কবিতার ক্ষেত্রে একটি দর্শন থাকা উচিত : হাবীবুল্লাহ সিরাজী

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০১:০৪ পিএম, ২৫ মে ২০২১

হাবীবুল্লাহ সিরাজী। কবি, মহাপরিচালক বাংলা একাডেমি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রাতে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা এটি প্রকাশ করছি। বি. স.

মিল্টন বিশ্বাস :জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে আপনার কবি হওয়া এবং আজকের এই প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের ইতিহাস কিভাবে জড়িত? কবিতা লেখার শুরুটা কিভাবে হলো? ষাটের দশকের মাঝামাঝি লেখার সূচনা করে কবে থেকে নিয়মিত লিখতে শুরু করলেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আমার পরিপ্রেক্ষিতটি অন্যরকম ছিল। আমার জন্ম মাতুলালয়ে। ফরিদপুর শহর থেকে বার মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি অজপাড়া গাঁয়ে। গাঁটির নাম রসুলপুর। এখানে মূলত তিন ঘর বাসিন্দা। তিন ঘর বাসিন্দার সঙ্গে আমরা আরেক ঘরকে যুক্ত করি। কারা বাসিন্দা ছিলেন? তাদের সম্পর্কে বললে আমার বেড়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে সহজ হবে। পূর্ব দিকের ঘরবাড়িগুলো ছিল মীরদের। মাঝখানে পাড়াটি কাজীদের। আর পশ্চিমের অংশটুকু খন্দকারদের। এর সঙ্গে যুক্ত আর একটি পাড়া আছে, সেটি হলো সৈয়দদের। এখন আপনি বুঝতে পারেন একটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে তিন ঘর এবং আর একটি ঘর, মোট চার ঘর—সেখানে আশরাফ শ্রেণির বসবাস। আমি আশরাফ ও আতরাফ প্রসঙ্গটি এই কারণে বলছি, তখনকার মুসলিম সমাজে চল্লিশের দশকের শেষ দিকে আমার জন্ম। সেসময় আশরাফ ও আতরাফের ব্যাপারটি প্রকট ছিল। এর পাশাপাশি প্রেক্ষাপটটিও বলতে হয়। অঞ্চলটি একটি ইউনিয়নের অধীনে। ইউনিয়নের নাম ‘গট্টি’। এই অঞ্চলটির প্রাতিষ্ঠানিক নাম রাহুতপাড়া। ‘রাহুতপাড়া’ একটি সম্পন্ন বসতিপূর্ণ এলাকা। এ এলাকায় একটি বাজার আছে। বাজারে একটি দাতব্য চিকিত্সালয় আছে; একটি পোস্ট অফিস আছে। একটি প্রাইমারি আর একটি ফি প্রাইমারি স্কুল আছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিত্সালয়ও আছে। ময়রার দোকান, কামারের দোকান ও স্বর্ণকারের দোকান আছে। সোলার কাজ করে মালাকার তারও দোকান আছে। এক অর্থে বেনেদের দোকানপাট একটি সাধারণ দৃশ্য। অর্থাত্ সার্বিকভাবে একটি গ্রাম বা পাড়া হওয়ার জন্য যে সমস্ত উপাদান দরকার, তার সবকিছু এখানে আছে। হিন্দুু ও মুসলমান মিলে একটি পাড়া। সে পাড়ার একটি ক্ষুদ্র অংশের কথা আগেই বলেছি। এর একটি অংশে আমার বসতি। এখানে অস্তিত্বের প্রশ্ন ছিল একটি নদী। সে নদীটির নাম ‘কুমার’। ‘কুমার’ পাড়ার গা ঘেঁষে ফরিদপুর শহর থেকে একেবারে মাদারীপুর পর্যন্ত গেছে। নদীটির উত্পত্তি পদ্মার কাছ থেকে আর শেষে গিয়ে মিলেছে মধুমতীতে। আমার বাল্যকালে এই কুমারের প্রভাব প্রবল—খেয়া নৌকা থেকে শুরু করে নদীর বালি, পলি, ফসল, জীবজগত্ এবং পাশাপাশি মানুষ। আমি যেভাবে বড় হয়েছি, আমার কাছে বাল্যকালে—মুরগির ঝোলেরও দু’টি ফারাক ছিল—আশরাফ বাড়ির মুরগির ঝোল এবং আতরাফ বাড়ির মুরগির ঝোল। এই কথাগুলো দীর্ঘভাবে বলতে হয়, তাহলে এভাবে বলতে হয় যে, মসলার ব্যবহার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবহারসহ সবকিছুই আমার বেড়ে ওঠার সঙ্গে কাজ করেছে। আর এই বেড়ে ওঠার পাশাপাশি নদীটি আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।

লেখালেখি করব, সেটি কখনো বালক বয়সে চিন্তা করিনি। বিস্তর পাঠ ছিল। আমার প্রথম পড়া বাড়িতেই। পত্রিকা-বই সবকিছু মিলিয়ে প্রথম পড়া বাড়িতেই। তখন ধর্মীয় পুস্তকের পাশাপাশি অন্য বইও পড়া হয়েছে। কারণ একটি রক্ষণশীল পরিবারে মাতুলালয়ে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমার পড়াটা যেভাবে শুরু করা দরকার, ঠিক সেইভাবেই শুরু হয়েছিল বলে আমি মনে করি। হাতেখড়ি স্বর্গীয় শ্রী সুধন্যচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের কাছে। আমার এখনো পরিষ্কার মনে পড়ে, শীতের সকাল, পূর্ব দিকে সূর্যের আলো, পিঠ দিয়ে আমি বসতাম এবং তিনি আমার সম্মুখে বসতেন। আমার যে ছায়াটি সামনে পড়ত, তখন তিনি বলতেন, দেখ ছায়াটা কতদূর এগোচ্ছে? তুমি ছায়া দেখতে থাকো, তখন আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতে দেখতে ছায়াটা যখন ঘাসের ওপরে পড়ত, তখন তিনি বলতেন, দেখ ছায়ার রং কী? যখন খালি মাটিতে পড়ত, তখন বলতেন, ছায়ার রঙ কী? এভাবে তিনি আমাকে প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। আমি আজীবন আমার এই শিক্ষকের কথা মনে রাখব। আমি একটি গ্রাম বা পাড়ায় জন্মেছি, যেখানে জেলে আছে, কুমার আছে, ঘোষ আছে, কৈবর্তসহ সবাই আছে। এর পাশাপাশি মুসলিম পরিবারও আছে। তবে প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে বলি, দশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি এই গ্রামে থেকেছি। তারপর মাধ্যমিক পড়ার জন্য আমাকে শহরে আসতে হয়েছিল। শহরে আমি মাধ্যমিক পাস করেছি ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে। উচ্চমাধ্যমিকও আমার ফরিদপুর শহরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। এই রাজেন্দ্র কলেজ আমার জীবনে লেখালেখির একটি মোড় দিয়েছে। কারণ তখন আমি বুঝতে পারি যে, কিশোর ও তরুণের মধ্যে পার্থক্য কী? কিশোর থেকে তরুণ হওয়ার জন্য কী কী উপাদান প্রকৃতিগতভাবে মানুষের ভিতরে প্রবেশ করে। পোশাকে ঢুকে যায়, মানসিকতায় ঢুকে যায় এবং প্রাপ্তবয়স্কের কাছাকাছি তরুণ যখন পৌঁছে যায়, তখন তার ভিতরে একটি অন্য রকম ক্রিয়া হয়। এর মধ্যে আমি জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান পড়ে ফেলেছি। এর ভিতরে আমি রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্র শেষ করেছি। কলেজজীবনে প্রবেশের আগে এই সব পড়া শেষ। কলেজজীবনে প্রবেশের পর আধুনিকতা শব্দটি নতুন করে আমার ভিতরে আসে। সেই আধুনিকতার হাত ধরেই জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমানরা আমার জীবনে আবির্ভূত হন। শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ আমাকে আলোড়িত করেছিল। সালটি ছিল ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬, তখন একটা সময় ছিল, যখন ভিপিযোগে ঢাকা থেকে বই যেত মফস্বলে। নতুন বইয়ের খবর পৌঁছে যেত লাইব্রেরিতে। তখন লাইব্রেরিতে খোঁজ নিতাম। লাইব্রেরিতে বলতাম, এই বই আমার দরকার। লাইব্রেরি আমার হয়ে অর্ডার করত এইসব বই লাগবে। ভিপিযোগে বই আসত এবং আমি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিতাম। আর যে সমস্ত পাঠাগার ছিল, সেগুলো আপডেট হতে সময় লাগত; অন্তত এক বছর। যার ফলে এই পাঠাগারে যখন বই আসে, তার আগেই আমি লাইব্রেরি থেকে বই কিনে ফেলেছি আমার মতো করে। সবকিছু ভাবতে হবে মফস্বল শহর ফরিদপুরের কথা মাথায় রেখে। সেই ফরিদপুরের অজপাড়া গ্রাম থেকে আসা এক বালকের কিশোর হওয়ার গল্প এবং তার তরুণ হওয়ার গল্প।

