গাজী সাইফুলের চা’দের গল্প

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৪৭ পিএম, ১৩ জুন ২০২০

সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে। চারদিকে শান্ত স্তব্ধতা ভর করছে একটু একটু করে। চুলার উপর দুটো জাম্বো সাইজের কেতলিতে চায়ের পানি বসায় বল্টু। কেতলিগুলোর তলার চারপাশে কালো কালির গভীর একটা হির পড়ে আছে। হাত দিয়ে মাটির চুলার কয়লার জালটা একটু একটু করে ঠেলে দেয় ভেতরের দিকে। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ফুঁ দিয়ে উসকে দেয় ঝিমিয়ে পড়া আগুনটাকে। পরক্ষণেই হনহনিয়ে ধরে ওঠে কয়লাটা।

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির মেইন গেট দিয়ে ঢুকলে হাতের একটু বামেই দুটো সিঙ্গেল চৌকি জোড়া দিয়ে বানানো চায়ের ছোট্ট টং দোকান। চারপাশে আধ-ময়লা মোটা নীল পলিথিন দিয়ে ঘেরা। আর ছাদ বলতে মাথার উপর এক ফালি সামিয়ানা টাঙানো। বসবার তেমন কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এ দোকানের কাস্টমার যারা আসে; তারা সবাই বল্টুর বেশ পরিচিত। বাঁধা কাস্টমার। তাই প্রতিদিন কী পরিমাণ চা বানতে হয়, তার হিসেবটা বেশ ভালো করেই জানে সে। শুধু শুক্রবারে কাস্টমারের চাপটা একটু বেশি থাকে। বন্ধের দিন বলে ভার্সিটি আর কলেজের ছেলে-মেয়েগুলো বেশ আড্ডা জমায়।

বল্টুর বয়স তেমন হয়নি। খুব বড়জোর এগারো কি বারো। গায়ের রং ছিপছিপে কালো, লিরলিরা শরীর, নারিকেলের আঁইচার মত গোলগাল মুখ। বল্টুর বাপ দবির মিয়া আগে এ দোকান চালাতো, এখন বাবা মারা যাবার পর বল্টু নিজেই চালায়। তাতে মা আর ছোট বোন বেনুকে নিয়ে কোনো রকমে থেমে থেমে চলছে তাদের দিন। আগুনের আঁচে বেশ ভালো মতনই ঘামিয়েছে সে। কপালে আর নাকের ডগার নিচের ছোট ছোট গজিয়ে ওঠা গোঁফে ঘামের রেখাটা চিকচিক করছে। বামহাতে কপালের ঘাম মুছল বল্টু। তারপর পেছনে ফিরতেই কেউ একজনকে লক্ষ্য করল দাঁড়িয়ে আছে দোকানে রাখা মাঝারি সাইজের বাক্সটার সামনে। এর ভেতরে সারি সারি করে বিভিন্ন ব্রান্ডের সিগারেট সাজিয়ে রেখেছে সে। বাইরে থেকে কাচের উপর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় সিগারেটের বিভিন্ন সাইজের রঙিন প্যাকেটগুলো। তার পাশেই এক পায়া ভাঙা একটি টেবিল পাতা। তাতে চায়ের স্টিলের একটা ট্রেতে সারি সারি চায়ের কাপ সাজানো, একটা প্লাস্টিকের বাটিতে ছেঁচে আনা আদা আর ছোট ছোট সাইজ করা লেবু। বেশ কর্কশ একটা কণ্ঠ-
‘কিরে চা হয়েছে বল্টু?’
প্রথমে বল্টু ঠিক বুঝতে পারে না, কে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির চুলা থেকে আগুনের লাল আঁচটা মুখের উপর বেশ কিছুটা আবছা হয়ে পড়ছিল। সজারুর কাঁটার মত ঠোঁটের উপর দুই গুচ্ছ গোঁফ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে আলোতে। বল্টুর আর চিনতে তেমন অসুবিধা হল না। উনি অভিজিৎ দা। নান্দীমুখ নাট্যদলের প্রধান পরিচালক। বল্টু তার দিকে কিছুটা পাশ ফিরে তাকালো। তারপর শরীরের চিটা পরা আধময়লা গেঞ্জিটা খুলতে খুলতে নেমে এলো চৌকি থেকে।
‘না, অভিজিৎ দা। পানি জাল অইতাছে, কতক্ষণ খাঁড়ান লাগব, পানিডা উতরাক।’
‘এত দেরি করে কেন যে চা বানাস বুঝি না।’ ভ্রু-কুঁচকে; ‘কাল হতে একটু তাড়াতাড়ি চায়ের পানি বসাবি। একটু পরেই আবার রিহার্সেল।’

