রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব: পর্ব-০২

জান্নাতুল যূথী
জান্নাতুল যূথী জান্নাতুল যূথী , গবেষক, শিক্ষক
প্রকাশিত: ০১:১৩ পিএম, ০৭ আগস্ট ২০২২

দুই সখীর মধ্যে জীবন ও মৃত্যুর ব্যবধানে শুরু হয় গল্পের নাটকীয়তা। কাদম্বিনীর চালচলন স্বাভাবিক নয়। সে ছোটবেলার সখী ও সাধারণ মানুষ থেকে সব সময় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। পৃথিবীতে নিজের অবস্থান নিয়ে তার মধ্যে দ্বিধা কাজ করেছে! সে কি আসলেই মৃত! তার সদুত্তর সে পায় না! ঘুমের মধ্যেও সে চমকে উঠে ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বের হয়ে যায়! হৃদয়কোণে জমে থাকা ভয় তাকে সবার থেকে দূরে নিয়ে গেছে! ঝড়-জলে ভিজে যখন শশ্মান থেকে গায়ে কাদা-জল মাখা নিয়ে বের হয়, তখন গ্রাম্য পথিকের জিজ্ঞাসায় মনে হয়, সত্যি সে পৃথিবীতে আছে! কিন্তু মনের ধন্দ থেকেই যায়! সে ধন্দ যোগমায়ার বাড়িতে উপস্থিত হলেও বার বার তাকে দগ্ধ করতে দেখা গেছে। যোগমায়ার স্বামী শ্রীপতিচরণবাবুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ যখন ঘটে, তখনো তাকে অপ্রকৃতস্থ দেখা যায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক:
‘কাদম্বিনী সইয়ের বাড়িতে আসিল, কিন্তু সইয়ের সঙ্গে মিশিতে পারিল না; মাঝে মৃত্যুর ব্যবধান। আত্মসম্বন্ধে সর্বদা একটা সন্দেহ এবং চেতনা থাকিলে পরের সঙ্গে মেলা যায় না। কাদম্বিনী যোগমায়ার মুখের দিকে চায় এবং কী যেন ভাবে, মনে করে, স্বামী এবং ঘরকন্না লইয়া ও যেন বহু দূরে আর, এক জগতে আছে। স্নেহ-মমতা এবং সমস্ত কর্তব্য লইয়া ও যেন পৃথিবীর লোক, আর আমি যেন শূন্য ছায়া। ও যেন অস্তিত্বের দেশে, আর আমি যেন অনন্তের মধ্যে।’১৫

কাদম্বিনীর মধ্যে একদিকে অবদমনের প্রকাশ ঘটেছে, অন্যদিকে মনের ধন্দ তাকে জীবনের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ করে তুলেছে! কাদম্বিনী সবার মাঝে থেকেও নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা! হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে যে মৃত্যু নামক দৃশ্য রবীন্দ্রনাথ অঙ্কন করেছেন, সে মৃত্যু তো দৈহিক। কিন্তু কাদম্বিনী কি আদৌ জীবিত ছিল? প্রাণ থাকলেই কি মানুষ জীবিত থাকে! তার মনের যে ক্রিয়া সমাজ-সংসারের কাছে কি রুদ্ধ হয়নি? বিধবা হয়ে পুত্র-কন্যা-মাতা-পিতাহীন জীবন তাকে কতটা প্রশান্তি দিয়েছিল? মৃত্যুই তার জন্য উত্তম ছিল না? জীবনের তাবৎ প্রশ্ন এখানে অসমীচীন নয়। এ জীবনক্রিয়া বন্ধ করে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থেকে কাদম্বিনীর জীবন যন্ত্রণাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন! কাদম্বিনীর হৃদয়াকুতি পাঠকের মনকে বিগলিত করে। সে যখন বলে, ‘কিন্তু আমি মরিয়াছি ছাড়া তোমাদের কাছে আর কী অপরাধ করিয়াছি। আমার যদি ইহলোকেও স্থান নাই, পরলোকেও স্থান নাই, ওগো আমি তবে কোথায় যাইব।’১৬

