রুদ্র-প্রচেতা : পর্ব ১০

ড. রাজুব ভৌমিক
ড. রাজুব ভৌমিক ড. রাজুব ভৌমিক , কবি ও লেখক
প্রকাশিত: ০৪:১৭ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০২০

একদিন প্রাভাতিকে কাঁচা বাজার করিবার জন্য প্রচেতাদের বাটিকার সামনে দিয়া হাঁটিয়া যাইতেছিলাম। অলক্ষিতভাবে পেছন হইতে কান্তা দিদির ডাক শুনিতে পাইলাম। ‘রুদ্র—এদিকে আয়।’ আমি প্রচেতাদের দরজার সামনে আসিয়া দাঁড়াইলাম। প্রচেতাকে দরজার ফোকর দিয়া বেশ স্পষ্টতই দেখিতে পাইলাম। প্রচেতা পড়ার টেবিলে বসিয়া মনযোগসহকারে পড়িতেছে। ‘না রে রুদ্র—আজ আমাদের তোর বাজার করিতে হইবে না। শুনেছি তুই নাকি পাড়ার ছেলেমেয়েদের কম্পিউটার শিখাইতেছিস?’ কান্তা দিদি কহিলেন। তখুনি আমি অনুমান করিতে পারিলাম যে আমার এতদিনের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হইতে আর দেরি হইবে না। ‘হ্যাঁ, দিদি—পরীক্ষা তো সেই কবেই শেষ হইয়াছে। আপাতত পড়াশুনা নিয়া আমার তেমন কোন ব্যস্ততা নাই। ইন্টারে পড়িবার জন্য কোথাও ভর্তি পরীক্ষাও দিব না। আমাদের এই সরকারী মুজিব কলেজেই ভর্তি হইব। তাই এই সময়টা কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিতেছি। পাড়ার অনেক ছেলমেয়ে কম্পিউটারের কিছুই জানে না। আমি শিখাইবার পর থেকে এরা এখন কম্পিউটার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে।’ আমি কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি বেশ প্রীত হইলেন। ‘আমাদের প্রচেতাকে একটু কম্পিউটার শিখাইতে পারবি?’ কান্তা দিদি কহিলেন। প্রচেতা তাহার মাতার কণ্ঠে আপন নাম শুনিবার সাথে সাথেই পড়ার টেবিল হইতে মাথা ঘুরাইয়া পিছন দিকে তাকাইলেন। তাহার নয়নে আমারও নয়ন মূর্ছা খাইয়া পড়িল। সে হয়ত বুঝিতে পারিল যে আমি এতক্ষণ তাহার পানে নির্লজ্জের মত চাহিয়াছিলাম। এদিকে আমি কান্তা দিদির নিবেদন শুনিয়া মনের ভিতর যেন দুর্গোপূজোর নবমীর রাতে আরতী সময়ের মত আনন্দের ঢাক-ঢোল বাজিতে লাগিল। এতই আনন্দিত হইছিলাম যে তৎক্ষণাৎ আমি কান্তা দিদির কোন এক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলাম না। তিনি আবার আমাকে জিজ্ঞেস করিলেন তখন সঙ্গে সঙ্গে কহিলাম, ‘অবশ্যই দিদি—প্রতিদিন সন্ধ্যার পূর্ববর্তী দুই-তিন ঘণ্টা পূর্বে আমাদের বাসায় কর্মকারদের মেয়ে পাখির সাথে পাঠাইতে পারেন। আমি তাহাকে শিখাইবার চেষ্টা করিব।’

