আমিনুল ইসলামের কবিতা: বৈচিত্র্যময় চিত্রকল্প

আবু আফজাল সালেহ
আবু আফজাল সালেহ আবু আফজাল সালেহ , কবি ও প্রাবন্ধিক
প্রকাশিত: ০৫:৪৭ পিএম, ০৩ মার্চ ২০২২

প্রথাগত রীতির বাইরে এসে যে ক’জন কবি কবিতা-নির্মাণ করছেন, তাদের একজন কবি আমিনুল ইসলাম (জন্ম ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৩)। অবলীলায় তার কবিতায় ঢুকে পড়েছে আশপাশের শব্দাবলী—ইংরেজিই হোক বা দেশি শব্দই হোক। এত পরিমাণের ইংরেজি শব্দের ব্যবহার আমিনুলের আগে কোনো কবি ব্যবহার করেননি; করলেও পরিমাণে অনেক কম। তার প্রথম পর্যায়ের কবিতাগুলো নির্মাণ করেছেন বলে ধরে নিতে পারি। তারপর আমূল পরিবর্তন এসেছে দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতায়। ভাঙাচোরা করে একটা স্থিরতা এসেছে। এই স্থিরতা একেবারেই শেষ নয়। বিনির্মাণ চলছে। তবে কবিতায় একটা নতুন স্বর সৃষ্টি হয়েছে। আমিনুল ইসলাম কবিতায় নিজত্ব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করি। মনন ও মেজাজে তাই তিনি স্বতন্ত্রধারার কবি।

আধুনিক বাংলা কবিতার বিষয়-বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করতে বসে তিনটি গুণের কথা বলতে পারি—চিত্র, সময় ও গল্প। যদিও কবিতার বিষয় অবশ্যই এই তিনটি গুণে সীমাবদ্ধ নয়। কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে চিত্রকল্প। চিত্রশিল্প প্রথমত মানসিক ভাবনা বা ধারণা। এটার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে চিত্রশিল্প। সম্ভবত সবথেকে প্রাচীন শিল্প মাধ্যম এটি। আদিম মানুষ গুহাগাত্রে ছবি এঁকে তার প্রমাণ রেখে গেছেন। চিত্রশিল্প কবিতা বেশি আলোচিত। দৃশ্যমানতা নিঃসন্দেহে তার একটি বড় কারণ। আঙ্গিকের নিরিখে চিত্রশিল্পের বিবর্তন কবিতার তুলনায় অনেক বেশি বিস্তৃত, সুস্পষ্ট এবং গ্রাহ্য। কবিতা পড়ে মানসপটে একটা চিত্র অঙ্কন হয়ে যায়।

জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতা পড়েই মনে হয় সেগুলোর চিত্রকলায় রূপান্তর করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। আমিনুল ইসলামের কবিতায় বৈচিত্র্যময় চিত্রকল্প দেখা যায়। সময় সচেতন কবিও তিনি। কবির অনেক কবিতায় গল্পচিত্র বিদ্যমান। এ তিনটি গুণকে কবিতায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমিনুল ইসলাম বহুমুখী-পন্থা প্রয়োগ করেছেন। এর অনেক উপাদান আবার তার নিজস্ব। তার নিজস্ব ও শক্তিশালী দিকগুলো আলোচনার মাধ্যমেই এগিয়ে নেব।

কবি আমিনুল ইসলামের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: তন্ত্র থেকে দূরে; মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম; শেষ হেমন্তের জোছনা; কুয়াশার বর্ণমালা; পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি; স্বপ্নের হালখাতা; প্রেমসমগ্র; জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার; শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ; হিজলের সার্কিট হাউস প্রভৃতি। সমালোচক যাদব চৌধুরী বলেছেন, ‘কবিতাকে যদি কবিতা হয়ে উঠতে হয়, তাহলে সেই কবিতায় উপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের যে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে, এ কথা মেনে নিতেই হবে (কবিতায় শব্দের ব্যবহার)।’ আসলে, কবিতা হয়ে ওঠে আপনা-আপনি। বললেই কবিতা লেখা যায় না। আমিনুল ইসলামের কবিতা মালায় মালায় গাঁথুনি হয়ে পুষ্টিলাভ করেছে। আনমনেই যেন পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছাতে পারছে।

