রুদ্র-প্রচেতা : পর্ব ০৯
আমি অব্যবহিতভাবে কহিলাম, ‘হু, পারিবো।’ বিশ্বাস করিতে পারিলাম যে, এইমাত্র কী ঘটিয়া গেল। কত পূর্ণিমার পশ্চাতে প্রচেতার সহিত আজ আমার প্রথম বাক্যালাপ হইল। কান্তা দিদি কিছুক্ষণ অনন্তর আমাকে বাজারের জন্য দুইটা একশত টাকার নোট ধরাইয়া দিল—এবং হরেক রকমের সবজি, মাছ ও দ্রব্যাদি আনিতে অনুরোধ করিল। তখন কান্তা দিদির কোন কথা বা শব্দই আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করিল না। উনি আর কি কহিয়াছিলেন কিন্তু সেইদিকে আমার বিন্দুমাত্র খেয়াল ছিল না। শুধু আমি মুচকি হাসিয়া কান্তা দিদিকে ‘ঠিক আছে—আনিতেছি’ কহিলাম। অতঃপর বাজারের সম্মুখে রওনা হইলাম। সেইদিন কেমন করিয়া বাজারে হাঁটিয়া গেলাম তাহা স্মরণ করিতে পারিলাম না। প্রথমে আমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনিলাম কারণ মাতাজি’র দেওয়া বাজারের তালিকাটি আমার সঙ্গেই ছিল। পরে যখন প্রচেতাদের বাজার করিবার জন্য প্রস্তুত হইলাম—তখন কান্তা দিদি আমাকে কি কিনিবার জন্য কহিলেন তাহা স্মরণ করিতে পারিলাম না। ভীষণ এক বিপদে পড়িলাম। অনেকক্ষণ ধরিয়া স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু সফল হইলাম না। অগত্যা আন্দাজ করিয়া বেশ কিছু মাছ এবং নানা ধরনের সবজি কিনিলাম। আমার পকেটে জমানো অতিরিক্ত পাঁচশত টাকা ছিল—সেখান হইতে কিছু অর্থ তাহাদিগের বাজার করিতে খরচ করিলাম। তারপরও বেশ চিন্তায় ছিলাম। যদি কান্তা দিদির বাজারগুলো পছন্দ না হয়? তাহলে তো প্রচেতার সাথে পুনরায় কথা বলিবার সুযোগটা আর হইবে না।
তখন দুই হাতে আমার বাজারের ব্যাগে ভর্তি ছিল। কেমন করিয়া এতদূর এই ব্যাগগুলো হাতে ঝুলাইয়া নিয়া যাইব সেটা বুঝিতে পারিতেছিলাম না। হঠাৎ ভাবিলাম রিকশাতে উঠিয়া যাইলে কেমন হয়? সাধারণত কাঁচা-বাজার হইতে পায়ে হাঁটিয়া বাসা পর্যন্ত যাইতে দশ মিনিটের মত সময় ব্যয় করিতে হয়। তাই সচরাচর পাড়ার কেউ তখন রিকশায় উঠিয়া বাজার করিতে যাইত না। বয়স্কদের মাঝে মাঝে দেখিতাম রিকশায় করিয়া বাজারে যাইতে—কিন্তু আমার এই স্বল্প দূরত্বটির জন্য রিকশাতে ওঠা কেমন বেমানান লাগিতেছিল। তারপরও বুঝিতে পারিলাম যে, আজ রিকশায় না উঠিয়া উপায় নাই। অতঃপর একটি রিকশাকে ইশারা দিয়া থামাইলাম। রিকশাচালকের বয়স আমার চেয়ে বেশ কম—বারো কিংবা তেরো বৎসর হইবে। তাহারে দেখিয়া শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হইয়া গেল। রিকশায় উঠিবার পর আমি তাহারে কহিলাম, ‘আপনি এই বয়সে পড়াশোনা না করিয়া রিকশা চালাচ্ছেন কেন, ভাই?’ তখন সে তাহাদিগের সংসারের নানা দুর্ভোগের কথা আমার কাছে বিস্তারিত বর্ণনা করিল। তাহার সাথে বাক্যালাপ করিতে মনটা খুব খারাপ হইয়া গেল। ‘আহা, আপনি এই বয়সে কতই না পরিশ্রম করিতেছেন।’ আমি কহিলাম। সে কহিল, ‘ভাই, আপনি আমাকে আপনি আপনি করিয়া কেন বলিতেছেন? আমি তো বয়সে আপনার অনেক ছোট।’ আমি কহিলাম, ‘ভাই, মানুষের সম্মান করা উচিত তাহাদিগের কর্ম বিবেচনা করিয়া—বয়স দেখিয়া না। একটা হাজার বছরের গাছের উপরও কিন্তু কুকুরে প্রস্রাব করিয়া থাকে কিন্তু গোলাপ গাছের উপর কুকুরটি তাহা করিতে পারে না।’ এইটা শুনিয়া সে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। ‘কথাটি বেশ বলিয়াছেন, ভাই।’ সে কহিল। এ সমাজে আমরা শ্রমের মূল্য দিতে জানি না—তবে বাহুবল কিংবা বয়সের সম্মান দিতে ঠিকই জানি। আর যদি কেউ মেয়েলোক হইয়া এ সংসারে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে তাহলে তাহার সম্মান তো দূরের কথা—তাহার নিজস্ব কোন পরিচয়ও থাকে না। একজন সাবালিকা মেয়ের পরিচয় এই সংসারে তাহার পিতার মাধ্যমে হইয়া থাকে। জন্মসনদে তাহার নামের ঠিক পরে তাহার পিতার নাম লিখা থাকে—কিন্তু যখন তাহার বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাহার পরিচয় তাহার স্বামীর নামে হইয়া থাকে। ভোটার পরিচয়পত্রে একটা বিবাহিত মেয়ের নামের পর তাহার পিতা এবং স্বামীর নাম লিখিত থাকে। কিন্তু একজন বিবাহিত পুরুষের ভোটার পরিচয়পত্রে তাহার স্ত্রীর নাম কখনো অন্তর্ভুক্ত থাকে না। ‘এটাই নিয়ম।’ সে কহিল।
তাহার সঙ্গে বাক্যালাপ শেষ না করিতেই প্রচেতাদের বাসার সামনে আসিয়া রিকশাটি থামিল। রিকশা থেকে নামিয়া প্রচেতাদের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াইলাম। তখন মনে ভীষণ ভয় কাজ করিতেছেল। কান্তা দিদি কত কিছুই না আমাকে আনিতে বলিয়াছে—আমি সব সঠিকভাবে আনিতে পারিলাম না। প্রচেতাদের দরজার উপর আস্তে করিয়া একটি ধাক্কা দিলাম। কান্তা দিদি দরজাটি খুলিল। আমি বাহিরে দাঁড়াইয়া প্রচেতাকে তাহাদিগের ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক তাকাইয়া খুঁজিতেছিলাম। কিন্তু প্রচেতাকে দেখিতে পারিলাম না। কান্তা দিদির হাতে তাহাদিগের বাজারের ব্যাগটি ধরিয়ে দিলাম আবার কিছু টাকাও ফেরত দিলাম। কান্তা দিদি বাজারের ব্যাগটির ভিতরে দেখিতে দেখিতে কহিল, ‘এত কিছু কি জন্য আনলি? তোকে তো এত কিছু আনিবার জন্য বলিনি।’ এই বলিয়া তিনি হাসিয়া দিলেন। আমি ভাবিলাম, ‘যাক বাবা, এই বারের মত রক্ষে হইল বুঝি।’ এরপর আমার বাসার সম্মুখে রওনা দিলাম। আমাদের বাসায় পৌঁছাইয়া মাতাজিকে বাজারের ব্যাগটি ধরিয়ে দিলাম। ‘কি রে তোকে আজ এত খুশি খুশি মনে হইতেছে? কারণটা কি?’ মাতাজি কহিলেন। আমি কিছু না বলিয়া আমার খাটের উপর বসিলাম। এরপর বালিশের উপর মাথা রাখিয়া প্রচেতার কণ্ঠ পুনরায় স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলাম।
