আবুল হাসানের কবিতা: নান্দনিক ভাষায় বিদ্রোহী উচ্চারণ
‘এমন সময় আসে/ বিপ্লবীর মন শুধু নয়, বনভূমি সেও বড় বেদনায়/ বিদ্রোহ জমিয়ে রাখে গাছে গাছে সবুজ পাতায় (বন্দুকের নল শুধু নয়)’—এমন উচ্চারণ কবি আবুল হাসানের (৪ আগস্ট ১৯৪৭-২৬ নভেম্বর ১৯৭৫)। আবার ‘আলেখ্য’ কবিতায় উচ্চারণের তীব্রতা আরও ঘন। ‘চে গুয়েভারার মতো দাড়িপূর্ণ ছবি/ ...তার বন্দুকের নলে ধ্রুব আত্মশক্তি/ এত তীব্র ছিল।/ বাহুতে ছিল পেশীকথা ছন্দে/ বেজে ওঠে রাজদ্রোহী গর্জনের কাঠ’। দুটি কবিতাংশেই ব্যতিক্রম সুর। উপমা-অলংকার ব্যবহারে নতুনত্ব। এমন কবিতা অনেক আছে কবি আবুল হাসানের। এসব কবিতায় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি, যা আগে দেখা যায়নি।
কবি আবুল হাসান স্বল্পসময়ে আধুনিক কবি। তিনি পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া; সাহিত্যিক নাম আবুল হাসান। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়ার বর্নি গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। তিনি সত্তর দশকের গীতল কবি হিসাবেও জনপ্রিয়। ষাটের দশকের অন্যতম জনপ্রিয়, মেধাবী কবি-প্রতিভা আবুল হাসান। মাত্র ২৮ বছরের জীবনকাল। এর মধ্যে তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত কিছু কবিতা। এছাড়াও রয়েছে গল্প ও কাব্যনাটক। মাত্র এক দশকের কাব্যসাধনায় তিনি আধুনিক বাংলার ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। তাঁর প্রকাশিত তিনটি গ্রন্থ হচ্ছে: রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭২), যে তুমি হরণ করো (১৯৭৪), পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)। এছাড়া আবুল হাসান গল্প-সংগ্রহ (১৯৯০), ওরা কয়েকজন (কাব্যনাট্য, ১৯৮৮) উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮২ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
কবি আবুল হাসানের কবিতায় শৈল্পিক ভাষা অনন্য। উপমা-অলংকার ও চিত্রকল্প ব্যবহারে পারঙ্গমতার পাশাপাশি সার্থকতারও পরিচয়ও রেখেছেন। এখানে কবি সার্থক ও অনন্য। তাঁর কবিতা পাঠ করে মনে হয় কবিতাগুলো শুধু নির্মাণ করার চেষ্টা তিনি করেননি বরং কবিতা হয়ে উঠেছে আপনা-আপনিই। আশার পাশাপাশি হতাশার কথাও এসেছে তাঁর কবিতায়। অনেকের মতো নষ্টালজিয়ায়ও ভুগেছেন তিনি। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরায় যেতে পারে: ‘...ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও’—কী দারুণ ব্যঞ্জনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে (ঝিনুক নীরবে সহো, পৃথক পালঙ্ক)’, ‘আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি/ জীবনের অস্তিত্বে মরছি... (অসভ্য দর্শন, রাজা যায় রাজা আসে)’, ‘...বাঘিনীর মুখে চুমো খেয়ে আমি বলেছি আমাকে উদ্ধার দাও।/ সক্রেটিসের হেমলক আমি মাথার খুলিতে ঢেলে তবে আমি পান করেছি মৃত্যু (গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর, যে তুমি হরণ করো)’।
প্রেমের কবিতায়ও এনেছেন নতুনত্ব। অনেক কবিতায় নিয়ে এসেছেন রোমাঞ্চ; প্রেম-বিরহের দারুণ আবহ! প্রেমের পাশাপাশি দ্বন্দ্বও দেখেছেন। আবেগের মধ্যে বাস্তবতা বুঝে নিতে চান তিনি। এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরতেই পারি—‘তোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ পড়ে আছে দ্যাখো প্রশান্ত টেবিলে/ ...শিশিরের মতো নম্র অপেক্ষার কষ্টগুলি ঝেড়ে ফেলেছি আমার অ্যাস্ট্রেতে... (প্রতীক্ষার শোকগাথা, রাজা যায় রাজা আসে)’, ‘...কতটুকু সংযম আছে তোমার?/ এত যে ভালোবাসতে চাও/ তার কতটুকু উত্তাপ সইতে পারবে তুমি? (প্রশ্ন)’, ‘...তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারশ/ ...আমি কোনদিন/ কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ/ আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো (প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী)’।