আমার লেখালেখির বৃত্ত তৈরি করেছি কলেজ জীবনে। আমি প্রথমে গদ্য লেখা দিয়ে শুরু করি। প্রথমে কিছু কাজ করি একেবারে নিজের মতো করে। আমার ভিতরে একটি সংশয় ছিল। আমি কি ‘সাধুভাষা’য় লিখব নাকি চলিত ভাষায় লিখব। এই শঙ্কা এসেছিল পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে। আমি আমার পাঠ্যপুস্তকে ‘সাধুভাষা’য় উত্তর পাচ্ছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা আমি সাধু ভাষায় লিখব না। আমি চলিত ভাষায় লিখব। এই করে আমি প্রথমে হোঁচট খাই। কিন্তু আমি ভাবলাম, হোঁচট খেলে আমার চলবে না। আমাকে চলিত ভাষায় লিখতে হবে। যেটা আমি নিজের মতো করে প্রকাশ করতে চাই। আমি মুখস্থ করতে পারতাম না। ফলে মূল টেক্সট পড়ার পর আমার নিজের মতো করে লিখতে হতো। আমার তৈরিটা প্রকৃতির কাছ থেকে; পরিবেশের কাছ থেকে। প্রথম লেখা ১৯৬২ সালে। কালিদাস রায়ের (১৮৮৯-১৯৭৫) একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে। অষ্টম শ্রেণির সেই কবিতায় পিতা তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য প্রার্থনা করছেন। আমি ওই বিষয়কে নিজের মতো করে আবার লিখলাম। কিন্তু এটা আমি প্রকাশ করিনি। আমার প্রথম প্রকাশিত লেখা ১৯৬৬ সালে ‘অন্ধকারের পথ ধরে’। এই লেখাটিও একটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা। এই লেখাটিও ঠিক আমার মতো করে উত্তরণের প্রাক্কালে লেখা। আমি তখন অনুবাদ করতে শুরু করলাম। কেন যেন মনে হলো, অনুবাদ বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে ভাষার চরিত্র নির্মাণে আমাকে সহযোগিতা করবে। আমি প্রচুর পরিমাণে অনুবাদ করেছি। সোভিয়েত লিটারেচার থেকে শুরু করে অনেক কিছু। তখন ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। ১৯৬৬ সালের কথা। দু’হাতে প্রচুর অনুবাদ করতাম এবং যে কোনো কারণেই হোক দৈনিক ‘সংবাদ’-এ আমার প্রচুর অনুবাদ ছাপা হয়েছে। পরবর্তীকালে এই অনুবাদের ধারাবাহিকতায় রুশ কবি আলেক্সান্দ্র সলজেনিসিন (১৯১৮-২০০৮) বাংলাদেশে আমি প্রথম অনুবাদ করি। আমি জাপানি কবি ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা (১৮৯৯-১৯৭২) প্রথম অনুবাদ করি। আমি ইতালিও কবি সালভাদর কোয়াসিমোডো (১৯০১-১৯৬৮) প্রথম অনুবাদ করি। এই অনুবাদগুলো আমি কোথাও ছাপিনি। আমার নিজেকে তৈরি করার জন্য এই অনুবাদগুলো করেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলি, আমার অনুবাদ ছাপার জন্য অনেক দীর্ঘ সময় লাগত। কারণ আমি অনুবাদগুলো মার্জনা বা ঘঁষামাজা করতে অনেক সময় নিতাম। এখনকার পরিপ্রেক্ষিত বলি, আমি আফ্রিকার কবিতা অনুবাদ করছি। এই কাজ আমি শুরু করেছিলাম ১৯৭২ সালে। এখনো অনুবাদ করছি। খুব কম সময়ের মধ্যে অনুবাদ হচ্ছে ‘রুমি’র কবিতা। কিছুদিন আগে একটি অনুবাদ করলাম ‘রসুল হামজার কবিতা’। বইটি বের হয়েছে। এটিও আমার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল। এই কাজটি শুরু করেছিলাম ১৯৭৫ সালে। বই বের হলো এই বছর (২০১৯) এসে। অনুবাদকে আমার কর্মের সঙ্গে আমি যুক্ত করতে চাই; আবার বিযুক্ত করতেও চাই। এই জন্য আমি অনেক সময় নিয়ে কাজ করেছি। আর ষাটের দশকের মাঝামাঝি কিভাবে লেখা শুরু করলাম? এ সম্পর্কে একটি ধারণা উপরের আলোচনা থেকে পাওয়া যাবে। আমি গদ্য দিয়ে শুরু করে প্রথম কবিতা ‘অন্ধকারের পথ ধরে’ লিখি। এরপর থেকে লিখছি। নিয়মিত লিখছি। মফস্বল শহর থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর থেকে আমার লেখালেখি নিয়মিত হয়ে গেছে। তখন গদ্যটাই প্রাধান্য ছিল। ঢাকায় স্থিত হয়ে আমি একরাশ অনুবাদ করার পর থেকেই কবিতা লেখায় নিমগ্ন হই। ভেবেছি কবিতার মাধ্যমেই কিছু হবে। ১৯৬৬ সাল থেকে আমি ঢাকায়।
১৯৬৬ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বুয়েট) ভর্তি হলাম। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম; কারণ যথারীতি এটি প্রাক-যোগ্যতা। কলেজজীবনে মোটামুটি লেখাপড়া করেছি এবং ফলও ভালো ছিল। সেই অর্থে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। তখনকার সেই অনুষঙ্গটা, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ পর্যন্ত সময়টাকে আমি মনে করি আমার তৈরি হওয়ার জন্য দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথম পর্যায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত গ্রামে ছিলাম। আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হলে থাকতাম। সে হলটির নাম হয় সোহরাওয়ার্দী হল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে লিয়াকত হলের নাম আমরা নিজেরাই বদল করি। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর আমি ছাত্র রাজনীতিতে কিছুটা জড়িত হই। এই রাজনীতি ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রশ্নের রাজনীতি। আমি পদেও ছিলাম। ছাত্রজীবন শুরু করেছিলাম প্রগতিশীল রাজনীতি দিয়ে। ছাত্র ইউনিয়নের তখন দুটি ভাগ ছিল। একটি মেনন গ্রুপ এবং মতিয়া গ্রুপ। প্রথমে কিছুদিন মেনন গ্রুপের কর্মী ছিলাম, তারপর আমি মতিয়া গ্রুপের কর্মী হই। তবে খুব খণ্ডকালীন। কিন্তু এদের ভিতর দিয়ে আমার বোঝার বয়স হয়েছিল। সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন তখন এসে গেছে। অন্তত আমরা যারা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তারা বিষয়টিকে প্রায় ধারণ করতে পেরেছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ছাত্রলীগে চলে আসি এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হই। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে নির্বাচিত সম্পাদকও হই; পরে সাহিত্য সম্পাদক। আমি প্রথম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টেকনিক্যাল বিষয়ে বাংলায় পত্রিকা বের করি। এতে টেকনিক্যাল বা কারিগরি বিষয় এবং সাহিত্যও ছিল। সেই প্রথমবারের মতো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হলো।

আমাকে তৈরি হওয়া জন্য আর একটি বড় সাহায্য করেছে ‘পলাশি’ এলাকা। পলাশিতে তখন ‘আজাদ’-এর অফিস ছিল। আজাদে সন্তোষ গুপ্ত থেকে শুরু করে যাঁরা কাজ করতেন, তখন সবাই ছিলেন জ্ঞানের দিক থেকে, কর্মযাপনের দিক দিয়ে উচ্চস্তরের। সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফা, যিনি শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়; তিনি একসময় আজাদের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। আজাদে ট্যাবলয়েট আকারে সাহিত্যের কাগজ হতো। সেখানে নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে ফরহাদ মাজহারসহ তখনকার তরুণেরা সবাই ছিলেন। ‘চিত্রাকাশ’ নামে আজাদের একটি সিনেমার কাগজ ছিল। সেখানে একটি আড্ডা ছিল। অর্থাত্ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং আজাদ অফিসকেন্দ্রিক একটি আসর জমে উঠেছিল। কখনো কখনো আমরা দৈনিক ‘পাকিস্তান’-এ এসেছি; কখনো কখনো আমরা ‘সমকাল’-এ গেছি। কিন্তু ‘আজাদ’ আমার কর্মকাণ্ডের একটি বড় অংশ দখল করে আছে। এই সময়েই আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব আবুল হাসানের, অন্যদিকে হেলাল হাফিজ থেকে শুরু করে নির্মলেন্দু গুণসহ সবার সঙ্গে। তবে বন্ধুত্বের পর্যায়ে শহীদ কাদরী ছিলেন আমার কাছে অগ্রগণ্য। রফিক আজাদ তখন ঢাকা শহরে নেই; শহীদ কাদরী ছিলেন। শহীদ কাদরীকে ঘিরে একটি আড্ডা হতো নিউমার্কেট এলাকায়। স্বাধীনতার আগে নিউমার্কেটে একটি রেস্তোরাঁ ছিল। সেখানে নিয়মিত সান্ধ্যকালীন আড্ডা জমত। ‘আজাদ’-এ আমি নিয়মিত লিখতাম। ‘চিত্রাকাশ’-এ আমার অনেক গল্প বের হয়েছে। যদিও পরে আমি গদ্যের পথে নিয়মিত কমই হেঁটেছি। আমার গল্পের বই ওই অর্থে তেমন হয়নি। আর এই সব লেখালেখি কেবল আমার গদ্য ভাষাকে তৈরি করার জন্য। আমি জানি, কবিতার ভাষা ভিতর থেকে হবে। এর জন্য আমি যত অনুশীলন করি, তা কেবল অনুবাদের জন্য থাকুক। কারণ অনুবাদের জন্য যদি কিছু তৈরি হয়। একসময় আমি প্রচুর লিখেছি; খাতার পর খাতা লিখেছি; ১৯৬৬ থেকে শুরু করে; তবে আমার প্রথম বই ১৯৭৫-এ।

মিল্টন বিশ্বাস :সেসময় আপনাকে অনুপ্রাণিত করতেন এমন কবি-সাহিত্যিক কারা?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের বই ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ তখন বের হয়েছে। আমাদের জন্য এই বই কবিতার ক্ষেত্রে বড় মোড় বলব। যে কবিতা আমরা পাঠ করছি, তার বাইরে এসে গুণ সংগ্রামের সঙ্গে স্বাধীনতার সঙ্গে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে কবিতা লিখেছেন। পাশাপাশি আবুল হাসানরা তখন লিখছেন। তিনি লিখছেন মর্মের কবিতা। মর্ম, সংগ্রাম ও ধর্ম যৌথভাবে আমাদের ভিতরে কাজ করেছে এবং আমার যা অনুষঙ্গী এবং আমার সময়ের বন্ধু কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সানাউল হক খান, হেলাল হাফিজ, জাহিদুল হক এঁরাও লিখছেন। ‘কণ্ঠস্বর’-এর সঙ্গে তাঁদের এক ধরনের যোগাযোগ। যদিও স্বাধীনতার আগে ‘কণ্ঠস্বর’-এর সঙ্গে সেই অর্থে কোনো হূদ্যতা ছিল না আমার। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে পরিচয় স্বাধীনতার পর। স্বাধীনতার আগে আমার সংগ্রামটুকু আমার একার ছিল; একেবারেই একার। আমার বন্ধু কেবল আমাকেই তৈরি করে নিতে হতো। বন্ধুত্ব কেবল একার হয় না। বন্ধুত্ব হওয়ার জন্য পারস্পারিক সম্পর্ক লাগে। কিন্তু যে পরিবেশে ছিলাম এবং আমি যে বৈপরীত্যে ছিলাম, সেখানে নিজেকেই নিজের জন্য গড়ে তুলতে হয়েছে।