অতিক্রান্তে আমি কাঁচাবাজারের সম্মুখে যাত্রা পুনরায় আরম্ভ করিলাম। কিছুদিনের মধ্যে প্রচেতা আমার কাছে আসিয়া কম্পিউটার শিখিবে বলে মগজের ভিতর স্বপ্নগুলো মৌমাছির দলের মত আমার নয়নের দিকে তাড়াইয়া আসিতে লাগিল। মনে হইতেছিল আমার সুপ্ত স্বপ্নগুলোর বাসায় কেউ একটা মস্ত ঢিল মারিয়া দিল। এইসব সুপ্ত স্বপ্নগুলোর সম্পর্কে পূর্বে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আজ কান্তা দিদি আমার সুপ্ত স্বপ্নের বাসায় ঢিল মারিয়া দিলে ধীরে ধীরে প্রচেতাকে নিয়া আমার সব স্বপ্নগুলো পরিষ্কার হইতে লাগিল। আমি দেখছিলুম প্রচেতাকে খুব নিকট হইতে দেখিবার স্বপ্ন—আমি দেখছিলুম তাহার চুলের গন্ধ আমার নাসিকায় প্রবেশের স্বপ্ন। তাহার কণ্ঠের কথা মম কর্ণে শুনিবার স্বপ্ন দেখছিলুম—তাহার নয়নে এই নয়ন দুটি রাখিবার স্বপ্ন দেখছিলুম। আহা—আনন্দে যেন আমি বৃষ্টির কণার মত সাগরে ভাসিয়া যাইতেছি। মানুষের জীবন এত সুখের হইলে—মানুষ কেনই বা স্বর্গে যাইবার জন্য এত লাফালাফি করিয়া থাকে। তাহারা কি আমার মত তাহাদিগের স্বর্গসুখ এই ধরাতে খুঁজিয়া নিতে পারে না? কেন মিছে মিছে তাহারা মন্দির মসজিদে গিয়া সময় নষ্ট করিয়া থাকে? সেটা মোর বোধগম্য হইলনা। পরক্ষণে আবার ভাবিলাম—আমি যদি প্রচেতাকে কম্পিউটার শিখাইতে আরম্ভ করি তাহা হইলে আমি তো তাহার শিক্ষক হইব! এটা ভাবিতেই কিছুটা লজ্জা পাইলাম।

সেদিন সন্ধ্যায় নাস্তা করিবার জন্য সাজুদের চায়ের দোকানে আসিলাম। দোকানের ভিতর সাজুকে দেখিতে পাইলাম না। তাই অনিমেষ জেঠা মসাইকে কহিলাম, ‘জেঠা সাজু কই?’ পরক্ষণে জানিতে পারিলাম সাজু আজ তাহাদিগের গ্রামের বাড়িতে গিয়াছে। তাই অগত্যা অনিমেষ জেঠা মসাইয়ের সাথে খোশগল্প আরম্ভ করিলুম। হঠাৎ জেঠা মসাই কহিলেন, ‘কিরে রুদ্র তুই বুঝি প্রচেতাকে পছন্দ করিস?’ সময় যেন তৎক্ষণাৎ থামিয়া গেল। আর ভাবিলাম—জেঠা মসাই কেমন করিয়া জানিল যে আমি প্রচেতাকে পছন্দ করি? নাকি সাজু উনাকে সব বলিয়া দিলেন। আবার ভাবিলাম—সাজু এরকমের ছেলেই না। সে এটা কখনো করিতে পারে না। আমিও জেঠা মসাইেয়র প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। ‘হ্যাঁ রে রুদ্র, আমি সব জানি। একদিন তোর মত আমারও বয়স ছিল। আমি সব-বুঝি।’ তখন তিনি জেঠা এবং জেঠিমা’র প্রেম কাহিনী সম্পর্কে আমায় বিস্তারিত বলিলেন। জেঠা মসাইও তখনকার সময়ে প্রেম করিয়া বিবাহ করিয়াছিলেন। উনার প্রেমজীবনের চড়াই-উৎরাই সবই খোলা মনে বিস্তারিত বলিলেন। এতে উনার প্রতি আমার বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা আরও বৃদ্ধি হইল। তিনি কহিলেন, ‘তুই পড়াশুনা শেষ কর। আমেরিকাতে গিয়ে ভালো করিয়া পড়াশুনা করিয়া একটি ভালো চাকুরি কর। প্রচেতাও পড়াশুনা করুক। প্রচেতা খুব ভালো একটি মেয়ে। চিন্তা করিস না—আমরা বয়স্করা তো আছি। প্রচেতার দাদু প্রসন্নবাবুর সাথে আমার গভীর খাতির। প্রসন্নবাবু তোর সম্পর্কে খুব ভালো জানে। তুই আগে আমেরিকায় যাইয়া সব ঠিক কর। আমিই একদিন প্রসন্নবাবুর কাছে তোর হইয়া বিয়ের প্রস্তাবটি দিব। আমার বিশ্বাস তোর মনোবাসনা একদিন অবশ্যই পূর্ণ হইবে।’