‘তোমার কণ্ঠ শুনিলে ব্যাকুল হয় মন
কলিজায় মারে শূল অবশ এই দেহে
কত স্বপ্ন দেখে মন তোমাতে সর্বক্ষণ
শুনিলে তোমায় মনে সুখ হাওয়া বহে।
তোর কণ্ঠ শুনে মোর কণ্ঠরোধ ভাবিয়া
প্রেম মিলন-মেলাতে আমি বেলুন কিনি
দুষ্টু বালকের মত দেখি তারে ঘুরিয়া
বারবার খুঁজি তোরে নতুন করে চিনি।
শুনিলে তোমার কথা ঐ রূপ দেখে আঁখি
আর তোমার আঙ্গুল যখন চুল সরাতে
কণ্ঠ না শুনে তোমার শুধু তোমায় দেখি
স্বপ্নের বীজ বুনিয়া ব্যস্ত আমি দিনেরাতে।
এমন মধুর কণ্ঠ কোথায় পাবো আমি
কতই না চেয়েছি গো প্রাণের প্রেমভূমি
শুনিতে এই সংসারে ভালোবাসা যে তুমি।’
এমন মধুর কণ্ঠ যে আমি স্বপনেও শুনি নাই। যতবার তাহার কণ্ঠ আমার স্মরণে আসিল ততবার আমার মুখমণ্ডলে হাসি শোভা পাইতেছিল। দূর হইতে জ্যেষ্ঠ সহোদরা মিলি আমার সব কাণ্ড দেখিতেছিল। সে আমার কাছে আসিয়া সব কিছু জানিতে চাইল। আমিও কিছু লুকাইলাম না। মিলি দিদিকে সবকিছু খুলিয়া বলিলাম। মাতাজি দূর হইতে কহিলেন, ‘কি রে তোরা কাকে নিয়া কথা বলছিস।’ তখন দিদি আমাকে কহিল, ‘আমাদের প্রচেতাকে নিয়া একটি গোপন শব্দ বা কোড ব্যবহার করিতে হইবে। যাতে কেউ বুঝিতে না পারে আমরা প্রচেতাকে নিয়া কথা বলিতেছি।’ অনেকক্ষণ চিন্তা করিলাম কিন্তু প্রচেতাকে নিয়ে কোন গোপন শব্দ বা কোড পাইলাম না। কিছুক্ষণ পর মাথায় একটি বুদ্ধি আসিল। ‘হাসপাতাল শব্দটি হইলে কেমন হয় রে দিদি? প্রচেতার পুরো নাম প্রচেতা গাঙ্গুলী মানে পিজি। ঢাকাতে পিজি হাসপাতাল নামে স্বনামধন্য একটি হাসপাতাল আছে। হাসপাতাল শব্দটি ব্যবহার করিলে কেহ বুঝিতে পারিবে না যে আমরা প্রচেতার সম্পর্কে কথা বলিতেছি।’ মিলি দিদি সাথে সাথে সম্মতি দিল। সেই দিন হইতে প্রচেতার আরেক নাম হইল ‘হাসপাতাল’। যেটা শুধু আমি আর দিদি জানিতাম। কয়েক মাসের মধ্যে আমার বয়সী পাড়ার অনেকে ছেলে ও মেয়ে প্রচেতাকে ‘হাসপাতাল’ নামে চিনিত। তাহারা সুযোগ পাইলে মজা করিয়া আমায় বলিত, ‘রুদ্র, তুই হাসপাতালে যাইবি? তোর যে রোগ হইয়াছে সেটা হাসপাতালে না যাইলে মুক্তি পাওয়া যাইবে না।’
