হুমায়ূন ভাইয়ের রাগ এবং অনুরাগ
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
আমার বাসায় তখন কোনো ফোন ছিল না। অফিস থেকে প্রতিদিন শামসুর রাহমান আর হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করতাম। তখন হুমায়ূন ভাই শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট। প্রায়ই ফোন ধরতো ছোট্ট মেয়ে শীলা। হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে তখন আমার খুব খাতির। শুধু তাঁর সাথেই নয়; গুলতেকিন ভাবী, আহসান হাবীব শাহীন—সবার সাথেই পারিবারিক সম্পর্ক। পল্লবীতে আয়শা খালাম্মা থাকতেন ছোট ছেলে আমাদের বন্ধু শাহীনের সাথে। ফলে জালের মতো সবার সাথে জড়ানো ছিল সম্পর্ক। জাফর ভাই নিউ জার্সি থাকলেও তাঁর সাথে যোগাযোগ ছিল ‘সাপ্তাহিক প্রবাসী’ সূত্রে। তিনি ওই পত্রিকার অন্যতম উপদেষ্টা আর আমি ছিলাম বাংলাদেশ প্রতিনিধি।
যা হোক। আমার ‘তুমি’ বই হুমায়ূন আহমেদ আর ইমদাদুল হক মিলনকে উৎসর্গ করেছি। হুমায়ূন ভাইও ‘অমানুষ’ আমাকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ‘আমার আছে জল’ এবং ‘সবাই গেছে বনে’ বাংলাদেশ বেতারে নাট্যরূপ দিয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা হয় আমাদের। ১৯৮৫ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ আড্ডার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকের প্রথম আড্ডা-আলোচনা হয় কবি আতাহার খানের শ্যামলীস্থ চারতলা বাসায়। সেই দিন হুমায়ূন ভাই একটা অদ্ভুত বাজি দিলেন—যদি কেউ সমস্ত শরীর দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগানো পা তুলে বিপরীত এক পায়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে নাটকের প্রথম সম্মানি তাকে দিয়ে দেবেন। সেদিন আমরা কেউ সেই বাজিতে জিততে পারিনি!
এরকম অনেক মজার এবং মধুর স্মৃতি আছে তাঁর সাথে। সেই সাথে তিক্ত স্মৃতিও আছে। যে কারণে তাঁর সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং দূরত্ব তৈরি হয়। শুধু তা-ই নয়; একপর্যায়ে আমাকে উৎসর্গ করা ‘অমানুষ’ থেকে বাদ দেন।
এক সকালে হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘দুলাল, দুপুরে স্টেডিয়ামে আসো। একসাথে খাবো’। যথারীতি গেলাম। লাঞ্চ করতে করতে বললেন, ‘ইনকিলাব ভবনে যাবো। আতাহারকে এই গল্পটা দেবো-পূর্ণিমার জন্য। চলো’।
আমি তো অবাক! বললাম, ‘আপনি, মওলানা মান্নানের কাগজে লিখবেন? আপনার বাবাকে না মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা হত্যা করেছে! আপনি না একজন শহীদের সন্তান! আপনি সৌরভ, আগুনের পরশমণি, ১৯৭১’এর মতো উপন্যাস লিখেছেন’!
রেগে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার পাঠক, পয়সা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দরকার’।
হুমায়ুন ভাই সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। ভীষণ বিরক্ত হলেন, রেগে গেলেন। ভাত খাওয়া শেষ না করেই হাত ধুয়ে বিল দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন। আমি বোকার মতো বসে রইলাম।
তখন আমি কাজ করি জব্বার (বর্তমান মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার) ভাইয়ের সাপ্তাহিক ঢাকার চিঠিতে। জব্বার ভাই আর হুমায়ূন ভাই একই এলাকার মানুষ এবং তারা পরস্পরের বন্ধুও বটে। ঘটনা শুনে জব্বার ভাই হাসলেন এবং বললেন, ‘আমার পাঠক, পয়সা এবং পৃষ্ঠপোষকতা দরকার’... এই শিরোনামে ঢাকার চিঠিতে আগামী সংখ্যার কভার স্টোরি করে দাও।
যথারীতি তা-ই হলো এবং হুমায়ূন ভাই আমাকে মনে মনে ব্লক করে দিলেন। দীর্ঘকাল পর তাঁর সেই অভিমান ভেঙেছিল নিউ ইয়র্কের মুক্তধারার বইমেলায়। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে শাওন মঞ্চে গান গাইছেন। হুমায়ূন ভাই ছেলেকে কাঁধে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন। আর আমাকে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কেন কানাডায় চলে গেলে?’ দেশে গেলে ধানমন্ডির বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তখন এক বুড়ো চাচা মিয়া এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার নাতি নাকি?’
হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘না। আমার পুত্র!’
আমি বললাম, ‘আপনি কি এখনো আমার উপর রাগ!’
তিনি আমাকে স্নেহের অনুরাগে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে বললেন, ‘না রে না। ঢাকায় গেলে বাসায় এসো।’
টরন্টো, ১৩ নভেম্বর ২০২১
এসইউ/এএসএম