দোআঁশ মাটির কোকিল : আত্মজৈবনিক বয়ান
আকাশ মামুন
কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘দোআঁশ মাটির কোকিল’ হলেও বয়ানে এঁটেল মাটির মতই শক্ত গাঁথুনি। কুমার যেমন পরম যত্নে-আদরে মাটিকে গড়ে তোলে দৃষ্টিনন্দন শিল্প—পলিয়ার ওয়াহিদও তেমনি শব্দের পর শব্দের গাঁথুনি দিয়ে দোআঁশ মাটির কোকিলকে গড়ে তুলেছের শিল্পিত সৌকর্যে। বসন্তে সবুজ পাতার ফাঁকে কণ্ঠ দুলিয়ে যেমন ডেকে ওঠে সুকণ্ঠি কোকিল—পলিয়ারের কবিতা পড়তে পড়তে তেমনই আমরা মিষ্টি স্বর শুনতে পাই।
শৈশব আর কৈশোরে কাদা-মটির গন্ধ লেগে থাকা পলিয়ার ওয়াহিদ আত্মপরিচয়ে বলিয়ান হয়ে বলে ওঠেন, ‘দোআঁশ মাটির ছেলে আমি’। নিরহংকার সে বয়ানে একজন সহজ-সরল কবির স্বীকারোক্তি ফুটে ওঠে। ফুটে ওঠে আত্মপরিচয়ের স্মারক। সেই পরিচয়ে বলিয়ান হয়েই কবি জিজ্ঞেস করেন—
‘এত প্রেম কেন ধানে?’
কিংবা বলেন,
‘মা আমি তোমার কাছে থাকবো—আর মাটির ঘরে শোবো।
আমার আর আমার কোন চাওয়া নেই।
আমি কৃষকের ছেলে মা—মাটি জল কাদা ছাড়া কী ভাবে বাঁচি?’
ইসলামি মেটাফোরের ব্যবহার দেখে মনে হয় পলিয়ার ওয়াহিদ মৌলানা কবি। তবে গোড়ামি আর সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তার নুরানি চেহারা ভেসে ওঠে-যখন পড়ি ‘কিলাসমেট’ কবিতা। সাম্প্রদায়িকতা আর গোষ্ঠিকেন্দ্রিক বৃত্তের বাইরে এসে কবি যোগ দেন বিশ্ব মানবতার সুদীর্ঘ কাতারে। তাই তো সনাতন ধর্মের সহপাঠিকে কেউ মুচি বলে কটূক্তি করলে তার মন খারাপ হতে দেখি।
বড় হয়ে মানুষের ভেতরের কুৎসিত মনের পরিচয় পেয়ে তিনি ব্যথিত হন। তখন তিনি বলে ফেলেন—‘বড় হতে হতে আমাদের শুয়োর আর ছাগল ঢুকে পড়ে/তখন কোথাও মানুষ খুঁজে পাইনে’। এ যেন পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক লাইনে বলে ফেলা। কিংবা তার প্রেমিকার দীর্ঘ তালিকায় যোগ হয় রত্নাদি—যাকে তিনি ভালোবেসে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। অন্যদিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতে চান দূরদেশের বন্ধু হিয়া বিশ্বাসের প্রতি। এত সব তার সাম্যবাদী মানসিকতার পরিচয় বহন করে। যেমন আল মাহমুদ বলতে পেরেছিলেন, ‘মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়শা আক্তার’—এর মতো মহাকাব্যিক লাইন। মক্তবের জীবন আয়শা আক্তারের জীবনকে বন্দি করেনি বরং সেখান থেকেও আয়শা আক্তারের স্বাধীন সত্তা ও স্বকীয়তার সন্ধান করেছিলেন কবি।
নামে ‘দোআঁশ মাটির কোকিল’ হলেও এঁটেল মাটির মত শক্ত কবিতারও স্থান দিয়েছেন বইটিতে। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি আর নষ্ট সময়কে আঘাত করেছেন চাঁচাছোলা ভাষায়। তাই তো ‘দূর্বাঘাস’ কবিতায় তাকে বলতে শুনি—‘আমি জানবো—তুমি ঘাতকের সময়ে জন্ম নেয়া দূর্বাঘাস’। অনুমান করছি কিশোর আন্দোলনে কবির সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে দুর্বৃত্তদের হুমকি ও হয়রানি তাকে ভীষণ আহত করে—যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ কবিতায়। আহত কবি বলে ওঠেন—‘সিজনালি তরমুজ কাটার মত ফালি করে রাখা রক্ত’। দেশ প্রেমিক কবি দেশকে নিয়েও ভাবেন। তাই তো দীর্ঘ চার দশকেও উন্নয়নের শ্লথ গতি কিংবা ক্ষণে ক্ষণে থমকে যাওয়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়ে কবির কপালে। তাই তো আক্ষেপে বলে ওঠেন—‘দেশপ্রেম সে তো দাদীর পানের বাটা থেকে চুরি যাওয়া মুনিয়ার টুকটুকে ঠোঁট’।
কিংবা স্বীকারোক্তি দেন—
‘এখন আমার প্রেমিকা বাংলাদেশ/খোদার কসম—এর পরে আর কেউ নেই’।
‘ফসল প্রেমিক আব্বা’ কবিতায় অন্তমিল ঠিক রাখতে গিয়ে কবিতার বিষয় বস্তুতে কিছুটা তারল্য পরিদৃষ্ট হয়। অন্তমিলের দিকে ঝোঁক না থাকলে হয়তো কবিতাটি আরও বেশি গাম্ভীর্যপূর্ণ ও ভাববহ হতে পারতো। কবির মহাকাব্যিক দীর্ঘ কবিতাগুলো পড়লে দৃশ্যগুলো চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। তবে কিছু জায়গায় খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। পাঠকের মনে হতে পারে, উদ্দেশ্যমূলক অকারণ দীর্ঘ করা হয়েছে।
সর্বোপরি ‘দোআঁশ মাটির কোকিল’ পাঠে যথেষ্ট তৃপ্ত হতে হয়। যা প্রেমের মতো কোমল ও পবিত্র বোধকে যেমন জাগ্রত করে; তেমনই একই সাথে সময়কে কঠিন হাতে চাবকে নিয়ে যায় অভিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন
প্রচ্ছদ: আল নোমান
দাম: ১৭৫ টাকা
এসইউ/জেআইএম