মিল্টন বিশ্বাস :বুয়েটে কী সাহিত্যচর্চার যথেষ্ট পরিবেশ ছিল?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমাকে আমরা করার জন্য আমার প্রচেষ্টা ছিল বেশি সাহিত্যের ক্ষেত্রে। বুয়েটে সবকিছুর বিষয়ে খুব চমত্কার সুন্দর পরিবেশ ছিল। সংগীতসহ অনেক কিছুই হতো। কিন্তু আমি যখন আসি, তখন আমি অ্যামেচার হিসেবে থাকতে চাইনি। শুরু থেকেই চেয়েছিলাম, আমি এর সঙ্গে লেগে থাকব। চলনে-বলনে, চলা-ফেরা, উঠা-বসায়; যার ফলে স্বাধীনতার আগে থেকে আমি ঢাকা বিশ্বদ্যািলয়ের মধুর ক্যান্টিন, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন থেকে শুরু করে সব এলাকায় বন্ধুবান্ধব তৈরি করার ক্ষেত্রে নিজে উত্সাহী হয়ে আলাপ করেছি। রাতের পর রাত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে থেকেছি। আমি আমার মতো করে বন্ধুদের সঙ্গে, কেউ কথা বলতে না চাইলেও ‘ভাই, একটু আলাপ করি’ বলেছি। কী লিখছেন কিংবা কী কাগজে কী বের হচ্ছে এইসব আলাপ জমেছে। তবে ১৯৬৬ থেকে ৭০-এর নির্বাচন কিংবা ৭১-এর মার্চ মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত সংগ্রামটিকে ধরে নেওয়া যায় সাহিত্যের জন্য সংগ্রাম পরিপূর্ণভাবে আমার নিজের একার ছিল। এর মধ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা কাগজ করেছি নাম ‘স্বরগ্রাম’। ‘স্বরগ্রাম’-এ সবাই লিখেছেন। যারা আজ প্রতিষ্ঠিত—সাহানুর খান মারা গেছেন, রফিক নওসাদ—সবাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মুহম্মদ নূরুল হুদা, ফরহাদ মাজহার, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী। রফিক আজাদ তখনো ঢাকায় আসেননি। রফিক আজাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ১৯৭২ থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত—অগ্রপথিক ও দিকনির্দেশক হিসেবে সম্পর্ক ছিল।

মিল্টন বিশ্বাস :২০১২ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘আমার কুমার’ আমরা পড়েছি। বইটির বিষয় সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :‘আমার কুমার’ সম্পর্কে আগেই একটু ধারণা দিয়েছি। ‘কুমার’ আমার জীবনের একটি প্রভাবিত অংশ—আমার বাল্যকালের নিজের ভিতর থেকে নিজের তৈরি হওয়ার ব্যাপারটি সেখানে এসেছে। বালির গুরুত্ব, পলির গুরুত্ব, ফসলের গুরুত্ব এবং জনমানুষের গুরুত্ব অন্তত আমাকে অনুভব করিয়েছে কুমার। কারণ তখন কোনো যানবাহন ছিল না একমাত্র নৌযান ছাড়া। সকালে টইটুম্বর পানি। কুমার ভেসে যাচ্ছে। পুরো এলাকা পানিতে ভেসে গেছে। এই কুমার আমাকে নদীর ভাষার পাশাপাশি মানুষের ভাষা বুঝতে শিখিয়েছে। কুমার ভাসিয়ে দিয়েছে, পলি পড়েছে, কার্তিক মাসে যখন পানি টান দেবে, পলিতে নতুন ফসল হবে। আবার কুমার শুকিয়ে গেছে, বালির চর ধূ-ধূ করছে। খেয়া নৌকা এপার ওপার করছে। তখন একটি মাত্র লঞ্চ চলত ফরিদপুর শহর থেকে মাদারীপুর পর্যন্ত। হাওলাদার কোম্পানির লঞ্চ। সকাল বেলা দক্ষিণে যেত, আবার বিকাল বেলা ফিরত। এটাই ছিল আধুনিক যান। আমরা লঞ্চকে জলমোটর বলতাম। আর আধুনিক যন্ত্র বলতে ছিল একটি চালের কল। হাটবারের দিন চালু হতো। ডিজেল ইঞ্জিনচালিত কল। সবাই ধান ভাঙতে সেখানে আসত। এই হলো আমার সময়ের যন্ত্রের ব্যবহার। আমি হারিকেনের আলোতে বাল্যকাল থেকে লেখাপড়া করেছি। আর শহরে এসে প্রথম আমি স্থল মোটর দেখি। কিন্তু এই দেখার আগেও আমার দেখা আছে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়। তখন যে রাজনীতিবিদরা নির্বাচন করেছিলেন, নির্বাচনের জন্য তাঁদের ব্যবহূত কালো রঙের মরিস গাড়ি। ধোঁয়া আর ধুলা উড়িয়ে যাচ্ছে, তার পিছে পিছে দৌড়াচ্ছি আমরা। আমি তখন বালক, বয়স সাত বছর। এই হলো আমার সভ্যতার দিকগুলো দেখা। তখন আমি হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে গ্রামোফোনের রেকর্ডে গান শুনেছি। এগুলো গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ছিল। গ্রামে পালকি ছিল; তবে আধুনিক গাড়ি কদাচিত্ কেউ নিয়ে আসলে দেখা যেত। ‘আমার কুমারে’ আমি অনেক কিছু দেখেছি এবং পড়েছি। এ গ্রন্থে আমার বাল্যকালের ১০ বছর পর্যন্ত বেড়ে ওঠার কাহিনি আছে। সেই কাহিনির ভিতরে গ্রামোফোনের কথা আছে। সেই কাহিনির ভিতরে নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। আখের রসের কথা আছে, জলমোটর, চৈত্রসংক্রান্তির কথা আছে। কারণ এ সবকিছুর ভিতর দিয়ে আমার বেড়ে ওঠা।

মিল্টন বিশ্বাস :পরবর্তীতে যাঁরা স্মৃতিকথা লিখেছেন, যেমন নির্মলেন্দু গুণ কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের স্মৃতিকথার সঙ্গে আপনার পার্থক্য কোথায়?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :ওঁরা যেসব স্মৃতি কথা লিখেছেন, তা ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন। তবে আমি খণ্ড খণ্ডভাবে আমার ওই অংশটুকু ধরার চেষ্টা করেছি। আপনি যদি খুব খেয়াল করে পড়েন, তাহলে দেখবেন, তাদের স্মৃতি কথার ভিতরে চরিত্র আছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে চরিত্র কম, প্রকৃতি বেশি। আমার স্মৃতি কথায় নামওয়ালা চরিত্র কম পাবেন এবং আমার ব্যক্তিগত রচনাতেও ব্যক্তিমানুষকে বেশি প্রাধান্য দিই না। বরং কর্মকে প্রাধান্য দিই। প্রকৃতিকে প্রাধান্য দিই। আমি নাম উল্লেখ কম করি। কারণ এতে নানা ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করি। একদিক থেকে আমি স্বতন্ত্র।
মিল্টন বিশ্বাস :পাঠকের মূল্যায়ন থেকে জানা যায়, আপনি যতটা প্রকৌশলী তার চেয়েও বেশি কবি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমি উপরে যা আলোচনা করেছি, এর ভিতর থেকে প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট কোনো কথা নিশ্চয় তুলে ধরিনি। আমি বিজ্ঞানের একটি শাখায় লেখাপড়া করেছি। প্রযুক্তিগতভাবে পড়ালেখা করেছি। আমি মনে করি, ওই লেখাপড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জন্য কর্মযাপন করেছি। কিন্তু মনে প্রাণে সাহিত্যের জন্য চেষ্টা করছি এবং চেষ্টা করে যাব। সেজন্যই হয় তো পাঠকের ভ্রান্তিটি তৈরি হয়। কারণ আমি আমার প্রকৌশল পরিচয়কে কোনো জায়গায় ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নই এবং আমি এটা গৌরব বা অগৌরবের কোনো অর্থেই না—এমনভাবে বিবেচনা করি। এটা শিক্ষার একটি অংশ ছিল। যা শেষ হয়ে গেছে। শিক্ষা ছাড়াও তো মানুষের অনেক কিছু হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওইভাবে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। আপনি মনে করতে পারেন যে, কারিগরি বিষয়টি আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল। আমার জন্য লাভ হয়েছে, আমি আমার চিন্তার জন্য, আমার জৈবিক অংশটিকে তৈরি করার জন্য বিজ্ঞান এবং সাহিত্য চর্চাকে সমার্থক বিবেচনা করেছি।

মিল্টন বিশ্বাস :প্রকৌশলী হওয়ায় সেই পঠন-পাঠন কিভাবে আপনার লেখনিতে ধরা পড়েছে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমার লেখনিতে প্রকৌশলী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচুর প্রভাব আছে। তবে পাঠক যদি খুবই সন্নিষ্ট হন, তাহলে প্রভাবটি ধরতে পারবেন। বিজ্ঞানের চিত্রগুলোকে আমি দর্শনের আলোকে সাহিত্যের অংশ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছি। আমি চাঁদকে কেবল চারদিকের সৌন্দর্যের দিক থেকে দেখিনি। চাঁদের একটি কার্যক্রম আছে। সৌরমণ্ডলে চাঁদের স্থান কী? প্রথম সূর্য, দ্বিতীয় পৃথিবী তারপরে তৃতীয় চাঁদ। চাঁদ সবসময় আমাদের কাছে একটি আকাঙ্ক্ষার বিষয় হয়ে থাকে। একটি কথা বলা হয়, চাঁদকে কেন মামা ডাকা হয়? মামি নয় কেন? তখন আমি বললাম যে, এই অর্থে মামা ডাকা হয়, মামা প্রিয় মামি নয়। এই জন্যই মামাবাড়ি যাওয়ার ছড়ায় আছে ‘মামী এলো লাঠি নিয়ে পালাই পালাই’। মামিকে অগৌরবের স্থান দেওয়া হয়েছে। আমাদের কবিরা চাঁদকে মামা ডাকে খুব প্রিয়তার প্রশ্নে।

মিল্টন বিশ্বাস :আপনি যে বিজ্ঞান-দর্শনের কথা বলছেন, কুমার তীরে বাল্যকালে বেড়ে ওঠা, তারপর কবিতায় নিমগ্ন হওয়া—একদিকে প্রকৃতি অন্যদিকে বিজ্ঞান—নেপথ্যে কোনো দ্বন্দ্ব কাজ করে কী?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমার বিজ্ঞান চেতনা কখনো আমাকে দ্বন্দ্বমুখর করেনি। কিংবা দ্বন্দ্বে আমাকে লিপ্ত করেনি। কারণ আমি পুরো ধারাকে নিজের মতো করে নিয়েছি। আমার শৈশবকে যুদ্ধ করে আমি কৈশোরে নিয়ে এসেছি। তাকে আলোড়িত করে আমি তারুণ্য এনেছি। আরো প্রলোড়িত করে সংগ্রামকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছি এবং তার সঙ্গে কবিতাকেও যুক্ত করেছি। আমার বইতে প্রচুর রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে। কিন্তু সেটা একটু আড়ালে। প্রচুর ব্যঙ্গ কবিতা রয়েছে। আসলে রাজনীতি নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছি। আমি একটি জিনিস বিশ্বাস করি যে, ‘ননসেন্স’ অনেক বিষয়ই সাহিত্য হতে পারে। সেটা কবিতা কিংবা শিল্পের ক্ষেত্রে। তবে কবিতার ক্ষেত্রে একটি দর্শন থাকা উচিত। যে দর্শনটির সঙ্গে যেন বিজ্ঞান থাকে। বিজ্ঞান যদি সঙ্গে থাকে, তবে সেই দর্শনকে পরিপূর্ণভাবে স্থাপন করতে পারে। আর এই দুটির সম্মিলিত রূপই সাহিত্য।

