সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পগুলো কেন খুব বেশি আলোচনায় নেই?
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, চল্লিশের দশকে কলকাতায় সাহিত্য জগতে যার আবির্ভাব। ছিলেন কূটনীতিক কিন্তু মৃদু ছিল তার কণ্ঠস্বর। অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো তার রচিত অসামান্য সব উপন্যাস।
লিখেছেন কয়েকটি ছোটগল্প ও নাটক যা প্রকাশিত। বইয়ে প্রকাশিত গল্পের বাইরেও তার রয়েছে ১৩টির মতো অপ্রকাশিত গল্প। লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস যতটা পাঠকের কাছে পৌঁছেছে, গল্পগুলো কিন্তু ততটা পৌঁছেনি। আর অপ্রকাশিত গল্প (যা বিভিন্ন সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কেবল) সম্পর্কে পাঠক খুব বেশি অবগত নন বোধহয়। যদি অবগতই হতেন তবে প্রায়ই তার লেখার উদ্ধৃতি আমরা সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে দেখতাম। লেখকদেরও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অপ্রকাশিত গল্পগুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা বা সমালোচনা করতে দেখা যায় না। এর কারণ কী? হয়তো তিনি ছিলেন নিভৃতচারী লেখক? গল্পগুলো বইয়ে প্রকাশিত না হওয়া তার একটি বড় কারণ। বলাই যায়, লেখকের জীবদ্দশায় গল্পগুলো বইয়ে প্রকাশিত হলে গল্পগুলো আরও পরিমার্জিত হতো। সত্যিকার অর্থে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সেই ১৩টি গল্প লেখক ও পাঠকের জন্য সম্পদই বটে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখা মানেই গভীর জীবনবোধ, আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাওয়া, সব ধরনের কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা। চমৎকার সব উপমা বা রূপকের মাধ্যমে তিনি সমাজ, চারপাশ ও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলেন। মানুষের প্রথাগত চিন্তায় তার লেখা আঘাত হানে যেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বেশিরভাগ লেখাজুড়েই থাকে অন্ধকার, নিস্তব্ধতা ও জীবনের ধ্রুব সত্য মৃত্যু।
তার রচিত অপ্রকাশিত গল্পগুলো থেকে কিছু উদ্ধৃতি পড়া যাক : ‘চিরন্তন পৃথিবী’ গল্পে নায়ক-নায়িকার কথোপকথনের শেষে বোঝা যায় নায়ক মৃত মানুষের সঙ্গে আসলে এতক্ষণ কথা বলছিল।
‘নওয়াজের ঠোঁট একটু নড়ল, অতি বিস্মিত ও অতি মৃতজড়িত কণ্ঠে হোসেনাকে প্রশ্ন করল : তুমি কে?’ ‘হোসেনা নির্বাক, বিমূঢ়। তার চোখে ভয় মিশ্রিত বিস্ময়। এ প্রশ্নের উত্তর সে কী করে দেবে? সে যে মানুষের ক্ষমতার বাইরে।’
‘ঝড়ো সন্ধ্যা’ গল্পে নায়ক পরকীয়ায় জড়িত। প্রেমিকা মমতাজকে তার ঘরে তুলতে সে মহাব্যস্ত। কিন্তু প্রেমিকা মমতাজ তাকে বলছে পুরো উল্টো কথা, যা শুনে নায়ক বিস্মিত।
