কবিতা অন্তপ্রাণ ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসান

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৩৭ পিএম, ০৪ আগস্ট ২০২২

এ কে এম ফয়সাল প্রিন্স

ষাটের দশকের জনপ্রিয় কবি আবুল হাসানের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯৭০ সালের এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন আবুল হাসান। এরপর থেকে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কলেজ জীবন থেকে কবিতা লিখতেন আবুল হাসান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে কবিতা লিখে চমকে দিয়েছিলেন শিক্ষকদের।

এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীকে পছন্দের বিভাগে পরীক্ষা দিতে হতো। কবি আবু হাসান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য যান, বন্ধুরা অনেকেই বলেছিলেন বাংলা বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। বন্ধুরা জানতেন আবুল হাসান ভালো কবিতা লেখেন। বন্ধুদের অনুমান সঠিক ছিল। আবুল হাসান ছিলেন কবিতা অন্তপ্রাণ। পরে আবুল হাসান ১৯৭০ সালের এশীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আবুল হাসান ১৯৮২ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান। এর আগে ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

আবুল হাসান বন্ধুদের কথা শুনলেন না। তিনি ইংরেজি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষার খাতায় লিখলেন শুধু একটি স্বরচিত ইংরেজি কবিতা। পরীক্ষার খাতা দেখে শিক্ষক অবাক। শিক্ষক আবুল হাসানের কবি প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হলেন। ওই শিক্ষক ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের কবিতাটি দেখালেন। আবুল হাসানের ভর্তি পরীক্ষার খাতায় কবিতা লেখার খবর চলে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে। তিনি আবুল হাসানকে ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি তো ভালো কবিতা লেখ। বাংলা বিভাগে ভর্তি হও।’ আবুল হাসান বললেন, ‘ইংরেজি কি সাহিত্য নয়? ইংরেজি বিভাগে পড়েও কবিতা লেখা যায়।’ আবুল হাসান ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলেন।

ইংরেজি বিভাগে পড়ার সময় আবুল হাসানের সঙ্গে প্রেম হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সুরাইয়া খানমের। নারী শিক্ষক ছাত্রের প্রেমে পড়েছিলেন। বিষয়টি অবাক হওয়ার মতো। হয়তো আবুল হাসানের ব্যক্তিত্ব, কবি প্রতিভা সুরাইয়া খানমকে বিমোহিত করেছিল। ১৯৭৪ সালে আবুল হাসান অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় পূর্ব জার্মানিতে। এরপর চেকস্লোভাকিয়ায়, সেখান থেকে আবার ফের বার্লিনে নেওয়া হয়। এরপর আবুল হাসানকে ফিরিয়ে আনা হয় ঢাকায়। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি রাজধানীর পিজি হাসপাতালে মারা যান। ওই সময়ে পিজি হাসপাতালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলেমর পাশের কেবিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন আবুল হাসান। মৃত্যু পর্যন্ত সুরাইয়া খানম আবুল হাসানের পাশে ছিলেন। আবুল হাসানকে বাঁচানোর জন্য সুরাইয়া খানমের নিরন্তর চেষ্টা ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

সুরাইয়া খানমের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার আগে বরিশাল বিএম কলেজে পড়ার সময় এক মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল। সে সম্পর্ক ছিল অল্প সময়ের। মৃত্যুর পরেও হাসানের পরিবারের সঙ্গে সুরাইয়া খানম অনেকদিন যোগাযোগ রেখেছিলেন। কবির গ্রামের বাড়িতে চল্লিশা উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলে অংশ নিয়েছিলেন।

কবিতা অন্তপ্রাণ ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসান

কবি আবুল হাসানের বাবার বাড়ি পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার মধ্য ঝনঝনিয়া গ্রামে। বাবা আলতাফ হোসেন মিয়া ছিলেন পুলিশ অফিসার। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি আলতাফ দারোগা (এসআই) হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট আবুল হাসান গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া উপজেলার বর্নি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। আলতাফ হোসেন মিয়া ও সালেহা বেগম দম্পতির প্রথম সন্তান আবুল হাসান। ওই দম্পতির চার ছেলে ও তিন মেয়ে। চিত্র পরিচালক প্রয়াত আবিদ হাসান বাদল কবি আবুল হাসানের ছোট ভাই। চার ভাইয়ের মধ্যে শুধু আমির হোসেন বেঁচে আছেন। তিনি খুলনা নগরীতে বসবাস করেন। গ্রামের বাড়িতে শূন্য ভিটা পড়ে আছে।

