আনিস ফারদীনের গল্প: জীবনের এপিঠ ওপিঠ

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০৫ পিএম, ২৩ আগস্ট ২০২২

এক
পিচঢালা পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলছে বাসটি। জাহাঙ্গীর সাহেব জানালার পাশের সিটে বসে আছেন। তার সাথে বসা একজন যাত্রী। বয়স পঞ্চাশ-বায়ান্ন হবে হয়তো। চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা। বা চোখের গ্লাসটা যেন একটু ঝাপসা। গায়ে একটা মলিন ফতুয়া। চুপচাপ বসে আছে লোকটি। তবে হাসিখুশি একটা ভাব যেন চোখেমুখে। প্রচুর যাত্রী বাসে। যাত্রীতে গিজগিজ করছে পুরো বাস। এরপরও কন্ডাক্টর ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছে। বাহিরে প্রচণ্ড গরম। গ্রীষ্মের তাপদাহে অস্থির যাত্রীরা। নেয়ে-ঘেমে একাকার যেন সবাই। বাসে যা দুই একটা ফ্যান আছে, সেগুলোও নষ্ট। সামনের দিকে ড্রাইভারের পেছনের সিটের উপরের ফ্যানটি অবশ্য ঘুরছে, তবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। যেন ফ্যানের খুব কষ্ট হচ্ছে ঘুরতে। একটু পরপর ড্রাইভার কষে ব্রেক করছে। হঠাৎ ব্রেক করায় যাত্রীরা ব্যালেন্স ঠিক না রাখতে পারায় একজন আরেক জনের উপর গিয়ে পড়ছে। এতে কালো ছিপছিপে দেহের ত্রিশ-বত্রিশ বয়সের একজন লোকের মেজাজ বিগড়ে যায়। কারণ ব্রেকের সাথে ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পারায় ওই লোক পড়ে যায়। কোনো রকম নিজেকে সামলে নিয়ে ড্রাইভারকে গালাগাল দিচ্ছে লোকটি। কন্ডাক্টর প্রতিবাদ করায় পিঠে কষে ঘুষি মেরে বসে সে। তা দেখে ড্রাইভার ইনস্ট্যান্ট গাড়ি থামায়। দু’পক্ষের সেকি তুমুল মারামারি। গাড়ি রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখায় দুই-তিন মিনিটের মধ্যে দুই দিক থেকে ইতোমধ্যে বিরাট জ্যাম লেগে গেছে পুরো রাস্তায়। এবার অন্য যাত্রীরাও গালাগাল দিচ্ছে ড্রাইভারকে। কেউবা আবার তামাশা দেখছে। কেউ কেউ আছে দেখি এরপর কী হয়, কী হয় টাইপ। গাড়ির মধ্যখানের একটা সিটে বসে জাহাঙ্গীর সাহেব এতক্ষণে সব কিছু দেখছিলেন। আর মনে মনে ভাবছেন মানুষের আসলে কমনসেন্স বলতে কিছু নেই। যে যেমন করে পারছে সুযোগ নিচ্ছে।