মিল্টন বিশ্বাস :বিজ্ঞান চেতনার কাজটি ত্রিশের দশকের কবিরা করেছেন। অগ্রজ লেখকদের মধ্যে কারা আপনার পথ আগলে রেখেছিল? নাকি সকলের আলিঙ্গনে ঋদ্ধ হয়েছেন? আপনার কাছে ভালো বা মন্দ লাগার বিষয় কিভাবে কাজ করেছে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমি ভালো লাগা, মন্দ লাগার বিষয় ভাবি না। যাঁদের পাঠ করার মতো বলে বিবেচনা করেছি, তাঁদের সবাইকে আমার ভালো লাগার আসনে বসিয়ে নিয়েই পাঠ করেছি। ত্রিশের দশকে পাঁচজন কবির নাম বলা হয়। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, কাব্য ভাষা এবং কাব্য দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁদের বিচার করেছি। আমি রবীন্দ্রনাথকে আমার মতো করে নিয়েছি। তিরিশের একজন বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র বৈরী কবি একসময় রবীন্দ্রনাথের প্রতি একেবারে সন্নিষ্ট হয়ে অনেক কাজ করেছেন। আমি রবীন্দ্রনাথকে সবার আগে মাথার উপরে নিয়ে তারপর বিচারের প্রশ্নে এসেছি। এই কারণে একজন আবু সয়ীদ আইয়ুব রবীন্দ্রনাথের অমঙ্গল চিন্তা এবং মঙ্গল ভাবনা যেভাবে বলেছেন, সেটি আমার জন্য পাথেয় ছিল। এই পাথেয়ের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনানন্দ দাশকে বুঝতে সুবিধা হয়েছে, সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বুঝতে সুবিধা হয়েছে। যখন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কিংবা পরিচয় পত্রিকাগোষ্ঠী জীবনানন্দ দাশকে গ্রহণ করতে রাজি ছিল না, তখন আমরা জীবনানন্দ দাশকে গ্রহণ করেছি। তিনি যে অবস্থান থেকে লেখালেখি করেছেন বা দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছেন তা আধুনিকতার সঙ্গে, পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত। তারও নিচে আরো অনেক কিছু আছে। মাটি আছে; কাদার নিচে ভাষা আছে। যেটা পরিপূর্ণভাবে ধারণ করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি কেবল প্রকৃতির কবি নন, মানুষের কবিও। এ থেকে তাঁরা হয়তো একটু অন্যভাবে দেখেছেন। আমি অগ্রজ বা অনুজের লেখা পড়ি আর ভাবি তাদের মতো করে পড়লে বা লিখতে পারলে আমার ভালো হতো। অনুসরণের কথা মাথায় এলেও যখন লিখেছি অনেককিছু, তখন কিন্তু আমার মতো করে হয়ে গেছে।

মিল্টন বিশ্বাস :অগ্রজ লেখক বা কবি আপনার পথ আগলিয়ে রাখেননি; প্রত্যেকে আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। আপনি যেহেতু বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষেও কবি-সাহিত্যিক ছিলেন—এ রকম কবি সাহিত্যিকরা কিভাবে প্রভাব রেখেছেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :১৯৪৭ সালে ধর্মীয়ভাবে দেশভাগের পর কিছু বিষয় প্রকট হয়ে ওঠে। দেশভাগের পর আমরা চাইলাম কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিককে ঢাকায় নিয়ে আসতে। এদিকে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান মিলে একটি দেশ পাকিস্তানই হলো। কলকাতার সাহিত্যিকেরা ঢাকায় চলে এলেন। নাম ধরেই বলা চলে ফররুখ আহমদ, তালিব হোসেন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী হাসান, আবুল হোসেন এলেন। এর ভিতর থেকেও আমাদের চেতনার অংশটুকু জারিত, যার ভিতর দিয়ে আমি বড় হচ্ছি। ৫০ ও ৫২ নতুনভাবে আমাকে প্রেরণা দিচ্ছে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে শুরু করে প্রেরণার অংশটুকু নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। বাংলা ভাষার অংশটুকু নতুনভাবে দেখা দিচ্ছে। জাতীয়তাবাদের অংশটুকু নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। আমার বিশ্লেষণে তখন ১৯০৫ নতুন মাত্রায় আসছে। ১৯১১ নতুন মাত্রা পাচ্ছে। ১৯৪২ নতুন ভাষ্য দিচ্ছে। সর্বোপরি ১৯৪৭-১৯৪৮ নতুন মাত্রায় উদ্ভাসিত। যার প্রতিফলন রাজপথে দেখা গেল। ১৯৫২-তে বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে, রক্ত ঝরিয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করলাম। এখানে আমি একটি কথা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, সেই রক্ত শুধু রক্ত ছিল না, খুনের ভাষা ছিল। আমি কেন খুনের কথা বলছি? এই খুনের অগ্রগামিতায় আমরা বিষয়টিকে বিস্তৃত করছি। আমরা ৫০-এর ভাষাকে ষাটের ভাষার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে পারিনি। আধুনিকতা, নৈরাজ্য সবকিছু আমাদের অভিযুক্ত করেছে। তার সঙ্গে বাঙালি চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকেও। আমরা জানি বাঙালি জাতীয়তাবাদ শব্দটি একটি ক্ষীণ ও স্থূল শব্দ। কিন্তু এর ব্যাপ্তি অনেক বড়। জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিকতাবাদে উপনীত। আমি চাই আগে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই কারণে সাহিত্যের অংশটুকুকে আমরা ১৯৫২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত একটি পর্বে বিস্তারিত করি। যার মধ্যে আবার অনেকগুলো পর্ব আছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে মূলত যা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের পর থেকে—সেটির বিস্তার দেখি অনেক পরে। পশ্চিম বাংলার চেয়ে আমাদের সাহিত্য ভিন্ন কেন? এর উত্তর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যাবে এখানে। আমার কিন্তু রক্তের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে খুনের ভাষা তৈরি হয়ে গেল। আমার কিন্তু নুনের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে লবণের ভাষা তৈরি হয়ে গেল। আমার কিন্তু লাল মাটির ভাষার সঙ্গে সঙ্গে পলির ভাষাও তৈরি হয়ে গেল। আমার বৃষ্টি আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত যখন নামল, তখন বৃষ্টি হিসেবেই নামল। এক ভাগে জল আরেক ভাগে পানি হলো না। যে মুহূর্তে বৃষ্টি মাটি স্পর্শ করে, তখন পর্যন্ত বৃষ্টি থাকে। তারপরে কিন্তু আমাদের কাছে জল আর পানি হয়ে যায়। আমরা কিন্তু জল আর পানিতে বিশ্বাস করলাম না। অর্থাত্ আমার জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। এই ভাষাকে আমরা তৈরি করলাম। কবিতায় তার প্রথম রূপরেখাটি আমরা প্রকাশ করতে পারলাম। এই কারণে বলা হয় বাংলায় বাংলা ভাষার যে রূপরেখা হচ্ছে তা ভিন্ন। তা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট বা যা কিছু বলেন এক দম ভিন্ন। যদিও আমরা মূল স্রোতের সঙ্গে আছি। যদিও আমরা প্রমিত বাংলায় আমাদের রচনাগুলো প্রকাশ করে আসছি। তারপর কবিতা এখানে একটি বড় কাজ করে গেল ভিতরে ভিতরে আগুনের সঙ্গে পানির মিলন, হাওয়ার সঙ্গে মাটির মিলন তৈরি করে দিল বাংলাদেশের জন্য।

মিল্টন বিশ্বাস :মুক্তিযুদ্ধের আগের এবং পরের পর্বের একটি পার্থক্য আছে। মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে আপনার জীবন ও সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলেছে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :মুক্তিযুদ্ধ যদি না হতো এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যদি আমাদের ভিতরে না আসত, তাহলে আমাদের সাহিত্যের ভাষা অন্য রকম হয়ে যেত। সাহিত্যের বিষয়বস্তু অন্য রকম হয়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে ভাবতে শেখাল—আমি বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে ভাবতে শেখাল—আমার বাংলাদেশ। একজন মানুষ আমাকে বললেন, তুমিও পারো—একটি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূগোলের ভিতরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ এককভাবে পৃথিবীতে প্রকাশ করতে। সারা পৃথিবীর মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত হতে। বাংলাদেশ ছিল—আমরা বাঙালি হিসেবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত দীর্ঘ এবং বিস্তৃত ছিলাম। একসময় আমরা ভাগ হয়েছিলাম; বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু এই ভাগ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এসে ১৯৭১ সালে নতুন করে চেতনার একটি ভাগ হয়। আবার ১৯৪৭ সালের ভাগ বাঙালির জন্য কার্যকর হয়নি। ’৭১-এর ভাগটি সাহিত্য চেতনায় আমাদের নতুনভাবে ভাবাল। এগুলো সব আপেক্ষিক কথা। আমরা বলি, আমাদের চেতনাপ্রবাহে নতুন করে যে জীবন এলো, সেটার সূত্রপাত আগেই হয়েছিল। ৬৬ সালে তার একটি শিকড় বড় করে গাঁথা হলো—৬৯-এর আন্দোলন এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে। ৬৬-এর ছয় দফা এবং ৬৯-এর আন্দোলনে জনজীবন ততখানি প্রভাবিত না হলেও ৭১-এ এসে আমি চেতনার অংশ হিসেবে শহর ও গ্রামকে একত্রিত করে ফেললাম। শহরবাসী গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিল এবং শহরবাসী প্রথমে বুঝতে পারল, এই শহর একটি মেকি শহর। এ শহরের সঙ্গে গ্রাম বিযুক্ত। অথচ আমাদের গ্রামের মানুষ, ভাই-বন্ধুরা প্রমাণ করল এই যুদ্ধ বাঙালির সার্বিক যুদ্ধ। যার ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ ছেলেমেয়ে গ্রামের; গ্রামের তরুণেরা। এটি আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন ছিল। বাংলাদেশ আজকের এই অবস্থানে আসার ৫০ বছর আগে তাদের অবদান ছিল অগ্রণী। হয়তো মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমরা সেটা করতে পারিনি। সেটা সাহিত্য জীবন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক জীবন এবং সমাজ জীবনেও। কিন্তু সেই মূল্যায়নের দিন এখন এসে গেছে। আমরা আবার নতুন করে বলছি, শহর থেকে গ্রামে যাব। এর ভিতরে একটি কারণ আছে। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত করেছি। তারও একটি কারণ আছে। অর্থাত্ আমরা যে বৃহত্তর অর্থে বাঙালি সত্তা, সে পরিচয় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দিয়েছে। এই মুক্তিযুদ্ধের পরেই আমরা ভাবতে শিখলাম, আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি স্বতন্ত্র। সর্বোপরি আমার সমস্ত মঙ্গল ভাবনা জারিত হলো। ফলে এই আমিকেই ‘আমরা’ করব।