কবিতা পাঠে আনন্দ পাই। শুরু হয় আনন্দ দিয়ে। কবিতা পাঠ শেষ হলে একটি বার্তা পাই। তাতে আমরা প্রজ্ঞাবান হতে পারি। রবার্ট ফ্রস্টের মতে, কবিতা Begins in delight and ends in wisdom। আমরা জানি, গাঁথুনি-চিত্রকল্প মিলেই চমৎকার কাব্যশৈলী সৃষ্টি হয়। রচনার উৎকর্ষতার জন্য অলংকার প্রয়োগের যৌক্তিকতা অনেক বেশি। ভালো-সাহিত্যের প্রধান গুণ হচ্ছে, পাঠককে লেখকের কাছে নিয়ে যাওয়া। তাই তথাকথিত দুর্বোধ্যতা ছেড়ে খুব সাধারণ কথার ছন্দে কবিতা রচনা করলে পাঠকের মন জয় করা সম্ভব হবে। Meditation before writing a poem আমিনুলের কবিতার বড় বৈশিষ্ট্য। তার কবিতা পড়লে পাঠক আনন্দ পাবেন এবং একই সঙ্গে প্রজ্ঞাবান হতে পারবেন। অলংকার প্রয়োগেও সফল তিনি। উপমার প্রয়োগের উপর কবির প্রাগ্রসর সৃষ্টিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। হাঙরের অনিদ্রার মতো, ভাতের হাঁড়ির মতো, আঁধারের প্রচ্ছদে নাটকের পর্দা ওঠার মতো ইত্যাদি উপমার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুপ্রাস, সমাসোক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। ধূসর দু-চোখ ফেঁড়ে ঢুকে যায়, খসে পড়ে অন্ধকার, আমাজান রাত হাঁটে ইত্যাদির মতো সমাসোক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। অন্ত্যানুপ্রাস (চরণান্তিক মিল) এখন খুব কম দেখা যায়। কবি আমিনুল ইসলাম এ ক্ষেত্রেও দক্ষ। চরণান্তিক মিল দিতে গিয়ে কবিতার বক্তব্য খণ্ডিত হয়নি বা সীমাবদ্ধতা আসেনি। এ গুণ আসলেই ব্যতিক্রমী। এ ব্যাপারে কবি সিদ্ধহস্ত।

কবিতার আধুনিক নামকরণ, দাপ্তরিক বা ডিজিটাল কাব্যস্বর নির্মাণ, বিষয়ের বৈচিত্র্যময়তা ও চিরন্তনতা, সমসাময়িক ভাবনা এবং বিশ্বসাহিত্যের কবিদের সঙ্গে চিন্তার সেতুবন্ধন কবিকে অনন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। ‘কুয়াশাপ্রিন্ট’, ‘বিকিনি রাত এবং ফুটো কনডম’, ‘বহুমূত্র বর্তমান ভেঙে পড়া ভবিষ্যৎ’, ‘আমার শরৎ দিন বিলি কাটে আকাশের চুলে’, ‘পাখির টক শো’, ‘ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র’, ‘দ্বন্দ্ব সমাস’ প্রভৃতি কবিতার শিরোনাম দেখেই অন্যরকম অনুভূতি চলে আসে। আধুনিক ও উত্তরাধুনিক জীবন-ভাবনা ও চিন্তায় জারিত আমিনুল ইসলাম রোমান্টিক মনের এক চির আধুনিক কবি। ভালোবাসার নতুনত্ব, এমন কিছু কবিতার শিরোনাম: ‘ভালোবাসার ইন্টারনাল অডিট রিপোর্ট’, ‘ভালোবাসা ঘুমিয়েছে—জেগে আছি আমি’, ‘চুমু’, ‘ঢাকার মেয়ে চন্দনাকে’, ‘বকুল আমার বান্ধবীর নাম’, ‘ভালোবাসার আকাশে নাই কাঁটাতারের বেড়া’, ‘অনুর্বর সময়ের চুমু’, ‘আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্ট’, ‘তোমার ভালোবাসা অথবা ধান্ধাবাজির পিএইচডি’, ‘দিঘি-দিঘি মন নদী-নদী ভালোবাসা’, ‘তোমার হোমিওপ্যাথ কাব্যতত্ত্ব’, ‘হে মেয়ে, ভালোবাসাও একটা কাজ’। এ দৃষ্টিভঙ্গি আমিনুল ইসলামের একান্ত নিজস্ব। তিনি অনায়াসে এসব শব্দ ব্যবহার করলেন। এই সাহস তাকে পূর্বজ এবং সমসাময়িকদের থেকে পৃথক করে দিলো।