তিনি পুনরায় কহিলেন আমাদের প্রেম-কথা অন্যরে নাহি বলিতে—কেননা মানুষ নাকি অন্যের সুখ সহ্য করিতে পারে না এবং কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত অন্যের অমঙ্গল কামনা করিয়া জীবন-যাপন করে। একটু ভাবিয়া দেখিলুম জেঠা মসাই ঠিক কহিলেন। সমাজে কিছু মানুষ অন্যের ক্ষতি দেখিবার জন্য দমবন্ধ করিয়া অপেক্ষা করিতে থাকে। তাই যেকোন মূল্যে হোক না কেন ইহাদিগের অপেক্ষাটি দীর্ঘ করিতে হইবে। তাহা হইলে একদিন তাহারা আপনা আপনি সরিয়া দাঁড়াইবে।

সেদিন জেঠা মসাইয়ের মুখে এসব শুনিয়া বুকের ভিতর আশার সঞ্চার হইল। বুঝিতে পারিলাম প্রচেতা একদিন আমার জীবনে আসিবেই। দিনদিন প্রচেতাকে নিয়া আমার আশার ছোট্ট ঘরটি বিশাল এক অট্টালিকায় পরিণত হইতেছিল। এখন আর শুধু প্রচেতাকে নিঃস্বার্থভাবে সারাজীবন ভালোবাসিয়া যাইব সেটা ভাবি না। এখন স্বপ্ন দেখি প্রচেতার সাথে বৃদ্ধ হবার—যেথায় ছোট্ট একটি সুখের সংসার হইবে। আমাদের অনেক সন্তান হইবে—প্রচেতা তাদের লালন-পালন করিবে। আমায় প্রতিদিন ভালোবেসে রান্না করিয়া খাওয়াইবে। প্রতিদিন ঘুম ভাঙিলে প্রচেতাকে দেখিব—আবার তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমার ঘুম ভাঙিবে। ছোটবেলায় স্বর্গ সম্পর্কে নানা লোকের মুখে নানা বাক্য শুনিয়াছি কিন্তু কেউ স্বর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত কহিতে পারিল না। যাহারা হয়ত স্বর্গ দেখিয়াছে তাহারা বহু আগেই ভব হইতে পালাইয়াছে। তাই স্বর্গ সম্পর্কে ভবের কারো তেমন কোন ধারণা নাই। তবে আমার স্বর্গ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণাই ছিল। যাতে ছিল প্রচেতার রাজত্ব—সকাল হইতে সন্ধ্যা অবধি।