‘আনোয়ার হাসল। বলল, আসবে মানে? তুমি যেখানে আছো, সেখানে কি তার কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে তাজ? তাকে তো আমি ভালোবাসি না। তাকে শিগগিরই ত্যাগ করব। আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ অনিবার্য।’
‘হঠাৎ উঠে মমতাজ জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। জানালা খোলা। আকাশের বুকে তারা, নিচে সিক্ত ঝোপঝাড়ের ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে জোনাকিরা জ্বলছে-নিভছে আর সোঁদাল গন্ধ বয়ে অতিমৃদু শীতল হাওয়া বইছে।’
জোনাকিগুলোর পানে তাকিয়ে অনুচ্চকণ্ঠে মমতাজ বলল, ‘আপনি ভুল করছেন, আনোয়ার সাহেব।’
‘পলকে আনোয়ার সোজা হয়ে বসল। হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে ব্যগ্র চাপা গলায় আবার বলল : ‘বুঝলাম না।’
‘আপনি বিজ্ঞ। আপনার বোঝা তো উচিত। মানে, যে অভাবটা আপনি আমাকে পূর্ণ করতে বলেছেন, তা আমার পক্ষে অসম্ভব।’
‘তুমি তো আমায় ভালোবাসো মমতাজ।’
‘ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসা ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধু হিসেবে, স্বামী হিসেবে নয়। ও কল্পনা আমার মনে কখনো স্থান পায়নি। আমাকে মাফ করবেন।’
এই গল্পে দেখি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নায়কের স্ত্রী রহিমা স্বামীর পরনারীতে আসক্তি জেনে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। স্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া ও প্রেমিকা মমতাজের ঘরে ফেরার মুহূর্তটি লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে-
‘সময় সচল বলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু পদশব্দে যেন করুণ ইতিহাস রচে ধীরে ধীরে রহিমা চলে গেল; গেল কিন্তু যেন জানিয়ে গেল না, যেন জানানোর মতো এ-জগতে তার কেউ নেই। স্বল্পালোকিত আবছা পথের বুকের ওপর দিয়ে কতক্ষণ আগে যে-বন্ধ গাড়ি ঘড় ঘড় শব্দ করে দাগ এঁকে গেছে, সে-দাগ মমতাজের গাড়ির গতিতে ও উজ্জ¦ল আলোতে নিমেষে মুছে গেল।’
যে মমতাজের জন্য নায়ক ঘর ভাঙতে এক মুহূর্ত চিন্তা করেনি, সে প্রেমিকাকেও নায়ক পায় না। নায়ক তখন ব্যাকুল হয়েছে তার স্ত্রীকে ফেরানোর জন্য। কিন্তু গল্পের সমাপ্তিতে আবারও দেখা পাই মৃত্যুর-
‘কী? কী হয়েছে?’ আনোয়ারের কণ্ঠে অস্বাভাবিক উত্তেজনা, চোখ-মুখ শঙ্কাকুল। রহিমার ভৃত্যের অশ্রান্ত কান্নার মধ্যে মধ্যে যেসব অসংলগ্ন কথা থেকে থেকে ফুটে বেরোতে লাগল, তা একত্র করে করে সংক্ষেপ করলে এই হয় যে, তাদের ঘোড়ার গাড়ি যখন স্টেশনে পৌঁছাল, তখন সে কৌচবাক্স হতে নেমে দরজায় নীরবে মায়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু মা তার নামল না বা সাড়া দিল না। তখন সে ডাকল, তবু গাড়ির ভেতরের অন্ধকারে নীরবতা। শেষে আলো নিয়ে দেখে তার মৃত্যু হয়েছে। -রহিমার মৃত্যু হয়েছে।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্প ‘হোমেরা’য় আমরা পাই হোমেরা নামের এক প্রতিবাদী নারী চরিত্র। নিচের উক্তিগুলো এরই প্রমাণ-