চৌকি থেকে নেমে মাথার উপর গাছপালাগুলোর দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকায় সে। নাক দিয়ে হু-হু করে দুটো নিশ্বাস ছাড়ে। দোকানের বাতির সুইচটা জ্বালায়। আলোতে ফকফকা হয়ে ওঠে পুরো দোকান। তারপর আবার সন্তর্পণে চায়ের কেতলিটার কাছে যায় বল্টু। ঢাকনাটা খুলে মুখটা কাছে নিয়ে যায়, সরু চোখে তাকায় কেতলির ভেতরটায়। এতক্ষণে পানিটা গটগটিয়ে ফুটছে। ফুটন্ত পানির বুটবুট একটা আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। বইয়াম হতে চা-পাতির গুঁড়া কেতলিতে মোট করে দেয়। তারপর অভিজিৎ দার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে বল্টু। বেশ খানিকক্ষণ পর-
‘দাদা আফনের চায়ে কি আদা দিমু?’
‘হ্যাঁ, দে একটু। গলাটা কেমন ধরে আছে আজ।’
‘আইচ্ছা ঠিক আছে।’
বলেই আবার একটা অধফালা হাসি দেয়। তার কিছুটা হাসি রোগ আছে। যখন-তখন অসৌজন্যমূলক হাসি হাসে! অভিজিৎ লোকটি তার দিকে এবার কিছুটা রগচটা চোখে তাকাল।
‘নে, হাসবি পরে। এবার চা-টা তো বানা। দেরি করিয়ে দিলি একদম।’
বল্টু চায়ের কেতলিটা খালি হাতেই ধরে। কেতলির হ্যাঙ্গারে বেশ দলা করে মোটা কাপড় পেঁচানো। তারপর খুব সাবধানে চায়ের লিকার ঢালে কাপে।
‘দাদা চা-ডা লন।’ চায়ের কাপটা এগিয়ে দেয় বল্টু। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নেন অভিজিৎ। সুরৎ সুরৎ করে একটা শব্দ করছে মুখ দিয়ে চা খাত্তয়ার সময়। চা’টা শেষ করেই,
‘দুটো ক্যাপস্টান দিস।’ বলেই নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয় বল্টুর দিকে।
সে দুটো সিগারেট এগিয়ে দেয়। ঠোঁটের আগায় সিগারেটটি রেখেই লাইটার দিয়ে ফুট করে সিগারেটটি ধরায়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে,
‘কত হয়েছে রে?’
বল্টু একটু হেসে হেসে বলল, ‘দাদা আডারো টেহা।’
‘ঠিক আছে। খাতায় লিখে রাখিস, যাবার সময় দিয়ে যাব।’ বলেই আর দাঁড়ালেন না। লম্বা লম্বা পা ফেলে অডিটোরিয়ামের ভেতরের দিকে চলে গেলেন। বল্টু তার চলে যাওয়ার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

কাঠ দিয়ে বানানো একটা পেটরা হতে ছলতা ওঠা লাল মলাটের একটা রোল করা খাতা বের করে সে। খাতায় তুলে রাখে বাকির হিসেবটা। পেটরার ভেতরে গতদিনের এক টাকা, দু’টাকার সিকি কয়েনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বল্টু কয়েনগুলোকে একটা কনডেন্স মিল্কের পুরোনো পটের ভেতর ভরে রাখে। তারপর হঠাৎ কী একটা ভেবে মনটা খুঁতখুঁতে হয়ে ওঠে, ছলছল করে ওঠে চোখ দুটো! একটু পরেই হিমাদ্রিকে দেখতে পেল বল্টু। হিমাদ্রি প্রিমিয়ার ভার্সিটির ছাত্র, প্রায়ই আসে এখানে আড্ডা দিতে। একা অবশ্য খুব কমই আসে, বেশিরভাগ সময়টাতেই আসে শুভ্রাকে নিয়ে। বল্টুর চোখের পলক পরার আগেই হিমাদ্রি দোকানের কাছে এসে এক পা সাইডের দেয়ালে ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। হিমাদ্রি কিছু বলবার আগেই সে এক কাপ-চা হিমাদ্রির দিকে এগিয়ে দিলো-
‘ভাইজান ধরেন চা।’ হিমাদ্রি হাত বাড়িয়ে চা-টা নেয়।
‘তোর শুভ্রা দিদিকে দেখেছিস?’ চায়ে চুমুক তুলতে তুলতে জানতে চায়।
‘না, দেহি নাই।’ বলেই খুকখুক হাসে বল্টু।
‘বদমাইশের মত হাসবি না একদম।’ মুখে বেশ তাচ্ছিল্যের একটা ভাব ফুটে ওঠে। ধমক খেয়ে মুখটা চুপসে যায় বল্টুর।