পরের দিন বিকেল সাড়ে চারটার সময় পাড়ার একটি মেয়ে পাখির সঙ্গে প্রচেতা কম্পিউটার শেখার জন্য আমাদের বাসস্থানে প্রবেশ করিল। আমাদের ঘরের কক্ষগুলো বেশ অগোছালো ছিল—তা লক্ষ্য করিয়া লজ্জা পাইলাম। প্রচেতা যে সত্যি সত্যি আসিবে তাহা ভাবিনি—তাহা না হইলে আমাদের কক্ষগুলোকে আরও গোছালো রাখিবার চেষ্টা অবশ্যই করিতাম। ‘কোথায় বসিব?’ প্রচেতা কহিল। আমি উত্তর না দিয়া তাহারে কম্পিউটারের কক্ষটি ইশারা দিয়া দেখাইয়া দিলাম। কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটি তাহার নিকটে আনিয়া দিলাম। প্রচেতা কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটির উপরে বসিল। পাখিও একটি চেয়ারে বসিল। আমি কম্পিউটারটি চালু করিলাম। প্রচেতার সামনে কম্পিউটারের কি-বোর্ডটিতে উইন্ডোজ বাটনটি টিপ দিতেই অজান্তে তাহার চুলের ঘ্রাণটি নাসিকার মধ্যে প্রবেশ করিল। মনে হইতেছিল সে গত দুইদিন তাহার চুলে কোন তেল দেয়নি—এবং তিন দিন আগে তাহার চুলে জুঁই মার্কা নারিকেল তেল মাখিয়াছে। তেলের ঘ্রাণটি অতটি প্রখর ছিল না কিন্তু তাহার চুলের প্রাকৃতিক সুবাস আমায় মোহিত করিয়াছিল। তাহাতেই আমার বাক্য-রোধ হইয়া যায়। এতদনুসারে এই সময়ের মধ্যে তাহার সাথে কোন বাক্যালাপ হয়নি। আমি ইশারাতে প্রচেতার সাথে যোগাযোগ করিতে লাগিলাম।

এদিকে পাখিসহ আরো বেশ কয়েকজন পাড়ার ছেলেমেয়েকে কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া আমাদের বাসায় কম্পিউটার শিখাইতেছিলাম। আজ পাখি লক্ষ্য করিল যে প্রচেতা একেবারেই নতুন এবং তাকে শুরু হইতে শিখাইতেছি। তাই পাখি আজ কম্পিউটার শিখিতে চাইল না। পাখি আমাকে কাকা বলে ডাকিত। কিছুক্ষণ পর পাখি কহিল, ‘কাকা, আমি একটু আসছি।’ এই বলে পাখি চলে গেল। যেহেতু আমি বহুদিন ধরিয়া কম্পিউটার ব্যবহার করিতেছি সেহেতু কম্পিউটার সম্পর্কে আমার বেশ ভালো ধারণাই ছিল। কম্পিউটারের বিভিন্ন কোডগুলো সহজ করিয়া আমি একটি খাতাতে লিখিয়া রাখিতাম। আজ প্রচেতাকে আমি সেই খাতাটি উপহার হিসেবে দিলাম। ‘এটা একটু পড়িলে কম্পিউটারের সবকিছু খুব সহজেই আয়ত্ত করা যাবে। আমি ওদের কাউকে এই খাতাটি দেখাইনি—শুধু তোমাকেই দিচ্ছি।’ আমি কহিলাম। এরপর ইশারায় কহিলাম খাতাটি সে ইচ্ছে করিলে নিয়ে যেতে পারে। প্রচেতা নয়নের উপর আমার নয়ন দুটি পড়িল। যেন সে বলিতেছিল, ‘আপনি শুধু আমাকে এই খাতাটি দিচ্ছেন? কেন?’ আমি ঠিক তার নয়নের ভাষা বুঝিতে পারিলাম। মনে মনে একটু কষ্টও পাইলাম। আর ভাবিলাম—কেন প্রচেতা বুঝিতে পারিতেছে না যে, আমি তাহাকে ভালোবাসি। তাই তাহাকে আমার মূল্যবান এই খাতাটি উপহার দিলাম। তাছাড়া আমি যে তাহাকে ভালোবাসি সেটা তাহার অজানা নয়। পত্রের মাধ্যমে সেটা সে বহু আগেই জানিয়াছে। তাহলে সে কেন এমন ভাব করিয়া আছে যে—যেন সে এসবের কিছুই জানে না? তাহলে কি নিস্তব্ধতা আমার পত্রের উত্তর—সে আমাকে ভালোবাসে না?

