মায়াবতী: পর্ব ২০
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—
আঠারো.
চারুকলা প্রাঙ্গণজুড়ে চিত্তহারা উৎসবের আয়োজন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল রিয়া। মুগ্ধচোখ ঘুরেফিরে খুঁজছে কাকে, জানে না ও।
কুসুমকে কল করল। না। মোবাইল বন্ধ। ব্যাপার কী, বন্ধ কেন?
মোবাইল ক্যান নট বি রিচড।
মন খারাপ হয়ে গেল রিয়ার। একা একা ঘুরে ঘুরে চারপাশে খুঁজতে লাগল কুসুমকে। রেজা মামাকেও খুঁজছে মন।
মুনা বলেছিল, মামাকে ফোন করে জানিয়ে দেবে বকুলতলায় আসার জন্য। জানিয়েছে? জানা হয়নি। মামা এসেছেন? বুঝে উঠতে পারছে না। খুঁজে পাওয়া যায় কি না দেখা যাক। যাকে আগে পাওয়া যাবে তার সঙ্গে ঘোরা যাবে। একসঙ্গে ঘোরার মজা আলাদা।
মন এখন এ ধরনের মজা পেতে চায় না। মন একা ঘুরতে চায়। একা ঘুরতে ভালো লাগছে। কেন লাগছে। বুকে ভয়ও জাগছে। রেজা মামার সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়! ভয়, নাকি আনন্দ, ঠিক বোঝে না ও।
ঐতিহ্যের পুরোনো ধাঁচে চীনামাটির ক্যানভাসে নতুন রূপ এসেছে। মাটির মডেলে চকচক করছে ভিন্নরকম জৌলুশ। ভিন্নরকম আকর্ষণ। ‘ক্লে ইমেজ’-এ অনন্য রূপ পেয়েছে মগ, ফুলদানি, ওয়াল হ্যাঙার, অ্যাশট্রে, টি-সেট, ডিনারসেট, চীনামাটির কানের দুল, লকেট। এমনি একটা পসরা নিয়ে বসে আছে তারুণ্যদীপ্ত একদল তরুণ-তরুণী। রিয়া ওদের সামনে এসে দাঁড়াল।
কিছু কিনতে ইচ্ছা করছে।
কী কিনবে ও? চয়েস করে মনে মনে, ‘ওয়াল হ্যাঙারটার’ ডিজাইন চমৎকার। ফ্যাশন প্রোডাক্ট না, ডিজাইন প্রোডাক্ট হিসেবে আইটেমটা মন কেড়ে নেয়।
‘ওয়াল হ্যাঙারটার’ দিকে আঙুল তোলে রিয়া। বিক্রেতা, এক তরুণী বলল, ছোট আপা, চমৎকার আইটেম চয়েস করেছেন। আর কিছু নেবেন?
রিয়া আবার আঙুল তোলে অ্যাশট্রের দিকে। তরুণী এবার অবাক হয়।
অ্যাশট্রে?
হ্যাঁ। ওটা দেন।
কার জন্য, আপা?
রিয়া হাসে।
কার জন্য কিনছে―সচেতন মনে উত্তর জানা নেই। মন বলছে, জানি জানি। কার জন্য কিনছে জানি, বলব না।
আইটেম দুটো নিয়ে সরে এলো রিয়া। নিরিবিলিতে এসে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
পরিচিত কেউ নেই আশেপাশে। শত শত নারী-পুরুষের মধ্যে কেউ পরিচিত না। এ কেমন কথা।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কয়েকজন যুবক। একজন পেছনের দিক দিয়ে ঘুরে আসে। হাতে তার সিগারেট। মুখ থেকে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয়। রিয়ার নাকে গন্ধ ঢোকে। নাক জ্বলে ওঠে। মাথা একপাশে ঘুরিয়ে নেয় ও। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আরেক যুবক, মোবাইল ক্যামেরা রিয়ার মুখের কাছে এনে চট করে ক্লিক করে।
রিয়া এবার রুখে দাঁড়াল।
ছবি তুললেন কেন?
যুবক হেসে জবাব দিলো, বিকৃত কোনো উল্লাসে না। সুন্দর মন নিয়ে মিষ্টিমুখের ছবি তুলে নিলাম। অসুবিধে কোথায়?
সুন্দর মনের হতে হলে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। অনুমতি নেননি। মোটেই সুন্দর মনের মানুষ না আপনি।
তাহলে সুন্দর মনের মানুষ হয়ে যাও, দোস্ত। অনুমতি নিয়ে নাও, অন্য যুবকটা পাশ থেকে এসে বলল কথাটা।
ক্যামেরা হাতের যুবক সঙ্গে সঙ্গে বলল, অনুমতি দেন ম্যাডাম। আরেকটা ছবি তুলি।
রিয়া দপ করে নিভে গেল। রেগে উঠেও নিজেকে সামলে নিয়ে ঝটকা মেরে ওদের সামনে থেকে সরে এসে চীনামাটির ক্যানভাসের সমারোহের পাশে বিক্রেতা তরুণীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল।
তিন যুবককে দেখে অভদ্র মনে হয়নি। পোশাকে অশোভন না। চেহারায়ও মনে হয়নি বখাটে। অথচ ওদের আচরণে রয়েছে বখাটেপনা। এমন শোভন চেহারা নিয়ে কীভাবে করে অশোভন কাজ?