কিছুদিন পর পিতাজী সুদূর আমেরিকা হইতে আবার ফোন করিলেন। তিনি আমাদের জানাইলেন যে আমাদের আমেরিকাতে যাইবার জন্য ভিসার কার্যক্রম প্রায় শেষ মুহূর্তে—কয়েক মাসের মধ্যেই আমাদের আমেরিকায় অভিবাসন নিতে হইবে। শুনিয়া যেন আমার মাথায় বাজ পড়িল। আবার চিন্তা করিলাম, তিনি এই কথাটি গত চার বছর ধরিয়া বলিতেছেন। আমি জানতাম যে আমাদের আমেরিকাতে কোন-দিন হয়তো যাওয়া হইবে না। কারণ আমেরিকানরা কেনই বা আমাদেরকে তাহাদিগের মত উন্নত একটি দেশে যাইবার অনুমতি দিবে। জ্যেষ্ঠ সহোদরা মিলি দিদিকে বললাম, ‘সত্যিই যদি আমরা আমেরিকাতে চলিয়া যাই—তাহলে আমার কি হইবে?’ দিদি খানিকক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, ‘তুই এক কাজ কর। প্রচেতাকে একখানা চিঠি লিখিয়া দে। আমি সেই চিঠিটি দিবার ব্যবস্থা করিব।’ দিদির কথা শুনিয়া তো আমি অবাক। আমি দিদির পাণে চাহিয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখিলাম দিদি একটা কাগজের টুকরা আনিয়া আমার হাতে দিলো। ‘লিখা শেষ করিয়া আমাকে দিশ।’ এই বলিয়া দিদি কক্ষ প্রস্থান করিল। আমি কক্ষে নিশ্চুপভাবে বসিয়া রহিলাম—আর ভাবিলাম এই ছোট্ট কাগজটিতে কিভাবে কহিব তারে আমি যে তাহারে কত ভালোবাসি। পরক্ষণে ভাবিলাম—আমাকে এই পত্রটি যে লিখিতে হইবে। কারণ এই পত্রের মাধ্যমে অন্তত প্রচেতা জানিতে পারিবে যে আমি তাহারে ভালোবাসি। অতঃপর আমি জীবনের প্রথম প্রেমপত্রটি লেখা আরম্ভ করিলাম।
‘প্রিয় অনুপ্তা,
জানি তুমি ভালো আছ। স্বর্গের দেবীদের সব সময়ই ভালো থাকিতে হয়। তুমি আমার কাছে স্বর্গের দেবীদের চেয়েও অনেক বেশিকিছু। তাই মাঝে মাঝে শঙ্কা হয়—আদৌ তোমাকে কোন-দিন আমার এই জীবনে পাইব কি-না। জানো—তোমাকে এই জীবনে আমার করিয়া পাই বা না পাই তাতে আমার কোন দুঃখ নাই। তবে কথা দিলাম—তোমাকে আমি সারাজীবন ভালোবাসিয়া যাইব। একজন ভক্ত যখন পূজা করিবার পূর্বে শঙ্খ বাজিয়ে দেবতাদের তাহার ভক্তির নিবেদন জানাইয়া দেয়—তেমনি আজ আমি এই পত্রখানি তোমাকে দিয়ে তোমার প্রতি আমার ছোট্ট ভালোবাসাটিও নিবেদন করিলাম। আজ হইতে তুমি জানিবে যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি—এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া। এর চেয়ে বেশি কিছু যে আমার চাহিবার নাই।
তোমাকে ‘অনুপ্তা’ বলিয়া এই পত্রে সম্বোধন করিলাম এই জন্য যে, তুমি একমাত্র আমার সেই—যে আমার শরীরে সকল অনুগুলোকে উত্তপ্ত করিয়া আমাতে নতুন জীবন স্থাপন করিয়াছে। তাহার জন্য তোমার কাছে সত্যি চির-ঋণী থাকিব। তোমার জন্যই আমি গত কয়েকটি বছর বেশ ভালোভাবে বাঁচিয়া আছি—এবং এইভাবে আমি সারাটি জীবন বাঁচিয়া থাকিতে চাই। এই পত্রটি লিখিবার পূর্বে আমি ভাবিলাম, কিভাবে তোমায় আমি বলিব যে কতখানি তোমায় ভালোবাসি। পরে ঠিক করিলুম যে—না, আমি তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি তাহা এই পত্রে বর্ণিত করিব না। কারণ তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা লিখিয়া প্রকাশ করিতে যাইলে পৃথিবীর সকল কাগজ-কলম শেষ হইয়া যাইবে। কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার সঠিক প্রকাশ হইবে না।
