মুজিববর্ষের বই ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০২:৫৯ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

ড. শামসুল আলম রচিত ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’ (২০২০) বইটি মুজিববর্ষের প্রথম প্রকাশনা; যা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কৃষকের সম্পর্কের বয়ান।এই বইটিতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা ও বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু কৃষির জন্য কি কি করেছেন তার একটা সুন্দর বর্ণনা তুলে ধরেছেন লেখক। কৃষি পরিবারে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও কৃষকদের জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখিয়ে একটি স্বাধীন দেশ এনেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি ছিল কৃষি ও কৃষক। কৃষি ও কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলে সোনার বাংলাদেশ সফল করার জন্য বঙ্গবন্ধু যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেই সব কর্মকাণ্ড তুলে ধরেছেন শামসুল আলম। এসব বিষয় লেখক বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। এতে বিষয়গুলো আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যেসব প্রবন্ধের মাধ্যমে এগুলো তুলে ধরেছেন তাহলো ’আজকের কৃষির যে ভিত্তি’, ‘মহাপুরুষের আবির্ভাব’, ‘সংবিধানে কৃষকের কথা’, ’স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর পদার্পণ’, ’বঙ্গবন্ধু, বিশ্বব্যাংক ও শিল্পায়ন’ ইত্যাদি।

লেখক ড. শামসুল আলম নিজে কৃষি অর্থনীতিতে এমএসসি হওয়াতে কৃষক নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। তিনি সেই কাজের সূত্রে বঙ্গবন্ধুর কৃষিভাবনা নিয়ে অভিভূত হন এবং সেসব ভাবনা আধুনিক মানুষের মাঝে তুলে ধরতে উপহার হিসেবে আমাদেরকে দিলেন মুজিববর্ষে এ বই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি ও কৃষকবান্ধব মানুষ। সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর উন্নত বাংলাদেশ এবং সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য কৃষির উন্নতির কোন বিকল্প ছিল না। সেই লক্ষ্যে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। তিনি জানতেন মানুষের প্রথম চাহিদা খাদ্য আর খাদ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তিনি কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কৃষি উন্নয়ন বলতে বোঝায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন।কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নের জন্য গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই দেশকে কৃষি অর্থনীতিতে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন কৃষি ও কৃষকের উন্নতি বিধান নিশ্চিত করা না গেলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।তিনি স্বপ্ন দেখতেন কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে। এ জন্য তিনি উচ্চতর শিক্ষা গবেষণা প্রশিক্ষণ এবং শহরের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলেন। জাতীয় বৈদেশিক নীতির জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও তার পরিপ্রেক্ষিতগুলো ছিল-

১. বঙ্গবন্ধু কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন । এ কারণে কৃষি কাজে জড়িত উপকৃত হয়েছেন। খাজনা দেওয়ার অক্ষমতা ও জটিলতা হতে মুক্ত হয়ে কৃষকরা আনন্দে কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু আমলে খাজনা আদায় থেকে সহজেই মুক্ত হয়েছিলেন।

২. অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম উপায় সম্পদের সুষম বণ্টন । বঙ্গবন্ধু সম্পদের সুষম বণ্টনে উৎসাহিত করেছিলেন।বঙ্গবন্ধু এক ব্যক্তির নামে ১০০ বিঘের উপরে জমি থাকাতে নিরুৎসাহিত করেছেন। অতিরিক্ত জমি ভূমিহীনদের মাঝে বণ্টন করে ভূমিহীনদের চাষাবাদ করার সুযোগ তৈরি করে দেন। এভাবে কৃষি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছেন। পুঁজিবাদী সাম্যব্যবস্থা নিরুৎসাহিত করেছেন।

৩. গ্রাম্যসমাজ ভিত্তিক গরিব কৃষকদের সহযোগিতার জন্য সদ্য মুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন।

৪. স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রায় ২২ লাখের বেশি পরিবারকে পুনর্বাসন করেছিলেন।

৫. কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে তিনি প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেন। বাজেটে ভর্তুকি দিয়ে বিনামূল্যে কীটনাশক ও সার সরবরাহ করেন। ফলে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে কৃষি উৎপাদন অতীতের যেকোনো সময় থেকে অনেক বেশি উৎপাদিত হয়েছিল। ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মী নিয়োগ করেছিলেন ।