কোনো মেয়েকে দেখে সুন্দর লাগলেই নিমিষে ছবি তুলে নিতে হবে? এ কোন মানসিকতা! কেন এই বিড়ম্বনা?
রাগ গিয়ে পড়ছে মুনার ওপর।
মুনা কেন রিং করেছিল। কেন তাকে আসতে বলল? সে বলেছিল রেজা মামাকে পাঠাবে। মামাকেও দেখা যাচ্ছে না। কুসুম তো সেলফোন বন্ধ রেখেছে। বজ্জাত কুসুমের আচরণেও রাগ জাগছে। রাগ আর রাগের মধ্যে বসে নেই। ক্ষোভ জাগছে এখন। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটাতে পারছে না। ক্ষোভ নিয়ে ভদ্রবেশে দাঁড়িয়ে থাকে ও।
কুসুম বলেছিল, নবান্নের উৎসবে আছে গ্রাম্য কৃষাণির বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার মতো সুখ। জানত সে, ওই সুখ মহাসুখ। জীবনের মৌলিক সুখের সবচেয়ে বড় সুখ।
সুখ না ছাই! মনের ঘরে জ্বলছে আগুন। ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে ও। নিজেই ছাই হয়ে বসে আছে। আনন্দময় পরিবেশে আর আনন্দ নেই। নিরানন্দ মনে কী করবে, বুঝতে না-পেরে, চলে যাওয়ার জন্য এবার পা বাড়াল ও।
এ সময় দেখল মুনাকে।
চারুকলার মূল ফটক পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বকুলতলার দিকে।
রিয়া দাঁড়িয়ে থাকে। মুনাকে ধরার ইচ্ছা হলো না। মুনাই খুঁজে ধরুক ওকে।
মুনা খুঁজে পাচ্ছে না রিয়াকে।
রিয়া নড়ছে না নিজের জায়গা থেকে। মুনার উদ্বেগ দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে ও। ছটফটানি দেখছে।
রিয়ার মন নরম হতে থাকে। মুনার আকুলতা নিজের মনের ক্ষোভ, রাগ কমিয়ে দিলো।
ধীরে ধীরে রিয়া এগোতে লাগল।
মুনার কাছে এসে দাঁড়াল।
মুনাকে ডাক দিতে যাচ্ছিল। থেমে যায় ও।
একজন ভদ্রমহিলা পাশ থেকে মুনার সামনে এসে বলল, এই মুনা।
মুনা বলল, আপা, আপনি?
হ্যাঁ। আমি। চিনতে পারছ?
জি আপা, পারছি। আপনি এখন কোথায় থাকেন?
আমি মিরপুর থাকি। একটা কলেজে পড়াই এখন।
বাসায় আসবেন আপা। অনেক দিন তো আসেন না।
রিয়া এ সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। কোনো প্রশ্ন না-করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মুনা দেখেই চিৎকার করে ওঠে, তোকেই খুঁজছি!
ঠান্ডা স্বরে রিয়া বলল, জানি।
ফটোসেশন শেষ করেই ছুটে এসেছি। বেশি দেরি হয়নি তো। কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিস?
রিয়া বলল, দেরি হয়নি।
মুনা এবার পরিচয় করিয়ে দিলো, আমার ছোটবেলার টিচার। বাসায় এসে পড়াতেন, নিশাত আপা।
রিয়া পরিচিত হলো নিশাত আপার সঙ্গে।
নিশাত আপা প্রশ্ন করেন, ফটোসেশনে কোথায় গিয়েছিলে?
বেইলি রোডে, স্টুডিও ঝিমিক্স।
ঝিমিক্স? আচমকা জোরেই প্রশ্ন করেন নিশাত আপা।
ড্রেসিংরুমে ঢুকেছিলে?
হ্যাঁ।
ওখানে ড্রেস চেঞ্জ করেছিলে? পুরোপুরি ওপেন হয়েছিলে ভেতরে?
হ্যাঁ।
রিয়া এবার মুখ খোলে, আপা, আপনার প্রশ্নের ভেতরে প্রশ্ন আছে। বিষয়টা কী? আপনি কি ঝিমিক্সে কখনো গিয়েছিলেন?
নিশাত আপা হঠাৎ অফ হয়ে গেলেন।
মুনা প্রশ্ন করল, এনিথিং রং আপা?