মিল্টন বিশ্বাস :আপনার শিল্প-সাহিত্য রচনাগুলোর ভিতরে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে কথা বললাম। আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৫ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য আপনার কবিতায় কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :লেখার ভিতরে আমি চেষ্টা করেছি আমার মতো করে গভীরভাবে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিফলিত করতে। যেমন আমি প্রথম লেখাটি পড়ি, ‘সেও এক বিস্ময়! জন্মের কাছাকাছি কোনো গাছ/ শিকড় ছিঁড়েই দেখে ঝুলে আছে চাঁদ/ পশ্চিম আকাশে।’(গাছ) এখানে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আছে। প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ‘বিস্ময়’ শব্দটি আমি ব্যবহার করেছি। যাঁরা আধুনিক কবি, তাঁরা বিস্ময় ব্যবহার করবেন না। আমি ইচ্ছা করে ব্যবহার করেছি। এখানে আমি আমার অপরিণামদর্শিতা এবং অজ্ঞতাকে প্রকাশ করার জন্য বিস্ময় ব্যবহার করেছি। জন্মের কাছাকাছি কোনো গাছ, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। শিকড় ছিঁড়েই দেখে ঝুলে আছে চাঁদ পশ্চিম আকাশে। আপনি যদি একের পর একটি লাইন ধরে পড়েন এবং আপনি চিন্তা করেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধ পাবেন। শেষে দেখেন—‘সোনালি সিঞ্চনচ্যুত হে বৃক্ষ, হে আয়ুষ্মতী গাছ!/ সবুজ শিকড় গেঁথে পবনের নায়/ আমাকে উড়াল দাও।’ আমি স্বপ্নের কথা বলেছি। পরের কবিতা ‘সাপ’-এ আসেন। আমার দ্বন্দ্বটা সাপ নিয়ে, কারণ নিজেই পুষছি সাপ। ৭৫-এর সংকটের আগেই আমাদের এবং আমার একটি সংকট ছিল। কাজেই আমার কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি কিছু কথা আছে। তাছাড়া ভিতরে তো অন্য প্রসঙ্গ আছেই। এখানে আমি একটু সরাসরি বলি। আমরা ভিয়েতনামে দীর্ঘ দিনের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। এখানে তুলনামূলকভাবে ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিল দেখেছি। যেমন দুটি লাইন বলি—‘যেমন ক’রে ধূসর তাঁবু, ইফেল টাওয়ার/ ব্রীজের তলে দশটি আঙুল/ অন্ধকারে বারুদ পোড়ে/ বাংলাদেশে-/ তেমন ক’রেই/ শেষ প্রহরে/ বুকের হাড়ে/ রইছে গোপন/ ভিয়েতনামের/ বোমার ধোঁয়া।’ (অগ্ন্যুত্সবে সহযাত্রী) এর মাধ্যমে আমি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থন করছি। আমি কতটুকু পেরেছি কিংবা না পেরেছি তা ভিন্ন কথা। তবে চেষ্টা করেছি। আমি সু এবং কু—এই দুটি শব্দকে প্রাধান্য দিই। আমি সু-এর সঙ্গে থাকতে চাই। কু-এর সঙ্গে থাকতে চাই না। আমি যোগের সঙ্গে থাকতে চাই, বিয়োগের সঙ্গে নয়। আমি গুণের সঙ্গে থাকতে চাই, ভাগের সঙ্গে নয়।

মিল্টন বিশ্বাস :অর্থাৎ জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা ইতিবাচক?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :জীবন সম্পর্কে যদি ইতিবাচক ধারণার সৃষ্টি না হয়, তাহলে বাঁচার কোনো অর্থ আসে না। আমার লেখার কোনো অর্থ আসে না। কী জন্য আমি লিখব এবং কী জন্য বাঁচব। আমি সরাসরি সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলছি না। কিন্তু আমার বলার ভিতর দিয়ে, যাপনের ভিতর দিয়ে আমি চাচ্ছি সমাজের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে। আমি হয়তো সেই অর্থে কৃতকার্য হচ্ছি না। আমার চিন্তা ও চেতনার ভিতরে সার্বক্ষণিকভাবে আমিকে আমরা করার পরিপ্রেক্ষিতে থাকতে চাই।

মিল্টন বিশ্বাস :পাঠক আপনার এসব চিন্তা, চেতনা, আবেগ ও এষণাকে কতটা গ্রহণ করছে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমাদের নানা রকমের পাঠক রয়েছে। পাঠকের প্রতি সম্মান নিয়ে শ্রদ্ধা নিয়ে বলি, পাঠকই শেষ বিচার। কিন্তু আজকের পাঠক আগামী দিনের পাঠক, তারও পরের দিনের পাঠক, ভিন্ন ভিন্ন পাঠক হবেই। আমি পাঠক দেখি বলেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছি। আমার পাঠক আমার মতো করে আছে। পাঠক হবে আমার মতো করে। তাছাড়া লেখার কোনো মানে হয় না। হয়তো যেদিন আমি থাকব না, কবরেও না, কোনো অস্তিত্বও নেই, সেটাই হয়তো আমার নিয়তি। পৃথিবীতে কোনো কিছু স্থির নয়। আর এত এত বড় বড় কথা বলেও কিছু হবে না। আমি চেষ্টা করছি আমার মতো করে যাপন করতে।

মিল্টন বিশ্বাস :‘জলপাই সোমবার’ কবিতাটি কি স্বৈরশাসকের প্রতীক?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :এটা ঠিক ‘জলপাই’ বললে আমরা অন্যভাবে ভাবি। কিন্তু এটাকে আপনি অন্যভাবে দেখবেন, আমাদের সাতটি দিন আছে, সাতটি রং আছে। আমি সাতটি দিনকে সাত রঙে চিহ্নিত করি। মানডে ওলিভ কালারের আমার কাছে। সানডের কালারটা আমার কাছে রেড কালারের। আমি যখন লেখালেখি করি, তখন সাতটি দিনকে সাতটি রঙের সঙ্গে তুলনা করে লিখি। আমার সাতটি রং আছে, আমার সাতটি দিন আছে। প্রতিটি ঋতু আমার কাছে জ্যামিতিক বোধ নিয়ে একেক করে যায়-আসে। আমার কবিতায় আমি যেভাবে দেখার চেষ্টা করি, তাতে পঞ্চভূতে আমার বিশ্বাস। আকাশ, মাটি, আগুন, হাওয়া সবকিছু মিলিয়ে আমার ভিতরে আমি চিত্রিত দর্শন। দিনগুলো আমার কাছে এক-একটি রঙের প্রতিনিধি।

মিল্টন বিশ্বাস :দেশ-বিদেশে আপনার প্রিয় কবি-সাহিত্যিক কারা?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :প্রিয় বলাটা অনেক সময় অহেতুক হয়ে পড়ে। তবে আমি এতক্ষণে যা বলেছি, তাতে আপনি ধরতে পারেন যে আমার ধারাটি কী? এই ধারার ভিতর দিয়ে আমি বাইরের একজন কবির নাম বলব। ইংরেজি সাহিত্যে পশ্চিমের কবি, আশির দশকে তিনি আমাকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করেছেন, তাঁর নাম কবি ডিলান টমাস (১৯১৪-১৯৫৩)। আর এর পাশাপাশি আমি আর একজন কবির নাম বলব। তিনি ইতালিয়ান কবি সালভাদর কোয়াসিমোডো। যদি বাংলাদেশে বাংলা ভাষার কথা বলেন, তাহলে একজন আছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ নন, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

মিল্টন বিশ্বাস :মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাদেশকে রূপময় করে তুলেছেন? তিনি আমাদের মৃত্তিকার সন্তান। তিনি আপনাকে আকর্ষণ করেন তাঁর জীবন নাকি সৃষ্টিকর্মের জন্য?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :তাঁর কাব্যের জন্য। জীবনের জন্য আকর্ষণ করে বেশি দিন টিকানো যায় না। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন—যাপন করার বিত্ত-বৈভব তাঁর ছিল—জমিদার সন্তান ছিলেন। শুরু থেকে তাঁর সঙ্গতি ছিল। যে দর্শনের সঙ্গে তিনি চলেছেন, সেই সঙ্গতি ছিল বলেই চলেছেন। যে আধুনিকতায় তিনি বিশ্বাস করতেন, সেটাও তাঁর কাছে ছিল। একজন বিদ্যাসাগর যখন তাঁর সমস্ত ভুলত্রুটিকে ব্যক্তিগত জীবনের পরিসর থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বিচার করেন, তখন বুঝতে হবে লোকটির ভিতরে কতটুকু বিষয় ছিল, যা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-যাপনে নয়, তাঁর কর্মে প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কর্মের ব্যাপারে বলি, আমি যদি হ্যাঁ অথবা না-এর ব্যাপারটি বুঝতে পারি, তাহলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাছ থেকে বুঝেছি। সোজা বাংলায় অ্যান্টি হিরোর বিষয়টি বাংলা সাহিত্যে আমাকে মাইকেল শিখিয়েছেন। অন্য কেউ নয়। একজন রাবণ কেবল একটি চরিত্র শুধু নয়, একজন অনুঘটক শুধু নয়, একজন মেঘনাদ একজন চরিত্র শুধু নয়, জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রচলিত সু অর্থে আমরা রামকে চিন্তা করছি, কু অর্থে রাবণকে চিন্তা করছি। এই রাবণের কাছ থেকে সু অংশটুকু যিনি বের করে নিতে পেরেছেন, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