শক্ত শক্ত ও রক্তজবার মতো উচ্চারণে কবি আবুল হাসান কবিতার বুনন দিয়েছেন। শুধু বুননই দেননি, শিল্পগুণে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কবি আবুল হাসানের কবিতায় শব্দ, বাক্য ও স্বরে ভিন্নতার পাশাপাশি নান্দনিকতা আছে। নান্দনিকতার আবহে বিদ্রোহী সুরও বাজিয়েছেন তিনি। আশার পাশাপাশি যেমন নিরাশা-হতাশা থাকে, তেমনই বৈষম্যও বিদ্যমান। নারী-পুরুষ ও ধনী-গরিব বৈষম্য সর্বত্রই বিরাজমান। কবি আবুল হাসানের এমন বৈষম্যের ক্ষেত্রে চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে নানান কবিতায়। যেমন- ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া (তোমার চিবুক ছোঁব না, যে তুমি হরণ করো)’, ‘অতটুকু চায়নি বালিকা।/ অত শোভা, অত স্বাধীনতা।/ চেয়েছিল আরও কিছু কম, ...একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী (নিঃসঙ্গতা, যে তুমি হরণ করো)’, ‘ছেলেটি খোঁড়েনি মাটিতে মধুর জল।/ মেয়েটি কখনো পরে নাই নাকছাবি।/ ...ছেলেটির চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,/ মেয়েটির মুখে কত মায়া মৌনতা... (যুগলসন্ধি, পৃথক পালঙ্ক)’ ইত্যাদি।
কবিতায় কবি ব্যবহার করেছেন প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান, লোকজ উপাদান আর চারপাশের উপাদান; পাখির কলকাকলি, দিনের মুখরতার চিত্রায়িত আবহের শব্দাবলী। হতাশা ও হাহাকারের ছবিও ফুটে উঠেছে আবুল হাসানের কবিতায়। ‘ক্ষুধা’ নিয়ে রাজনীতি। কিন্তু এ সমস্যা নিয়ে আন্তরিক প্রচেষ্টা খুবই কম। যা আছে তার বেশিরভাগই লোক-দেখানো। কবির কলম থেকে বের হয়েছে অমৃত শব্দাবলী। বাঙ্ময় হয়েছে তাঁর কবিতা। যেমন ধরি, ‘আমি জানি না দুঃখের কী মাতৃভাষা/ ভালোভাষার কী মাতৃভাষা/ বেদনার কি মাতৃভাষা/ যুদ্ধের কী মাতৃভাষা/ শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ/ আর এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা (মাতৃভাষা)’।
কবির শিল্পবোধ দারুণ অনুভূতিময়। কবির শিল্পভাবনা এমন ‘শিল্প হল স্বাতীর হাতের ঐ কমলালেবু/ লজ্জায় আনত মুখ রোদের ফড়িং/ শিল্প হলো স্বাতীর কানের রিং (স্বাতীর সঙ্গে এক সকাল)’—কী দারুণ ভাবনা! এমন ভাবনাগুলোই বলে দেয় কবি আবুল হাসানের রুচিবোধ; তাঁর অনুভূতিগুলো কেমন! আমাদের স্বাধীনতা আমাদের অস্তিত্ব। কবির অমোঘ উচ্চারণ—‘...কেবল পতাকা দেখি/ কেবল উৎসব দেখি,/ স্বাধীনতা দেখি,/ তবে কি আমার ভাই আজ/ ঐ স্বাধীন পতাকা?/ তবে কি আমার বোন, তিমিরের বেদিতে উৎসব? (উচ্চারণগুলি শোকের)’।
শব্দ বা ভাষা প্রয়োগের প্রাঞ্জলতা কবির মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। কবি আবুল হাসান শুধু যৌবনের উদ্দামতাই তুলে ধরেননি; জীবন, জীবন বোধ, তার পারিপার্শ্বিকতার জটিলতা, সমকালীন রাজনীতি, স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের হতাশা নিয়েও কবিতা রচনা করেছেন। সময়কে এড়িয়ে যাননি। আবুল হাসানের অসংখ্য কবিতার পঙক্তি কবিতাপ্রেমী মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। কবিতা ভালোবাসেন, কবিতায় যাপন। তিনি কোনো সংগঠন তৈরি করেননি। তাঁকে কোনো দলে যোগ দিতে হয়নি। কোনো গোষ্ঠীর হাতে কবিতা তুলে দিয়ে যেতে হয়নি। আবুল হাসানের কবিতা যতই আলোচনায় আসবে; ততই তাঁর কবিশক্তির বহিঃপ্রকাশ হবে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
এসইউ/এমএস