মায়াবতী : পর্ব ০৫
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি-
ছয়.
গুলশান থানা-বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ। থানার ওসির সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। কালো প্রাডো গাড়ি ঢুকতে দেখে কথা থেমে গেল তাঁর। একটু এগিয়ে এলেন তিনি।
রেজা গাড়ি থেকে নেমেই ফারুক সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বাল্যবন্ধু। বন্ধুর জন্য তো বন্ধু করবেই। এ ভরসার চিড় ধরেনি। ফারুক সাহেব রেজা মামাকে নিয়ে ওসির অফিস কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন। দ্রুত হেঁটে মুনা আগেই সাইনবোর্ড দেখে ওই কক্ষে ঢোকে।
রিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে।
ছুটে গিয়ে রিয়ার পাশে দাঁড়াল মুনা। ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে পরস্পরকে।
রিয়া শক্ত করে মুনার হাত চেপে ধরে থাকে। চোখ বেয়ে নেমে আসতে শুরু করে অশ্রুধারা।
এবার রেজা এসে সামনে দাঁড়ায়।
উঠে দাঁড়াল রিয়া।
রেজা ওর মাথায় হাত ছুঁয়ে দেয়। দুবার হালকা টোকা দিয়ে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।
মামার হাতের ছোঁয়া পেয়ে আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে রিয়া।
কিছুটা সময় নিল সবাই। কেউ কথা বলছে না। রিয়া কেঁদেকেটে নরম হয় একসময়। তারপর গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল সবাই।
ফারুক সাহেবকেও গাড়িতে তুলে নেয় রেজা।
পেছনে রিয়া এবং মুনা। সামনে ফারুক সাহেব। ড্রাইভ করছে রেজা।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে।
কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই নির্বাক।
রিয়াকে কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। আপাতত ওকে রেস্টে থাকতে দেওয়া উচিত। নিজে থেকে কিছু বলার জন্য উৎসাহিত করা যাবে না। চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। ফিসফিস করে কথাগুলো বললেন ফারুক সাহেব।
রেজা মনোযোগ দিয়ে বন্ধুর কথা শোনে। নিজেও রিয়ার কেউ না। তবু মনে হচ্ছে অনেক কাছের কেউ। তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।
মুনা বসে আছে রিয়ার হাত ধরে। কথা বলেনি, প্রশ্নও করেনি। অনেকক্ষণ পর রিয়া মুখ খোলে, মামণি কেমন আছে? বাপি? তারা এল না কেন?
মুনা সহজ থেকে বলল, আন্টি বাসাতেই আছেন। উনাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। এজন্য ডিস্টার্ব করিনি। গেলেই তাঁকে দেখবি, আঙ্কেল খুঁজে বেড়াচ্ছেন তোকে। উঁনিও আসছেন বাসায়। তোর খবর দেওয়া হয়েছে।
রিয়া বলল, ওদের মুখ দেখাব কীভাবে?
মুখ দেখানোর কী আছে? ঘরের মেয়ে ফিরে এসেছে, ভালো আছে। এটাই তো যথেষ্ট।
মামণির ওপর রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তখন তো বুঝতে পারিনি রাগের মাশুল এভাবে দিতে হবে।
মাশুল মানে? ওরা কি জুলুম করেছে? অত্যাচার করেছে? খারাপ কিছু করেছে? মুনা বেশ ভয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রিয়া দ্রুতই জবাব দেয়, না না খারাপ কিছু করার উদ্দেশ্য ছিল না ওদের। আমাকে আটকে রেখে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল। বাপির কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ব্যাস। খারাপ কিছু করতে পারেনি। এটাই যথেষ্ট। ভুল করেছিস। শিক্ষা পেয়েছিস। এ শিক্ষা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। মুনা আবারও বেশ সপ্রতিভ জবাব দিল।
ওরা আমার কিছু ছবি তুলে নিয়েছে। এবার ভীত গলায় বলল রিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে ফারুক সাহেব পেছনে ফিরে তাকালেন। কোনো প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল না তাঁর এখন। তবুও তিনি প্রশ্ন করলেন।
ছবি খারাপভাবে তুলেছে?