একটু পরেই শুভ্রাকে দেখতে পেল হিমাদ্র্রি। শিল্পকলার পেছনের গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে সে। একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে, পাড়ে কিছু ছিটেফোঁটা নকশা। ব্লাউজটাও সাদাই বেছে নিয়েছে। সাথে আরেকটা মেয়েকেও দেখা যাচ্ছে, সে পরেছে হালকা মেজেন্ডা রঙের জামদানি শাড়ি। শুভ্রাকেই বেশ সুন্দর লাগছে। ঢুকে হিমাদ্রির দিকে তাকিয়েই একটা হাসির ঢেকুর তুলল শুভ্রা। এসেই,
‘কেমন আছেন জনাব?’
‘হুম ভালো।’
‘ও আচ্ছা, পরিচয় করিয়ে দেই আমার ফ্রেন্ড শুশ্রী।’
মেয়েটি বেশ লাজুক স্বভাবের, চোখ তুলে আর তাকালো না। মাথা নিচু করেই শুধু একবার তরল একটা কাটা সুরে বলল, ‘আমার কাজ আছে। আমি বাসায় যাব, তোরা আড্ডা দে।’
‘সে কি! মাত্রই তো এলাম। আর এখনই যাই। কিছুক্ষণ আগে কি প্ল্যান করলাম ভুলেই গেলি?’
মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায় শুভ্রার। সেদিকে একপলক তাকায় শুশ্রী মেয়েটি। তারপর থেকেই একদম চুপ। শুধু কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল হিমাদ্রি আর শুভ্রা। বল্টু এরই মধ্যে বাকি দু’জনকেও দু’কাপ চা বানিয়ে দিলো। সে সবার দিকে মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। তারপর আচমকা ইলেকট্রিসিটি চলে যায়, পুরো শিল্পকলায় বেশ ঘটঘটা একটা অন্ধকার। হিমাদ্রি এ সুযোগে শুভ্রার পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়।
‘তোমাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে, তুমি এত সুন্দর কেন?’ গলাটা নিচু করে শুভ্রার কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফুসুর ফুসুর কথা বলছে সে।
‘আহাহা, পূর্ণিমার চাঁদও আমাকে দেখলে ফেইল মারবে তাই না!’ মুখ ভেংচায় শুভ্রা।
‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, সেকি মোর অপরাধ?’
‘কবি হয়েছ দেখছি!’ শুভ্রার মনটা কেমন যেন শান্ত হয়ে আসে!
অন্ধকারটা বেশ গাঢ়। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। শুধু বল্টুর কালো মুখটা হালকা লালচে দেখা যাচ্ছে চুলোর আগুনের আঁচে। পাশাপাশি তিনটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে অথচ অস্তিত্বহীন মনে হচ্ছে। হিমাদ্রি আলতো করে শুভ্রার কোমরে হাত রাখল, কিছুই বলল না সে। শুধু একবার তাকালো।
‘অসভ্য কোথাকার!’
‘অসভ্য কেন! আমি কি করলাম?’ বলেই শুভ্রার কোমর থেকে হাতটা সরিয়ে অফ মুডে চলে যায় হিমাদ্রি।
শুভ্রা গলাটা আস্তে করে একটু খাঁকানি দিলো, ‘এত্ত রাগ?’ তাতে তেমন ভাবান্তর হলো না তার। অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে রইল। শুভ্রা কিছুটা অবাক করে দিয়ে অন্ধকারেই হিমাদ্রির পাঞ্জাবির কলারটা হেচকা একটা টান দিয়ে মুখটা একদম কাছে নিয়ে আসে, তারপর কুটুস করে নিঃশব্দে একটা নিষিদ্ধ চুমু খায়। হিমাদ্রির চোখটা কেমন জ্বলজ্বল করে ওঠে। একটা শুভ্রময় হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণায়। শুভ্রাও একফালি একটা চিকন হাসি দেয়। হিমাদ্রির বুকে মাথা রেখে কেমন ভারি নিশ্বাস ছাড়তে থাকে শুভ্রা। তারপর; আচমকাই ‘মাগো’ বলে একটা চিৎকারের শব্দ! শব্দটার বেরিয়ে আসা কণ্ঠটা বেশ পরিচিত,
‘বল্টুর গলা না?’ মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে আসে হিমাদ্রির। চোখ সরিয়ে তাকাতেই বল্টুর কালো দেহটি গড়াগড়ি খাচ্ছে দু’টো চৌকি জোড়া দিয়ে বানানো টংটার উপর। অন্ধকারে গরম ধোঁয়া ওঠা কেতলির পানিটা হাত ফসকে ছিটকে পড়ে চৌকি, লিরলিরা শরীর আর নারিকেলের আঁইচার মত গোলগাল মুখটার একপার্শ্বের পুরোটা জুড়ে। চিৎকারটা কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে, জৌলুসতা হারায় রাতের অনুভূতিময় সময়টা। হিমাদ্রি, শুভ্রা আর শুশ্রী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থকে।

এর আরও প্রায় আধঘণ্টা পর আসে ইলেকট্রিসিটি। জ্বলে ওঠে চারপাশের নিয়নের আলোগুলো। খবর পেয়ে দৌড়ে ছুটে আসে বল্টুর মা। ছেলে আর মায়ের আর্তচিৎকারে আরও ভারী হয়ে ওঠে নিমিষেই একফালি জায়গায় সামিয়ানা টাঙ্গানো জায়গাটা।
‘আম্মা গো, আম্মা গো।’
‘বাজান, আমার সোনা মানিক কিচ্ছু অইব না তর।’
হাতের চা-টা এখনো দু’চুমুক বাকি হিমাদ্রির। কাপের শেষভাগে একফালি লেবু পড়ে আছে এখনো!

এসইউ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।