‘চিঠির উত্তর দাও বা না দাও, ভালো তো বাসোই;/ মুখে ‘না’ ‘না’ শব্দ নিয়ে গাল পেতে দাও—/ আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের সামনে (চুম্বন নিয়ে লেখা যে কবিতার সকল চরিত্র কাল্পনিক)’। চুমু নিয়ে কবির বিশেষ বার্তা। ‘চুমু একটি ফার্স্ট গিয়ারের নাম, চুমু একটি নিবন্ধন নম্বর/ অতঃপর—/ অটো-ইস্টাব্লিসমেন্ট অব এভরিথিং, চুমু একটি অব্যর্থ এসএমএস, চুমু একটি রোমান্টিক সুইচের নাম/ যেখানে টিপ দিলে/ খুলে যাবে/ ভালোবাসার হাজারদুয়ারি মহল (চুমু)’ ইত্যাদি বাগশৈলী দেখা যায়। Art for art’s sake বা নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে বর্তমান কবিতার একটি অনুষঙ্গ। আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্যতম উপাদান বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সৌন্দর্য। তার কবিতা পড়লে কান যেমন সন্তুষ্ট হয়; তেমনি চোখও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। মানসপটে এক গভীর ভালো লাগার চিত্র সৃষ্টি হয়।

কবির লিরিকধর্মী কবিতাগুলোও চমৎকার। পাঠককে চমৎকারিত্ব দেয়, মুগ্ধ করে। অন্যরকম ভালো লাগা তৈরি করতে সক্ষম। অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস হচ্ছে প্রকৃতি। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান কবিকে হাতছানি দেয়। কবি সেগুলো কবিতায় রূপান্তর করেন। যিনি যত ভালোভাবে (পরিপূর্ণতার আলোকে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তিনি তত সার্থক কবি। কবি আমিনুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে অনেক সফল বলে মনে করি। তার কবিতায়, চিত্রকল্পে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির নদী, পাহাড়, বন-বাদাড়, আকাশ, বাতাস ইত্যাদি কবিতায় মালার গাঁথুনি হয়েছে।

আমিনুল ইসলামের লিরিকধর্মী ও ভূগোলধর্মী কবিতাগুলোও চমৎকার। যেমন: ‘আমাকে মনে রাখবে/ গরিবের বউয়ের মতো এক ভূগোল’, ‘বাঁশি বাজে সর্বনাশের বাঁশি বাজে ভাঙার/ বাঁশি বাজে আক্রমণের বাঁশি বাজে হানার (বাঁশি)’, ‘আয়না থেকে চোখ সরিয়ে আমার চোখে রাখো/ আমার চোখের দৃষ্টিটুকু তোমার চোখে মাখো (ড্রেসিং টেবিল)’, ‘কখন তুমি আকাশ হলে/ অন্ত্যমিলের মোহনায়/ ঢেউয়ের কাছে জেনে দেখি/ নদীর কোনো দ্রোহ নাই! (প্রেমের কবিতা)’ ইত্যাদি। আমিনুলের কবিতায় নদীও নারীর মতো কথা কয়। নদী তার কাছে মায়ের মতো, প্রেমিকার মতো। ‘অতএব এসো, আমরা দুজনে মিলে/ একটা পাহাড় এবং একটি নদী কিনে ফেলি;/ তখন সমুদ্রটা ফ্রি পেয়ে যাব (আমরা দুজনকে ভালোবাসব, কেন?)’—এখানে পাশ্চাত্যধারার কবিতার মতো তেজস্বীর সন্ধান পাই। কবি আমিনুলের এমন অনেক কবিতা রয়েছে যা ইউরোপীয় স্টাইল ও আভিজাত্য ধরা দিয়েছে। মহানন্দা নদীর তীরে কবির শৈশব কেটেছে। মহানন্দা ও নদীর প্রসঙ্গ এসেছে অনেক কবিতায়। শেলির ইতালিয়ান চিত্রকল্প যেন আমিনুলের নদী, প্রতিবেশ। শেলির ইতালিয়ান চিত্রকল্প আর আমিনুলের নদীবিষয়ক ও ভূগোলের চিত্রকল্প যে একই সূত্রে নির্মিত—মিলেমিশে যেন একাকার।