মিল্টন বিশ্বাস :মাইকেলের ব্যক্তিজীবনের যে হাহাকার, আর্তনাদ; তা তাঁর কাব্যে আছে কি?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :প্রতিটি লেখকের হাহাকার, কান্না, দুঃখ অদৃশ্যভাবে কাব্যের ভিতরে থাকে। তাঁর এত কিছু ছিল। তবু অর্থ সংকটে পড়েছেন। নানাভাবে তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত করে তুলেছেন। তাঁর ভিতরে কাব্য ভাবনা বা চরিত্রের ভিতরে কতটুকু তাঁকে সেটা দংশন করেছে? আমার তো মনে হয়, সেই অর্থে তাঁকে কিছুই দংশন করেনি। মাইকেল যে মাপে আধুনিক বাংলা কবিতাকে, অন্তত যে ধারার ভিতর দিয়ে আমরা আসছিলাম, আমাকে অন্তত চিহ্নিত করে দিলেন, এই একখানি বই যার নাম ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। এটি তুমি পাঠ করো তোমার জীবনের অংশ বা জীবনযাপনের অংশ হিসেবে। একটি মিথকে ব্যবহার করলেন কিন্তু সেই মিথের অ্যান্টি মিথ হিসেবে। এটি একটি বিশাল ব্যাপার। প্রথমে বললেন ‘গাইব মা, বীররসে ভাসি ...’। বলুন তো সেই উচ্চারণ, তখনকার সময়ে। এই যে বীররসের যে আহ্বান এটি তো বীরের বা সু-এর মঙ্গলের পক্ষে যায়। আমার প্রিয়তার কারণে বললাম। আর রবীন্দ্রনাথ চেতনার অংশ। সার্বিকভাবে প্রত্যহ রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারপরও তো কথা থাকে, ঘরেরও তো দুয়ার থাকে। কেবল চারপাশে দেয়াল দিলেই তো ঘর হয় না। দুয়ার থাকে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাওয়া লাগে। আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আছি, কিন্তু যন্ত্রের ভিতরে ফ্রেস হাওয়া দেওয়ার ব্যবস্থা লাগে। আর এই ফ্রেস হাওয়া দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ। মাইকেল হলেন মূল ঘর।

মিল্টন বিশ্বাস : প্রাতিষ্ঠানিক পরিধির মধ্যে থেকে এবং অসংখ্য দায়িত্ব পালন করে কাব্য চর্চা করেন কিভাবে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :এটি আমার জন্য অত্যন্ত সুখকর উচ্চারণ যে, আমি বাংলা একাডেমিতে এখন কর্মী হিসেবে কাজ করছি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কারণে আগে যেসব অঞ্চলে আমাকে কাজ করে আসতে হয়েছে, সেই অঞ্চলের তুলনায় এটি স্বর্গ। অর্থাত্ এখানে কাজ করার এবং শ্রমের যে আনন্দ, সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে শ্রমকে লাঘব করা যায় এখানে। কিন্তু আমি যে অঞ্চলে এবং পরিবেশ থেকে এসেছি, যে সমস্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে এসেছি, তার ভিতর থেকে সাহস করেছি সাহিত্য করার। তবে সাহিত্য না করলেও কিছু আসে যায় না। আমি বাংলা একাডেমিতে এসে ভাষা, সাহিত্য এবং মঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি। এই যোগ্যতা তো আমার আগে ছিল না। যে কারণে সবকিছু ত্যাগ করে আমি এখানে আসার শপথ নিয়েছিলাম। যিনি কাব্যচর্চা করবেন তিনি করবেনই—মানুুষের ঘর-সংসার থেকে শুরু করে সবকিছু ছাড় দেওয়ার ভেতরে। আপনি সংসার যাপন করবেন, সেখানেও পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে ভাগ করে নিতে হবে। তা না হলে ৪০ থেকে ৬০ বছর পর সংসারে অশান্তি বেঁধে যাবে। যখন পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে ভাগ করে নিলেন, তখন আপনার ৫০ থেকে সন্তানকে আবার ভাগ দিতে হবে। স্ত্রীকেও ৫০ থেকে ভাগ দিতে হবে। আমি যখন অন্য পেশার সঙ্গে কাজ করেছি, তখন কবিতা আমার সঙ্গে ছিল। তখন আমি ভেবে নিয়েছি এটিই আমার কবিতা। এটিই আমার পেশা। এখানে কাজ করতে এসে সবাই আমার বন্ধু। সবকিছু অনুকূলে। এত আনন্দের ভিতরে আছি, আমার বাড়ির ভিতরে আছি। আনন্দ যাপন এক জীবনে পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। যতটুকু পারি যাপনের অংশ হিসেবে দেখার চেষ্টা করি।

মিল্টন বিশ্বাস :সাহিত্যের নানা ধারায় আপনি বিচরণ করেছেন। কবি হিসেবেই আপনাকে চিনি। এর বাইরে আপনি যদি ঔপন্যাসিক হতেন?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমি যদি পারতাম তাহলে হয়তো ওই দিকেই যেতাম। আমি প্রচুর গল্প লিখেছি। ওই অর্থে কোনো বই নেই। নতুনভাবে আমি কিছু গল্পের আচ্ছাদনে লেখার চেষ্টা করেছি। সম্প্রতি ‘আয় রে আমার গোলাপজান’ নামে আমার একটি বই বের হয়েছে। এটিকে ঠিক গল্পও বলতে পারেন, অনুবাদও বলতে পারেন। উপন্যাস পারতাম না। কারণ এর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শ্রম দেওয়া দরকার, ভাষা ব্যবহার, ভাষা রীতির দিকে নজর দেওয়া দরকার। উপন্যাস অধিক যোগাযোগনির্ভর। এখানে প্রচ্ছন্নতার কোনো বিষয় নেই। যেটুকু আছে, তা সাহিত্যিক প্রচ্ছন্নতা। ওই ক্ষমতা আমার নেই।

মিল্টন বিশ্বাস :গল্প-উপন্যাসে কি কাব্যচর্চার প্রভাব থাকে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :অবশ্যই থাকে। কবিতায় একটি গল্প থাকে। এখানে আমার কবিতা পড়বেন, দেখবেন একটি গল্প আছে। এগুলো পড়লে প্রতিটি থেকে একটি করে গল্প পাবেন।

মিল্টন বিশ্বাস :আপনার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। প্রথম কবিতার বই ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। দ্বিতীয় বই ‘মোমশিল্পের ক্ষয়ক্ষতি’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৭ সালে। কবি হিসেবে পরিচিত হলেও আপনার প্রথম বই ‘উপন্যাস’। গদ্যের পর কবিতায় আত্মনিয়োগের বিষয় সম্পর্কে জানতে চাই। কথাসাহিত্য দিয়ে শুরু করে কবি হওয়ার বিষয়ে।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমি লেখালেখি প্রথমে কবিতা দিয়েই শুরু করি। তবে যে কারণেই হোক কথাসাহিত্যের বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমে। স্বাধীনতার পরপরই প্রকাশক আগ্রহ দেখায়। আর প্রকাশক যদি বইয়ের বিষয়ে আগ্রহ দেখায় তাহলে ওই লোভটি সংবরণ করা কঠিন। বলা চলে প্রকাশকের আগ্রহে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম কবিতার বই ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা বের করে। তবে প্রথমটি ‘উপন্যাস’ কি না ঠিক জানি না। লেখা এবং চর্চার ক্ষেত্রে আমি সক্ষম কি না তার একটি অনুশীলন হচ্ছে ওই উপন্যাসটি। অনুশীলন করতে করতে আমি একটি বই প্রকাশ করি। কেবল প্রকাশকের কারণে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর সেই অর্থে আর কোনো উপন্যাস বের হয়নি। আশির দশকে আমার আত্মজৈবনিক লেখা ‘পরাজয়’ নামে বের হয়। বলা চলে এটি কথাসাহিত্যের একটি অংশ। ‘আয় রে আমার গোলাপজান’—এটি কি কথাসাহিত্যের অংশ নাকি নয়? সেটা বোদ্ধা পাঠকেরা বিচার করবে। কোনটা কোনটার অংশ। অবশ্য আমি সেভাবে লিখিনি। এটা কবিতার বই ও ওটা গদ্যের বই—আমি ঠিক সেইভাবে লিখি না। আমি যখন লিখি, তখন একটা চিন্তা আমার মাথায় থাকে, তা হলো কে পড়বে? বিষয়ের বাইরে আর কোনো চিন্তা নেই। সেইভাবে আমি আমার ছন্দ ও শব্দ নির্বাচন করি। আমার কবিতার বিষয় এবং শিশুদের বিষয় কিন্তু একই। কেবল শব্দ এবং ছন্দকে আমি ওইভাবে নির্বাচন করি।

মিল্টস বিশ্বাস :আপনার ‘কবিতাসমগ্রে’র পাঠক হিসেবে জানি, আপনার কবিতার বুনন, ভাষাশৈলী, কলাকৌশল, উপস্থাপন এবং বিষয় নির্বাচনে ধারাবদল বা পরিবর্তনের প্রবণতা রয়েছে। বিষয়টি কি আপনার সচেতন প্রয়াস? নাকি কবিতা নিয়ে সমকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার তাগিদ?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :ব্যাপারটি হলো আমি একেকটি সময় একেকটি ঘোরে বা যাপনের সঙ্গে ছিলাম। তখন যে লেখাগুলো হয়েছে, সেটি একটি অংশ। আর পরিবর্তনের বিষয়ে আমি মনে করেছি এবং সে মোতাবেক অনেক লেখেছি। এবার একটু অন্যভাবে লিখতে পারি কিনা? নানা উপাত্তে আমি বাঁক বদল করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করেছি, এটা একজন কবির জন্য জরুরি। কেন জরুরি? এতে করে তাঁর চিন্তার প্রসারতা বাড়ে, তার বিষয়বস্তুর গভীরতা বাড়ে। সর্বোপরি পাঠক তাঁকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে পারেন। সময় মানুষকে তাঁর দাবির কাছে নিয়ে আসে। সময়ের বাইরের আরেকজনও আসতে পারে। সময়ের বাইরে আসার এক ধরনের প্রবণতা আমার আছে। আমি অত্যন্ত ধৃষ্টতার সঙ্গে বলি, সময়ের বাইরে আমি থাকতে চাই। সময়ের সামনে থাকতে চাই।

মিল্টন বিশ্বাস :আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা শব্দটি আমার কাছে ক্লিসে শব্দ। আধুনিকতা কী দিয়ে পরিষ্কার করছেন? এর মানে সময় দিয়ে আধুনিকতা বিচার করা হচ্ছে। কিন্তু সময়ের কি বর্তমান আছে? সময়ের কোনো বর্তমান নেই। বর্তমান কাল বলে কোনো কাল নেই। আমরা প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াসকে বর্তমান বলে চালাচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যে সময় অতীত হয়ে যাচ্ছে। অতীতের ওপর ভর করে বর্তমানকে ডিঙিয়ে ভবিষ্যত্ নির্মিত হয়। বর্তমান বলে কোনো কাল নেই। অর্থাত্ আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতা আমাদের তৈরি করা একটি অংশ বা খণ্ড। একটি ইলিশ মাছকে মাথার দিকে, পেটের দিকে এবং লেজের দিকে কেটে বিভক্ত করা হলো। বলা হলো এটা ইলিশের মাথার লেজ, পেটির লেজ এবং এটি শেষের লেজ; সমগ্র অংশ কিন্তু ইলিশ। পুরো জিনিসকে ভোগ করতে হবে। অনুরূপভাবে সাহিত্যের পুরো বিষয় আমাদের ভোগ করতে হবে। সেটা আধুনিক, অতি আধুনিক কিংবা উত্তর-আধুনিকতা বা প্রতিস্থাপনই হোক না কেন। উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে আমার কোনো ধরনের বক্তব্য নেই।