দুই
একটি বাস জাহাঙ্গীর সাহেবের বাসটিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ। কিন্তু এ বাসের ড্রাইভার সাইড দিচ্ছে না। একরোখা হয়ে পুরো রাস্তা দখল করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চালাচ্ছে বাস। যাতে পেছনের বাসটি সামনে না যেতে পারে। লোকাল রোডগুলোয় হরহামেশা চলে এসব। ভাড়ার ক্ষেত্রেও বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হয় যাত্রীরা। যেন দেখার কেউ নেই। এতে অবশ্য দু’একজন যাত্রী ক্ষেপে গেছে ড্রাইভারের ওপর। দুই একটি বাস সামনে থেকে আসছে। গন্তব্য বিভাগীয় শহর থেকে জেলা শহর। তবে রোডে ভালোই সিএনজি চোখে পড়ে এখন। বলা চলে সবুজ কালারের সিএনজিগুলোর দখলে পুরো আঞ্চলিক সড়ক। গাড়িগুলোর জন্যই মূলত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সড়কগুলোয়। গত পরশু একটি সিএনজিতে থাকা ড্রাইভারসহ মোট ছয়জন যাত্রীকে একটি বাস চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই পাঁচজন মারা যায়। বাকি একজনকে হাসপাতলে নেওয়ার সময় মারা যায়। আর এ ঘটনা এই সড়কের জন্য নিত্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কোনো ধরনের প্রতিকার নেই। কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই সড়কে চলে এসব গাড়ি। আবার অধিকাংশ ড্রাইভারের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা ড্রাইভিং প্রশিক্ষণও নেই। শুধু পেটের তাগিদে অনেকে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে উঠে বসেছে। এসব দেখার জন্যও যেন কেউ নেই। নামে মাত্র কর্তৃপক্ষ যারা আছে, তাদের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। তারা শুধু কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এসে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন কিংবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করবেন, এমন বুলি আওড়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেন। দিনের পর দিন যায়, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। তাই ড্রাইভার কিংবা যাত্রী কেউ আইনের তোয়াক্কা করে না এদেশে। কথায় আছে ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। তেমনই আইনের শিথিলতা মানুষকে আইন ভাঙতে যেমন সাহায্য করে, আইনের কাঠিন্য আইন মানতে বাধ্য করে। কিন্তু এ আইন মানাতে বাধ্য করবে কে? জনগণ আইন না মানলেই বা কীভাবে আইনের প্রয়োগ সম্ভব!

তিন
জাহাঙ্গীর সাহেবের পাশের সিটে বসা লোকটির এসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কী হলো না হলো যেন কিছুই যায় আসে না তার। চোখেমুখে যেন হাসি লেগে রয়েছে। জাহাঙ্গীর সাহেবের একটু কৌতূহল হলো। ব্যাপার কী! বাসে কত সব কী হচ্ছে, গণ্ডগোল হচ্ছে, অথচ এই লোক নির্বিকার। জাহাঙ্গীর সাহবের কেমন জানি মনে হচ্ছে লোকটাকে। না লোকটার সাথে একটু কথা বলে দেখি। কারণ কি এভাবে থাকার! না, আমি আবার কী বলবো! অপরিচিত মানুষ। যদি আবার কিছু মনে করে বসে। মনে মনে সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে জাহাঙ্গীর সাহেব। আবার ভাবে একটু কথা তো বলাই যায়। না, জিজ্ঞেস করি কিছু একটা। যদি কথা বলে, তাহলে ভালো। না বলতে চাইলে নাই। অনেক ভেবেচিন্তে কথা বলা শুরু করে।
ভাই কেমন আছেন?
এই তো ভালা। উত্তর দেয় পাশের সিটে বসা অপরিচিত লোকটি। জাহাঙ্গীর সাহেব কথা বলে জানতে পারেন, লোকটির নাম হাদিসুর।
ভাই কই যাবেন আপনি? জিজ্ঞেস করেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
এই তো ভাই, আমি নিশ্চিন্তপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যামু। ক্যান, আপনিও কি ওইখানে যাইবেন?
আমি এর দুই স্টেশন পর নামবো। উত্তর দেন জাহাঙ্গীর সাহেব।