কবিতার ভাঙাগড়ার কাজটি ঠিকই করে যাচ্ছেন কবি আমিনুল ইসলাম। চিত্রকল্পে নতুন উপাদান যোগ করছেন। উপমা-উৎপ্রেক্ষা বা অলংকারেও নতুন শব্দ, শব্দসমষ্টি বা শব্দশ্রেণি নির্মাণ করছেন। নতুন শব্দ বা শব্দশৈলী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। আমিনুল ইসলামের কবিতায় নতুনের স্বাদ পাওয়া যায় তার অনেক কবিতায়। কবিতায় শব্দের নানাবিধ ব্যবহার কবি থেকে কবিকে আলাদা করে। ছোট ছোট চিত্রকল্পের কবিতা আমিনুলের কবিতাকে আলাদা করেছে। টি এস এলিয়টের কবিতায় ছোট ছোট চিত্রকল্প লক্ষ্য করা যায়। উজ্জ্বল ঘুমভাঙা এক কিশোরের চোখ, ধুয়ে দেয় তার প্রত্নরাঙা পা, রংপুর সুগার মিলের আখের ছোবড়া, তার ঠোঁটের লালা শুক্রকীট হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, জানাশোনা দুটি নদী রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল, শ্রাবণের এক যমুনা, দাদুর দুচোখ-ছোঁয়া পশমি গোধূলি, গন্ধম রক্তাক্ত, ইয়েস-স্যার-মার্কা সুখ, জগৎ বেড় জালের মতো, জীবনানন্দ-বনলতার ফিসফিসানি, একপক্ষীয় সান্ধ্য অধিবেশন, চাঁদ ডোবার শব্দে ছিন্ন, সাঁঝের ঊরুতে, বুশের ইচ্ছার মতো রোগের বিস্তার, যিশুর ফুঁ, নগ্ন পায়ে চুমু, বিচূর্ণ জলের আয়না, পৃথিবীর ঠোঁটে গন্ধ, স্বপ্নশাসিত শিশুকাল ইত্যাদির মতো নতুন নতুন ধারণা ও চিত্রকল্প পাঠককে নতুনের স্বাদ দেয় ও বিমোহিত করে।

তার কবিতায় বিশেষণের চমৎকার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিশেষণের ব্যবহারের উপর কবিতার শৈলী বা মান অনেকাংশে নির্ভর করে। বৈচিত্র্যময় বিশেষণের ব্যবহার কবি আমিনুল ইসলামকে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। হাটভাঙা হাটুরিয়া, সর্বনাশের বাঁশি, শ্যামার আহত কণ্ঠ, সাঁঝরঙা, ধাঁধারঙ, দাঁতাল স্তব্ধতা, ঘুমযুক্ত লোকালয়, গেরিলা আঙুল... ইত্যাদির মতো বিভিন্ন বিশেষণ কবিতায় মাধুর্য এনেছে। কবিতার ভাষার স্পষ্টতা কবি আমিনুল ইসলামকে অনন্য করেছে। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগ করে যাচ্ছেন কবিতায়। এ গুণ কবিতাকে পাঠকের কাছে সহজেই নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। পেশাগত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার প্রয়োগও কবিতায় দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তিনি আবার কিছু দাপ্তরিক ও পরিভাষা শব্দের ব্যবহার করছেন, যা বক্তব্যকে নতুন ব্যঞ্জনায় বলিষ্ঠ দানে সক্ষম হচ্ছে। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বেশ বোঝাপড়া রয়েছে আমিনুল ইসলামের। তার কবিতায় বাক্যটির যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে।

কবি আমিনুল ইসলাম কবিতা নির্মাণ ও বিনির্মাণের ক্ষেত্রে কাব্যশৈলী/স্টাইলে পুনঃপুনঃ পরিবর্তন আনয়ন করেছেন; বিভিন্ন উপাদানে নতুনত্ব এনেছেন, চিত্রকল্পেও একই কথা প্রযোজ্য। বিভিন্ন অলংকার ও চিত্রকল্প প্রভৃতির যথাযথ প্রয়োগ করেছেন কবিতায়। এ ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক। চোখ বা দেখার সৌন্দর্য যা মনের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে নন্দনতত্ত্বের নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে গিয়ে কবি আমিনুল শব্দ ব্যবহারের জাদুতে দর্শন, শ্রবণ, স্বাদ, স্পর্শ প্রভৃতিকে বেশি পরিমাণে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন। আমেরিকার সমাজের (কবিতায় প্রচলিত) ‘কথোপকথন স্টাইল’ উঠে এসেছে তার অনেক কবিতায়। তেমনি আমিনুল ইসলামের কবিতায় ‘কথোপকথন ভঙ্গি’ পাঠককে বিমোহিত করে। আধুনিক কবিতায় মনীষীদের উদ্ধৃতির ব্যবহার দেখা যায়। আমিনুল ইসলামের কবিতায়ও উদ্ধৃতির ব্যবহার দেখা যায়।

