আট রকমের গল্প: জীবনের নানাবিধ বিশ্লেষণ
দেওয়ান শামসুর রকিব একাধারে নাট্যকার, নির্মাতা, ঔপন্যাসিক ও মিডিয়াব্যক্তিত্ব। পাশাপাশি তিনি একজন গল্পকার। তার আলোচিত একটি গল্পের বই ‘আট রকমের গল্প’। বইটিতে ৮টি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো হলো—‘ক্ষমা অথবা দ্বিধা’, ‘করোনাবন্দি দিনগুলি’, ‘ডাল ভাত আলুভর্তা’, ‘খুনির মেয়ের কোন অপরাধ ছিল না!’, ‘নাহিদবিষয়ক কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন’, ‘রক্তবীজ’, ‘ঢেউ’, ‘এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’।
তার একটি গল্প থেকে অন্য গল্পের দূরত্ব বিষয়বৈচিত্র্য ও রহস্যে পরিপূর্ণ। যে কারণে গল্পগুলো পাঠ করার সময় আরও রঙিন মনে হয়। পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রতিটি দৃশ্যপট। মনে হয়, আমাদেরই জীবনের গল্প। মনে হয়, জীবনের নানাবিধ বিশ্লেষণ। কারণ তার প্রতিটি গল্প আমাদের পারিপার্শ্বিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তার গল্প আমাদের সমাজব্যবস্থা এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ হয়ে ওঠে।
সুতরাং এ কথা বলাই যায়, দেওয়ান শামসুর রকিবের গল্পগুলো মানসিক চিন্তার খোরাক হয়ে থাকবে। কেননা তার গল্পগুলো সাবলীলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি মানুষের কল্যাণ, প্রকৃতির উন্নয়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভেবেছেন। তাই তো প্রতিটি গল্প পাঠ শেষে মনে হবে, লেখক গল্পের বিষয়বৈচিত্র্য, সমাজ বাস্তবতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা, চরিত্র চিত্রণ ও মনুষ্যত্ব বিশ্লেষণে বিশেষ যত্নবান ছিলেন। মৌলিক চিন্তার রসায়ন দিতে চেষ্টা করেছেন।
আমি বিশ্বাস করি, দেওয়ান শামসুর রকিব নিয়মিত গল্পচর্চা করলে পাঠকমহল আরও বেশি উপকৃত হবে। কারণ তার শব্দশৈলীর উৎকর্ষ পাঠককে বিমোহিত করবে। কেননা তার প্রতিটি গল্পেই আলাদা আলাদা ব্যঞ্জনা উপস্থাপিত হয়েছে। তার গল্পে সমাজব্যবস্থা, পুরুষতন্ত্র, কুসংস্কার, মহামারী, বাস্তবতা, কিশোর অপরাধ, অবক্ষয়, মানসিক অবসাদ প্রভৃতি বিষয় ফুটে উঠেছে। প্রতিটি গল্পেই লেখক দারুণ মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন।
জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যায় তার গল্পের চরিত্ররা। তার গল্পের চরিত্র শমিক, রিয়া, নাসিম, শিলা, আরিফ, নাজনীন, কায়সার, কণা, নাহিদ, সালমা যেন এ সমাজেরই প্রতিনিধি। নিয়তির চক্রে যেন তারা বাঁধা পড়ে আছেন। তারা যেন আমাদের মাঝেই বড় হয়ে ওঠেন। আমাদের অগোচরে বা অন্তকরণেও যেন তারা বসবাস করেন। তাই তার গল্পের চরিত্রগুলো বহুদিন পাঠক মনে বেঁচে থাকবে।
‘ক্ষমা অথবা দ্বিধা’ গল্পে শমিক বিভিন্ন স্বপ্নের কথা শুনিয়ে নারীকে ভোলালেও বিয়ের পরপরই হয়ে যায় তথাকথিত সমাজের বাস্তব চিত্র! ‘করোনাবন্দি দিনগুলো’ গল্পে উঠে এসেছে কুসংস্কার। সব দায় এসে পড়ে নারীর ওপর। ‘ডাল, ভাত, আলু ভর্তা’ গল্পের নায়ক আরিফ জীবনের নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত হয়; তখন সে হয়ে যায় একা। ‘খুনির মেয়ের কোন অপরাধ ছিলো না!’ গল্পটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।
‘নাহিদবিষয়ক কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন’ গল্পে উঠে এসেছে মানসিক অবসাদ। কেননা পরাজয়, ব্যর্থতা থেকেই প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ডিপ্রেশন চলে আসে। ‘রক্তবীজ’ গল্প আমাদের ঐশীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে কিশোর অপরাধের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ‘ঢেউ’ গল্পটি পারিবারিক। এটি বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কের গল্প। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অবহেলার গল্প। বইয়ের শেষ গল্প ‘এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর’ পাঠকের হৃদয়কে নাড়া দেবে। পাঠ শেষে হাহাকারের সুর বেজে উঠবে।
বইটি সম্পর্কে অনেকেই মূল্যায়ন করেছেন। কথাসাহিত্যিক শাহানা সিরাজী বলেছেন, ‘ঘুণেধরা সমাজের চিত্র দেওয়ান শামসুর রকিব দুর্দান্তভাবে তুলে ধরেছেন এ গল্পে। একের দায় অন্যের ওপর চাপানো এ সমাজের নেশা। লেখক সমাজের নাসারন্ধ্র খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।’
কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেছেন, ‘আট রকমের গল্প গ্রন্থটিতে ৮টি গল্প স্থান পেয়েছে। এক গল্প থেকে অন্য গল্পের দূরত্ব বিষয় বৈচিত্র্যে পূর্ণ। এ কারণে গল্পগুলোকে রঙিন মনে হয়েছে।...গল্পে শব্দশৈলীর উৎকর্ষ আমাকে খুশি করেছে।’
তিনি অন্যত্র বলেছেন, ‘মানব জাতির কল্যাণে, প্রকৃতির উন্নয়নে বা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যে শব্দগুলো লেখক ব্যবহার করেছেন, ওই শব্দগুলো লেখককে হারিয়ে যেতে দেবে না কালের অন্ধকারে। লেখককে গল্পের বিষয় বৈচিত্র্য, যেমন সমাজ বাস্তবতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা, চরিত্র চিত্রণ ও মনুষ্যত্ব বিশ্লেষণে যত্নবান মনে হয়েছে। মৌলিক চিন্তার রসায়ন দিতে চেষ্টা করেছেন লেখক।’
দেওয়ান শামসুর রকিবের ‘আট রকমের গল্প’ বইটির প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশিত হয়েছে বেহুলাবাংলা থেকে। দাম ২২৫ টাকা। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি। নির্মাণে-গল্পে পাঠকের মাঝে চির জাগরুক থাকবেন তিনি।
এসইউ/এমএস