ওই স্টুডিওটার বদনাম আছে। ওদের ড্রেসিংরুমে গোপন ক্যামেরা ফিট করা থাকে। মেয়েদের গোপন ছবি ধরে রাখে ক্যামেরায়।
না না। মিথ্যা কথা। ফটোগ্রাফার দেশের সেরা একজন ব্যক্তিত্ব। ওনার দ্বারা এমন ক্রিমিনালিটি সম্ভব না।
নিশাত আপা আশ্বস্ত হলেন না মুনার কথায়। মুনার বিশ্বাস ভাঙতে চাইলেন না। নিজে একবার ওইখানে গিয়েছিলেন ফটোসেশনে। ঝামেলায় পড়েছিলেন। ঘটনা সত্যি। অনেকের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছিলেন।
মুনাকে সব বললেন না। বললেন, তাহলে তো ভালোই। তবু বললেন, এ ধরনের স্টুডিওতে ভবিষ্যতে যেতে চাইলে সাবধানে যাবে, কেমন?
মুনা বলল, জি, মনে থাকবে আপনার কথা।
নিশাত আপা এবার সামনের দিকে পা বাড়ালেন। একজন সুদর্শন ভদ্রলোক তাকে ইশারায় ডাকছে। খেয়াল করল রিয়া।
হাসিমুখে ওরা বিদায় জানায় নিশাত আপাকে।
নিশাত আপার অভিযোগ কাউন্টার দিয়েছে মুনা। তবু ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেল। চোখ বন্ধ করে একবার ড্রেসিংরুমের আনাচেকানাচের দৃশ্য ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করল ও। তেমন কিছু ইমেজ খুঁজে পেল না। মনে শঙ্কা ঢুকে গেল। শঙ্কা নিয়ে তাকাল রিয়ার চোখের দিকে।
রিয়া পড়তে পারল মুনাকে। মুনার মন অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলল, আমাকে তো শাস্তি দিলি?
কীসের শাস্তি?
এই যে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছি। এটা শাস্তি না?
মুনা এবার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। শোন, রেজা মামাকে রিং করলাম। ওনার ফোনসেট অফ ছিল। ল্যান্ডফোনে বাসায় ফোন করলাম, মামণি বলল মামা ঘুমাচ্ছে। এজন্য তাকে আর ইনফর্ম করতে পারিনি।
ওহ! রিয়ার মন শান্ত হয়। গোপনে গোপনে রেজা মামার ওপরও রাগ হয়েছিল। রাগ পানি হতে থাকে। বেচারাকে দোষ দেওয়া যায় না। সে যে এখানে একা একা ঘুরছে জানতেন না তিনি। কুসুমও জানে না। কুসুমকেও ক্ষমা করে দিলো ও। তবে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখার অপরাধ ক্ষমা করতে সময় লাগবে, বুঝতে পারল রিয়া।
মুনা বলল, চল।
চল মানে? ঘুরে দেখবি না?
না, ঘুরতে ইচ্ছা করছে না।
কেন?
নিশাত আপার কথা শুনে মনের উৎসাহ দমে গেছে। চল, চলে যাই।
রিয়া জোর দিয়ে বলল, তোর চরিত্রে তো এমন উদ্বেগ মানায় না। যাবি কেন?
আমি কি রোবট নাকি, আমার আবেগ নেই?
না। সে কথা বলছি না। বলছি এসব ঘটনা তো তুই স্মার্টলি ফেস করতে পারিস।
ফেস করেছি। চল। আর থাকার ইচ্ছা নেই।
কুসুমকে খুঁজে দেখবি না? কার সঙ্গে ঘুরছে, চল দেখি, গোয়েন্দাগিরি করি।
গোয়েন্দাগিরির কথা শুনে চমক লাগল মুনার মনে। চমকটা ঝলসে উঠল না। ভোঁতা মন নিয়ে বলল, তুই যা বলিস, আমি তোকে অপেক্ষা করিয়েছি, অপেক্ষার মাশুল তো আমাকে দিতে হবে, তাই না?
থাক অপেক্ষার মাশুল দিতে হবে না। চল, বাসায় চল। আর নে, এই গিফ্ট দুটো তোর গাড়িতে তুলে নে।
কীসের গিফ্ট?
আমার দেওয়া গিফ্ট। নবান্নের গিফ্ট। তোর জন্য না। মামার জন্য। মামাকে দিস।
ওহ! এক্সাইটিং। মামা নিশ্চয়ই তোর গিফ্ট পেয়ে খুশি হবে।
খুশি যাতে না হতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দিই। বলতে বলতে হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে। কলম বের করে। কাগজের ওপর লেখে, ‘রেজা মামা, থ্যাঙ্কস ফর নো স্মোকিং। রিয়া। লিখে কাগজটা অ্যাশট্রের ঢাকনির ভেতর ঢুকিয়ে দিলো।
মুনা প্রশ্ন করল, এটা কী?
রেজা মামার চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র। স্মোকিঙের বিরুদ্ধে শিক্ষা। তারপর দুজনই হেসে উঠল তুমুল স্বরে।
চলবে...
এসইউ/এএসএম