রচনার মহত্ব ও ঐশ্বর্যমহিমা বা প্রভাবিত ক্ষমতা তৈরি করতে রূপকল্পনা কার্যকরী পদক্ষেপ। এটি একটি মানসিক ধারণা। আধুনিক কবিতায় রূপকল্প অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। তাই কবিতায় কল্পনার পাখা জুড়ে দিতে হবে। কল্পনা যতদূর বিস্তৃত হবে ততদূরই কবিতার সার্থকতা। পি বি শেলি বলেন, ‘poetry is the expressions of the imagination (A defence of poetry)’। কবি আমিনুলের এমন অনেক কবিতা রয়েছে যা ইউরোপীয় স্টাইল ও আভিজাত্য ধরা দিয়েছে। তার কবিতায় পাশ্চাত্যধারার কবিতার মতো তেজস্বীর সন্ধান পাই। পুরাতন চিত্রকল্প পাঠককে একঘেয়েমিতে অনাসক্ত করে তোলে। ফলে নতুন নতুন চিত্রকল্প নির্মাণ ও অলংকারে নতুনত্ব আনা সত্যিকারের কবিত্ব। পাঠক খোঁজে নতুন নতুন ইমেজ। আর আমিনুলের কবিতায় নতুন নতুন ইমেজ, চিত্রকল্প লক্ষ্য করা যায়। যা তার কবিসত্তার অন্যতম গুণ।

তিনি লেখার মাধ্যমে নিজস্ব একটি কাব্যস্বর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। দৈনন্দিন শব্দের পাশাপাশি দাপ্তরিক কিছু শব্দ যোগ হয়েছে তার কবিতায়। আমিনুল ইসলাম ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রকৃতিসন্ধানী কবি। তার এ সন্ধানে শেকড়মুখিনতার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রেও শেকড়মুখিনতা লক্ষ্য করা যায়। ঐতিহ্যের পাশাপাশি ইতিহাস ও প্রযুক্তিগত শব্দাবলীর ব্যবহার গভীর ব্যঞ্জনাময় হয়েছে। কবিতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক শব্দাবলী বা টার্ম অনায়াসে ঢুকে পড়েছে তার অনেক কবিতায়। তার এমন কবিতা পড়লে পাঠককরা আনন্দ পাওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অনেক অজানা খবর পেয়ে যাবেন। একজন বড় কবির কাব্যকর্মের উৎকর্ষ নির্ভর করে বিষয়-বাছাই, নান্দনিক উপাদান (শব্দ, অলংকার ইত্যাদি) ইত্যাদির জুতসই প্রয়োগের ওপর। ‘তার বন্যা-বন্যা কণ্ঠ আমার স্যামসাং সেলফোনে’, ‘কবিতা লিখে লিখে সে হয়ে উঠেছে আধখানা সিলভিয়া প্লাথ’, ‘মৌরসি রক্তের মতো’, ‘জেনিফার লোপেজের মিনিস্কার্ট’ ইত্যাদির মতো নান্দনিক শব্দ ও অলংকার আমিনুলের কবিতায় কোমলতা ও মাধুর্যের পাশাপাশি পাঠককে বাড়তি ব্যঞ্জনা উপহার দিতে সক্ষম।

কবিতা জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যকে তুলে ধরে থাকে। কবি একটি সুরেলা পাখির মতো অন্ধকারে থেকে মানুষকে আনন্দ দেয়। কবি বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে থেকেও পাঠককে যথার্থ শব্দচয়নে জাগিয়ে তোলেন, সমস্যা চিহ্নিত করেন এবং সমাধানের মন্ত্র দেন। আমিনুল ইসলামের কবিতা ধারণ করেছে আমাদের সমাজসত্তার সামগ্রিক বিবর্তন। তার কবিতার বিষয়বস্তু বিবিধ এবং বৈচিত্র্যময়। শস্য-শ্যামল ও নদীমাতৃক বাংলাদেশের ছবি প্রকৃতি ও মানুষের কথা উঠে এসেছে তার কবিতায়। পাশাপাশি শহুরে-জীবন, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়, প্রতারণাপূর্ণ জীবনবৈশিষ্ট্য ইত্যাদি কবিতার পঙক্তিতে পরিণত করতে পেরেছেন তিনি। বিচিত্র শব্দের ব্যবহার আধুনিক কবিতায় অন্যতম অনুষঙ্গ। সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফারসি দেশি, পরিভাষা, প্রযুক্তিগত বিভিন্ন শব্দ ব্যবহারের কৌশলও দারুণ। ‘যতদূর অভিবাসন, ততদূর মাতৃভাষা/ যতদূর মাতৃভাষা, ততদূর মাতৃভূমি (অভিবাসীর গান)’—তার এ কবিতাংশের মতোই তার কবিতা ছড়িয়ে পড়ুক ততদূর, মাতৃভূমি যতদূর।

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।