মোটামুটি খারাপই বলা চলে। পিস্তলের মুখে ছবি তুলেছে। হুমকি দিয়ে বলেছে, টাকা না পেলে ওসব ছবি অনলাইনে ছেড়ে দেবে।
তুমি ভয় পেয়ো না। আমি ছবি উদ্ধার করব। ওদের অ্যারেস্ট করতে পারব। আমার বাহিনী এখন ওদের ধরার কাজে নেমে পড়েছে।
রিয়া চুপ করে থাকে। রেজাও চুপ। ফারুক সাহেব আশ্বাস দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। রেজার চোখে বেশ চিন্তিত লাগছে এখন তাঁকে।
তুই না বললি, খারাপ আচরণ করেনি? মুনা প্রশ্ন করল।
মানে শারীরিক কোনো নির্যাতন করেনি। ছবি তুলেছে।
ন্যূড ছবি?
পুরো ন্যূড না। আধাআধি। রিয়া ভীত গলায় জবাব দিল।
ওটাই তো খারাপ আচরণ। মামা, আপনি অ্যাকশন নিন। ওদের ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কথিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তেতে ওঠে মুনার গলা। আর কেউ রিঅ্যাকশন দেখাচ্ছে না। কেবল মুনাই উত্তেজিত।
ফারুক মামা আবারও বলেন, ভয়ের কিছু নেই। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আপাতত তোমার মা-বাবাকে বিষয়টা বোলো না। ওঁরা ভেঙে পড়বেন। পরে আমিই বলব সব। রিয়াকে উদ্দেশ করে কথা শেষ করেন ফারুক সাহেব।
গাড়ি চলে এসেছে। বাসার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। কুসুমকলি বাসার জানালা দিয়ে দেখতে পায় গাড়ি। দ্রুত সে ছুটে এল নিচে।
কুসুমকলি নিচে আসার আগেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় রিয়া, মুনা।
ফারুক সাহেব নামতে চাইছিলেন না।
রেজা গাড়ি থেকে নেমে আসার কারণে তিনিও নেমে এলেন। অ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনার নিজের গাড়িতে আসার কথা। আসেননি। বন্ধুর সঙ্গে এসেছেন।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুসুমকলি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল রিয়াকে। ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল দুজন। মুনা বুকে জড়িয়ে ওদের পতন ঠেকাল।
তিন বান্ধবী জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। অসাধারণ সুন্দর দৃশ্য। ফারুক সাহেব মুগ্ধ হয়ে দেখলেন দৃশ্যটি। নিজেকে সফল মনে হলো। বিপদ থেকে কাউকে উদ্ধার করতে পারার আনন্দই আলাদা। কর্মজীবনে অনেক ভালো কাজ করেছেন তিনি। তবে এ কাজের ভালোটা অন্যরকম লাগছে। অন্যরকম আনন্দ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন ওদের দিকে। ইচ্ছা ছিল চলে যাওয়ার। ইচ্ছা সামলালেন। ওদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য মনস্থির করলেন।
রেজা এগিয়ে এসে ফারুক সাহেবের হাত ধরে বলল, থ্যাঙ্কস ফারুক। ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব। থ্যাঙ্কস এ লট।
ফারুক সাহেব মনে মনে ভাবেন এ ধরনের কাজ প্রায়ই তাদের করতে হয়। তাদের চাকরি হচ্ছে থ্যাঙ্কসলেস ধরনের। কোনো ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত হন না। তিরস্কৃত হন। সমালোচিত হন। এখন ছোটো কাজে প্রশংসিত হচ্ছেন। বাল্যবন্ধুর সম্মান তুলে আনতে পেরেছেন। ছোটো কাজ থেকে বড়ো কাজের স্বাদ পাচ্ছেন।
মুখে হাসি নিয়ে ফারুক সাহেব বললেন, থ্যাঙ্কসের প্রয়োজন নেই রেজা। তিন মায়াবতীর আনন্দঝিলিক দেখেই পুরস্কার পেয়ে গেছি আমি। ভালো লাগছে, বেশ ভালো লাগছে আমার। আসামি ধরতে বাকি কাজ করার জন্য আমাদের অ্যাকশনের কার্পণ্য হবে না।
রিয়া সহজ হয়ে বলল, মামণি কোথায়, বাপি কোথায়?