‘(হোমেরা) : আমি তাকে ভালোবাসি। এবং এ কথা বলতে এখন আমার আর লজ্জা নেই।’
‘(আকরম) না! আমি থাকতে তুমি কখনো যাকে-তাকে ভালোবাসতে পারো না। আর ভালোবাসা যে পুতুলখেলা নয়, এ কথা আশা করি এতদিনে শিখেছ। তা ছাড়া আরেক কথা শোনো। তোমার মতো মেয়ের প্রেমে পড়বে এমন ছেলে এক নির্বোধ ছাড়া- এ দেশে কেউ নেই।’
এবার হোমেরার মুখটি সামান্য কালো হয়ে উঠল। তবু তার ঠোঁট, কী চোখ কিছুই কাঁপল না। কিন্তু কথা যখন সে কইল, তখন শব্দে শব্দে রুক্ষতা তীক্ষè হয়ে উঠল-
‘আমাকে নিয়ে কথা বলার আপনার কোনো অধিকার নেই, আপনি আমার কেউ নন।’
‘(আকরাম)- সে কথা আমি মানতে যাব কেন? গায়ের জোরে বললেই সব কথা খাটে না জেনো। তুমি আমার আপন বোন নও বটে, কিন্তু চাচাতো বোন এবং চাচা-চাচি বেঁচে নেই বলে তোমার ওপর আমার সম্পূর্ণ অধিকার।’
চাচাতো ভাইয়ের কথা শুনে এক মুহূর্ত দেরি না করে হোমেরা তার দিকে পেপারওয়েট ছুড়ে মারে। যে মেয়ের মা-বাবা কেউ নেই ও অন্য ঘরে বাস তার- সে মেয়ের পক্ষে পেপারওয়েট ছুড়ে মারা প্রতিবাদই বটে।
আর তাই আকরামের মুখে শুনি-
‘এই বিশ্বে কোথায় যে একটা বিরাট ক্ষত রয়েছে বুঝতে পারিনে। সে ক্ষত গভীর পচা ঘায়ের মতো। মানুষের দেহের ঘা সারে, কিন্তু এ ঘা কখনো সারবে না।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চমৎকার একটি গল্প ‘স্থাবর’। যারা নৌকা বানায়, তাদের নিয়েই এ গল্প।
লেখক তাদের শারীরিক ও চরিত্রের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে-
‘কিন্তু যখন ওরা রেগে ওঠে তখন তাদের মুখ দিয়ে অনর্গল খৈ ফুটতে থাকে আর চোখ জ্বলতে থাকে আগুনের মতো। লোহার মতো শক্ত দেহ হলেও তাদের মন মাটির মতো নরম, ব্যবসা করেও তারা লোক ঠকাতে জানে না, তারা টাকা বাজিয়ে নেয় বটে লুকিয়ে নেয় না। এরা স্থাবর, জঙ্গম হওয়া তাদের গাঁয়ের বা রীতির ধারা নয়। এরা অন্যের চলার যান তৈরি করে, নিজেরা চলে না; সারাজীবন এরা শুধু নৌকো ভাসায় কিন্তু ভাসে না।’
সাগর পার থেকে ফেরা যে তাদের জন্য দুঃসাধ্য। তাই লেখক বলেন-
‘সাগরের ডাক শুনছ, কিন্তু তাতে কান দিও না। শহর থেকে লোক তবু ফেরে, সাগর থেকে কেউ ফিরতে পারে না।’
‘সবুজ মাঠ’ গল্পে আমরা পাই প্রকৃতির এক চমৎকার বর্ণনা, যেখানে গল্পের এক দম্পতি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে জীবনযাপন করেন।
লেখকের ভাষায়-
‘ঘুম হতে জেগে জানালা খুলে ওরা বাইরের পানে তাকাল : বর্ষণসিক্ত মাঠটা স্বচ্ছ সূর্যালোকে ঝকমক করছে। ইস, মাঠের সবুজ রঙটা কী খুলছে, যেন চৈতের নতুন পাতার মতো রঙ। তার পর রাবেয়া পথটার পানে তাকাল এবং সে পথের মধ্যে ঔদাসীন্যের চিহ্ন পেল না। আর হয়তো তাই তার মনে এমন একটা আনন্দ নিবিড় হয়ে উঠল যে, নীল আকাশের যে দিকেই সে তাকালল, তার মনে হলো যে, মোহমুক্ত সে-স্বচ্ছ নীলিমায় অন্তর শুধু ভরে উঠেছে। আর আকবরের শুধু একটি কথা বারবার মনে হতে লাগল যে, তবু ভালো, সবুজ মাঠের প্রান্তে তারা জীবনের প্রথম নোঙর ফেলেছে।’
