সুজন হাজংয়ের চারটি কবিতা
হাজং রমণীরা যোদ্ধা, সংসারী
সন্ধ্যার প্রদীপ নিভে গেলে নেমে আসে অন্ধকার! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হাজং গ্রাম।
ঘুম ভাঙে পাখির কলকাকলিতে,
হাজং রমণীর সুখ যেন ভোরের আকাশে উঁকি দেয় নিশ্চুপ! বাতাসে শাঁ শাঁ শব্দে উঠোনজুড়ে গাছের বিবর্ণ পাতা ঝরে পড়ে। পাতার রান্নার ধোঁয়ায় চোখে জল আসে, আবার ফুঁ দেয় বাঁশের চোঙা দিয়ে, সহসা ধপ করে জ্বলে ওঠে আগুন!
আবার জেগে ওঠে বিদ্রোহী গ্রাম, আউশ আমন ধানের ক্ষেত।
হাজং রমণীরা যোদ্ধা, সংসারী।
তারা আজীবন ঘরমুখী, বিশ্বাসে পাহাড়ের মতো অবিচল।
চাষাবাদে হাজং রমণীর সুনিপুণ হাত, রাঙাপাথিনে অপূর্ব মেদহীন শরীর, কপালে সিঁদুর, এখনো দূ্র থেকে হাজং গ্রামে উলুধ্বনি শোনা যায়।
****
প্রজন্ম, একদিন মনে রেখো তাঁদের কথা
সভ্যতার ক্রমবিকাশে হাজংদের জীবন বিপন্ন...
তবুও টিকে থাকার লড়াইয়ে তারা সাহসী যোদ্ধা।
সংস্কৃতির শেকড়ে তারা মৌলিক;
এক গর্বিত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী।
ভূমির উত্তরাধিকারী হাজংরা এখন ভূমিহীন, প্রজন্ম হারিয়েছে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি, ভূমির নিরঙ্কুশ মালিকানা।
তাঁদের অধিকাংশ দেশান্তরী হয়েছিল সাতচল্লিশের দেশভাগে,
আবার চৌষট্টিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়;
পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, সাজানো ফুলের বাগান, গবাদিপশু, দেওঘর, শস্যক্ষেত রেখে।
কৃষক মুক্তির সংগ্রামে অবিচল, তীর ধনুক হাতে গর্জে উঠেছিল হাজংরা টংক, তেভাগা আন্দোলনে;
একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্তাক্ত চোখে, খালি পায়ে, সুপ্রশস্ত বুকে;
আবার পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে,
পাহাড়ি জনপদে প্রতিশোধের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল, গ্রামের উঠতি বয়সের হাজং যুবাদের চোখ, মুখ লাল হয়েছিল;
সেদিন পিতৃহত্যার বদলা নিতে নিরস্ত্র হাতের পেশীতে যেন মহিষাসুর বধ হয়েছিল।
নিজস্ব ভূখণ্ডে, লড়াইয়ে
ত্যাগ স্বীকার করতে করতে নীরবে ক্ষয়ে যাওয়া হাজংদের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষতে আসেনি কেউ!
হাজংদের জীবনের বঞ্চনার গল্প কেউ হয়তো জানে না, তাঁদের দেশের জন্য, মায়ের মমতার জন্য রক্তদানের ইতিহাস কেউ হয়তো জানে না।
প্রজন্ম, একদিন মনে রেখো তাঁদের কথা...
****
ভূমি
যে ভূমিতে এখনো পূর্বপুরুষদের রক্তের দাগ লেগে আছে, সে ভূমি হাজংদের।
যে ভূমিতে এখনো পূর্বপুরুষদের আত্মারা আর্তনাদ করে, সে ভূমি হাজংদের।
যে ভূমিতে একসময় হাজংরা খরার দিনে
গান গেয়ে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামাতো
সে ভূমি হাজংদের, আজ নেই।
****
গ্রামের ধুলোমাখা পথে হেঁটে যাবো আবার
নির্বাসনে নয়, ভালোবাসার টানে,
শেকড়ের সন্ধানে
গ্রামের ধুলোমাখা পথে হেঁটে যাবো আবার...
বিরিশিরি তোমার সৌন্দর্য চিরকালই আমাকে মুগ্ধ করে,
রাঙাপাথিন, দকমান্দা পরিহিত হাজং, গারো তরুণীর চোখে প্রেম
ও বসন্তের হাওয়া দোলা দেয়।
লাল গালিচায় নয়, নগ্ন পায়ে মৃত্তিকার বুকে হেঁটে যাবো...
দামা, দাদিক, রাং, খ্রাং, আদুরু, নাগড়া মিল্লাম, স্ফি আর বাঁশের বাঁশির সুরেলা টানে!
আবার সেখানে জেগে উঠবো ওয়ানগালা উৎসবে।
পাহাড়ের বুক চিরে ছোট ছোট ঝরনার ধারে বসে পাখির গান শুনবো...
আমার পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যগাথা
দোলপুজা, চরমাগা, মহিষাসুর বদ, রাসলীলা, দেউলি উৎসবে মন রাঙাবো...
অপেক্ষায় থেকো বন্ধুরা,
শেষ বিকেলের আড্ডা হবে সোমেশ্বরী নদীর তীরে, গারো পাহাড়ের চূঁড়ায়, রাণীখং, বিজয়পুরের স্বচ্ছ নীল জলের ধারে, আমার সেই সাদামাটির দেশে, আমার সেই মহুয়া মলুয়ার দেশে!
অতঃপর বাংলাদেশ-ভারতের শেষ সীমান্তে।
আবার কথা হবে বন্ধুরা,
সবুজ দূর্বাঘাস কিংবা সিলিকন বালির উপর দাঁড়িয়ে...
এসইউ/এমএস