আরিফুল হাসানের গল্প: না ঘর, না ঘরের মানুষ

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:২৫ পিএম, ১৬ জুলাই ২০২২

মনুর দোকানে বসে চা খায় হাবুল। হাবুলের পাঁচ ভাই। তাদের দাপট ক্ষমতাসীন পর্যায়ে না হলেও ভয় পায় মানুষ। কোনদিকে কী অঘটন বাঁধিয়ে দেবে, তা নিয়ে তটস্থ থাকে গ্রামবাসী। পাজি-পাজরা, দুষ্টু লোকদের মতিগতি বোঝা যায় না। যেখানে দা না যাবে, সেখানে তারা কুড়াল চালিয়ে দিতে পারে। তাই হাবুলদের দেখলে লোকে মৌখিক তোষামোদ করে, চা-টা, বিড়িটা সেধে খাওয়ায়। হাবুলরাও এসবকে তাদের নিজেদের অধিকার বলে বিশ্বাস করে।

কাজীরপাড় গ্রামে এই একটি মাত্র চায়ের দোকান। দোকানদার মনু মিয়া টাক মাথায় চা বানায় এটি গ্রামবাসীর কাছে তাজ্জব লাগে। লোকে বলে, বড়লোক হলে মাথায় টাক পড়ে। মনু মিয়া চা দোকানদারী করে। অবশ্য সে একসময় বড়লোক হতে যাচ্ছিল, কিন্তু কপাল খারাপ, বিদেশ তার বেশিদিন সয় না। অবশ্য তখনো তার মাথায় টাক পড়া শুরু হয়নি। গ্রামে এসে সিএনজি কেনে। দু’চার টাকা ভালোই উপার্জন করতে থাকে। বছর না যেতেই সিএনজিতে ত্রুটি দেখা দেয়। মেকানিক মেকানিক করতে করতে শেষে বিক্রিই করে দেয়। তখন তার মাথায় টাক পড়া শুরু করে। লোকে ভাবতো, মনু মিয়া হয়তো এ যাত্রায় অন্তত লাখোপতি হতে যাচ্ছে। কেন যে তার মাথায় টাক পড়লো গ্রামবাসী বুঝে পায় না। বছর তিনেক হলো, সে এখনো চা বেচে।
মনু, একটা বিস্কুট দিবি ভাই!
মনু অলস হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বয়ামের মুখ খোলে। তিন টাকা দামের লম্বা একটি বিস্কুট এগিয়ে দেয় হাবুলের দিকে। হাবুলের থেকে মনুর দূরত্ব বেশি, হাবুল একটু উঠলেই নিতে পারে, কিন্তু মনুকে ধমক দেয়।
আরে বেডা একটু দিয়া যাচ্ছা।
মনু মিয়া চায়ের টেবিলটাকে একপাশে টেনে শরীর গুটিয়ে বের হয়। বিস্কুটটা দিতে দিতে বিরবির করে,
হাবুল ভাই, তিনশ পঁচাত্তুইর টেয়া অইছে।
দিমু, দিমু।
মনু কোনো কথা বলে না। ঘুরে তার দোকানের ভেতর চলে যায়। এই মুহূর্তে তার দোকানে আর অন্য কোনো মানুষ নেই। একটু আগেও ক’জন মুরুব্বি বসা ছিলেন। জোহরের আজান হওয়ায় উঠে ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে চলে গেছেন। মনু মিয়া একা বসে বসে তার টাক হওয়ার রহস্য এবং চা-দোকানির জীবন নিয়ে চিন্তা করছিল। হাবুল আসায় বরং অবকাশ পেয়েছে। দুপুরের তেতে ওঠা রোদে হাবুল সম্পর্কে জানার পরও একজন কথা বলার মানুষ পাওয়ায় তার ভালো লাগছে। অবশ্য হাবুল খুব সুবিধার কথা বলে না। আজও সে প্রস্তাব করে বসলো, যাইবিনি, বেডিমেম্বরের বাইত?
মনু লজ্জা পেয়ে হাসে।
আয়, দুফরেই এক টিপ দিয়া আই।
মনু কোনো কথা বলে না। আস্তে আস্তে দোকানের ঝাঁপ ফেলে। হাবুল কাপের শেষ চাটুকু ছুড়ে ফেলে উঠে লুঙ্গির গিট ঠিক করে পরে। হাবুলকে আড়াল করে মনু তিনশ টাকা পকেটে গোঁজে। হাবুল দেখে ফেলে।
আমারে পঞ্চাশটা টেয়া দেচ্ছা মনু!
টেয়া দিয়াম কইত্তে?
মনুর গলায় কিছুটা ঝাঁঝ আসে। কিন্তু সে টাকাটা দেয়। সে জানে, পঞ্চাশ টাকা না দিলে হাবুল এখন অন্য কাজের ছুতা তুলে অন্য কোথাও চলে যাবে। এই দুপুরের রোদে হঠাৎ যে আনন্দস্বপ্ন মনুর মনে চিলিক দিয়ে ওঠে, তাকে সে হারাতে চায় না।

হাসনা হঠাৎ করে এসে মহিলা মেম্বার হয়েছে। এর আগে সে কোথায় ছিল অনেকেই বলতে পারে না। লোকে বলে, শহরের বস্তিতে কোনো পাড়া চালাতো। সাথে তিনটা মেয়েও এসেছে। হাসনা বলে, এগুলো তার মেয়ে কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না। স্বামীটাকেও আসল না নকল পরীক্ষা করে দেখতে চায় মানুষ, ক্ষমতায় কুলায় না। কৌতূহল, কৌতূহলই থেকে যায়। তবে একটি বিষয় সবাই পরিষ্কার হয়, এই মহিলা মেম্বারের এখানে কিছুটা গরবর আছে।