লোকটির প্রফুল্ল মন আর হাসি-খুশি থাকার কারণ জিজ্ঞেস করেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় উত্তর দেয় হাদিসুর, ঠিক কইছেন। গতকাইল এ মাসের বেতন পাইছি। সাথে ঈদ বোনাসও। অনেক টাকা ঋণ নিছিলাম গতবছর। এই মাসে শোধ কইরা ফেলতে পারুম। সাথে বাসার সবার লাইগ্যা ঈদের জামা কাপড় কিনতে পারুম, তা ভাইবা একটু ভালা লাগতাছে।
আপনি কী করেন? যদি কিছু মনে না করেন বলবেন? জিজ্ঞেস করেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
এই প্রশ্নে হাদিসুর বলে সে নীট কনসার্ন গার্মেন্টসে ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করে।
আপনাদের ওখানে বেতন কেমন? সুযোগ-সুবিধা কেমন পান আপনারা? জিজ্ঞেস করেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
ভাই যা পাই, চইল্যা যায় কোনোমতে। এই তো এই মাসে ঈদ বোনাসসহ ষোলো হাজার চারশ টাকার মতো পাইলাম। ঈদ উপলক্ষে বড় স্যাররা আরও পাঁচ হাজার টাকার মতো বকশিস দিছেন। সব মিইল্ল্যা একুশ হাজার টাকার মতো পাইছি।
তো আপনি এতো খুশি কেন? জানতে চান জাহাঙ্গীর সাহেব।
অনেক টাকা পাইছি। অনেকদিন পর আজ বাসার সবার লাইগা ঈদের জামা কাপড় কিনতে পারুম। গত ঈদে আমার বড় ম্যাইয়াডা অসুস্থ আছিল। ওর চিকিৎসা করাতে যাইয়া কাউকে কিছু কিনে দিবার পারি নাই। পুরা বছর কাউরে নতুন কিছু দিবার সুযোগ অয় নাই। উল্টা আরও ধার-দেনা করতে অইছে। সারাবছর ধইরা ধার শোধ করছি। এই মাসে ধার শোধ কইরাও কিছু টাকা হাতে থাকবো। ইদের পর বাকি যা আছে, তা শোধ কইরা দিমুনে। এবার ইনশাল্লাহ সবাইরে কিছু না কিছু কিইন্যা দিমু।
অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বলে যায় হাদিসুর। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয় তাকে। বাসায় কে কে আছেন? এমন প্রশ্নে সহাস্য বদনে উত্তর দেয় হাদিসুর। যেন জাহাঙ্গীর সাহেবের সাথে এই আলাপন ভালোই লাগছে তার।

হাদিসুর বলতে থাকে, আমার সংসারে বউ, দুই মাইয়্যা আর এক পোলা আছে। পোলা এবার ক্লাস এইটে বৃত্তি পাইয়া ক্লাস নাইনে উঠছে। ছোট মাইয়্যা ক্লাস ফাইভে পড়ে। বড় মাইয়্যার ঘরে আবার একটা নাতনি আছে। ক্লাস থ্রিতে পড়ে এবার। ডাক নাম বিলকিস। ভালা ছাত্রী। কেলাসে রোল এক। জানেন কি সুন্দর করে কথা কয়! আমি বাড়ি গেলে নানা, নানা বইল্যা ছুইটা আয়ে আমার কাছে। কী ভারি মিষ্টি মাইয়্যা। কিন্তু কপালডা খারাপ মাইয়্যাডার। এই বয়সে বাপরে হারাইয়া এতিম হইয়া গেছে। ওর বাপ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী আছিল। একদিন ম্যানহোলে পইড়া যায়। ওখান থেইক্যা আর উঠতে পারে নাই। ওখানে নাকি বিষাক্ত গ্যাস আছিল। সে গ্যাসে দম বন্ধ হইয়া মারা গ্যাছে। টিভিতেও নিউজ হইছিল। পরে উদ্ধারকর্মীরা তার লাশ উদ্ধার করে। আমার নাতনির বয়স আছিল তখন এক বছর। এখন নাতনি আর ওর মা, মানে আমার বড় মাইয়্যাও আমার লগেই থাকে।
এই পর্যায়ে এসে হাদিসুরের চোখে পানি দেখা যায়। চোখ ছল ছল করছে। হাদিসুর হাতের তালু দিয়ে চোখ মোছে। জাহাঙ্গীর সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন এসব শুনে। কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না। আসলে অনেকেই আছেন, যারা বিপদগ্রস্ত লোককে সান্ত্বনা দিতে পারেন না। বলা চলে সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পান না তারা। জাহাঙ্গীর সাহেবও তাদের একজন। যাই হোক, নিজেকে সামলে নেয় জাহাঙ্গীর সাহেব।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করেন হাদিসুরকে। তো কী কিনবেন? কিছু ভেবেছেন?
জ্বি, আমার বউয়ের জন্য সুন্দর দেইখ্যা একটা শাড়ি নিমু। বড় মাইয়্যার জন্য শাড়ি আর জুতা কিনতে অইবো। ছোট মাইয়্যার জন্য সুন্দর দেইখ্যা একটা ফ্রক। আর পোলাডার জন্য একটা শার্ট আর একটা জিন্স প্যান্ট। উত্তর দেয় হাদিসুর।
নাতনীর জন্য কিছু কিনবেন না? জিজ্ঞাসা করে জাহাঙ্গীর সাহেব।
আরে কি যে কন না ভাই! ওর জন্য কিছু না নিলে আমারে ঘরে ঢুকতে দিবো? আমার নানু ভাই কইছে এই ঈদে একটা লাল জামা আর একটা স্কুল ব্যাগ কিইন্যা দিতে ওরে। ওর বাবা মারা যাওনের পর আমিও খুব কিছু একটা কিইন্যা দিবার পারি নাই। বাবা মরা ম্যাইয়া। খুব কিছু চায়ও নাই। তাই এবার কিইন্যা দিমুই। বেশি কিছু তো আর চায় নাই। সামনের বাজার থেইক্যা আজ সবার লাইগ্যা জামা কাপড় কিনুম। ওইখানে সব কিছু দামে সস্তা। কম দামে ভালা জিনিস পাওন যায়।
এক নিঃশ্বাসে বলে যায় হাদিসুর। বাস এখনো চলছে, মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাস পৌঁছে যাবে নিশ্চিন্তপুর বাস স্টপেজে। জানালা দিয়ে গরম বাতাস একটু পরপর ঝাপটা মারছে জাহাঙ্গীর সাহেবের চোখেমুখে। বাস সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। পেছনের বাসটি এখনো হর্ন দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু বাসটিকে ওভারটেক করার সুযোগ পাচ্ছে না।