এভাবে কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। প্রচেতা নিয়মিত আমাদের বাসায় আসিয়া আমার কাছে কম্পিউটার শিখিয়া যাইতেছে। প্রচেতার সাথে আমার সাধারণত কম্পিউটার নিয়ে বাক্যালাপ হইত—এর বেশি কিছু নয়। মাঝে মাঝে একটু মন খারাপ হইত যখন ভাবিতাম প্রচেতা আমাকে হয়ত ভালোবাসে না—কারণ ভালোবাসিলে নিশ্চয় সে আমার সাথে আকার ইঙ্গিতে কিছু বুঝাইয়া কহিত। অন্যদিকে আমি একপ্রকার ভালোই ছিলাম কেননা আমি প্রচেতাকে নিয়মিত দেখিতে পারিতাম। তাহার সাথে কথা বলিতে পারিতাম। যখনি প্রচেতা কম্পিউটার শিখিবার জন্য আমাদের বাসায় আসিত সেই মুহূর্তগুলোতে আমি যেন স্বর্গের এক কোণায় ডুবিয়া থাকিতাম। তখন এই ধরার কোন চিন্তাই আমার মগজে ডুকিতো না। আমি যেন আনন্দের সাগরে ভাসিতাম। হঠাৎ একদিন মাতাজি কহিলেন, ‘রুদ্র—তোর জন্মকুষ্ঠীটি নষ্ট হইয়া যাইতেছে। তুই তো কম্পিউটার ভালো চালাইতে পারিস। একটু দেখ না তুই কুষ্ঠিটা ঠিক করিতে পারিস কি না।’ এই বলিয়া মাতাজী আমার অর্ধগলিত জন্মকুষ্ঠীটি আনিয়া আমার হাতে তুলিয়া দিলেন। আমিও বেশ যত্ন সহকারে আমার কুষ্ঠীটি কম্পিউটারে ডিজাইন করিতে লাগিলাম।

আমার কুষ্ঠীটি কম্পিউটারে ডিজাইন করিতে মনে পড়িল— এই জন্মকুষ্ঠীর কাজই বা কি? আমি জানিতাম বিবাহের পূর্বে বর এবং কনের কুষ্ঠী দিয়া গণক মসাই কোন এক গণনা করিয়া দুই পক্ষকে জানায় যে, এই বিবাহ আসলে হওয়া উচিত কি-না। বর ও কনের দুই কুষ্ঠীর মধ্যে ভালো মিল হলেই তখনকার সময়ে বিবাহ হইত—এবং বর ও কনের পিতা-মাতা কখনো গণকের কুষ্ঠীর বিচারের বাহিরে সিদ্ধান্ত নিত না। একমাত্র কুষ্ঠীর মধ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মিল হলেই তখন বিবাহ নির্ধারিত হইত। এই ভাবিয়া হঠাৎ আমি ভয় পাইয়া গেলাম। যদি আমার এবং প্রচেতার কুষ্ঠীর মধ্যে মিল না হয়? তাহলে আমাদের পিতা-মাতা কখনো আমাদের বিবাহে রাজী হইবে না। ভবিষ্যতে আমারা দু’জন দু’জনকে যতই ভালোবাসি না কেন কুষ্ঠীর মধ্যে গ্রহ-নক্ষত্রের মিলন না হইলে আমাদের বিবাহ কখনো সম্ভব হইবে না। তাই ঠিক করিলাম আমাকে যেমন করিয়া হোক আমাদের দু’জনের কুষ্ঠীর বিচার একজন গণকের কাছে করাইতে হইবে। বুঝিতে পারিলাম এই জন্য বুদ্ধি খাটাইতে হইবে। আমাকে এমন কিছু করিতে হইবে যাতে প্রচেতার মাতা আমাকে প্রচেতার কুষ্ঠীটি আপনাআপনি আমার হাতে তুলিয়া দিবে। তখন আমার প্রচেতাকে কম্পিউটার শিখাইবার বুদ্ধিটির কথা মনে হইল। আমি ঠিক করিলাম আমার কুষ্ঠীটি ভালো করিয়া ছাপাইতে হইবে—এরপর সেটি দেখাইয়া পাড়ার অন্য ছেলে-মেয়েদের কুষ্ঠী বিনা পারিশ্রমিকে করিয়া দিতে হইবে। এতে একটু কষ্ট হইবে কিন্তু পাড়ার অন্যদের কুষ্ঠীর ডিজাইন দেখিলে প্রচেতার মাতা একদিন নিশ্চয়ই প্রচেতা এবং তাহার বড় ছেলে সজলের কুষ্ঠীটি আমাকে দিয়া করাইবে। প্রচেতার মাতা যখন প্রচেতার কুষ্ঠীর ডিজাইনটি আমাকে করাইতে দিবে তখন কুষ্ঠীটির ডিজিটাল ফাইলটি কম্পিউটারে সংরক্ষিত করিয়া রাখিব, যাতে ভবিষ্যতে দরকার হইলেই সেটা প্রিন্ট করিয়া গণক মসাইকে আমার কুষ্ঠীর সাথে প্রচেতার কুষ্ঠীর মিল আছে কি-না, তাহা জানিতে পারিব।