মিল্টন বিশ্বাস : আপনার ‘প্রেমের কবিতা’, ‘কবিতাসমগ্র’ প্রভৃতি সংকলন আছে। এ ধরনের গ্রন্থ কেন প্রয়োজন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :প্রকৃত অর্থে সংকলন তৈরি হয় কখনো কখনো কবির ইচ্ছানুযায়ী। আবার প্রকাশকের ইচ্ছাও কাজ করে। প্রকাশক তার বাজার এবং পাঠক বিবেচনা করে প্রেমের কবিতা, প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা এমন বিভিন্ন নামে বই করেন। তবে মূলত বিষয়টি কবিতা হয়েছে কি না, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর তাঁকে ব্যবচ্ছেদ করা যায়। তাঁকে প্রেম, প্রকৃতি ও বিদ্রোহের কবিতা বানানো হয়। আমিও লোভের বা প্রলোভনের ভিতরে আছি। প্রকাশক বলেছেন এইভাবে একটি বই দেন। আমি দিয়েছি, প্রকাশিত হয়েছে।
মিল্টন বিশ্বাস :আপনার নতুন পাঠক সৃষ্টি হয় কিভাবে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :নতুন পাঠক নানাভাবে সৃষ্টি হয়। পাঠক সবসময় চায় তাঁর নিজের প্রয়োজন। নিয়মিত পাঠক কয়জন? পাঠকের চিন্তা সবসময় শর্টকাট। আমি তরুণ, প্রেমে পড়েছি, দেখি বাজারে প্রেমের কী কী কবিতার বই আছে। আমি আবৃত্তি করি, আবৃত্তির জন্য কী কী বই আছে, কাউকে উপহার দেওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ কবিতা কী কী আছে। পাঠক এইভাবে নিজেকে খণ্ড খণ্ড করে ফেলে। লেখক তাঁর সঙ্গে প্ররোচনায় পড়ে যায়। যদিও আমিও সেই প্রলোভনের শিকার।

মিল্টন বিশ্বাস :কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে আপনি কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছেন এবং যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাই। কারণ বাংলা একাডেমির অনেক কাজই অনুবাদ নিয়ে।

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমার অনুবাদ করতে অনেক সময় লাগে। আমি খুব কম সময়ে অনুবাদ করেছিলাম একটি বই। বইটির জন্য আমার ভিতর থেকে খুব তাড়া ছিল। বইটি আমি মাত্র চার বছরে শেষ করেছিলাম। পাঠক হিসেবে আমি খুব অণু; অনুবাদক হিসেবেও তাই। একটি লাইন দশ বার পড়ার পর আমি ভিতরের শিকলটি খুলতে চাই। আমি শিকল রেখে দরজা লাগাতে চাই না। শিকলটি খুলে দরজা লাগাতে চাই। কারণ শিকল খোলাটাই হচ্ছে অনুবাদকের মূল কাজ, মানে টেক্সট খুলে ফেলা। সবাই কিন্তু শিকল খুলতে পারেন না। যিনি খুলতে পারেন, তিনি আবার ইচ্ছা করলে দরজা লাগাতে পারেন না। অনুবাদ হচ্ছে দরজা ও শিকল খোলার বিষয়। প্রথমে বিষয়ের, তারপর গড়নে ও গঠনে, তারপর হলো চরিত্রের, অর্থাত্ লেখক চরিত্র থেকে শুরু করে অনুবাদ চরিত্রের, তারপর সময় এবং সবার শেষে ভাষা। অনুবাদের ক্ষেত্রে খুলতে জানলে জোড়াও লাগানো যায়। যেমন :অপটু মেকারকে ঘড়ি ঠিক করতে দিলে খোলার পরে আর জোড়া লাগাতে পারে না। তখন সেটাকে ঘড়িও বলা যায় না এবং অচল হয়ে যায়।

অনুবাদ কিন্তু তেমনি, যিনি পটু, তিনি প্রকৃত অর্থে জোড়া লাগাতে পারেন। রবীন্দ্রনাথও টি এস এলিয়ট অনুবাদ করেছেন। আমাদের জীবনানন্দও কিন্তু ইয়েটস অনুবাদ করেছেন। যাঁরা প্রাণের টানে অনুবাদ করেন, তাঁরা একটি রিলিফ চান। সু-অনুবাদকই সুরের সঙ্গে ভাষার সঙ্গে থাকতে চান। আর কু-অনুবাদকই ভালো কবি—সবই গিলে ফেলে। ওই অনুবাদ বাংলা ভাষায় হয়, কিন্তু অনুবাদকের নাম থাকে না। বাংলা ভাষায় এমন রচনা অনেক আছে যাতে অনুবাদকের নাম থাকে না। কবিতাকে গিলে ফেলে নিজের কবিতা বলে ফেলে। এখন অনুবাদের নানা চরিত্র। তবু আমরা চাই দুধ দেখতে সাদা—খেতে টক নাকি ঝাল? পরিপূর্ণ স্বাদ? বা ঝোলের স্বাদ না পাই? অন্তত মূল দুধের ঘোলের স্বাদটা যদি ধরি তবে ওটাই অনুবাদ। আমি খুব কাঁচা অনুবাদক। নিজেকে তৈরি করার জন্য অনুবাদ দিয়ে শুরু করেছিলাম। আমি আফ্রিকার কবিতা অনুবাদ করছি। আফ্রিকার কবিতা অনুবাদ করতে হলে পুরো আফ্রিকার ইতিহাস জানতে হবে। যার কারণে আমার সময় লাগছে। আমি একটি রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে। আশরাফ ও আতরাফ বাড়ির মুরগির ঝোলের পার্থক্য বুঝি। আমি এখনো রেজাই, মানে রেকাব চিনি। ফারসি কিংবা আরবি উর্দু শব্দ বুঝালে আমি বুঝতে পারি।

মিল্টন বিশ্বাস :আপনার ‘কবিতাসমগ্রে’ বঙ্গবন্ধু এবং ১৫ আগস্ট নিয়ে কবিতা আছে—বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ নিয়ে ‘একা ও করুণা’ রচনা করেছেন। আপনার সৃষ্টিকর্মে বঙ্গবন্ধু কিভাবে প্রভাব রেখেছেন?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমার সৃষ্টিকর্মে বঙ্গবন্ধুর প্রভাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘একা ও করুণা’ কাব্যনাটক ফর্মে লেখা। চরিত্র হিসেবে এর মধ্যে বাংলাদেশ ও পার্লামেন্ট আছে। এর ভিতর একজন পুলিশ ও চোর আছে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে অনেক বিষয় আছে। প্রকরণের দিক থেকে আলাদা এটি। চোর ও পুলিশ আরেকটি প্রতিরোধ। পার্লামেন্ট আরেকটি প্রতিরোধ। এইসব প্রতিরোধ দিয়েই আমি বুঝাতে চেষ্টা করেছি— ‘এই যে রক্তাক্ত পথ/ এই যে উত্থান-/ এই যে মনুষ্য-রূপ/ এই যে মৃত্তিকা/ সবুজ-লালের এই আগুন-পতাকা/ কতোদূর তার সঙ্গে যাবে?’ এর অর্থ বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাস করল বাংলাদেশ, তখন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে বললেন, ‘তোমার সমান আমি’/ মানে বাংলাদেশের সমান। ‘তোমাতেই লীন-/ এই মাটি, এই জল, আকাশের রং/ আমার রক্তের মধ্যে তোমাকে খুঁজুক।/ জন্মের ফসল থাক নিরবধি কাল।/ জয় হোক মানুষের/ বাঙালি বাংলার।’
মিল্টন বিশ্বাস :এখন আরো কিছু প্রসঙ্গে কথা বলি। আপনার মতে বাংলা সাহিত্য কিভাবে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :বাংলা একাডেমির একটি অনুবাদ শাখা রয়েছে। আমরা অনুবাদ শাখাকে পূর্ণাঙ্গ করতে চাই। পৃথিবীর যে সমস্ত ভাষাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি, সেগুলোর মধ্যে প্রধান ভাষা হলো ইংরেজি। তার কারণও আমরা জানি। আমরা দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিলাম। ইংরেজদের আধিপত্যে ছিলাম। ফলে ইংরেজি ভাষাটি নানাভাবে এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। যদি ফরাসিরা শাসন করত তাহলে আরেক রকম হতো। বাংলা একাডেমি জন্মলগ্ন থেকেই অনুবাদ করে আসছে। অনেক ভালো ভালো অনুবাদ এখান থেকে বের হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের কিছু কিছু বই ভিন্ন ভাষায় অনুবাদের কাজও হয়েছে। যেমন :পূর্বের জাপানি ও কোরিয়া ভাষা, মধ্য অঞ্চলের ফার্সি ভাষা, পশ্চিম অঞ্চলের আরবি ভাষা, স্প্যানিস ও জার্মান ভাষা। এইসব ভাষায় বাংলা ভাষার বই অনূদিত করার পরিকল্পনা চলছে। এ কাজের জন্য আমরা আলাদা সেল করার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে আমরা একটি বই আরবি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছি, বইটির নাম ‘শেখ হাসিনা :যে রূপকথা শুধু রূপকথা নয়’; মূল রচয়িতা মিশরীয় লেখক মোহসেন আল আরিশি। আমি মনে করি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বইটি দারুণভাবে প্রভাব ফেলবে।

মিল্টন বিশ্বাস :আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের গুরুত্ব কী?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :আমরা বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করানোর জন্য নানাভাবে চেষ্টা করার প্রেক্ষাপটে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা এবং সাহিত্য মেলা করার চিন্তা-ভাবনা সবসময় করি এবং করে আসছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক রূপটি আন্তর্জাতিক রূপে পরিগণিত হয় না। এখানে নানা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক সাহিত্য মেলার নামে কিছু কিছু কাজ করে। এখানে বড় কাজটি করে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’। তবে ওটাও আমি মনে করি, ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য দিয়ে ফেস্টিভ্যালটি হয়। যদি সম্ভব হয়, তাহলে আগামীতে সত্যিকার অর্থে আমরা একটি সাহিত্য সভা, সম্মিলন যাই বলি না কেন, তা করার চেষ্টা করব। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আন্তর্জাতিক একটি বই মেলা আয়োজনেরও পরিকল্পনা করেছি। যেটার সঙ্গে আমাদের মন্ত্রণালয়ও থাকবে। মন্ত্রণালয় মোটামুটিভাবে একটি দায়িত্ব আমাদের ওপর দিয়েছে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা করার জন্য। ওই বইমেলা করার পাশাপাশি একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য উত্সব করারও। এটা গেল বাংলা ভাষার বিকাশ ও অনুবাদের দিক। বাংলা একাডেমির অন্যান্য ক্রিয়া-কলাপের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করেছি।

