ড. তপন বাগচীর সাক্ষাৎকার- প্রথম পর্ব

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:০৮ পিএম, ২৬ মে ২০২০

নব্বই দশকের শীর্ষস্থানীয় কবি, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক ড. তপন বাগচী। জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরে। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী ও মা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ-পিএইচডি। বর্তমানে বাংলা একাডেমির উপপরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তার উল্লেখযোগ্য ছড়া-কিশোর কবিতাগ্রন্থ হলো— মুজিব-নামে রক্তদামে (২০১৯), পরিবেশ পড়ি বেশ (২০১৮), কবি ঠাকুর ছবি ঠাকুর (২০১৭), মেঘের ভেলা ছায়ার খেলা (২০১৭), ছন্দোবদ্ধ ভাবের পদ্য (২০১৩), চোখের পাতায় বুকের খাতায় (২০১২), সকালবেলা স্মৃতির ভেলা (২০১১), সমকালে তমকালে (২০১০), মঙ্গা আসে ঘরের পাশে (২০০৯), রাতের বেলা ভূতের খেলা (২০০৯), ঢাকা-লন্ডন ইমেইল ছড়া (রব্বানী চৌধুরী-সহযোগে, ২০০৭), খাচ্ছে ছুটি লুটোপুটি (১ম ২০০৭, ২য় সং ২০১৬), স্বপ্নেবোনা তূণীর সোনা (১ম ২০০৬, ২য় সং ২০১৬), চরকাবুড়ি ওড়ায় ঘুড়ি (১৯৯৫), রুখে দাঁড়াই বর্গী তাড়াই (১ম ১৯৯৪, ২য় সং ২০১৬)।

কিশোরগল্পের বইগুলো হলো— ফণিদার যত ফন্দিফিকির (২০১৯), মাটির নিচে নদীর ধারা (২০১৭), পুরাণের তিন নদীর গল্প (২০১৫), সাতদিনের সাতকাহন (২০১১) এবং শুভর শখের গোয়েন্দাগিরি (১ম ১৯৯২, ২য় সং ২০০১)। কবিতাগ্রন্থ— শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি, কেতকীর প্রতি পক্ষপাত, অন্তহীন ক্ষতের গভীরে, সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল। প্রবন্ধগ্রন্থ— সাহিত্যের এদিক-সেদিক, সাহিত্যের কাছে-দূরে, চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : চন্দ্রাহত অভিমান, নির্বাচন সাংবাদিকতা, নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার, তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি— তাঁর সময়ের সবচেয়ে বেশি পুরস্কারে ধন্য হয়েছেন তিনি। গান লিখে তিনি ৪ বার পেয়েছেন স্টান্ডার্ড চার্টার্ড দ্য ডেইলি স্টার সেলিব্রেটিং লাইফ গীতিকার পুরস্কার (২০১৯, ২০১৬, ২০১৪, ২০১৩)। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পদক (২০২০), নজরুল পুরস্কার (চুরুলিয়া ২০১৯), নজরুল অ্যাওয়ার্ড (মেমারি ২০১৯), অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), সুফিসাধক আরকুম শাহ স্মৃতি পদক (২০১৭), অনুভব বহুমুখি সমবায় সমিতি সাহিত্য পদক (২০১৩); সাংস্কৃতিক খবর সম্মাননা (২০১২); নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার (কোলকাতা, ২০১১); ২ বার বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ফেলোশিপ (২০১২ ও ২০১০), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (কোলকাতা, ২০০৮); মাইকেল মধুসূদন পদক (২০০৮), এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮); জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮); নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮); পাক্ষিক ‘মুকসুদপুর সংবাদ’ সম্মাননা (২০০৭); জসীমউদদীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬); মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)। এ ছাড়া জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের আরও পদক-পুরস্কার রয়েছে তার সংগ্রহে।

