বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবেশ ভাবনা
সাইফুর রহমান তুহিন
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথমবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবেশবাদী কবিতায় রেখে গেছেন তার গভীর প্রভাব। যদিও সাহিত্যে পরিবেশবাদ একটি সাম্প্রতিক ধারণা। তারপরও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে এর চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। তার সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রকৃতি ছিল একটি নিয়মিত বিষয়। পরিবেশবাদী কবিতার ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে শুধু সৌন্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেয়ে একে বাঁচিয়ে রাখার দিকটিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসাধারণ চিন্তাবিদ, লেখক, সংগীতজ্ঞ ও দার্শনিক। নিজের লেখা কবিতা, ছোটগল্প, গান এমনকি চিঠিপত্রেও তিনি প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আকর্ষণ প্রকাশ করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে প্রকৃতি যেন আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে দেখা দেয়। তার প্রথম কবিতা ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ প্রকৃতির সৌন্দর্যকেই ফুটিয়ে তোলে। কবিগুরুর জীবদ্দশায়ই (১৮৬১ থেকে ১৯৪১ সাল) প্রকৃতিকে ধ্বংসের বিষয়টি একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সময়টা ছিল বিজ্ঞানের সম্মুখ পানে এগিয়ে যাওয়ার। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে উন্নত দেশগুলোয় আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি বন-জঙ্গল এবং তরতাজা জমি ধ্বংস হতে দেখেছেন। একদিকে প্রকৃতির প্রতি আধ্যাত্মিক অনুরাগ আর অন্যদিকে প্রকৃতি ধ্বংস হওয়া কবিগুরুকে এ বিষয়ে লিখতে প্রবলভাবে আগ্রহী করে তোলে।
পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার বিষয়টি সাহিত্যের ক্ষেত্রে বেশ সাম্প্রতিক ধারণা হলেও রবীন্দ্রনাথ এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে এটি নিয়ে ভেবেছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তাকে একজন পরিবেশবাদী বলাও অযৌক্তিক হবে না। ১৯১৬ সালে জাপান সফরে যাওয়ার সময় সাগরে তেল নিঃসরণের বিষয়টি পরিবেশের ওপর মানুষের নেতিবাচক প্রভাবের ব্যাপারে কবিগুরুকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতি নিয়ে মানুষের উদ্বেগের ঘাটতি তাকে বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে লেখার রসদ জোগায়। প্রকৃতিকে চিত্তাকর্ষক ও আবেগময় ভাষায় উপস্থাপনের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ তার কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ ও গানে স্পষ্ট ভাবেই পরিবেশ সচেতনতার নিদর্শন রাখেন। বিষয়টিকে তিনি শুধুই তার সাহিত্যকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও পতিসার গ্রামে যথাক্রমে ১৮৯৪ ও ১৯১৪ সালে তার পল্লী উন্নয়নের উদ্যোগ ছিল কৃষকদের জন্য কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মতোই। এর পাশাপাশি কুটির শিল্পের ওপর গুরুত্বারোপ করে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতি নিয়ে তার গভীর চিন্তা-ভাবনার প্রমাণ দেন। প্রকৃতির সবচেয়ে ফলদায়ক উপাদান গাছ শুধুই অতি সাধারণ বৃক্ষমাত্র নয়, কবিগুরুর সাহিত্যকর্মেরও উপাদান। তিনি তাদের সাথে কথা বলতেন এবং সানন্দে তাদের নিজের প্রতি এক উপহার হিসেবে স্বীকার করতেন। ১৯২৯ সালে তিনি ‘বনবাণী’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন বৃক্ষরোপণ উৎসব উপলক্ষে। এ কবিতায় কবি নির্বিচারে প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের জন্য আধুনিক সভ্যতার সমালোচনা করেন।
পরিবেশের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার বিষয়টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন খুবই সোচ্চার। ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতায় আধুনিক জীবনের অবসাদের বিষয়টি এতটা নিঃসারভাবে ফুটে উঠেছে যে, কবি প্রস্তর-হৃদয় থেকে মুক্তি লাভের জন্য খুব সাদামাটাভাবে আগের সেই বন্য জীবনে ফিরে যেতে চেয়েছেন। সর্বনাশা সভ্যতার কবল থেকে তিনি রেহাই চেয়েছেন এভাবেই। ‘বসুন্ধরা’ কবিতায়ও তিনি প্রকৃতির সাথে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রবন্ধও পরিবেশবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটায়। ‘তপোবন’ রচনায় বন হচ্ছে একটি জীবন্ত প্রাণিসত্তা। এখানে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে, একসময় বনই ছিল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু।