কথা শেষ করতে পারল না রিয়া। শেষ করার আগেই অ্যাপার্টমেন্টের মূল ফটক খুলে গেছে। বাপির গাড়ি প্রবেশ করেছে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লবিতে।
দ্রুত নেমে এলেন ইমরুল চৌধুরি, রিয়ার বাবা। রিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বাপির বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ওঠে রিয়া।
ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ইমরুল চৌধুরি।
প্রত্যয়ের সুরে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে, মামণি। ভয় পেয়ো না।
কথা শেষ করে তিনি হাত বাড়ালেন ফারুক সাহেবের দিকে। দেখেই তাকে চিনতে পেরেছেন, টিভিতে প্রায়ই তাঁকে দেখা যায়।
আপনি নিশ্চয়ই ফারুক সাহেব।
জি।
ধন্যবাদ ভাই। অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার বাসা পর্যন্ত ছুটে এসেছেন, আমি কৃতজ্ঞ। একদম নত হয়ে বললেন ইমরুল চৌধুরি।
কুসুমকলি এবার সামনে এগিয়ে এসে রেজা মামার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় ইমরুল চৌধুরিকে।
আঙ্কেল, ইনি হচ্ছেন আমাদের রেজা মামা। মুনার মামা। উনিই রিয়াকে উদ্ধারের জন্য ফারুক আঙ্কেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
ওহ্! থ্যাঙ্কস। বলেই হাত বাড়ালেন রেজার সঙ্গে।
রিয়া এবার ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। দুপদাপ পা ফেলে দ্রুত উঠে এল দোতলায়।
রাহেলা চৌধুরি শুয়ে আছেন বিছানায়।
মায়ের শোবার ঘরে ছুটে এসে হোঁচট খেল ও।
মায়ের কক্ষ বিবর্ণ। এলোমেলো। টিপটপ থাকতে পছন্দ করেন মামণি। সংসারের সব কিছুতেই থাকে নান্দনিক সৌন্দর্য।
না। কোথাও সৌন্দর্যের ছাপ নেই। একদম অন্যরকম ঘর। একদম অন্যরকম মামণির ঘুমন্ত মুখের অভিব্যক্তি।
রিয়ার মন হাহাকার করে ওঠে, ভেতর থেকে কেঁদে ওঠে। ঝাঁপিয়ে ধরতে যাচ্ছিল মাকে।
কুসুমকলি আগলে ধরে ঠেকাল তাকে।
নো কান্না। চুপ। একদম চুপ থাক। আন্টি ঘুমাক। দুদিন একদম ঘুমাননি।
রিয়ার ভেতরের কান্না থমকে গেছে। ভেতরের কষ্টের বাইরের প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে ও।
রিয়া নিজের ঘরে আসে। সঙ্গে আসে মুনা। কুসুম।
রিয়ার বাইরের চোখ শুকিয়ে গেছে। ভেতরের চোখ ভেজা এখনো। মনের গোপন কোণে শূন্যতা জেগে ওঠে। শূন্যতা গাঢ় হয়। একসময় ছবিগুলোর জন্য ভয় জেগে ওঠে। ওয়েবসাইটে যদি ছেড়ে দেয় এসব ছবি!