যখন প্রথম শহর থেকে বাড়িতে আসে, সাথে তেমন কিছুই আনতে পারেনি। শুধু বাপের পোড়ো ভিটের দু’প্রান্তে দুটো দোচালা টিনের ঘর করেছিল। তখন মানুষজনও তেমন চিনতো না তাদের। ক্রমে গ্রামের মাথা-মোড়লদের ভিড় জমতে থাকে তার বাড়িতে। আনাগোনা আরও বাড়ে। দু’তিনটি গ্রামের সর্দার-মাতব্বররা আসে। এবং দেখতে দেখতে হঠাৎ করে নির্বাচনে পাসও করে যায় হাসনা। সবার তাজ্জব লাগে, কীভাবে কী হলো!

পাস করার পর হাসনার এক দুর্সম্পর্কের খালাতো বোনের মেয়েও এসে ওঠে তার বাড়িতে, নাম কলি। সে একটু দেখতে কালো। গ্রামের মেঠো মরদেরা তার কাছেই যায়। কলি অবশ্য ঢংও করতে পারে বিস্তর। গ্রামের অনেক যুবকেরই সুন্দরী বউ ঘরে কাঁদে, কিন্তু কলি যে কি নেশা তা যুবকরা কুলকিনারা করতে পারে না। যুবকদের বুকে আঙুল রেখে কলি বলে, ছত্রিশ প্রকার লীলা জানি, কোনটা দেহামু? তারপর খিলখিল করে হেসে ওঠে। যুবকরা সে হাসিতে খুন হয়। ছুটে যায় অনেক চল্লিশ-পঞ্চাশেরও পুরুষ। হাসনার তিন মেয়ের চাহিদা বেশি, ওদের কাছে ঘেঁষতে চাষাভুষাদের মুরোদ নেই। ওরা কলিতেই সন্তুষ্ট হয়।

যেতে যেতে পথে হাবুল মনুকে বলে, বুঝলি মনু, ঘরের বউ অইলো ডেগের ভাত, যেমনে মন চায় এমনে, যহন মন চায় তহন খাইতে পারবি। পুরুষ মানুষ আলগা না খাইলে কি বাঁচে!
মনু লাজুক হেসে ওঠে। পুকুরের পাড় বেয়ে তারা গিয়ে মাঠে নামে।
বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ইরি ধানের চারাগুলো হাওয়ায় হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। ফড়িং ও ফিঙের ওড়াউড়ি দুপুরকে আরও নির্জন করে দেয়। মাঠের চাষারা ফিরে গেছে। দূরে ইস্ক্রিমের ঘরটা এখন নিঝঝুম নিশ্চুপ। ছলছল করে জল তুলছে না ইঞ্জিনটা। তর্জার বেড়ার ফাঁকে পাম্পের পাইপের মুখটা শুকিয়ে তার লালচে আয়রনগুলোকে সাদা সাদা দেখাচ্ছে। হাবুল মনুকে ডাক দেয়, ও মনু, তোর দোকানটা আমার কাছে বেইচ্চালা।
মনু রাগে গড়গড় করে। হ, বেইচ্চালাইতাছি তোমার কাছে!
হাবুল হো হো করে হেসে উঠে। আরে, ঠাট্টা করছি।
অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে হাবুল মনুকে বলে,
আরে মনু, আমি তো টেয়াই আনছি না লগে?
হ্যাঁ, এহন উফায়?
হাবুল অভয় দেয়, তুই সামনে আগা, আমি দৌড়াইরা গিয়া লইয়া আই।
মনু বলে, আমি খাড়ামু।
না, খাড়ান লাগতো না। তুই গিয়া শুরু কইরা দে। আমি আইতাছি। কলি আইজ তুইঅই ফোডা!

চিক করে হেসে ওঠে মনু। মনে মনে খুশি হয়। হাবুলের সাথে গেলে সে আগে কখনোই পায় না। এটি তার অনেকদিনের ক্ষোভ। আজ এই সুযোগ পেয়ে একটি তৃপ্তি আসে মনে। সে আরও জোরকদমে মহিলা মেম্বার হাসনার বাড়ির দিকে যেতে থাকে।

কাজীরপাড় গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠটিতে আগে নানারকম ফসল ফলতো। এখন লাভ-লসের কথা ভেবে চাষিরা শুধু ধান চাষই করে। মনু মিয়ার জমি আছে এক টুকরো। মাঠের আল দিয়ে যেতে যেতে তার ক্ষেত এসে যায় এবং সে একপলকের জন্য সেখানে থামে। মাঠের অন্যান্য জমি থেকে তার জমিটা নিরস, কিছুটা ম্লান করে তাকে। কিন্তু সে পরক্ষণেই আবার ছোটে, মাঠ পেরিয়ে, খাল পেরিয়ে মহিলা মেম্বারের দুর্সম্পর্কের খালাতো বোনের মেয়ে কলির দরজায় গিয়ে টোকা দেয়।

গ্রামে ফিরে এসে মনু মিয়ার দোকানের পেছন দিয়ে পুকুরপাড় ধরে সোজা মনু মিয়ার বাড়িতে এসে হাজির হয় হাবুল। মনুর বউ তাকে ইশারায় ঘরে ডেকে দরজা ভিজিয়ে দেয়।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।