ইতিহাসের হাত ধরে এগিয়েছে এক আনা মন
সাদত আল মাহমুদ এ সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখক। ইতোমধ্যেই তার বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটদের জন্য লেখা বই প্রকাশিত হয়েছে। এবারের অমর একুশে বইমেলায় তার প্রকাশিত উপন্যাস ‘এক আনা মন’ ইতোমধ্যেই পাঠকমহলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ২৪০ পৃষ্ঠার বৃহৎ পরিসরের উপন্যাসে প্রেমের অন্তরালে উঠে এসেছে ফেলে আসা ইতিহাস।
উপন্যাসের শুরুতেই সরাইল পরগনার কথা বলা হয়েছে। লেখকের ভাষ্যমতে, ১৯৩০ সালে ত্রিপুরার সঙ্গে সরাইল পরগনা যুক্ত হয়। যা ইতিহাস, তা-ই অতীত। আবার সব অতীত ইতিহাস নয়। আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা আগামীকাল অতীত। উপন্যাসে পটভূমি হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সরাইল পরগনার সম্ভ্রান্ত সৈয়দ আকবরের সন্তান যোবায়েরের সঙ্গে নর্তকীর মেয়ে নারগিসের প্রণয় ঘটে। যোবায়েরের সঙ্গে প্রণয় ঘটার কারণে নারগিসকে সৈয়দবাড়ির সহানুভূতি ও আশ্রয়স্থল হারাতে হয়, নারগিসের মা মমতাজও বিতাড়িত হন সৈয়দ বাড়ি থেকে।
ইতিহাসের হাত ধরে উপন্যাসে উঠে এসেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নোবেল অর্জন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবহেলিত লেখা ‘দেবদাস’ কীভাবে বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থে পরিণত হয়। অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, বঙ্কিম চন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, জসীম উদদীনের ‘কবর’ কবিতা নিয়েও মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো কথা উপন্যাসে ছড়ানো রয়েছে।
কাহিনির পরবর্তী ধাপে নর্তকীর মেয়ের সঙ্গে অসম সম্পর্ক গড়ে ওঠার আশঙ্কায় সৈয়দ আকবর যোবায়েরকে কলকাতায় পড়তে পাঠিয়ে দেয়। যোবায়ের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সরাইলে ফিরে আসে। নারগিসের সঙ্গে পুনরায় তার ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়। ভয়ঙ্করভাবে সৈয়দ আকবর তার স্বরূপ উন্মোচন করে। মমতাজ-নারগিস দু’জনকেই গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। মা-মেয়ে দুজন ঢাকা শহরে আশ্রয় নেয়। যোবায়ের কলেজে শিক্ষকতা শুরু করে। একপর্যায়ে ঢাকার মেয়ে ইয়াসমিনকে বিয়ে করে। কয়েক বছর না যেতেই ওদের দু’জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। যোবায়েরের মতো নারগিসও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়।
পুরো ভারতবর্ষের সর্বত্র ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ইংরেজরা প্রতিনিয়ত দিশাহারা হতে থাকে আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল পৃথিবীজুড়ে কড়া নাড়ছে। মার্কিন-ব্রিটিশ মিত্রবাহিনী গড়ে তুলেছে। ইংরেজ কর্তাবাবুদের কৌশলী প্রলোভনে ভারতীয় নওজোয়ানরা মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে নামে। পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা, পাঞ্জাব, বাংলাদেশসহ ভারতের অনেক জায়গাতেই জাপানিরা বোমা মেরে জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। জার্মানি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউসও আক্রমণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান নামে দুটি পারমাণবিক বোমা মারে। পারমাণবিক বোমার আঘাতে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে দেয়।
উপন্যাসের শেষের দিকে এসে আমরা লক্ষ্য করি, ব্রিটিশ শাসনামলের সমাপ্তির পথে এসে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ভারতের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের উদ্যোগে ভারত-পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
উপন্যাসের একেবারে শেষ অংশে আমরা আবার ফিরে আসি সরাইলে। কারণ যোবায়ের নারগিস দীর্ঘদিন একাকী জীবনযাপন করে দু’জনই নিজেদের জন্মস্থান সরাইলে ফিরে আসে। দীর্ঘদিন পর দুজনের মিলনের পথে নারগিস বলেই ফেলে, ‘তুমি তো আমাকে কখনো এক আনা মনও দাওনি। আমি তোমাকে ‘ষোলো আনা মন’ দিয়েই ভালোবেসেছি।’ যোবায়ের নার্গিসের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলে, ‘আমিও তোমায় ভালোবেসেছি; তবে সেটা এক আনা কী ষোলো আনা ছিল সে তর্কে যেতে চাইছি না, যা এক আনা তাই ষোলো আনা।’
আলোচক: মশিউর রহমান, শিশুসাহিত্যিক।
এসইউ/পিআর