মায়াবতী: পর্ব ৩৫
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
চৌত্রিশ.
বিকাল চারটায় রিয়া গাড়ি নিয়ে দাঁড়াল রোকেয়া হলের গেটের পাশে।
মোবাইলে কুসুমকে কল করার জন্য বাটন চাপতে লাগল।
কল করার প্রয়োজন হলো না। পাশ থেকে ছুটে এসে কুসুম গাড়ির উইন্ডশিল্ডে টোকা দিতে থাকে।
কুসুমকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল রিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও পেল। ক্যাম্পাসে এমন লাবণ্যময়ী মেয়ের নিরাপত্তা নিয়েই প্রথম শঙ্কাটা ঢোকে মনে।
গাড়িতে উঠে বসেছে কুসুম।
রিয়া ড্রাইভারকে বলল, উত্তরায় চলো। রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে।
কুসুম প্রশ্ন করে, রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স কেন?
ওখানে সবাই জড়ো হব। তারপর একসঙ্গে যাব মুনার শ্বশুরবাড়ি।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
কুসুম আবার প্রশ্ন করে, মুনা কি সবাইকে ইনভাইট করেছে?
রিয়া শান্ত গলায় জবাব দিলো, না। আমরা বিশেষ উদ্দেশ্যে যাচ্ছি।
বিশেষ উদ্দেশ্য?
হ্যাঁ।
উদ্দেশ্যটা কী?
লো টোনে সব কথা খুলে বলে ও কুসুমকে।
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল কুসুম। মুনার জীবনের এ পরিণতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওরা। গাড়ির মধ্যে নীরবতা নেমে আসে। দুই বাক্পটু বান্ধবীর মন একসঙ্গে হাহাকার করে ওঠে।
গাড়ি ছুটতে থাকে উত্তরার দিকে।
রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সের সামনে এসে দেখে মার্কেটের খোলা লবির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রেজা মামা। পাশে দাঁড়ানো যেবু আপা।
রিয়া চট করে নড়ে উঠল। দুজন কি একসঙ্গে এসেছেন? মনে প্রশ্ন হানা দিলেও ভাবার সময় পেল না। ওরা গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধনের গাড়ি ওদের সামনে দাঁড়াল। বাঁধন গাড়ি থেকে বেরিয়ে রিয়া আর কুসুমের কাছে আসে। পরে সবাই রেজা মামা ও যেবু আপার দিকে এগিয়ে যায়।
যেবু একটু আগ বাড়িয়ে ওদের সামনে দাঁড়ালেন।
রিয়ার হাত ধরে যেবু আপা বললেন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ রিয়া। তোমার বাপির অফিসে পুনমের চাকরি হয়ে গেছে। ভালো পোস্টে জয়েন করেছে সে। সম্মানজনক চাকরি পেয়ে পুনম নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল।
রিয়া বলল, আপা, থাক সে কথা। মুনার কথা বলুন। কী করা যায়? আমাদের মধ্য থেকে একজন কথা বললে ভালো হবে।
বাঁধন বলল, মুরুব্বি হিসেবে রেজা মামা কথা বলবেন। ফ্রেন্ডদের মধ্য থেকে তুই বলবি, রিয়া।
রিয়া বলল, না। রেজা মামা আর যেবু আপা কথা বলুক।
কুসুম বলল, রিয়া, ঠিক বলেছিস।
যেবু বললেন, সবার আগে আমরা বোঝার চেষ্টা করব, মুনা বিষয়টা কতটুকু জানে?
ইয়েস। মামা সায় দেয়।
মামার ইয়েস উচ্চারণের মধ্যে আছে যেবু আপার ওপর মামার আত্মসমর্পণের প্রমাণ। তা অনুভব করে চুপ হয়ে গেল রিয়া। অন্যরা সূক্ষ্ম বিষয়টা খেয়াল করেনি। বিষয়টা আত্মসমর্পণের প্রমাণ নাও হতে পারে। রিয়াই এমনটা মনে করছে কেবল।
যেবু উঠে বসেছেন বাঁধনের গাড়িতে।
সবার সামনে ইচ্ছাকৃতভাবে কি একটা কিছু লুকালো যেবু আপা? মামার গাড়িতে না উঠে বাঁধনের গাড়িতে উঠল কেন? নাকি তিনি একাই এসেছেন? রিয়ার মনে আবার প্রশ্ন আসে। প্রশ্ন লাই দেওয়ার সুযোগ পেল না ও।
তিনটা গাড়ি একসঙ্গে মুনার শ্বশুরবাড়ির গেটে এসে হর্ন দিলো।
বাসার গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে মুনার ননাস আদৃতা সামনে এসে বলল।
ওমা! আপনারা! না জানিয়ে এভাবে হুট করে এলেন যে!