তাঁর প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া টুকু। তিনি আবুল হাসান নামে কবিতা লিখতেন। শৈশব কেটেছে নানা বাড়ি টুঙ্গীপাড়ার বর্নি গ্রামে। ঝনঝনিয়া থেকে বর্নি খুব বেশি দূরের গ্রাম নয়। কবির নানা আব্দুল গফুর মোল্লা কবিকে টুকু নামে ডাকতেন। বড় মেয়ের বড় সন্তান। এ কারণে নানার আদর আর প্রশ্রয়ে টুকু বেড়ে ওঠেন প্রকৃতির কোলে।

আবুল হাসানের বাবা পুলিশে চাকরি করায় কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেছেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা নানা বাড়ির বর্নি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এসএসসি পাস করেছেন ঢাকার একটি স্কুল থেকে। এইচএসসি বরিশালের বিএম কলেজ থেকে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

কবিতা অন্তপ্রাণ ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসান

আবুল হাসান ছিলেন আড্ডাবাজ ও উড়নচণ্ডী। পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা শেষ না করেই যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায়। শুরু করেন সাংবাদিকতা। পাশাপাশি চলে কবিতা ও প্রবন্ধ লেখা। নিজের লেখাগুলোর পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করতেন না। তাঁর একটি পাণ্ডুলিপি পিরোজপুরের আইনজীবী প্রয়াত এম এ মান্নানের কাছে ছিল।

আবুল হাসানের সেজ ভাই আমির হোসেনের স্ত্রী রাজিয়া পারভীন জানালেন, আবুল হাসানকে তিনি দেখেননি। তবে শাশুড়ি সালেহা বেগমের কাছে গল্প শুনেছেন। কবির মন ছিল কোমল। মানুষের প্রতি ছিল মায়া। তিন বোন হোসনে আরা খানম অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, রওশন আরা খানম কলেজ শিক্ষক ও ছোট বোন ডা. জাহানারা চায়না।

কবি কামাল চৌধুরী ২০০১ সালের শুরুতে পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি কবির ছোট ভাই অধ্যাপক আমির হোসেনকে একদিন ডেকে পাঠান। কামাল চৌধুরীর সঙ্গে কবি আবুল হাসানের পরিচয় ছিল। তিনি চেয়েছিলেন পিরোজপুরে কবির স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সড়কের নামকরণ করার। কামাল চৌধুরী অল্প সময়ে পিরোজপুরে কর্মরত থাকায় উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হয়নি। কবির পরিবারের সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন না। ঝনঝনিয়া গ্রামে পড়ে আছে কবির শূন্য ভিটা। গ্রামে নেই কবির স্মৃতিচিহ্ন।

আবুল হাসানের ভাই অধ্যাপক আমির হোসেনসহ পরিবারের সদস্যদের দাবি, ঝনঝনিয়া গ্রামের সড়কটি কবির নামে নামকরণ ও কবির নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হোক। গ্রামের তরুণরা একবার কবির নামে পাঠাগার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে অর্থাভাবে সেটি এগোয়নি।

কবি আবুল হাসান তাঁর ‘জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন’ কবিতায় লিখেছেন,
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবে না,
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই।’
এ ছাড়া তাঁর ‘চামেলী হাতে নিম্নমানের মানুষ’ কবিতায় উঠে এসেছে বাবা আলতাফ হোসেন মিয়ার কথা। মাত্র ২৮ বছর বেঁচে ছিলেন কবি। ক্ষণজন্মা কবি আবুল হাসান আমাদের জন্য রেখে গেছেন তিনটি কাব্যগ্রন্থ। যা কবিতাপ্রেমীদের কাব্যক্ষুধা মেটায়। কবির জন্মবার্ষিকীতে অশেষ শ্রদ্ধা।

লেখক: সংবাদকর্মী, পিরোজপুর।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।