পৃথিবীর অপরূপ শোভা কাদম্বিনীকে স্পর্শ করতে পারেনি! জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব তাকে নিশ্চিত মৃত্যু ঘটাতে বাধ্য করেছে! সবার কাছে অগ্রহণযোগ্যতা তাকে মনাসিকভাবে দ্বিধান্বিত করেছে। শেষ পর্যন্ত কাদম্বিনী মরে প্রমাণ করলো যে সে মরে নাই! একথার মধ্যে একদিকে তার বেঁচে থাকার আকুতি অন্যদিকে তার প্রতি ঘটে যাওয়া সমাজের অন্যায় আচরণকে প্রমাণিত করেছে। সে যে বেঁচে থেকেও সমাজের চোখে মৃত, তা প্রতিপদেই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কাদম্বিনী হৃদক্রিয়া বন্ধের মাধ্যমে যার সমাপ্তি ঘটেছে।

‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পটি ১২৯৮ বঙ্গাব্দে সাধনা পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ছোটগল্প। গল্পটির মূল চরিত্র রাইচরণ। বারো বছর বয়স থেকে অনুকূলদের বাড়িতে কাজ করে সে। এ সূত্রে অনুকূলকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছে রাইচরণ। কালের পরিক্রমায় অনুকূল এখন সরকারি চাকুরে। তার একমাত্র পুত্র খোকাবাবুর দেখভাল করার দায়িত্বও পড়ে রাইচরণের ওপর। কাহিনির শুরু এখান থেকেই। রাইচরণ একদিন খোকাবাবুকে নিয়ে পদ্মাতীরে বেড়াতে যায়। খোকার বায়না সামলাতে কদম্বফুল পাড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাইচরণ। এমন সময় হঠাৎ পদ্মাগর্ভে ঝপ করে শব্দ হলো। খোকাবাবুর সাক্ষাৎ না পেয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাইচরণ বুঝতে পারে সব শেষ! খোকাবাবু আর নেই! সে পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

‘একবার ঝপ করিয়া একটা শব্দ হইল, কিন্তু বর্ষার পদ্মাতীরে এমন শব্দ কত শোনা যায়। রাইচরণ আঁচল ভরিয়া কদম্বফুল তুলিল। গাছ হইতে নামিয়া সহাস্যমুখে গাড়ির কাছে আসিয়া দেখিল, কেহ নাই। চারি দিকে চাহিয়া দেখিল, কোথাও কাহারও কোন চিহ্ন নাই।’১৭

প্রাণপণ চিৎকার করে খোকাবাবুর কোনোই সন্ধান মেলে না। অনুকূল বাবুর স্ত্রী রাইচরণকে দোষী সাব্যস্ত করে। ফলে রাইচরণ কষ্টে এতদিনের মনিবের বাড়ি ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে যায়। বহুদিন পরে দৈবক্রমে রাইচরণের এক পুত্র সন্তান হয়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সন্তানের সব দায়িত্ব রাইচরণের নিজের ওপর থাকলেও খোকাবাবুকে হারানোর বেদনা তাকে সদা জাগরুক রেখেছিল। তাই নিজের সন্তান ফেলনার প্রতি প্রথমদিকে কোনো দায়িত্ব পালন করেনি রাইচরণ। হঠাৎ রাইচরণ আবিষ্কার করে, তার সন্তান যেন সেই খোকাবাবু। রাইচরণের জীবন নাট্যে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ফেলনাকে মনিব অনুকূলের সন্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে রাইচরণ ভৃত্যের মতো দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তার মনে সব সময় দাদাবাবুর পুত্রকে হারানোর বেদনা কাজ করে। একসময় রাইচরণ নিজের কাঁধে দোষ তুলে নিয়ে অনুকূলকে বিশ্বাস করায়, এই সন্তানই তার সন্তান। গল্পটিতে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা প্রথম থেকে শেষাবধি বিদ্যমান। এ গল্পের প্রথমেই দেখি অনুকূল বাবুদের বাড়িতে রক্ষণ ও পালন কাজে সহয়তা করে রাইচরণ। কিন্তু যখন অনুকূলের সন্তান খোকাবাবু জন্মালো, তখন তারও দায়িত্ব গ্রহণ করে। রাইচরণের মনে অপরাধবোধ কাজ করে। তাই অনুকূলের স্ত্রী যখন দোষারোপ করে, তখন সে আত্মপক্ষ সমর্থন করেনি। মনের দ্বন্দ্বই তাকে শত সাধনার সন্তানকে কাছে টেনে নিতে দেয়নি। বরং সন্তানের সঙ্গে মালিকপুত্র-ভৃত্যের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। রাইচরণ বিশ্বাস করতো ভালোবেসেই খোকাবাবু তার সন্তান হয়ে জন্ম নিয়েছে।