চার
হাদিসুরের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় জাহাঙ্গীর সাহেবের। ভাবতে থাকেন তিনি। কী জীবনযাপন হাদিসুরের মতো মানুষগুলোর। অথচ দিন শেষে তারা সুখী মানুষ। কী সুখী মানুষ তারা! এদের তিন বেলা খেয়েপড়ে বেঁচে থাকাতেই সুখ। জাহাঙ্গীর সাহেব এই ঈদে সব মিলিয়ে দেড় লাখ টাকার মতো ঈদ বোনাসহ বেতন পেয়েছেন। এক ছেলে, এক মেয়ে। সংসারের মোট সদস্য চারজন মাত্র। অথচ সব সময় তিনি দুশ্চিন্তায় কাটান। বছর দুয়েক আগে বিভিন্ন চিন্তায় একবার স্ট্রোক করেছেন। অবশ্য এখন একটু সুস্থ আছেন। তবে এখনো চিন্তায় ডুবে থাকেন তার মৃত্যুর পর ছেলেমেয়ের কী হবে। ওদের উন্নত জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে। সাথে বাড়ি-গাড়ি। এসব চিন্তা জাহাঙ্গীর সাহেবকে ঘুমোতে দেয় না। তিনি উপলব্ধি করেন, আসলে সন্তুষ্টি মানুষের মনের ব্যাপার। মানসিক সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড় সন্তুষ্টি।