তিনি আরও বলেছেন, এটি জ্ঞানের উৎস, এটি আমাদের পরিচর্যা করে এবং আমাদের সভ্যতার কর্ণধার হলো সাধু-সন্ন্যাসীরা যারা প্রাচীন বনে বসবাস করতো। রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ সচেতনতার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ‘পল্লী প্রকৃতি’, ‘উপেক্ষিত পল্লী’, ‘ভূমিলক্ষ্মী’, ‘বৃক্ষরোপণ’ ও ‘হালকারশানা’ গ্রন্থে। ‘শ্রীনিকেতন’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ শহর ও নগরের সংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে তার প্রবল বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘অরণ্যদেবতা’ রচনায় তিনি আগামী দিনের পরিবেশ সংকটের বিষয়টি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সমসাময়িক খুব কম সাহিত্যিকই বিংশ শতাব্দীতে পরিবেশের এ বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিতে পেরেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি একজন সত্যিকারের স্বপ্নচারী; যিনি একবিংশ শতাব্দীর একজন নাগরিকের মতো চিন্তা করতে পেরেছিলেন। চিঠিপত্রের সংকলন ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে রবীন্দ্রনাথ পদ্মা নদী ও তার চারপাশের অনুপম সৌন্দর্য সম্পর্কে একটি দারুণ চিত্র উপস্থাপন করেছেন।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলার নজরকাড়া সৌন্দর্যের সংস্পর্শে আসেন। গড়াই নদীতে বার বার ভ্রমণ এবং মানুষের জীবনে ঋতু পরিবর্তনের বৈচিত্র্যের প্রভাবের বিষয়টির উপস্থিতি তার লেখায় পাওয়া যায়। ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’ নৃত্যনাট্যেও রবীন্দ্রনাথের পরিবেশবাদী চিন্তাধারার জোরালো উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ১৯২২ সালে রচিত ‘মুক্তধারা’ ছিল যান্ত্রিক জীবনের প্রতি তার প্রবল অনীহার এক প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ। ১৯২৫ সালে রচিত ‘রক্তকরবী’ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অনৈতিক দিকটি চিত্রায়িত করে, যারা প্রকৃতি ও পরিবেশকে অগ্রাহ্য করেছে। এই রক্তকরবী এখনো আধুনিক যুগের দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয়ে দোলা দেয়।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘বলাই’তে প্রকৃতির প্রতি তার গভীর অনুরাগ ও আধ্যাত্মিক একত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায়। মাতৃহীন বালক বলাই ভীষণ প্রকৃতিপ্রেমী এবং প্রকৃতি মাতা ছাড়া সে অসম্পূর্ণ। বিখ্যাত কবিতা ‘দুই পাখি’তে (যেটিকে গানেও রূপ দেওয়া গয়েছিল) কবিগুরু পরিবেশ ও সংস্কৃতির মধ্যে বৈসাদৃশ্য তুলে ধরেছেন দুটি পাখিকে চিত্রায়িত করে, যার একটি বনের মধ্যে মুক্ত এবং আরেকটি খাঁচায় বন্দি। দুই ধরনের দুটি সৃষ্টির মধ্যে কলহ-বিবাদ প্রকারান্তরে মানব সৃষ্ট সংস্কৃতি ও আদিম প্রকৃতির মধ্যে প্রতীকী সংঘাতকেই সামনে নিয়ে আসে। ‘প্রশ্ন’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবেই পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপারে তার মানসিক আঘাতের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। নিজের ভেতরের পরিবেশবাদী সত্তা তাকে খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, অবাধে পরিবেশ ধ্বংস হওয়া প্রতিরোধ করা ক্রমান্বয়ে অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
রবীন্দ্রনাথের এই পরিবেশবাদী চেতনা খুব সহজেই তাকে সমসাময়িক অন্যান্য অনেক সাহিত্যিকের চেয়ে আলাদা করে তোলে। আর কোনো সাহিত্যিক এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের কেউ এতো তাড়াতাড়ি পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে এমন জোরালো প্রতিবাদ করেননি। নিজের সাহিত্যকর্মে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তাতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, পরিবেশের প্রতি বাধাহীন নিষ্ঠুরতার বিষয়ে তিনি কতটা সজাগ ও সমালোচনামুখর ছিলেন।
অর্থহীন এ ধ্বংসলীলাকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। প্রকৃতি আধ্যাত্মিকভাবে আমাদের ধারণ করে এবং টিকে থাকার ব্যাপারে সুরক্ষা দেয়। তাই আমরা এর ওপর নিষ্ঠুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারি না এবং প্রকৃতির সাথে জটিল বন্ধন ভাঙতেও পারি না। আর এ কারণেই প্রকৃতি মাতাকে সম্ভাব্য বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিল অক্লান্ত প্রচেষ্টা, যার ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রয়েছে। তার শতাব্দী-প্রাচীন চিন্তা-ভাবনা এখনকার যুগেও খুবই বাস্তবসম্মত। পরিবেশ রক্ষায় তার প্রবল আকুতি ক্রমেই বাস্তব রূপ লাভ করছে।
লেখক: ফিচার লেখক ও সাহিত্য সমালোচক।
এসইউ/এমএস