‘ছেলে পড়ে-শুনে ভালো এবং দেখিতে-শুনিতেও বেশ, হৃষ্টপুষ্ট উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ-কেশবিন্যাসের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি, মেজাজ কিছু সুখী এবং শৌখিন। বাপকে ঠিক বাপের মতো মনে করিতে পারিত না। কারণ, রাইচরণ স্নেহে বাপ এবং সেবায় ভৃত্য ছিল, এবং তাহার আর একটি দোষ ছিল—সে যে ফেলনার বাপ এ কথা সকলের কাছেই গোপন রাখিয়াছিল।’১৮

সন্তানকে কখনো আদর করে কাছে রাখেনি রাইচরণ! এ গল্পে অনুকূলের বা ফেলনার কোনোই ক্ষতি হয়নি। তারা একে অন্যকে পেয়ে আনন্দে জীবনযাপন করতে থাকে। কিন্তু রাইচরণ প্রথমত চোর ও বিশ্বাসঘাতক। দ্বিতীয়ত, নিজের সন্তানকে পেয়েও না পাওয়ার বেদনা! তবে পাপবোধ ঘোচাতে গিয়ে সব খুইয়েছে।

এই গল্পের মনস্তাত্ত্বিক দিকের পাশাপাশি দুটি বিষয় মনকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। খোকাবাবু যখন পদ্মাগর্ভে ডুবে যায়, তখন রাইচরণ কদম্বফুল তোলায় ব্যস্ত। কিন্তু যেই রাইচরণ দাদাবাবুকে চোখের আড়াল করতো না সে সর্বনাশা পদ্মার তীরে সতর্ক না হয়ে কীভাবে খোকাবাবুকে রাখে? নাকি গল্পের কাহিনি নির্মাণের সুবিধার্থে রবীন্দ্রনাথ মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাকে ভেদ করে অতি নাটকীয়তার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। ফেলনাকে নিয়ে যখন অনুকূলের বাড়িতে উপস্থিত হয় রাইচরণ, তখন অনুকূল শুধু নিয়ন্ত্রিত সম্পর্কের কথা জেনে কেন ক্ষান্ত হলো! মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া মায়ের সম্বল ফিরিয়ে দিয়ে রাইচরণ নিজেই অপরাধের শাস্তি গ্রহণ করলো। কিন্তু অনুকূলের স্ত্রী খোকাবাবুকে এতদিন পর ফিরে পেয়েও উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণের তোয়াক্কা করেনি। বরং এটাই যেন পাওয়ার ছিল। এ ক্ষেত্রে একদিকে সন্তানহারা মায়ের অন্ধ-যুক্তিহীন মাতৃপ্রেম, অন্যদিকে যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হওয়ার শঙ্কা! তখন এতদিনের হাহাকারের অবসান না হওয়ার ভয়! মা-বাবার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বই সন্তানকে নিয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই থেকে বিরত রেখেছে।