পরিশেষে কহিতে চাই—আমরা হয়তো খুব শীঘ্রই আমেরিকাতে অভিবাসন নিতে পাড়ি দিব। যদি কোন-দিন সেটা সত্য হয়—তারপরও জানিবে তুমি সর্বদা আমার প্রাণে রহিবে। যতদিন থাকে এই প্রাণের স্পন্দন, ততদিন তোমাকে আমি ভালোবাসিয়া যাইব।
ইতি,
তোমারই রুদ্র’
চিঠি লিখিয়া শেষ করিলাম। তারপর প্রচেতাকে দিবার জন্য বড় দিদি মিলির হাতে চিঠিটি তুলিয়া দিলাম। মিলি দিদি আমাদের বাম পাশের এক প্রতিবেশীর দুই মেয়ে অমি এবং লিমাকে চিঠিটি দিলো। অমি এবং লিমা দুই বোন। তাহারা যেদিন জানিয়াছে আমি প্রচেতা ভালোবাসি সেদিন হইতে তাহারা ইচ্ছেমত পাড়ার সব মহিলার দুই কানে আমার এবং প্রচেতার নামে বিনা-বেতনে বহু বিজ্ঞাপন চালাইয়াছে। অবশ্য সেই জন্য আমার মন কখনো খারাপ হয়নি। একদিক হইতে ভালো হইয়াছে—এতে পাড়ার অন্য মেয়েরা অন্তত আমার দিকে অন্যদৃষ্টিতে তাকাইবে না। আমাদের প্রেমের প্রতি অমি এবং লিমার অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়া তাহাদিগের প্রতি শ্রদ্ধা একটু বাড়িয়া গেল। তাহারা দুই সহোদরা আমা হইতে বয়সে অনেক বড়—তাই আমাকে প্রেম বিষয়ে নানা পরামর্শ না চাহিবা মাত্রই দিত। তাহাদিগের নিকট প্রেম বিষয়ে বহু তথ্য জানিতে পারিলাম। যা-ই হোক—তাহারা কোন এক উপায়ে প্রচেতাকে আমার চিঠিটি দিতে সক্ষম হইল। পরেরদিন দেখিলুম এই দুই বোন তাহাদিগের ঘরের সামনে সিঁড়ির উপর বসিয়া খোশগল্প করিতেছে। আমি তাহাদিগের নিকট যাইলাম। ‘দিদি, প্রচেতাকে চিঠিটি দিতে পারিলেন তো?’ আমি জিজ্ঞেস করিলাম। ‘হ্যাঁ, গতকাল বিকেলেই দিয়েছিলাম।’ অমি কহিল। আমি তাহাদিগের পাণে চাহিয়া রহিলাম—বিস্তারিত কিছু শুনিবার জন্য। কিন্তু তাহারা আর কিছুই বলিল না। বেশ চিন্তায় পড়িয়া গেলাম। না জানি—কি হইতে কি হইয়া গেল!
‘দিদি, প্রচেতা আর কিছু কহিয়াছে?’ চিন্তার সুরে আমি জিজ্ঞেস করিলাম। ‘না, চিঠিটি দিয়েই চলিয়া আসিলাম। প্রচেতার মাতা বাসার ভিতরে ঘোরাঘুরি করিতেছিল। তাই অযথা ঝুঁকি নিতে চাইনি।’ লিমা কহিল। তাহাদিগের কাছে প্রচেতার অঙ্গ-ভঙ্গি বা প্রচেতার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলুম কিন্তু তাহারা সেদিন আর কোন বিস্তারিত কহিতে পারিলেন না। সেদিন রাতে আমার বিন্দুমাত্র নিদ্রা হয়নি। সারা নিশি শুধু ভেবেছিলুম—প্রচেতাকে নিয়ে। চিঠিটি হাতে পাইয়া সে কি পুরোটা পড়িল? নাকি ফেলে দিলো? চিঠিটি পড়িবার পর সে কি আমায় খারাপ ছেলে ভাবিতেছে? নাকি আমায় নিয়ে সে এখন ভাবিতেছে?