তপন বাগচীকে নিয়ে সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ এবং গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের ঘটনাও উল্লেখযোগ্য। তার পঞ্চাশ বছরকে কেন্দ্র করে বীরেন মুখার্জীর ‘দৃষ্টি’, অনাদিরঞ্জন বিশ্বাসের ‘বাকপ্রতিমা’, নীলাদ্রিশেখর সরকারের ‘কথাকৃতি’ এবং রুবেল আনছারের ‘রিভিউ’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। তার উপর রচিত হয়েছে পাঁচটি গ্রন্থ— নদিয়ার শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের ‘শিশুসাহিত্যে তপন বাগচী বর্ণময় আলোকদ্যুতি’, গোপালগঞ্জের হরিদাস ঠাকুরের ‘কবি তপন বাগচীর মনন-দর্শন’, রাজশাহীর ড. অনুপম হীরা মণ্ডলের ‘সাহিত্যের তপন বাগচী: বিচিত্র বিভাকর’, দিল্লির মনীষা কর বাগচীর ‘মূলসন্ধির কবি তপন বাগচী- নিবিড় অনুধ্যান এবং কলকাতার নরেশ মণ্ডলের ‘তপন বাগচীর সাহিত্য- চকিত বীক্ষণ’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক কবি তরুণ মুখোপাথ্যায় ‘প্রেমিক কবি তপন বাগচী’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার উপর আরও কিছু গবেষণা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রুবেল আনছারের সহযোগিতায় সমকালের আলোচিত এই সাহিত্যিকের মুখোমুখি হয়েছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষক সাবরিনা আফরিন সিলভী

tapon1

সাবরিনা আফরিন সিলভী: আপনি তো শিশুসাহিত্য রচনা করেন। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও আপনার বিচরণ রয়েছে। কোন পরিচয়ে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
তপন বাগচী: আমি সচেতনভাবেই শিশুসাহিত্য রচনা করি। মনে হয় কিছু কথা শিশুদের জন্যই বলা উচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, সেলিনা হোসেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, অসীম সাহা, আবিদ আনোয়ার, বিমল গুহ, গোলাম কিবরিয়া পিনু প্রমুখ সাহিত্যিক শিশুদের জন্য লিখেছেন। কিন্তু তাঁদেরকে কেউ শিশুসাহিত্যিক বলে ডাকেন না। তাঁরা কেউ কবি, কেউ কথাসাহিত্যিক। আমি ছড়া, কিশোরগল্প, প্রবন্ধ প্রভৃতি প্রকরণের সাহিত্য রচনা করলেও আমার সাধনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কবিতা। তাই কবিতার পরিচয়টিই আমি মুখ্য মনে করি। তবে শিশুসাহিত্যিক কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে কেউ ছড়াকার বললে আমি অখুশি হই না। কারণ ওই শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে আমার উল্লেখযোগ্য কাজ আছে বলে ধারণা করি।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: আপনার শিশুসাহিত্যের কিছুটা পরিচয় পেতে চাই—
তপন বাগচী: সংখ্যার বিচারে বলা যায়, আমার ছড়ার বইয়ের সংখ্যা ১৫, কিশোরগল্প বইয়ের সংখ্যা ৫ আর শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ ৫ খানা, কিশোরতোষ ইতিহাসগ্রন্থ ১ খানা। যাঁরা ‘ফুলটাইম শিশুসাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচিত, তাঁদের কারো কারো চেয়ে এই ২৬ খানা বইয়ের সংখ্যা কম নয় নিশ্চয়ই। তবে আমি মনে করি, সংখ্যাবিচার নয়, গুণবিচারই সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর সেই বিচার করতে পারেন পাঠক এবং কখনো কখনো সমালোচক। আমার শিশুসাহিত্যের অবদানের মূল্যায়নের ভার পাঠক ও সমালোচকের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: আপনার সমকালে শিশুসাত্যিকদের পরিচয় জানতে চাই—
তপন বাগচী: আমার সমকালীন কবিদের মধ্যে হাসানআল আবদুল্লাহ, টোকন ঠাকুর, রহমান হেনরী, জ্যোতির্ময় সেন প্রমুখ কবি ছড়া লিখেছেন। তবে কবি পরিচয় আড়ালে চলে যাওয়ার ভয়ে কিংবা ছন্দেও দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেক কবিই ছড়া লিখতে চান না। তবে জ্যোতির্ময় সেন এখন কবিতার চেয়ে ছড়ার প্রতিও বেশি আকৃষ্ট। মনি হায়দার ও প্রশান্ত মৃধা কথাসাহিত্যের পাশাপাশি শিশুসাহিত্যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। আর কেবলই শিশুসাহিত্যের আঙিনায় বিরাজ করছেন এমন সাহিত্যিকরা হলেন সিকদার নাজমুল হক, আনজীর লিটন, রোমেন রায়হান, সারওয়ার উল ইসলাম, বাকীউল আলম, হুমায়ুন কবীর ঢালী, সোহেল মল্লিক, জগলুল হায়দার, আতিক রহমান, চন্দনকৃষ্ণ পাল প্রমুখ। বয়সে একটু বড় হলেও জাহাঙ্গীর আলম জাহান আমাদের সময়ের বড় এক ছড়াকার। আবার এরই মধ্যে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন আরজু আহমদ ও ওবায়দুল গণি চন্দনের মতো শক্তিশালী ছড়াকার। আবার একসময়ে ভালো লিখে আর টিকে থাকেননি অনেকে। ছড়াকার টিপু কিবরিয়া এবং সৈয়দ ওবায়দুল হকের নাম মনে করতে পারি। খুব ভালো লিখতেন একসময়। তারপরে একসময় আর মূলস্রোতে রইলেন না।