আমাদের জীবনের নানা ধাপ নিয়ে লেখকের নিদারুণ সত্যকথন গল্পে এসেছে এভাবে-
‘তার পর সে চোখ হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল। নবাগতা ফিরে তাকাল আফজলের পানে, তাকিয়ে আস্তে হেসে বলল : ছেলেবেলায় মনে হতো বছরগুলো কত দীর্ঘ, অথচ এখন মনে হয় তার ঠিক উল্টো, শুধু ছেলেবেলায় মানুষের কাছে জীবনটা অতি বড় ঠেকে, তার পর থেকে সে ধারণা ভাঙতে থাকে, তাও ক্রমশ। কারও কারও বা হঠাৎ। যেমন আমার। যেদিন আমার জীবনে বিয়ের বাজনা বেজে উঠল সেদিনই যেন স্বচ্ছ পরিষ্কার দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম কী সংকীর্ণ এই আমাদের জীবন। মানুষের যৌবনে প্রৌঢ়ত্বের ছায়া, প্রৌঢ়ত্বে বার্ধক্যের। আর বার্ধক্যে? মৃত্যুর হয়তো বা।’
‘মৃত্যু’ গল্পে লেখক ওই সময়কার আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক গৃহবধূর জীবনের বর্ণনা দেন এভাবে-
‘প্রতিবছর নিয়মিতভাবে, ব্যতিক্রমশূন্যভাবে তার স্ত্রী সন্তান প্রসব করতে লাগলেন।’
‘তা ছাড়া প্রতি বৎসর সন্তান জন্মলাভ করাবার ফলে বেচারী হাঁফ ছাড়ারও ফুরসত পাননি, একটি বুকের দুধ খেয়ে একটু হাঁটি হঁটি পা পা করতেই হঠাৎ ট্যাঁ করে চোখ বোজা মাংসের পি- আরেকটি অতিথির আগমন হয়েছে। কাকে রেখে কাকে নেন, আবার কাউকে রেখেও চলে না।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বেশিরভাগ গল্পেই নারী চরিত্রগুলো হঠাৎ করেই যেন ব্যতিক্রমীভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, গল্পে তৈরি করে নতুন বাঁক। আর তাই ‘মৃত্যু’ গল্পের সেকেলে উকিল খান সাহেব বদরুউদ্দিনের স্ত্রী আমেনা খাতুনের (লেখকের ভাষায়- কোনকালের মানুষ তা বলা মুশকিল) প্রতিবাদটি ছিল অভিনব।
‘তার কালো রংচটা ছেঁড়া আচকান পরে কোর্ট অভিমুখে রওনা হচ্ছেন, এমনি সময়ে তার স্ত্রী আমেনা খাতুন তার মাথায় এক পাতিল ডাল ফেলে দিয়েছিলেন।’ স্বভাবতই এ ঘটনার পর খান সাহেবের স্ত্রী অসুস্থাবস্থায় স্বামীর সেবা বা চিকিৎসকের পরামর্শ কিছুই পাবেন না, তা বলাই বাহুল্য। তবে গল্পের শেষ লাইনটি পড়লে বাস্তবে দেখা ঘটনার সঙ্গে মিল পাই যেন।
‘আমেনা খাতুন মারা গেলেন। আর মৃত্যুর পর কোনো ক্রোধ থাকতে পারে না বলে বদরুদ্দিন সাহেব নিঃসংকোচে স্ত্রীর মৃতদেহের জন্য অর্থ ব্যয় করলেন। ফকিরও খাওয়ালেন অনেক।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ১৩টি অপ্রকাশিত গল্পের কয়েকটি থেকে উদ্ধৃতি দিলাম মাত্র। জানি, উদ্ধৃতিগুলো পড়ে পাঠকের তার গল্পগুলো পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে। পাঠকের যেমন গল্পগুলো পড়ে মনের তৃপ্তি মিটবে, তেমনি যারা তরুণ লেখক- তাদেরও গল্প লেখার সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পগুলো পথ দেখাবে বৈকি!
এইজআর/পিআর