বাঁধন ঝট করে বলে বসে, ওমা, মামা আসবে ভাগনিকে দেখতে, ফ্রেন্ড আসবে ফ্রেন্ডকে দেখতে, বলে-কয়ে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে নাকি?
কথার ধরন দেখে দমে যায় আদৃতা।
‘যারে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা’ প্রবাদটা আচমকা কাজ করেছে বাঁধনের মাথায়। নিজেকে সামলাতে পারেনি ও। কথার টোন মধুর হয়নি। মধুর হবে কোত্থেকে?
ইতোমধ্যেই তো এ বাড়ির চরণ বাঁকা হয়ে গেছে। বাঁকা চরণের জন্য তো বাঁকা টোনই আসবে।
বাঁধনের হাত চেপে ধরে রিয়া। ওদের মধ্যে কথা চলে হাতে হাতে: হাতে অন্যরকম চাপ দিয়ে রিয়া বলল, চুপ বাঁধন। মুখে কথা না।
বাঁধনের হাত রিয়ার হাতে ঝাঁকি দেয়।
ঝাঁকির অর্থ তুই চুপ থাক। ছেড়ে দেবো নাকি?
রিয়ার হাতের আরেকটা চাপ টের পায় বাঁধন। এ চাপ অনুনয়ের সংকেত পাঠায় ওকে। বাঁধন এবার চুপ হয়ে যায়। হাতে হাতে, চাপে চাপে কথা আপাতত থেমে যায়।
ওরা সবাই ভেতরে ঢোকে।
ড্রয়িংরুমে ছুটে আসে আরিয়া। মুনার ননদ আরিয়ার উচ্ছ্বাসে নরম হয়ে গেল বাঁধনের মন। একবার রিয়ার হাতে চাপ দেয় বাঁধন। রিয়া বুঝে ফেলে বাঁধন এখন খুশি। আরিয়ার অ্যাপ্রোচ বাঁধনের মন ভালো করে দিয়েছে।
আরিয়াকে উদ্দেশ করে যেবু বলেন, মুনাকে ডাকো। মুনা আসছে না কেন?
আরিয়া ছুটে গেল ভেতরে।
একটু পর ড্রয়িংরুমে আসেন মুনার শাশুড়ি, শহরবানু।
তাঁর চোখে বিস্ময়। মুখে হাসি টেনে রেখেছেন তিনি। বিস্ময়ের চাপে হাসিটা লাগছে বীভৎস। হঠাৎ এতগুলো গেস্ট একসঙ্গে দেখে ভিরমি খেয়েছেন তিনি।
একটু পর হাত ধরে ভাবিকে নিয়ে এলো আরিয়া।
ধীরপায়ে এগিয়ে এলো মুনা। পরনে লাল শাড়ি। মাথার ওপর শাড়ির আঁচল টানা। ড্রয়িংরুমে ঢুকে খুব ধীরে চোখ তুলে তাকাল মুনা, এ বাড়ির বউ।
চোখাচোখি হয় রিয়ার সঙ্গে।
চোখাচোখি হয় কুসুমের সঙ্গে।
চোখাচোখি হয় বাঁধনের সঙ্গে।
রিয়ার চোখ ফেটে যায়। বুক ফেটে যায়। চোখ বেয়ে নেমে আসে টলটল অশ্রুধারা।
কুসুমও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।
বাঁধনের চোখেও নামে কান্নার ঢল।
ওদের কান্না দেখে রেজা ও যেবুর চোখও টলমল করে ওঠে।
মুনা চোখ নামিয়ে নেয়।
মুনা কাঁদছে না।
মুনার চোখে পানি নেই। পাথরের চোখ নিয়ে ও বসে পাশের সোফায়। শহরবানু উঠে চলে গেলেন ভেতরে।
সঙ্গে সঙ্গে তিন বান্ধবী একসঙ্গে ছুটে আসে মুনার কাছে। মুনাকে জড়িয়ে ধরে রিয়া।
তিনজনই একসঙ্গে বলে, ভালো আছিস?
