিত করে রাখে বলে সে আপনাকে তার চেয়ে বড় ক্ষেত্রে জানে না। এই জন্যেই জ্ঞানে কর্মে সে দুর্বল। সংস্কৃত শ্লোকে বলেঃ যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী”। অর্থাৎ ভাবনাই হচ্ছে সাধনার সৃষ্টিশক্তির মূলে। নিজের সম্বন্ধে, নিজের দেশ সম্বন্ধে বড় করে ভাবনা করবার দরকার আছে, নইলে কর্মে জোর পৌঁছয় না এবং অতি ক্ষীণ আশা ও অতি ক্ষুদ্র সিদ্ধি নিয়ে অকৃতকার্য হতে হয়। নিজের কাছে নিজের পরিচয়টাকে বড় করবার চেষ্টাই সভ্যজাতির ইতিহাসগত চেষ্টা। নিজের পরিচয়কে সংকীর্ণ দেশকালের ভূমিকা থেকে মুক্তিদানই হচ্ছে এই চেষ্টার লক্ষ্য”। (বৃহত্তর ভারত, কালান্তর, ১২তম খণ্ড, ৬৫১)

ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা
ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা পর্যালোচনা ছিল রবীন্দ্রনাথের বেশ আগ্রহের বিষয়। ঠিক এই শিরোনামে বাংলা ১৩১৮ সালে তিনি একটা প্রবন্ধ লেখেন। ভারতবর্ষ তথা বিশ্ব ইতিহাসের মূল সুরটা হচ্ছে দ্বন্দ্ব। আমাদের অলক্ষ্যে প্রতিমুহূর্তে সৃষ্টি ও ধ্বংসের লীলা চলছে, চলছে ভাঙা ও গড়ার নিয়ত আয়োজন। তাঁর কথায়, “কালের সেকেন্ডের কাঁটাকে দেখিতে পাইতাম তবে দেখিতাম বিশ্ব নিমিষে নিমিষে থামিতেছে ও চলিতেছে—তাহার একটানা তানের মধ্যে পলকে পলকে লয় পড়িতেছে। সৃষ্টির দ্বন্দ্বদোলকটির একপ্রান্তে হ্যাঁ অন্য প্রান্তে না...”। (ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা, পরিচয়, ৯ম খণ্ড, ৬২৭)। প্রাচীন ভারতবর্ষের মাঝে অনার্য ও আর্যের মধ্যে যে বিরোধ দেখা দেয়, সেখান থেকেই সম্ভবত ভারতবর্ষের যাত্রাপথ প্রশস্ত হতে শুরু করে। কিন্তু শুধু দ্বন্দ্ব তো ইতিহাসের সীমান্ত রেখা হতে পারে না। বিশ্বছন্দ তত্ত্বের নিয়ম তো আছেই যেখানে ঘটে থাকে আত্মপ্রসারণ ও মিলনের সন্ধিক্ষণ। অনার্য ও আর্যের মাঝে বিরোধ ও যোগবন্ধনের মধ্যে দিয়ে প্রাথমিক ইতিহাসের সূত্রপাত ঘটে। আদর্শিক তথা ভাবগত দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ইতিহাসের এই গতি বড্ড সর্পিল। এই বিতর্ক অর্থাৎ যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির মাধ্যমে ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারিত হয়েছে। অমর্ত্য সেন চমৎকারভাবে ইতিহাসের এই গতিধারাকে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ গ্রন্থে। তিনি লিখছেন, “মতভিন্নতাকে ভারতের স্বাভাবিক একটি ব্যাপার করে তুলতে এটি সাহায্য করেছে। বিতর্ক চালিয়ে যাবার নিরন্তর অনুশীলন আমাদের গণজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ”। (অমর্ত্য সেন, তর্কপ্রিয় ভারতীয়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃ ১০-১১)। ভারতীয় মহাকাব্যগুলো ইতিহাসের এই উপাদানগুলোকে ভাবগতভাবে ধারণ করেছে। পক্ষ ও বিপক্ষ দল তৈরি করে বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতবর্ষ এই হার না মানা যুদ্ধে সংঘাত ও মিলনের এই আশ্চর্য মহানিকেতন! ধর্মশংকর ও বর্ণশংকর জাতি হিসেবে ভারতবর্ষের সুনাম ও দুর্নাম রয়েছে। এখানে যেমন জাতি বৈরিতা আছে; তেমনি আছে এই বৈরিতার মাঝে মিলনের সূত্র। রবীন্দ্রনাথ সেজন্য তাঁর Nationalism in India শুরু করেছেন এই বলে যে, “Our real problem in India is not political. It is social”। পশ্চিম দেশের মানুষের যেমন নৃতাত্ত্বিক ঐক্য আছে, আছে ভাষা ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব সাযুজ্য, ভারতবর্ষে ঠিক এর উল্টো। পশ্চিমে মানুষের মাঝে নেই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেই বিশেষ একটা শ্রেণি বৈরি মনোভাব কিন্তু ভারতবর্ষে আশ্চর্যরকম বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে গোত্র বিদ্বেষ, শ্রেণি সংঘাত আর বর্ণ উৎপাত। কাজেই একটা বিরাট সংহতির জন্য এই দেশে দরকার পড়েছে ঐক্যের, প্রয়োজন হয়েছে বিরোধের মাঝে মিলনের। একটা কথা পরিষ্কার, প্রতিটা মানুষের অবস্থান যেহেতু আলাদা, চাওয়া-পাওয়া যেহেতু ভিন্ন, মত-নৈতিকতা যেহেতু বৈচিত্র্যময় অবস্থান–সেকারণে একটা সাধারণ ঐক্যের কাছে সবাইকে আসতেই হবে। কারণ ব্যক্তির ছোট্ট সীমানার মাঝে মুক্তি নেই; আছে বৃহৎ ঐক্যের সার্থকতা। তাঁর নিজের কথায়, “Each individual has his self-love. Therefore, his brute instinct leads him to fight with others in the sole pursuit of his self-interest. But man has also his higher instincts of sympthay and mutual help”। (Nationalism, p. 87)। কাজেই মানুষের মাঝে মানবতার টানে বিরাট ঐক্য ও হৃদয় বৃত্তির সম্প্রসারণ ভারতবর্ষের বিশেষ লক্ষ্য।

প্রথম পর্ব- রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শনের সীমানা

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।