‘রাজপথের কথা’ গল্পটি ১২৯১ সালের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত। প্রথম পর্যায়ের গল্প হলেও এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ছোট্ট কলেবরে মানব মনের জটিল মনস্তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। গল্পটির কথক স্বয়ং রাজপথ। যার নিজের বাকশক্তি নেই; প্রাণহীন জড়বস্তু! কিন্তু এই জড়ের জবানিতে উঠে এসেছে এক নারীর হৃদয়ের গভীর যাতনা! প্রেমহীন জীবনকে রাজপথের সঙ্গে বহমান করে তুলেছে! রাজপথ শুধু তার জায়গায় স্থবির হয়ে পড়ে আছে কিন্তু মানুষের জীবনে কান্না আসে, হাসি-কান্নার সমাবেশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন স্রোতের মতো সব হারিয়ে যায়, থেকে যায় কিছু স্মৃতি! যে স্মৃতির সমুদ্রে ডুবে বারবার মানুষ নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে! ছোট্ট বালিকা রাজপথের বটগাছের শাখা লোকালয়ে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতো। একদিন জড়ের দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে ঘরে ফেরে। ওই রাস্তায় বালিকার পা আর পড়েনি। তার গভীর অন্তর্বেদনা রাজপথের হৃদয়কে বিগলিত করেছে! ছোট্ট কলেবরে একটি রাজপথের আত্মজবানিতে মানব হৃদয়ের কঠিন সত্যকে তুলে ধরেছেন।

‘এমন কতদিন, এমন প্রতিদিন, সে ধীরে ধীরে আসিত, ধীরে ধীরে যাইত। একদিন ফাল্গুন মাসের শেষাশেষি অপরাহ্নে বালিকা সেইখানে সেই তরুতলে আসিয়া দাঁড়াইল; কিন্তু সেদিন আর একজন আসিল না। আবার রাত্রে সে ধীরে ধীরে বাড়িমুখে ফিরিল। কিছু দূরে গিয়া সে আর চলিতে পারিল না। আমার উপরে, ধূলির উপরে লুটাইয়া পড়িল। দুই বাহুতে মুখ ঢাকিয়া বুক ফাটিয়া কাঁদিতে লাগিল।’১৯

বালিকার হৃদয়ের বেদনাকে রবীন্দ্রনাথ যত স্বল্প আয়তনে তুলে ধরুন না কেন, তা যেন বিশাল সমুদ্রের সমান! না পাওয়ার বেদনাকে বিশ্লেষিত করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ মনস্তত্ত্ব থেকে অনেকটা খসে দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনবোধ সম্পন্ন সাহিত্যিক। মানবমনের দোলাচলতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত তার গল্পে তাই আষ্টেপৃষ্ঠে। যে বালিকা একসময় তার প্রেমিক পুরুষের হয়তো পরিবার, সমাজের মানুষকে লুকিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অভিসারে আসতো যখন সেই প্রেমিক থেকে প্রত্যাখ্যাত, তখন গভীর বেদনাকে তাকে ঘিরে ধরে। নিশ্চল হয়ে পড়ে তার জীবনের আশা!

‘কী প্রখর রৌদ্র। (...) এখনকার বাতাসে যে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া যাইতেছ, তুমি চলিয়া গেলে কি তাহারা তোমার পশ্চাতে পড়িয়া তোমার জন্য বিলাপ করিতে থাকিবে, নূতন অতিথিদের চক্ষে অশ্রু আকর্ষণ করিয়া আনিবে? বাতাসের উপরে বাতাস কি স্থায়ী হয়? না না বৃথা চেষ্টা। আমি কিছুই পড়িয়া থাকিতে দিই না—হাসিও না কান্নাও না। আমিই পড়িয়া আছি।’২০

