আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : একটি আলোকিত সন্ধ্যার গল্প
নাজমুল হুদা
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লিফটে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে প্রথম কাছ থেকে দেখা। চলমান লিফটের ছোট পরিসরে আমাদের টুকটাক কথা চলতে থাকলো। খুব বেশি সময় নয়; বেশি কথা নয়। তারপরও সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত শুভ্র মানুষটার হাস্যমুখী মুখে যে ভালো লাগার দ্যুতি দেখেছিলাম, তা মুগ্ধ করার জন্য যথেষ্ট। কথাগুলো মনে রাখার মতো। স্যার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে তার ব্যস্ততা প্রসঙ্গে বললেন, ‘আরে আমি তো এ প্রতিষ্ঠানের সিইও না-কি, সব কিছু তো দেখভাল করতে হয়। তোমরা যেমন চাকরি কর, আমিও তো এখানে তা-ই করি।’
তা বটে। তবে আমাদের কর্মঘণ্টা বেঁধে দেওয়া আছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আমরা সেই সময়ে কাজ করে অভ্যস্ত। কিন্তু স্যার? তার তো কোনো কর্মঘণ্টা কেউ বেঁধে দেইনি কখনো। তারপরও তো কাজ করে চলেছেন অবিরাম। আশি পেরিয়ে এসেও এখনো হাসিমুখে সামলে নিচ্ছেন সব। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি কথা সবসময় আমাকে নাড়া দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের আসল প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত নিজের সঙ্গে। নিজের অক্ষমতা, অযোগ্যতা, লোভ ও পাপের সঙ্গে। নিজের হীনতা, অজ্ঞতা, মূঢ়তা ও দুর্বলতার সঙ্গে।’
এ জন্যই হয়তো তিনি একের পর এক পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম পথ। ১৯৬১ সালে ২২ বছর বয়সে মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে পেশা জীবনে পদার্পণ। হ্যাঁ, তিনি বাবার মতো শিক্ষকই হতে চেয়েছিলেন। হয়েছেনও তাই। কিন্তু লেখালেখি, কণ্ঠস্বর পত্রিকা সম্পাদনা, টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসহ সাংগঠনিক কর্মতৎপরতায় হয়ে উঠেছেন আরও উজ্জ্বল, দীপ্তিমান, আলোকিত মানুষ।
আলোকিত মানুষ গড়ার সেই উদ্যোগের ৪০ বছর পার হয়েছে গত বছর। ইতোমধ্যে বইপড়াসহ নানামুখী কার্যক্রমে ৪০ বছরে ১ কোটি মানুষকে সরাসরি স্পর্শ করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। মাত্র ২৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১৯৭৮ সালে পাঠচক্র দিয়ে যাত্রা শুরু, যা আজ সারাদেশের ৬৪ জেলার ১১ হাজার ৫০০ স্কুলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি হিসেবে যা দেশের ৫৮ শহরের ১ হাজার ৯০০ জায়গায় সময় মতো পৌঁছে দেয় বই। এতো যে বই, সব বই কি আসলে কাজের, আনন্দের বা পাঠকপ্রিয়? তিনি নিজেও লিখেছেন ৫০টিরও বেশি বই।
বইপড়া নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলে থাকেন, ‘সব বইয়ের মধ্যে প্রভাবিত করার মতো কিছু না কিছু উপকরণ থাকে। সবচেয়ে খারাপ বইয়ের মধ্যেও এমন দু-একটি লাইন থাকে। তা পড়ে মনে হয় জীবনকে নতুন বা আলাদাভাবে উপলব্ধি করা যায়।’ উপলব্ধির জন্য শুধু বইপড়া নয়, নানা সৃজনশীল কার্যক্রমের আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে তার হাতে গড়া বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আলোর ইশকুল, শিল্প-কর্মশালা, সাহিত্য আড্ডাসহ বিভিন্ন আয়োজনে আলোকিত ও মুখর থাকে রাজধানীর বাংলা মোটরের সুউচ্চ ভবন।
আমার প্রথম বই ‘ক্যারিয়ার ক্যারিশমা’ স্যারের হাতে তুলে দিতে গিয়েছিলাম এ আলোকিত ভবনে। এক সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ হলো। কবি আলমগীর শাহরিয়ার আমাকে নিয়ে গেলেন স্যারের কক্ষে। বেশ দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ হয়েছিল সমকালীন সাহিত্য, অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতি এবং অসঙ্গতি নিয়ে। তরুণদের কর্মকাণ্ড, ক্যারিয়ার ভাবনার কথা তুলতেই একপর্যায়ে তিনি বলে বসলেন, ‘আচ্ছা, মেধাবীরা সব বাইরে চলে যেতে চায় কেন? ওখানে গিয়ে কী পায়? আমার তো মনে হয়, এসব মেধাবী দেশে থাকলে ভালো কিছু করতে পারত। আর তোমরা তো ওদের সব বড় চাকর হওয়ার বা বানানোর পরামর্শ দাও। বড় কিছু করার কথা বলো না।’ আমি মাথা নাড়লাম। কথা সত্য।
যে দেশে এতো অনিশ্চয়তা, এতো শঙ্কা সেখানে সবাই থাকবে কীভাবে? থাকলে তো চাকর হয়েই থাকাটাই নিরাপদ। নিজে কিছু করা বরং আত্মঘাতী। আমার ধারণা, উনি খুব ভালো করেই জানেন বিষয়গুলো। ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইতে তার দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ তো তুলে ধরেছেন সবিস্তারে। তারপরও আমার মতো নগণ্য মানুষকে এই কঠিন প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হতে পারে ভিন্ন আঙ্গিকে বিষয়গুলো নিয়ে জানা।
তিনি এসব নিয়ে ভাবেন বলেই জানতে চান, আলোচনা করেন। আমি বেশ বিনয়ের সাথে বললাম, ‘স্যার, এখন অনেক তরুণ নিজেই নতুন কিছু করার কথা ভাবছে, উদ্যোগ নিচ্ছে, সামাজিক কাজে এগিয়ে আসছে; এমনকি বিদেশ থেকে ফিরে এসেও কাজ করছে।’ তিনি মৃদু হাসলেন। সেই হাসিতে আশা ও আশঙ্কা দুটোই ছিল। এই দুই মিলিয়েই তো আমাদের পথচলা। স্যারও তো এভাবে আশি পার হয়ে এসে এখনো বলেন, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। তাহলে লক্ষ-কোটি তরুণের বড় কিছুর স্বপ্ন দেখতে দোষ কি?
লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
এসইউ/জেআইএম