উহ্! ভাবতে পারল না। চোখ বন্ধ করে বলল, আমাকে এক গ্লাস পানি দে।
কুসুমকলি ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এল।
একদমে পুরো গ্লাস শেষ করে রিয়া। নীরবে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ান।
ইমরুল চৌধুরি বসার ঘরে ঢুকেই হোঁচট খেলেন। একদম অন্যরকম ড্রয়িংরুম। সোফার কুশনগুলো ঠিক জায়গায় নেই। সোফার সাইড টেবিলের ওপর রয়েছে কয়েকদিন আগের একটা নিউজ পেপার, পেপারের ভেতরের পাতা খুলে আছে, এক অংশ নিচে ঝুলে আছে। পেপারের ওপর বসে আছে হলুদ ছোপ। মনে হচ্ছে ঝোল লেগে আছে।
বসার ঘর গোছানোর সুযোগ পেলেন না ইমরুল চৌধুরি।
পেছনে ঢুকলেন রেজা ও ফারুক সাহেব।
সোফায় বসে পড়ল রেজা। পেপারের হেডলাইনের দিকে নজর গেল তার :
যমুনাপারের মানুষের জীবন ও সম্পদ অরক্ষিত। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের উজান ও ভাটি অঞ্চলে নদীভাঙনের যে প্রকৃতি দেখা যাচ্ছে, এতে জেলা সদরের বিস্তীর্ণ এলাকা যমুনার গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিধ্বস্ত স্পার বাঁধ ও গ্রোয়েন মেরামত শুরু হয়েছে অসময়ে।
‘ভাঙন ও বিধ্বস্ত’ শব্দ দুটোর ওপর চোখ আটকে গেল রেজার।
কিছুটা আনমনা হয়ে ওই দিকে তাকিয়ে রইল। ‘অসময়’ শব্দটিও তাকে আক্রান্ত করে। অবচেতন মনে নাড়া দেয় বিষাদের সুর।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফারুক সাহেবের দিকে তাকাল রেজা।
এ সময় ফারুক সাহেবের মোবাইল ফোন সেটের রিংটোন বেজে ওঠে।
কমিশনার সাহেবের ফোন।
সোফা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন ফারুক সাহেব।
কল অ্যাটেন্ড করেই দ্রুততার সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
ইমরুল চৌধুরি কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না। রেজাও উঠে দাঁড়াল। বন্ধুকে পৌঁছে দিতে হবে। এ তাগিদ নিজের ভেতর কাজ করছে। আবার রিয়ার সঙ্গেও কথা বলা দরকার। আসামিদের তোলা রিয়ার অশোভন ছবিগুলো জব্দ করতে হবে। নেগেটিভ উদ্ধার করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ইমরুল চৌধুরিকে এখন বলা যাবে না। নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। ভাবলেন রেজা।
উভয়ে ইমরুল চৌধুরির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বাইরে এলেন।
ফারুক সাহেব ক্রিমিনাল ইনটেন্ড বুঝতে পেরেছেন। রিয়ার ন্যুড ছবি তুলে রেখেছে, সন্ত্রাসীরা ওই ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করবে, রিয়ার বাবার থেকে মাসে মাসে টাকা আদায় করবে। নিজেদের মাদকের খরচ জোগাতে এ ভয়াবহ পথে পা বাড়িয়েছে ওরা। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। আশা করা যায় সন্ত্রাসী চক্রকে ধরা যাবে। ছবির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন।
মনে হয়, মেয়েটা সব সত্য প্রকাশ করেনি। চিন্তিতমুখে বললেন ফারুক সাহেব।
রেজা প্রশ্ন করে, আর কী সত্য থাকতে পারে? তুমি কি মনে করো পুরোপুরি রেপ করেছে তাকে?