ইতোমধ্যে বাস নিশ্চিন্তপুর স্টপেজে পৌঁছে গেছে। হাদিসুর গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। কী মনে করে জাহাঙ্গীর সাহেবও নেমে পড়েন গাড়ি থেকে। পিছু নেন হাদিসুরের।
এই ভাই, একটু দাঁড়ান বলে পেছন থেকে হাদিসুরকে ডাক দেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
ভাই আপনি তো বলছেন এই বাজারের কথাই, তাই না?
জ্বি, এই বাজারের কথা বলছি। কিন্তু ভাই, আপনি না দুই স্টেশন পরে নামনের কথা। এইহ্যানে নাইমা গ্যালেন যে! অবাক হয় হাদিসুর। ভাই কোনো সমস্যা হইছে? নাকি আমি আবার কোনো ভুল-ভাল কইরা ফালাইছি আপনার লগে।
না কিছু করেননি। ভাবলাম এই বাজারে যেহেতু সব সস্তায় পাওয়া যায় তাই কিছু জিনিস কিনে নিব এখান থেকে। দেখি আপনার কথার সাথে বাস্তবের মিল পাওয়া যায় কি না। উত্তর দেন জাহাঙ্গীর সাহেব।
কি যেন কন না ভাই! এইহ্যানে দোকানদাররা দাম বেশি রাখে না। এইহানে সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। আপনি চাইলে আপনিও কিছু কমদামে কিইন্যা নিতে পারেন। উত্তর দেয় হাদিসুর।
আচ্ছা চলেন। বলে হাদিসুরের পিছু নেন তিনি। দুজন মিলে হকার্স মার্কেটের একটা দোকানে প্রবেশ করে। হাদিসুর তার চাহিদামতো জিনিসপত্র কিনছে। তার চোখেমুখে সে কী আনন্দ। আনন্দ যেন আর ধরে না। ধরবেই বা কীভাবে? গত ঈদেও তো কিছু কিনতে পারেনি। এগারো হাজার টাকা বেতনে কি আর পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে? বাসা ভাড়া, সাথে পানি থেকে শুরু করে চাল-ডাল সবকিছু কিনে খেতে হয়। সাথে কত রকম বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখ বলা যায় না। তাই সুযোগটা হাদিসুরের জন্য যেন ডাবল ঈদ। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন জাহাঙ্গীর সাহেব। সব কিছু কেনা হয়ে গেছে হাদিসুরের।
ভাই আপনি কিছু লইবেন না? জিজ্ঞাসা করে হাদিসুর।
হ্যাঁ কিনবো তো। আপনার সব জিনিসের দাম কতো আসছে জিজ্ঞাসা করেন তো।
দোকানদার ভাই কতো হইল সব মিইল্লা? দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে হাদিসুর।
ভাই বেশি না। সব মিলায়া আপনার হইছে সাত হাজার আটশ পঁচাশি টাকা।
কী কন ভাই, এত ক্যামনে অয়! বলে ওঠে হাদিসুর। চোখ ছানাবড়া তার। আপনি না কইছেন সবগুলার দাম একসাথে কমাইয়া রাখবেন! বলতে থাকে হাদিসুর।
এমন সময় কাঁধে হাত রাখেন জাহাঙ্গীর সাহেব। কমানো লাগবে না ভাই।
কী কইতাছেন ভাই! দোকানদার তো বলছে সব একসাথে এখান থেকে নিলে দাম কম রাখবো। হাদিসুর বলতে থাকে।
যে টাকাটা আসছে, আমি পুরো টাকাটা দিয়ে দিতে চাই। আপনি যদি কিছু মনে না করেন। জাহাঙ্গীর সাহেব জবাব দেন।
কী কইতাছেন ভাই? আপনি ক্যান দিবেন? জিনিস তো আমাগো লাইগ্যা কিনছি সব। আপনি তো কিছু কিনেন নাই।
আরে ভাই সমস্যা নাই, টাকাটা আমি দিয়ে দেই।
না ভাই, এইডা হয় না। আপনি ক্যান দিবেন! আমার কাছে তো মেল্লা টাকা আছে। আপনি দেওন লাগবো না। এই বলে অসম্মতি জানায় হাদিসুর।
ভাই আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আপনি যে টাকা পেয়েছেন, তা দিয়ে আপনি ঋণ পরিশোধ করে ফেলবেন। সাথে আপনার বাচ্চাদের স্কুলের বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দেবেন। কখনো পারলে আপনি এই টাকা আমারে আবার ফেরত দিয়ে দিয়েন।
আমি আপনারে কই পামু? পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দেয় হাদিসুর।
এই নিন আমার ভিজিটিং কার্ড। যখন মন চায় এখানের ঠিকানায় চলে আসবেন, আসলেই আমাকে পেয়ে যাবেন। আপনি অনুমতি দিলে আমি টাকাটা দেই।
অনেক্ষণ পর এবার রাজি হয় হাদিসুর। টাকা পরিশোধ করে দেন জাহাঙ্গীর সাহেব। জামা-কাপড় কেনা শেষে হাদিসুরকে এক মাসের মুদি বাজারও করে দেন জাহাঙ্গীর সাহেব। এবার আর না করেনি হাদিসুর। লোকটিকে সাক্ষাৎ ফেরেশতা মনে হয় যেন। হাদিসুর অবাক না হয়ে পারে না। অল্প পরিচয়ে এত কিছু! এমন মানুষ আর কখনো দেখেনি হাদিসুর।