আমি কম্পিউটারে আমার কুষ্ঠীটির ভালো করিয়া ডিজাইন করিলাম—এবং প্রিন্টও করিলাম। আমার কুষ্ঠীটির প্রিন্ট কপি দেখিয়া আমার মাতাজি তো রীতিমত অবাক! সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের পাশের বাসার মাস্টারের বউকে দেখাইলেন। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী একে একে পাড়ার সবাই তাহাদিগের সন্তানের কুষ্ঠী কম্পিউটারে ডিজাইন করিবার জন্য আমার কাছে দিলেন। আমিও বেশ যত্ন করিয়া তাহাদিগের কুষ্ঠীগুলো কম্পিউটারে ডিজাইন করিয়া প্রিন্ট করিয়া তাহাদিগের হাতে দিলাম। অতঃপর কিছু দিনের মধ্যে প্রচেতার মাতা আমাকে প্রচেতা এবং সজলের কুষ্ঠীটি কম্পিউটারে প্রিন্ট করিবার জন্য অনুরোধ করিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি প্রচেতার কুষ্ঠী কম্পিউটারে সংরক্ষিত করিয়া রাখিলাম—এবং অতিরিক্ত একটি কপি আমার পকেটে রাখিলাম। উদ্দেশ্য একটাই—প্রথম যেদিন গণক মসাইকে আবার দেখিব, তৎক্ষণাৎ যেন আমার এবং প্রচেতার কুষ্ঠী গণকের হাতে তুলিয়া দিতে পারি। গণক মসাই আমাদের পাড়াতে বসবাস করে না—বহু দূরে কোন এক ছোট্টগ্রামে উনার বসবাস। মাঝে মধ্যে তিনি আমাদের পাড়াতে আসিত। তাই আমি সেদিন হইতে গণক মসাইয়ের অপেক্ষায় দিন কাটাইতেছিলাম। আমাদের দুই জনের ভবিষ্যৎ জানা যে খুব জরুরী—তা না হইলে আমাদের বিবাহ কোনদিন হইবে না।