৬. কৃষিপণ্য বিশেষ করে ধান, পাট, তামাক আখের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ন্যূনতম ন্যায্য মূল্য বেধে দিয়েছিলেন। গরিব কৃষকদের রেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির আওতায় খাদ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।‘বঙ্গবন্ধু, বিশ্বব্যাংক ও শিল্পায়ন’ প্রবন্ধে দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু বলেছেন শ্মশান হওয়া বাংলাকে তিনি সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে চান ।

বঙ্গবন্ধু প্রথম বাজেটে কৃষিখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ২১ দফার প্রতিটা দফাই ছিল কোনো না কোনোভাবে কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলকামি। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।বন্যা ও খরার হাত থেকে কৃষককে রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।সরকারি ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করেন।

ড. শামসুল আলম লিখেছেন, বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘বাংলার মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি তাইতো বারবার বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষণকে টেনে এনেছে।’ এই বাংলার মাটি বাংলাদেশের মাটি, যদি সোনার চেয়ে খাটি না হতো তাহলে এতদিন আমাদের পরাধীন থাকতে হতো না। তিনি আরো বলেন বাংলার মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই মাটিতে সোনালি ফসল ফলিয়ে সোনার বাংলা তৈরি করা সম্ভব। কৃষি বিপ্লবের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন ‘আমাদের গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে, কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। অধিক শস্য উৎপাদন করার জন্য মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।

সমবায় ভিত্তিতে কাজ করে দেখাতে হবে।শহরমুখী রাজনীতির কথা ভুলে যেতে বলেছিলেন।তিনি বলেছিলেন, আমরা এখন গ্রামের দিকে যাচ্ছি। তখন আপনাদের দাম অনেক বেড়ে যাবে। শহরের ভদ্রলোকেরা দেখি আপনাদের চিন্তার কোন কারণ নাই। কারণ গ্রামীণ অর্থনীতির দিকে যেতে হবে, কৃষককে বাঁচাতে হবে, উৎপাদন করতে হবে, তা না হলে বাংলাকে বাঁচাতে পারবো না। বাংলাদেশের সংবিধানে কৃষি খাতের জন্য নীতিমালা প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছিলেন কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য সে কাজটি শেষ করে যেতে পারেননি । স্বাধীনতার পরে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো দিক-নির্দেশনা ছিল না।তাই স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় কৃষিখাতের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের উন্নতি কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নত করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ভূমিকা রেখেছে। তাঁর নেতৃত্ব মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে।তাই মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও গ্রামীণ উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপ আমাদের কাছে অনুসরণীয়। বঙ্গবন্ধুর কৃষিবিপ্লব ও সবুজবিপ্লব কর্মসূচিকে বাস্তবায়নের ফলে আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।বর্তমানে চাল উৎপাদন করে খাদ্য চাহিদা পূরণ করছি আমরা।মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন ৩য় হয়েছে। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন ৩য়। ড. শামসুল আলমের মতে, আমাদের আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে।

মূলত ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের ৯টি প্রবন্ধে ড. শামসুল আলম বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি অনাবিষ্কৃত দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। গ্রন্থটি অনর্থক অর্থনৈতিক তত্ত্বের চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। কিংবা বলা যায় কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির ইংরেজি নামে পরিকীর্ণ করে তোলেননি বঙ্গবন্ধুর কুষিভাবনাকে উপস্থাপন করার সময়।কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম সহজ-সরল ভাষায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলার কৃষি নিয়ে যা লিখেছেন তা সাধারণ পাঠককেও মোহিত করবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।

কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু, ড. শামসুল আলম, পার্ল পাবলিকেশন্স, ২০২০, প্রচ্ছদ : বিডি ৭১, মূল্য : ২০০ টাকা।

এইচআর/এমকেএইচ

মূলত ‘কৃষি ও কৃষকের বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের ৯টি প্রবন্ধে ড. শামসুল আলম বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি অনাবিষ্কৃত দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। গ্রন্থটি অনর্থক অর্থনৈতিক তত্ত্বের চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। কিংবা বলা যায় কৃষির আধুনিক প্রযুক্তির ইংরেজি নামে পরিকীর্ণ করে তোলেননি বঙ্গবন্ধুর কুষিভাবনাকে উপস্থাপন করার সময়।কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শামসুল আলম সহজ-সরল ভাষায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলার কৃষি নিয়ে যা লিখেছেন তা সাধারণ পাঠককেও মোহিত করবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।