পাঁচ
হাদিসুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান জাহাঙ্গীর সাহেব। আবার আরেকটা বাসে ওঠেন তিনি। মিনিট বিশেক পর নিজের গন্তব্যে পৌঁছে যান জাহাঙ্গীর সাহেব। বাস থেকে নেমে তিনি রিকশায় চেপে বসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে যাবেন। তার চোখেমুখে হাসি। এ হাসি তৃপ্তির হাসি। অন্তরে এক স্বর্গীয় সুখ ভর করেছে যেন। এতটা তৃপ্তি এর আগে কখনো লাগেনি তার। ভাবছেন, এতদিন এত ভালো লাগেনি কেন? কত কিছুই তো করেছেন জীবনে। সারাটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। অথচ আজকের মতো এই অনির্বচনীয় ভালো লাগা তার কখনো অনুভূত হয়নি। জাহাঙ্গীর সাহেব ভাবতে থাকেন হাদিসুরের কথা। কী সুন্দর জীবন তাদের। আহামরি কাড়িকাড়ি টাকা নেই। অথচ কী সুখী মানুষ। কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। দিব্যি পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুখ নিয়ে বেঁচে আছে। এরা যেন সুখের ফেরিওয়ালা। এরা বংশ পরম্পরায় সুখ বিক্রি করে যায়। হয়তো মাসে একদিন মাংস খায়, সপ্তাহে প্রায় দিন ভাত, ভর্তা আর ডাল-সবজি যাদের জীবনের অনুষঙ্গ। তারাই রাতে ঘুমোতে যায় সবার আগে। সকালের স্নিগ্ধ বাতাস তো তাদের জন্যই। নগরের অন্য সব মানুষ টাকার পেছনে ঘুরতে গিয়ে বিক্রি করে দেয় আত্মসম্মান, সত্তা আর বিবেক। অন্যকে ঠকাতে গিয়ে নিজেকেই ঠকিয়ে যায় পক্ষান্তরে। অথচ তারা জানে না, শুধু টাকা দিয়ে যে জীবনে ভালো থাকা যায় না। মন-মানসিকতা আর চিন্তা উন্নত না হলে কখনো কেউ সুখী হতে পারে না। সুখ আসে অন্যের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে দিয়ে।

জাহাঙ্গীর সাহেবের রিকশা এগিয়ে চলছে দ্রুত। দক্ষিণা বাতাস মুখে এসে ঝাপটা দিচ্ছে। অসম্ভব ভালো লাগছে তার। জাহাঙ্গীর সাহেব মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, এখন থেকে প্রতিমাসে বেতনের একটা অংশ দিয়ে গরিব মানুষের জন্য কিছু করবেন। জামা-কাপড় কিনে দেওয়া, দুস্থদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা এরকম কিছু। সাথে এতিমখানার বাচ্চাদের জন্য কিছু দিবেন। রিকশা বাসার সামনে এসে থামে।

জাহাঙ্গীর সাহেব রিকশা থেকে নামেন। রিকশার বেলের আওয়াজে স্ত্রী খাদিজা বেগম দরজা খুলে দেন। দু’জন মিলে ঘরে প্রবেশ করেন।

এই খাদিজা, জায়নামাজটা একটু দাও তো। আমি ওজু করে আসি। বলে ওয়াশরুমে চলে যান জাহাঙ্গীর সাহেব।
অযু করে এসে জায়নামাজে মাগরিবের নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে যান। খাদিজা বেগম অবাক না হয়ে পারে না। ব্যাপার কী! কী হলো আবার? মনে মনে ভাবতে থাকেন খাদিজা। যে লোককে এত করে বলেও নামাজ পড়তে রাজি করাতে পারেননি অথচ নিজ থেকেই আজ নামাজ পড়ছেন। কী এমন হলো আজ।

খাদিজা বেগমও নামাজ পড়তে দাঁড়ায়। নামাজ শেষে হাত তুলে দোয়া করতে থাকে, ‘হে আল্লাহ আমার স্বামীকে সব খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখো। ঈমান ও কল্যাণের পথে চলার তাওফিক দাও। তার সব নেক বাসনা পূর্ণ করো।’ খাদিজার চোখে জল। জল গড়িয়ে পড়ছে খাদিজার দোয়ারত হাতের তালুতে।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।