এভাবে বেশকিছু দিন অতিবাহিত হইয়া যায়। একদিন গণক মসাইকে আমাদের পাড়াতে আবার দেখিতে পাই। বুকের মধ্যে হঠাৎ যেন একটি ঝড় নামিয়া আসিল। যদি আমার এবং প্রচেতার গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ভালো না হইয়া থাকে? তাহলে তো বিরাট সর্বনাশ হইয়া যাইবে। ‘দাদু আপনাকে আমার মাতাজি কেন ডাকিতেছে।’ গণক মসাইকে আমি কহিলাম। আমার ডাকে তিনিও সাড়া দিলেন। তিনি আমাদের বাসায় প্রবেশ করিলে আমি গোপনে আমার পকেট হইতে আমার এবং প্রচেতার কুষ্ঠী দুইটি এবং পঞ্চাশ টাকার একটি নোট উনার হাতে তুলিয়া দিলাম। ‘এই কুষ্ঠী দুইটি কার?’ গণক মসাই জিজ্ঞেস করিলেন। যেহেতু কুষ্ঠীর নাম এবং ডাক নাম ভিন্ন হয় তাই তিনি প্রথমে কহিতে পারিলেন না যে কুষ্ঠীগুলো কার। ‘আমার এক বন্ধুর—একটু দেখেন তো এই দুই কুষ্ঠীর মিল আছে কি-না?’ আমি কহিলাম। তখুনি গণক মসাই অনুমান করিতে পারিলেন যে কুষ্ঠীগুলোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক রহিয়াছে। কিন্তু যেহেতু কুষ্ঠীর সাথে তাহার হাতে পঞ্চাশ টাকার নোটটি ধরিয়া দিলাম, তাই উনি চুপ করিয়া গণনা করিতেছিলেন। এদিকে মাতাজি রান্নাঘরে রান্না করিতেছিল। তিনি এখনো জানিতে পারিলেন না আমাদের ঘরে গণক মসাই বসিয়া রহিয়াছে। এদিকে গণক মসাই বারবার আমাদের কুষ্ঠীর দিকে তাকাইয়া চিন্তা করিতে লাগিল। গণক মসাইকে দেখিয়া আমার বুকখানি কাঁপিতে লাগিল। অনেকক্ষণ আমার এবং প্রচেতার কুষ্ঠী গণনা করিবার পর গণক মসাই কহিলেন, ‘এই দুই জনের বিবাহ হইতে কোন সমস্যা নাই। বিবাহ হইবার সম্ভবনা বেশি। কিন্তু দুইজনের একজন কোন কারণে বহুদূরে চলিয়া যাইবে।’ গণক মসাইয়ের কথা শুনিয়া আমি বেশি খুশি হইলাম। ভাবিলাম—যাক আমাদের বিবাহে আর কোন বাধা রইল না। এরই মধ্যে মাতাজির কণ্ঠ শুনিতে লাগিলাম। তাড়াতাড়ি গণক মসাইয়ের হাত থেকে আমাদিগের কুষ্ঠীগুলো নিয়া আমার পকেটে পুরিয়া রাখিলাম।

দেখিলুম মাতাজি এবং গণক মসাই বাক্যালাপ করিতেছিল। এদিকে আমি আমার কক্ষে আসিলাম—এবং একটি বই হাতে তুলিয়া পড়িবার ভান ধরিলাম। কিছুক্ষণ পর মনে পড়িল গণক মসাইয়ের কথা, তিনি কহিলেন আমাদের দুইজনের একজন কোন কারণে বহুদূরে চলিয়া যাইবে—সেটা তিনি কি বুঝাইলেন? এই বিষয়ে বিস্তারিত জানিতে পারিলে একটু ভালো লাগিত। আমাদের সামনের কক্ষের দিকে একটুখানি তাকাইয়া দেখি গণক মসাই ইতিমধ্যে প্রস্থান করিয়াছেন। ভাবিলাম হয়ত তিনি বোঝাইতে চাহিয়াছিলেন যে, আমি তো কিছু দিনের মধ্যে আমেরিকাতে চলিয়া যাইব।

চলবে...

এসইউ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।