‘মুক্তির উপায়’ গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৯৮ বঙ্গাব্দে সাধনা পত্রিকার চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশ করেন। এটি আপাদমস্তক একটি মনস্তাত্ত্বিক গল্প। এই গল্পের দুটি প্লট। প্রথম পর্যায়ে ফকির চাঁদ ও হৈমবতী। দ্বিতীয় পর্বে নবগ্রামবাসী ষষ্ঠীচরণের ছেলে মাখনলালের কাহিনি। গল্পটিতে মনস্তাত্ত্বিক ও হাস্যরসাত্মক কাহিনির আড়ালে জীবনের অমোঘ যাতনার রূপায়ণ করা হয়েছে। যদিও গল্পে হাস্যরস এসেছে, তবু এখানে মানব মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব বিশেষভাবে দৃশ্যমান। ফকির চাঁদ বাল্যকাল থেকেই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। বৃদ্ধ সমাজে তাকে বেমানান দেখাতো না। কারণ সে সর্বদা গম্ভীর থাকতো। দেহের গঠনও গম্ভীর করে তুলেছিল। ফকির চাঁদের স্ত্রী হৈমবতী। অল্প বয়স। তার মন পৃথিবীর সম্পূর্ণ বিষয়ে নিবিষ্ট থাকলেও ফকির চাঁদ তাকে আধ্যাত্মিক করে গড়ে তুলতে চেয়েছে। হৈমবতীর কৌতূহলী মন বারবার বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ প্রাণ খুঁজেছে। হৈমবতী ও ফকির চাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে। সংসারে সদস্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসে আর্থিক অনটন। ফকির চাঁদের জীবন ক্রমে জটিল হয়ে ওঠে। আর্থিক সচ্ছলতা আনতে চাকরির উদ্দেশ্যে বের হলেও হতাশ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়। একদিন হঠাৎ গৌতম বুদ্ধের মতো সংসারত্যাগী হয় ফকির চাঁদ।

‘পিতার তাড়নায় এতোবড় গম্ভীর প্রকৃতির ফকিরকেও আপিসে আপিসে কর্মের উমেদারিতে বাহির হইতে হইল, কিন্তু কর্ম জুটিবার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। তখন সে মনে করিল, ‘বুদ্ধদেবের মতো আমি সংসার ত্যাগ করিব।’ এই ভাবিয়া একদিন গভীর রাত্রে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া গেল।’২১

একদিকে ফকির চাঁদের গৃহত্যাগের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, অন্যদিকে মাখনলালের গৃহত্যাগের কাহিনি। দুই কাহিনির সূত্রপাত আলাদা হলেও ঘটনা গিয়ে মিশেছে একটি জায়গায়। মাখনলালের দুই স্ত্রী। উভয়ে মিলে মাখনলালকে সাতটি মেয়ে ও একটি ছেলে উপহার দিয়েছে। কিন্তু সাংসারিক শান্তির বদলে নিত্যদিন ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকে। বিরক্ত হয়ে একদিন মাখনলালও নিজ ঘর ছাড়ে। এদিকে ফকির চাঁদ ঘুরতে ঘুরতে নবগ্রামে উপস্থিত হয়। তৈরি হয় নাটকীয়তা। জটিলতার রেশ যেন কিছুতেই কাটে না। মাখনলালের পিতা ষষ্ঠীচরণ সন্তানের নিরুদ্দেশকে কেন্দ্র করে জীবনকে যখন ওষ্ঠাগত করে তুলেছে, তখন সেখানে ফকিরের আবির্ভাব। এই ফকিরকেই নিজের ছেলে দাবি করে যে দ্বন্দ্ব ঘনিভূত করে তোলে। মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে নিজের স্ত্রী, বাবা কীভাবে স্বামী-সন্তানকে চিনলো না! সন্তান যতদিন পরেই ঘরে ফিরুক, তাকে কি চেনা যাবে না? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গল্পের প্লট তৈরি করতে গিয়ে মাঝে মাঝে পাঠককেও দ্বিধায় ফেলেছেন! ফকিরকে মাখনলাল ভেবে তাকে ষষ্ঠীচরণের পরিবার টানাহেঁচড়া করেছে। সাংসারিক জটিলতার কারণে ঘর ত্যাগ করলেও সমাজ তো ত্যাগ করতে পারেনি। নিজের বোনা জালে নিজেই জড়িয়েছে।

‘ফকির ভাবিল, এইবেলা এখান হইতে এক দৌড় মারি। কিন্তু রাস্তায় বাহির হইলেই পাড়ার লোক কুকুরের মতো তাহার পশ্চাতে ছুটিবে, ইহার কল্পনা করিয়া তাহাকে নিস্তব্ধভাবে বসিয়া থাকিতে হইল। যেমনি মাখনলালের দুই স্ত্রী প্রবেশ করিল, ফকির অমনি নতশিরে তাহাদিগকে প্রণাম করিয়া কহিল, মা আমি তোমাদের সন্তান।’২২