রেপ, রেপই। পুরোপুরি বা আধাআধি বলে কিছু নেই। রেপ না করলেও পুরো ন্যূড ছবি তুলেছে মনে হচ্ছে।
ছবি তুলেছে। এ নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ। কিন্তু রেজা এটা তোমার পারসেপশন। রিয়ার পারসেপশন ভিন্নরকম হবে। ওর মনে সব সময় একটা আতঙ্ক কাজ করবে। ওই আতঙ্ক তার মানসিক ভাঙন তৈরি করতে পারে। তাকে যথাযথ সাপোর্ট দিতে হবে।
রেপ ঘটে থাকলে তো চিকিৎসারও ব্যবস্থা করতে হবে। আরও একধাপ এগিয়ে বলল রেজা।
মাদকাসক্ত ছেলেরা রেপের ব্যাপারে তত বেপরোয়া থাকে না। তাদের বেপরোয়া আচরণ টাকা জোগাড় করার দিকে বেশি ঝুঁকে থাকে। রেপ হলে মানসিক বিপর্যয় আরও বেশি হতো রিয়ার। তেমন বিপর্যয় ঘটেছে বলে মনে হয়নি আমার। সুতরাং উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
কথা বলতে বলতে গাড়িতে এসে ওঠেন রেজা ও ফারুক সাহেব। পুলিশ কমিশনারের বাসার দিকে রওনা দিলেন তারা।
সাত.
ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকেছেন রাহেলা চৌধুরি।
রুটিনমতো শুরু হয়েছে জীবনযাপন। মেয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন মেয়ে ঘুমাচ্ছে।
যেন পৃথিবীর কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ইমরুল সাহেব ড্রয়িংরুমে বসে চা পান করছেন। একই সঙ্গে পড়ছেন খবরের কাগজ। পত্রিকার পাতা থেকে চোখ তুলে তাকালেন।
রাহেলাকে এখন বেশ ঝরঝরা লাগছে তার। বেশ তরতাজা লাগছে। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। বিপর্যয়ের কোনো চিহ্ন নেই। ধীরপায়ে কিচেনের দিকে এগোলেন তিনি। কিচেনের ফ্লোরে তেলাপোকা ছুটোছুটি করছে। অসংখ্য বাচ্চা তেলাপোকা কিলবিল করছে। দেখেই মাথা ধরে গেল।
এই শেফালি, কাজের বুয়ার দিকে এগিয়ে প্রশ্ন করলেন, ফ্লোর মোছো না?
শেফালি বলল, হ মোছামুছি করি। তবু তেইল্লাপোকা কমে না।
মিথ্যা বোলো না, প্রতিদিন মুছলে এ অবস্থা হতো না। ঝাঁঝ নিয়ে বললেন রাহেলা চৌধুরি।
বুয়া কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। সে জানে, ঝাঁঝালো সময়ে তর্ক করতে নেই। তর্ক করলে খেপে যাবেন খালাম্মা। কিচেনের বাইরে বারান্দায় বসে কপি কাটছিল ও। কাজ থামিয়ে ওঠে। বালতিতে পানি ভরে নেয়। পানিতে ঢেলে দেয় কয়েক ফোঁটা স্যাভলন। মোছার কাপড়টি ভিজিয়ে চেপে নেয় সে। তারপর আবার চারদিক মোছা শুরু করে।
বুয়ার দিকে আর তাকালেন না রাহেলা চৌধুরি। গ্যাসের চুলার সামনে দাঁড়িয়ে অটোবাটনে চাপ দেন তিনি। চুলা জ্বলে ওঠে।
চায়ের কেটলি বসিয়ে দেন। চা তৈরি করে প্রতিদিন ভোরে নিজ হাতে রিয়ার ঘরে কাপ নিয়ে ঢোকেন। খাটের সাইড টেবিলে কাপটি রেখে মেয়েকে ডেকে তোলেন।