২০২০ সালের বইমেলাটি আমরা বঙ্গবন্ধুর নামে উত্সর্গ করব। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে বাংলা একাডেমি বাংলা এবং অন্য ভাষায় একশ বই প্রকাশ করবে। এই কাজটি আমরা ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছি এবং এগিয়ে যাচ্ছে। কাজটি করতে আমাদের মোটামুটি ৫ বছরের পরিকল্পনা রয়েছে। ৫ বছরের মধ্যেই ১০০ খানা বই করব। আমাদের ইচ্ছা তথা সবার ইচ্ছা যেন বইয়ের গুণগত মান ঠিক থাকে। সেদিকে আমরা সর্বাধিক নজর দেওয়ার চেষ্টা করব। এর পাশাপাশি আর একটি কাজ, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি যদি মনে করে, তাহলে কাজ করবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং আমাদের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট, সর্বোপরি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো কী ছিল? স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নে কী করা উচিত? এই পরিপেক্ষিতে আমরা কিছু বই করার পরিকল্পনা করেছি। আমাদের যা নিয়মিত কাজ বইয়ের পুনর্মুদ্রণ, ভাষা ও সাহিত্যের জন্য গবেষণার জন্য কাজ করা, সেগুলো ভালোভাবে হচ্ছে। আমাদের এখান থেকে আগে অনেক পত্রিকা বের হতো। মাঝখানে নানা কারণে পত্রিকাগুলো প্রকাশে ব্যত্যয় ঘটেছে। বর্তমানে ‘উত্তরাধিকার’ আমরা নিয়মিত বের করছি। ইতোমধ্যে দুটি সংখ্যা বের হয়েছে। ‘ধান শালিকের দেশ’ও আমরা নিয়মিত করার চেষ্টা করছি। একটি সংখ্যা বের হয়েছে, আর একটি সংখ্যা আগামীতে বের হবে। আমাদের একটি ইংরেজি জার্নাল আগামী জুন মাসে বের হবে। আমাদের বিজ্ঞান পত্রিকা আগামী মাসে না হলেও পরের মাসে বের হবে। আমাদের ‘বাংলা একাডেমি গবেষণা পত্রিকা’ নামে একটি গবেষণা পত্রিকা আছে। যার একটি নতুন সংখ্যা বের হয়েছে। ছয় মাস অন্তর এটি বের হবে। বাংলা একাডেমির নিজস্ব একটি পত্রিকা ছিল ‘বাংলা একাডেমি বার্তা’ সেটি প্রথম সংখ্যা এ মাসে বের হবে। নতুন সংযোজনের মধ্যে ‘লোকজ’ উপাদান, সাহিত্য ও লোকজ ব্যবহার ও আচার সর্বোপরি লোক উপাদান নিয়ে আমরা একটি কাগজ করার চিন্তা করছি। সেটির প্রাথমিক পরিকল্পনার কাজ এগিয়ে চলছে। মোটামুটিভাবে আমাদের পত্রিকাগুলোর এই অবস্থা।

মিল্টন বিশ্বাস :বাংলা একাডেমি স্বনামধন্য লেখকদের বই প্রকাশে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ নিয়ে নতুন আর কী কাজ করছেন এই মুহূর্তে?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :ভাষা এবং সাহিত্যে যারা গৌরবজনক ভূমিকা পালন করেছেন, জীবিত বা মৃত, তাঁদের একটি করে মৌলিক বই বের করব। যাঁরা বাংলা একাডেমির ফেলো—জীবিত বা মৃত তাঁদের একটি করে মৌলিক গ্রন্থ আমরা করব। যিনি কবি, তাঁর কবিতার বই, তিনি ঔপন্যাসিক তাঁর একখানা উপন্যাস করব। আর গবেষণার ক্ষেত্রে ভালো গবেষণাধর্মী বই আমরা করতে আগ্রহী। আমাদের হাতে অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে আছে। নানা কারণে আমরা সে বইগুলো প্রকাশ করতে পারছি না। আশা করছি আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে নিয়মিতভাবে আমরা করে যেতে পারব। বাকি রইল আমাদের সংস্কৃতি উপবিভাগ এবং অন্যান্য উপবিভাগগুলো। আপনারা জানেন যে, আমরা আমাদের মহান ব্যক্তিদের জন্মমৃত্যুর দিনগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করি। তাঁদের ওপর সেমিনার করি, নানা পাঠ্য নিয়ে আলোচনা করি।

এরই সঙ্গে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এক মাসব্যাপী সেমিনার, কবিতা পাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে থাকি। আমাদের এখানে আগে একটি প্রকল্প চালু ছিল—তরুণ লেখক প্রকল্প। সবাই এটি পছন্দ করেছিলেন। তবে নতুনভাবে কিছু করা যায় কি না সেটা দেখা হচ্ছে। সেটি হতে পারে বিদেশি ভাষা শিক্ষা নিয়ে। অনুবাদের অংশ হিসেবে ভাষা শিক্ষা নামে নতুন একটি শাখা যুক্ত করার বিষয় আমরা ভাবছি। আমরা বিভিন্ন ভাষা শেখানোর চেষ্টা করব। তরুণদের দিয়ে অনুবাদের কাজ করানো হবে। বলতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট’ আছে, ‘আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ’, জার্মানির ‘গ্যেটে ইনস্টিটিউট’ আছে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ভাষা শেখায়। কিন্তু বাংলা একাডেমি বাংলা একাডেমির মতো কাজ করবে, তারা তাদের কাজটি করবে। আমরা রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে, আমাদের মননশীলতার অংশ হিসেবে এইসব কাজ করব। মোটা দাগে এই হলো বাংলা একাডেমির পরিকল্পনা।

মিল্টন বিশ্বাস :বাজেট বা টাকার উত্স কি যথেষ্ট?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :বাজেট একমুখী নয়, দ্বিমুখী। আমরা চাইব, তারা দেবে। আশা করছি, আমরা যদি ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি, আমাদের জনবল, মনোবল এবং আমাদের কর্মবল দিয়ে আশা করি যে, আমরা প্রথমবার হয়তো ১০ ভাগ পাব, দ্বিতীয়বার ২০ ভাগ পাব। তাই বলে ৫ বছরের একটি পরিকল্পনা আমরা কেন করব না। যদি না পাই তাহলে বলব আমি এটা পারিনি। কিন্তু বাজেটের দোহাই দিয়ে আমি তো বসে থাকতে পারব না।
মিল্টন বিশ্বাস :অতীতে হুমায়ূন আজাদ স্যার দশ খণ্ডে বাংলা ব্যাকরণ লেখার জন্য পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। সে প্রস্তাবটি পাস হয়নি। এজন্য আশঙ্কা থেকে যায় কি?

হাবীবুল্লাহ সিরাজী :কেন পাস হলো না সেটার ব্যাপারে আমি জানি না। তবে বাংলা একাডেমি একটি বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছে। যতটুকু আমি বুঝতে পারি, এটি সর্বজনগ্রাহ্য। এটির কর্ম সম্পাদনা পরিষদের কোনো ধরনের আপত্তি-বিপত্তি ছিল না।

মিল্টন বিশ্বাস :সাহিত্যের মান নির্ধারণ নিয়ে এবারও বইমেলায় কথা উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
হাবীবুল্লাহ সিরাজী :সাহিত্যের মান নির্ধারণ নিয়ে আমি কিছু বলব না। কারণ সাহিত্যের মান নির্ধারণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। খুব একটি অমৌলিক ব্যাপার। সাহিত্য কোনো মাছ কিংবা দুধ না। সাহিত্যের যে সমস্ত উপাত্ত ধরে, তা সাদামাটা কথা। পাখির আনন্দ, মঙ্গল চিন্তা—সাদামাটা চিন্তা—ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। এসব কিছু থাকলেই আমি মনে করি সাহিত্য। এগুলো হলো বিষয়ভিত্তিক কথা। কিন্তু মূল বিষয় হলো সাহিত্য। তৈরি হওয়ার বিষয়। ভাষা, শব্দ, বাক্য ও চরিত্র নির্মাণের বিষয়। প্রতিটি শব্দের মাঝে দুনিয়াকে দেখা, প্রতিটি বর্ণের মধ্যে জগতকে দেখা। সাতটি রং থেকে শুরু করে ছয়টি ঋতুকে দেখা। এটি কিন্তু সাহিত্য রচনার অংশ। এটিকে ধারণ করে যেসব রচনা হবে, নিশ্চয় জনগণ তা গ্রহণ করবে, পাঠক গ্রহণ করবে। আজ না গ্রহণ করলেও দশ বছর পর তা গ্রহণ করবে। পুরস্কার যাচাইয়ে সাহিত্যের বিচার সেই অর্থে হয় না। কোনোদিনই তা হয়নি। বাংলা একাডেমিও সেটি করতে পারে না। বাংলা একাডেমি সর্বোত্তমভাবে চেষ্টা করে নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশে যাঁরা গুণীজন তাঁদের জুরি বোর্ডে রেখে একটি পুরস্কার প্রদান করার জন্য। এখানে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, অন্তত আমি আমার সময়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের কোনো ভূমিকা এখানে নেই। পুরস্কার নিয়ে মান যাচাইয়ের বিষয় ধর্তব্যের বিষয় নয়। অনেক বড় বড় লেখক নোবেল পুরস্কার পাননি, তাই বলে কি তারা লেখক নন?

এইচআর/জেআইএম

সাহিত্যের মান নির্ধারণ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। খুব একটি অমৌলিক ব্যাপার। সাহিত্য কোনো মাছ কিংবা দুধ না। সাহিত্যের যে সমস্ত উপাত্ত ধরে, তা সাদামাটা কথা। পাখির আনন্দ, মঙ্গল চিন্তা—সাদামাটা চিন্তা—ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। এসব কিছু থাকলেই আমি মনে করি সাহিত্য। এগুলো হলো বিষয়ভিত্তিক কথা। কিন্তু মূল বিষয় হলো সাহিত্য। তৈরি হওয়ার বিষয়। ভাষা, শব্দ, বাক্য ও চরিত্র নির্মাণের বিষয়। প্রতিটি শব্দের মাঝে দুনিয়াকে দেখা, প্রতিটি বর্ণের মধ্যে জগতকে দেখা। সাতটি রং থেকে শুরু করে ছয়টি ঋতুকে দেখা। এটি কিন্তু সাহিত্য রচনার অংশ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।