ফকির ও মাখনলালের সাংসারিক দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে নতুনভাবে আবারও উভয়ে গোলকধাঁধায় পড়ে! ফকির চাঁদ যখন মাখনলালের বাড়িতে উপস্থিত হয়, যদিও উপস্থিতিটা অনাকাঙ্ক্ষিত, তবুও নাটকীয় ঘটনার একপর্যায়ে বোঝা যায় ফকির চাঁদ হৈমবতীর ভাইয়ের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছে। তাকে ঘিরে মাখনলালের দুই স্ত্রী-সন্তানেরা দ্বন্দ্বে লিপ্ত। শেষমেশ মাখনের দর্শনে সব রহস্যের জাল ছেঁড়ে। গল্পটি হাস্যরসে ভরপুর হলেও মানবমন কীভাবে প্রতিনয়ত বিক্ষিপ্ত হয়, তার নিদর্শনের কোনোই ঘাটতি নেই। ফকির চাঁদ ও মাখনলালের মুক্তির কোনো উপায় রবীন্দ্রনাথ বাতলে দেননি। সাংসারিক জটিলতা। স্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব, নিরুদ্দেশ হওয়া। কিন্তু জীবনের ঘূর্ণিপাকে এসে আবারও পরিবারেই নিজেদের সমর্পণ করেছে।

‘একটি অপরিচিত নিরীহ ব্যক্তিকে নিজপদে অভিষিক্ত দেখিয়া সে এতক্ষণ পরম সুখানুভব করিতেছিল; অবশেষে হৈমবতীকে উপস্থিত দেখিয়া বুঝিতে পারিল, উক্ত নিরপরাধ ব্যক্তি তাহার ভগ্নিপতি। (...) দুই স্ত্রীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিল, এ আমারি দড়ি, আমারই কলসী।’২৩

রবীন্দ্রনাথের প্রথম সারির গল্প ‘একরাত্রি’। এটি সাধনা পত্রিকায় ১২৯৯ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। গল্পের কথকই একরাত্রির কেন্দ্রীয় চরিত্র। কথক ও সুরবালার বাল্যপ্রেমকে কেন্দ্র করে কাহিনির সূত্রপাত। যদিও এই সম্পর্ককে প্রেম না বলে শৈশবের অপরিণত খুনসুঁটিই বলা চলে। সুরবালাকে কেন্দ্র করে নায়কের প্রভুত্ব যেন সমগ্র গল্পেই বিদ্যমান। নায়কের অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে ঘর ছাড়তে বাধ্য করে। কথক কলকাতার কলেজে পড়াকালীন রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। একসময় দেশোদ্ধারে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয় না। সভায় বক্তৃতা, লিফলেট বিলি করা, চাঁদা তোলার জন্য বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করে বেড়ানো, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপন বিলি করা, সভাস্থলে গিয়ে বেঞ্চি চৌকি সাজানোসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। রাজনৈতিক মঞ্চে নিজেকে মাটসীনি গারিবালডি করে তুলতে সদা জাগরুক কথক। কিন্তু শেষপর্যন্ত নীতির চেয়ে জীবনসংগ্রামের পাল্লা ভারী হওয়ায় অচিরেই সংসারের হাল ধরতে হয়। কলকাতায় থাকাকালে শৈশবের সঙ্গী সুরবালার সঙ্গে বিবাহ ঠিক হয়। কিন্তু কথকের অতিরিক্ত স্বদেশপ্রীতি ও বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞা তাকে একাজে নিবৃত্ত করে। যেই সুরবালার প্রতি একসময় প্রভুত্ব করতো, তাকেই দূরে ঠেলে দিয়েছে! একদিকে নায়কের জীবন সম্পর্কে উদাসীনতা, অন্যদিকে সুরবালার প্রতি প্রকৃত প্রেমের অভাব! সুরবালার সঙ্গে ছোটবেলা বউ-বউ খেলাটায় সীমাবদ্ধ ছিল। গল্পের কোথাও সুরবালার জন্য তার টান লক্ষ্য করা যায় না।