মর্নিং টি না পেলে রিয়া খেপে যায়। মেয়ের এ অভ্যেসের প্রতি বেশ সতর্ক তিনি। আজও সতর্কতার অভাব নেই। অতি সচেতনও না এখন। একদম স্বাভাবিক। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো এগোচ্ছে সব কাজ। চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন দারুচিনি, ছোটো এলাচ ও আদা। চায়ের সঙ্গে দুধ একদম পছন্দ করে না রিয়া। রিয়ার পছন্দমতোই প্রস্তুত হয়েছে চা।
কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। গরম ভেজা ধোঁয়া আঁকাবাঁকা লাইনের মতো উঠে যাচ্ছে ওপরে। ওপরের ধোঁয়ার ঘূর্ণি ছড়িয়ে যাচ্ছে শূন্যে। নাকে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ টের পেলেন তিনি। প্রতিদিন এ ঝাঁঝ এনজয় করেন। আজও প্রসন্ন মনে মেয়ের ঘরে ঢুকে বেডসাইড টেবিলে চায়ের কাপ আলতো শব্দে রাখেন। কাপ পিরিচের মৃদু টোকায় টুংটাং শব্দ হয়। শব্দ শুনে চমকে ওঠে রিয়া; চোখের পাতা খুলে যায়। চোখ মেলে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছেন সামনে।
মমতাময়ী মা তাকিয়ে আছে ছোটো বাচ্চার মতো।
মায়ের একমাত্র কাজ সন্তানের অসুবিধে দূর করা। সন্তানের মন ভালো রাখার জন্য সব ঠিকঠাক করা। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিষ্কণ্টক করার জন্যই ঘুরপাক খায় মায়ের চিন্তা। এসব চিন্তা থেকে এ মুহূর্তে রাহেলা চৌধুরির চাওয়া হচ্ছে, শান্ত মেজাজে মেয়েকে ঘুম থেকে তোলা। সময়মতো কলেজে যাওয়ার জন্য মেয়েকে তৈরি করা। মেয়ের হঠাৎ চমকে ওঠা দেখতে অভ্যস্ত নন তিনি।
অবাক হয়ে মেয়েকে দেখলেন এখন। এমন চমকে উঠল কেন, রিয়া?
রিয়া, ভয় পেয়েছ মামণি? মেয়ের পাশে এসে শরীরে হাত রেখে প্রশ্ন করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
রিয়া দ্রুত বিছানা থেকে ওঠে। আচমকা মাকে জড়িয়ে ধরে। কোনো জবাব না দিয়েই জড়িয়ে ধরে থাকে ও। জড়িয়েই থাকে। ভেতর থেকে কান্না ছুটে আসে। কান্না সামাল দিয়ে চুপ থাকে কিছুক্ষণ।
রাহেলা চৌধুরি অবাক। এমন করছে কেন রিয়া।
রিয়া এবার শান্ত গলায় বলে, সরি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। এক্সট্রিমলি সরি, মামণি।
ফ্যালফ্যাল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন মা। বিস্ময় কাটেনি তার। চোখেমুখে এখনো অন্যরকম বিহ্বলতা ফুটে আছে। মেয়ের কথার পিঠে কথা বলছেন না তিনি। নিজে থেকেও কিছু জিজ্ঞেস করছেন না।
রিয়া বলল, আর ভুল হবে না মামণি। আর রাগ করব না আমি। আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
রাহেলা চৌধুরি বলেন, আচ্ছা যেয়ো না।
আমাকে মাফ করেছ মামণি?
কেন মাফ করব? কী হয়েছে তোমার? রাহেলা চৌধুরির ঠান্ডা স্বর। শীতল প্রশ্ন।
রিয়া পালটা প্রশ্ন করে, কী হয়েছে মানে?
হ্যাঁ। কী হয়েছে! সেটাই তো জানতে চাই। রাহেলা চৌধুরির কণ্ঠে কোনো পরিবর্তন নেই।
তোমার ওপর রাগ করে আমি পালিয়ে গেলাম। দুদিন পর উদ্ধার করা হলো আমাকে। তুমি কিছুই জানো না? কেউ তোমাকে কিছু বলেনি?