tapon1

সাবরিনা আফরিন সিলভী: ‘ফণিদার যত ফন্দিফিকির’ গল্পগ্রন্থে যে ছড়াগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তা কি সব আপনার লেখা?
তপন বাগচী: স্বতন্ত্র ছড়া নয় ওগুলো। ওই কাহিনির প্রয়োজনেই রচিত। কাহিনিকে এগিয়ে নিতে মাঝখানের ঘটনার ফাঁক পূরণে কিংবা চরিত্রের মুখে সংলাপ হিসেবে আমি তাৎক্ষণিকভাবে ছড়াগুলো রচনা করেছি। এটি ‘ফণিদার যত ফন্দিফিকির’ গল্পগ্রন্থেই কেবল নয়, আমার শিশুতোষ অন্যান্য গ্রন্থেও এই ধরনের প্রচেষ্ট রয়েছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার গল্পগ্রন্থ ‘সাতদিনের সাতকাহনে’ও এরকম ছন্দোময় চরণ আছে। আমার প্রথম শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ ‘শুভ শখের গোয়েন্দাগিরি’তে ভূত ও পাখির মুখে সংলাপ হিসেবে এই সমিল চরণের আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন চট্টগ্রামের এক অগ্রজ ছড়াকার ওমপ্রকাশ ঘোষরায় স্থানীয় এক সংবাদপত্রে বইটির আলোচনা করতে গিয়ে আমার এই উদ্যোগের খুবই প্রশংসা করেন। গল্পকারসত্তার ভেতরেই তিন কবিসত্তা আবিষ্কার করেন। তাতে আমি উদ্বুদ্ধ হই। পরবর্তীকালে ছোটদের জন্য গল্প লিখতে গেলেই আমি এই কাজটি করে থাকি। গল্পের ভেতরে এরকম ছড়া লিখতে আমার বেশ ভালো লাগে।

সাবরিনা আফরিন সিলভী: শিশুতোষ গল্পের শেষে মোরাল বা নীতিবাক্য দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি-না? আপনার গল্পের শেষে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন মোরাল ব্যবহার করেননি? (ঈশপের গল্পের মতো)
তপন বাগচী: ঈশপের মূল গল্পের শেষে এরকম নীতিবাক্য উল্লেখ করা ছিল বলে আমার মনে হয় না। ঈশপের গল্প তো অনূদিত, পুনর্কথিত ও সম্পাদিত হতে হতে এই পর্যন্ত এসেছে। সেখানে ছোটদের কাছে গল্পের উপযোগিতা বৃদ্ধি করতে গিয়ে কোনো এক সম্পাদক গল্পের শিক্ষণীয় বিষয়টি গল্পের শেষে জুড়ে দিয়েছেন বলে আমার ধারণা। ঈশপ তো গল্পকথক। তিনি কেন নীতিবাক্য বলবেন? পাঠ শেষে পাঠকের মনেই তো এই নীতিকথা জেগে উঠবে। সমালোচক কিংবা সম্পাদকও নীতিকথা জুড়ে দিতে পারেন। এই কাজ গল্পকারের নয় বলেই আমার বিবেচনা। তাই আমি গল্পের শেষে মোরাল বা নীতিবাক্য জুড়ে দিতে চাইনি। আমার ধারণা পাঠকই প্রতিটি গল্পের নীতিবাক্য নিজের মতো করে কল্পনা করে নিতে পারবেন।

চলবে...

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।