‘দুই-চারি মাসের মধ্যে খবর পাইলাম, উকিল রামলোচনেবাবুর সহিত সুরবালার বিবাহ হইয়া গিয়াছে। পতিত ভারতের চাঁদা-আদায়কার্যে ব্যস্ত ছিলাম, এ সংবাদ অত্যন্ত তুচ্ছ বোধ হইল।’২৪

সুরবালার সঙ্গে নায়কের মানসিকভাবে সম্পৃক্ততা ছিল না। তাই সুরবালার বিবাহের খবর সূর্যের আলোর মতোই স্বাভাবিক। নোয়াখালী বিভাগের একটি ছোটো শহরে এনট্রেন্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের পদে নিযুক্ত হলে সুরবালার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে নায়কের। সুরবালার স্বামী রামলোচন সরকারি উকিল। রামলোচনের সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ ঘটে, তখন সুরবালা পর্দার আড়ালেই থেকেছে। নায়কের প্রতি গভীর অভিমান, ক্ষোভই যেন এই অন্তরাল! জীবনের স্বপ্ন যাকে নিয়ে বুনেছিল আট থেকে আঠারো পর্যন্ত, সেই নায়কই তাকে অবলীলায় দূরে ঠেলে দিয়েছে। সুরবালার প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধ তার মধ্যে কাজ করেনি। হতে পারে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি প্রবল ঝোঁক সেইসঙ্গে সুরবালার প্রতি অনাগ্রহ। পর্দার আড়ালে সুরবালার চুড়ির শব্দ তাকে সামান্য বিচলিত করলেও সেখানে মনের লেশমাত্র সংযোগ ছিল না।

‘মনের ভিতরে কে বলিল, তখন যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না। সেই শৈশবের সুরবালা তোমার যত কাছেই থাকুক, তাহার চুড়ির শব্দ শুনিতে পাও, তাহার মাথাঘষার গন্ধ অনুভব কর, কিন্তু মাঝখানে বার বার একখানি করিয়া দেয়াল থাকিবে। মনের ভিতরে কে বলিল, তখন যাহাকে ইচ্ছা করিলেই পাইতে পারিতে এখন মাথা খুঁড়িয়া মরিলেও তাহাকে একবার চক্ষে দেখিবার অধিকারটুকুও পাইবে না।’২৫

অবচেতন মনে সুরবালাকে প্রত্যাশা করলেও সেখানে প্রেমের স্পর্শ ছিল না। গল্পের নায়কের মনের কোনো চঞ্চলতাই দেখা যায় না। বরং বারবার তার নিজের জীবনই প্রধান হয়ে উঠেছে। এমনকি ঝড়ের রাতে দুজনে একই পাড়ে আশ্রয় নিলেও তাদের মনের কথা গোপনেই প্রবাহিত হতে থাকে। যেই সুরবালা শিশুকালে কথকের আপনার ছিল, এত কাছে থেকেও তার আর নায়কের মধ্যে একপৃথিবী দূরত্ব। সুরবালার নারীস্বভাব এবং কথকের প্রেমহীন সত্তা দুটো একবিন্দুতে মিশে নিকটও তাদের দূরের বাসিন্দা করেছে। অবচেতনে তাই সুরবালার সুখ কামনা ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নিজের অপরাধবোধ হয়তো খানিক ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল।

‘সে ঢেউ না আসুক। স্বামীপুত্র গৃহধনজন লইয়া সুরবালা চিরদিন সুখে থাকুক। আমি এই এক রাত্রে মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়াইয়া অন্তত আনন্দের আস্বাদ পাইয়াছি।’২৬

মনের মধ্যে উদরতার সৃষ্টি হলেও সে নিজের অবচেতন মনের পাপবোধের ফল মাত্র। তাই প্রকৃতির ঝড় থামলেও কথকের মনের কোথায় যেন ঝড়ের বেগ কমে না!

চলবে...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে মনস্তত্ত্ব 

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।