রাহেলা চৌধুরি মাথা নাড়িয়ে বললেন, না। কিছুই জানি না। কেউ আমাকে কিছু বলেনি। একদম স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলেন তিনি।
এবার ঘাবড়ে গেল রিয়া। তার এমন বিপদের কথা শুনেও মায়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কথায় আচরণে একদম স্বাভাবিক তিনি। মনে হচ্ছে উনি তার মা নন। মায়ের দেহের মধ্যে যেন ভর করেছে অন্য নারী। এ নারীর মন তার মায়ের মন নয়।
মামণি, আমি রিয়া। মাকে ঝাঁকি দিয়ে জোরেই বলল রিয়া।
হ্যাঁ। রিয়াই তো।
আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি। আবারও জোর দিয়ে বলল রিয়া।
ফিরবে কেন। তুমি তো আছোই আমার কাছে।
না। আমি ছিলাম না।
কোথায় ছিলে?
তোমাকে ছেড়ে পালিয়েছিলাম।
রাহেলা চৌধুরি হাসিমুখে বললেন, পালিয়েছিলে!
হ্যাঁ, পালিয়েছিলাম।
কোথায় পালিয়েছিলে?
ওই যে, পাড়ার ওই বখাটের হাত ধরে পালিয়েছিলাম।
কই। তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে। আমিই তো তোমাকে ঘুম থেকে তুললাম।
রিয়া কোনো জবাব দিতে পারল না। কথা থেমে গেল ওর। মা এত স্বাভাবিক! দিন তার আগের মতোই আছে। আগের মতোই চলছে। একটা কিছু বলতে যাচ্ছিল রিয়া।
কথা না শুনেই উঠে দাঁড়ালেন রাহেলা চৌধুরি।
মেয়ে এসব কী বলছে! মেয়ের কথা কেয়ার করলেন না তিনি। নিজের ঘরে ফিরে এলেন। রিয়া অবাক চোখে মায়ের চলে যাওয়া দেখছে। এই মুহূর্তে মা একদম শান্ত। একদম স্বাভাবিক।
নিজেদের শোবার ঘরের পর্দা সরিয়ে দিলেন রাহেলা চৌধুরি। স্লাইডিং ডোর টেনে পুরো ঘর খুলে দিলেন। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবার।
বারান্দায় শোভা পাচ্ছে একটা নতুন ফুলের টব। টবে আছে জেড ট্রি। বাংলা নাম হতে পারে জেড গাছ। বিরল গাছটা বেড়ে উঠেছে বিরল সুন্দর একটা টবে। দামি টব। গাছটার উচ্চতা প্রায় তিন ফুট। দেখতে সবুজমণি গাছের মতো রসালো, চকচকে নজরকাড়া কালচে সবুজ। আকৃতি চামচের মাথার মতো, চর্বিদার, মাংসল। কাণ্ডটা, পাতার মতো দেখতে দৃষ্টিনন্দন ও মাংসল। ঘন মাংসল পাতার সঙ্গে পাথরকুচি পাতার তুলনা করা চলে। অনেক সময় ফুল ফোটে। পিংক কিংবা সাদা ফুল। ফুলের আয়ু ক্ষণস্থায়ী। অর্কিড ফুল দীর্ঘস্থায়ী হলেও ক্ষণস্থায়ী ফুলের সৌন্দর্য আলাদা। গাছটা বাড়ে ধীরে ধীরে। কেউ কেউ এটিকে বলে টাকা গাছ বা মানি ট্রি।
এসব কথা জানেন রাহেলা চৌধুরি। হালকা হাত বুলিয়ে জেড গাছের ক্ষণস্থায়ী ফুলে আদর বুলিয়ে দিলেন। ঝরে যাওয়ার আগে যতটুকু আদর দরকার ততটুকু দিতে কার্পণ্য নেই তাঁর। ফুলের সামনে এসে এভাবে প্রফুল্ল হয়ে উঠল তার মন।
চলবে...
এসইউ/এএসএম