মুনার মুখে হাসি ফোটে। অন্যরকম শান্তির হাসি। হাসিতে মিশে আছে বিষাদের গোপন ঢেউ। ও জবাব দেয়, ভালো আছি।
তিনজন আরও ঘেঁষে বসে। চাতক পাখির মতো মুনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আরও কিছু জানতে চাচ্ছে তারা।
যেবু দূর থেকে দেখেন, রেজা দেখে, বোঝার চেষ্টা করে মুনার ভেতরের কথা। মুনা কি জেনে গেছে অম্লানের কীর্তি?
মুনা আবার চোখ তুলে সবাইকে দেখছে। ম্লানমুখে নির্মল হাসি ফুটে ওঠে আবার। হাসি নিয়েই বলল, আমার নতুন অতিথি আসছে। মা হতে চলেছি।
মুনার দিকে আবারও অবাক চোখে তাকাল রিয়া।
অবাক চোখে তাকাল কুসুম।
অবাক চোখে তাকাল বাঁধন।
প্রায় একসঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ওরা।
এ কীসের কান্না?
আনন্দের, নাকি বেদনার?
জানে না ওরা। বোঝে না ওরা।
আনন্দের সংবাদে কান্না দেখে মুনা অবাক হলো। দেখে রেজা মামা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দেখে যেবু আপার চোখেও আনন্দ নেই। বিস্ময়।
মা হওয়ার সংবাদে কি খুশি হয়নি ওরা?
এ ভাবনা নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে মুনা।
একটু পর সহজ হয়ে যায় রিয়া। সহজ হয় কুসুম। সহজ হয়ে বাঁধন বলে, কনগ্র্যাচুলেশন! বলেই তিনজনই আবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে! কাঁদতে থাকে।
একসময় ওদের কান্না থামে।
রেজা বলল, কনগ্র্যাচুলেশন।
যেবু বলল, কনগ্র্যাচুলেশন।
তিন ফ্রেন্ডের দিকে তাকিয়ে মুনা বলল, তোরা কেন কাঁদছিস বুঝতে পারছি।
রেজা একটু এগিয়ে এসে বলে, কী বুঝেছিস?
তোমরা বোধ হয় জেনে গেছ, অম্লানের আগের বিয়ের কথা।
রিয়া মাথা নাড়ে। বাঁধন মাথা নাড়ে। কুসুমও মাথা নাড়ে। রেজা ও যেবু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে শোনে মুনার কথা।
রিয়া বলল, তুই সব জেনেছিস মুনা?
ঠান্ডা গলায় মুনা জবাব দেয়, জেনেছি।
মেনে নিয়েছিস সব?
সবার দিকে আবার চোখ তুলে তাকাল মুনা। মুখে এবার ঝরঝরা হাসি ফোটে। অবিচল কণ্ঠে বলল, আমি আমার সন্তানকে মেনে নিয়েছি। আমার পেটের সন্তানের তো কোনো দোষ নেই। আমি তার জন্য বসবাসের ভূমি চাই। বেঁচে থাকার জন্য শান্তি নিশ্চিত করে যেতে চাই।
রেজা এবার সামনে আসে।
চল, আমাদের সঙ্গে চল। বাসায় চল।
মুনা বলল, না। এখন এ বাড়ি ছেড়ে যাব না।
রিয়া বলল, চল, প্লিজ।
মুনা বলল, না।
মামাকে উদ্দেশ করে বলল, বাপিকে বলো আমি ভালো আছি। মামণিকে বলো আমি সুখে আছি। সুখবরটা দিয়ো ওদের। বোলো, যে মায়া দিয়ে ওরা আমাকে বড়ো করেছে, একই রকম মায়া দিয়ে আমি আমার সন্তানকে বড় করব।
রিয়া আবার কাঁদতে থাকে।
বাঁধন আবার কাঁদতে থাকে।
কুসুম আবার কাঁদতে থাকে।
ওদের কান্না থামে না। রেজা ও যেবুর চোখেও আবার পানি আসে।
মুনার চোখে পানি নেই। ও স্থির। অবিচল। ওর ভেতর ফুঁড়ে জেগে-ওঠা শাশ্বত মাতৃত্বের কাছে হার মেনেছে জাগতিক চাওয়া-পাওয়া। জীবনের অন্ধকার সরিয়ে নতুন আলোয় জ্বলে উঠেছে মুনার মন। এ আলোয় ও দেখছে অনাগত সন্তানের বিজয়।
চলবে...
এসইউ/এমএস