পরের দিন বিকেলে দুই বোন অমি ও লিমাকে আবার তাহাদিগের বাসার সামনে দেখিতে পাইলাম। তাহাদিগের দুই বোনের মধ্যে বেশ সখিতা ছিল। কোথাও যাইলে তাহারা দুইজন একসাথে যাইত। তাহাদিগকে দেখিতে পারিয়া আবার জিজ্ঞেস করিলাম, ‘দিদি আপনার সাথে প্রচেতার দেখা হইয়াছে? সে কিছু কহিয়াছে?’ তখন লিমা কহিল, ‘ হুম, তেমন কিছু প্রচেতা বলিল না। তবে সে কহিয়াছে, তুমি তো আমেরিকায় চলিয়া যাইবে?’ আমি কহিলাম, ‘আমেরিকায় যাইলে কি হইবে? আমি তো প্রচেতাকে অনেক ভালোবাসি। তাকে কি কখনো ভুলিতে পারিব?’ আমি কহিলাম। তাহারা বলল, ‘ঠিক আছে, পরবর্তীতে প্রচেতার সাথে দেখা হইলে তাহাকে সবকিছু বুঝিয়া বলিব।’ এরপর মাঝেমধ্যে অমি ও লিমা সুযোগ পাইলেই প্রচেতার সাথে কথা বলিবার চেষ্টা করিত। প্রচেতাকে নানা উপায়ে আমার কথা বলিবার চেষ্টা করিত—এবং পরক্ষণে তাহারা আমাকে প্রচেতা কি করিতেছে বা কি বলিয়াছে সবই বলিত। কিন্তু কেন জানি প্রচেতা কখনো আমাকে সে ভালোবাসে বা পছন্দ করিত তাহা কখনো বলেনি।
একদিন লিমার সাথে প্রচেতার মাতা গল্প করিতেছিল। প্রচেতার মাতা কান্তা লিমাকে কহিতেছিল, ‘আমাদের প্রচেতার কম্পিউটার শিখার খুব দরকার। না শিখিলে সে এই বিষয়ে একদম অজ্ঞ থাকিবে। কিন্তু কোথায় শিখানো যায় সেটা নিয়ে ভাবিতেছি।’ আমাদের ঘরে একটি কম্পিউটার ছিল। ঐ সময়ে পুরো পাড়াতে আমাদের ঘরে একমাত্র কম্পিউটার ছিল। পূর্বে আমি কম্পিউটার বিষয়ে নানা রকমের কোর্স করিয়াছি—তাই কম্পিউটার সম্পর্কে আমার বেশ ভালো ধারণা ছিল। লিমার কাছ থেকে এই কথা শুনিয়া আমার মাথায় একটি বুদ্ধি আসিল। আমি ভাবিলাম— প্রচেতাকে আমিই কম্পিউটার শিখাইব। কিন্তু কিভাবে তাহাকে কম্পিউটার শেখানো যায় তাহা নিয়া বহু চিন্তা করিয়াছি। সেদিন ঠিক করিলাম আমাদের পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে কম্পিউটার চালাইতে শিখাইব। তাই পুরো পাড়াতে প্রচেতাদের পরিবার বাদে অন্য প্রায় সব পিতা-মাতাকে আগ্রহ দেখাইয়া কহিলাম, ‘আমার এখন একটু ফ্রি সময় আছে। আপনারা চাইলে আপনাদের সন্তানকে বিনা খরচে আমার কাছে কম্পিউটার শিখাইতে পাঠাইতে পারেন।’ বিনা খরচে কম্পিউটার শিখাইব, তা শুনিয়া প্রায় সব পিতা-মাতাই তাহাদিগের সন্তানকে আমার কাছে কম্পিউটার শিখিতে পাঠাইল। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধু একটাই—প্রচেতার পিতা-মাতা একদিন আমাকে প্রচেতাকে কম্পিউটার শিখাইতে বলিবে। এইভাবে বেশ কয়েক সপ্তাহ চলিয়া গেল। আমি পাড়ার প্রায় আট-দশ জন ছেলে-মেয়েকে কম্পিউটার শিখাইতেছিলাম। মাঝেমধ্যে প্রচেতাদের সকালের বাজারটি আমি করিতাম। প্রচেতার পিতা ডাক্তারি করিতে সকালবেলা যাইত আর আসিত সন্ধ্যায়—তাই অনেক সময় তাহাদিগের বাজার করিবার মত কোন লোক ছিল না। তাই আমি মাঝেমধ্যে তাহাদিগের বাজার করিয়া দিতাম—এতে তাহাদিগের পরিবারের প্রায় সবার সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। মাঝেমধ্যে তাহারা আমার সাথে গল্পও করিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়—এখন পর্যন্ত প্রচেতার মাতা কান্তা দিদি প্রচেতাকে কম্পিউটার শিখাইতে আমাকে বলেননি। তবে কি তিনি জানেন না যে, আমি পাড়ার অন্য ছেলে-মেয়েকে বিনামূল্যে কম্পিউটার চালানো শিখাইতেছি?
চলবে...
এসইউ/এমএস