মোহিত কামালের লুইপার কালসাপ : বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য সৃষ্টি

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৩:২৭ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২০

লুইপা’র কালসাপ (২০১৯) কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল রচিত একটি অসাধারণ উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি। উপন্যাসের প্রথাগত আঙ্গিক ছেড়ে নতুন এক ঢং-এ রচিত এ উপন্যাস। বিষয় হিসেবে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদকে এনেছেন তিনি। এমন প্রাচীন বিষয় নিয়ে খুব বেশি লেখক উপন্যাস রচনা করেননি। ঔপন্যাসিক মোহিত কামাল যে সাহস দেখিয়েছেন তা অতুলনীয়।

মোহিত কামাল ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় মনোচিকিৎসক হলেও লেখালেখি তাঁর নেশা। এরই মধ্যে তিনি উপন্যাস ও গল্প মিলে ৫১টির বেশি বইয়ের রচিয়তা। সাহিত্যের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান।যে কোনো দেশের সাহিত্যে যুগে যুগে কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে যাদের মাধ্যমে সাহিত্য আলোকিত হয় তেমনি একজন লেখক মোহিত কামাল।

চর্যাপদ এর বিষয় ও সামাজচিত্রকে স্বাতী ও ময়ূরীর মাধ্যমে চর্যাপদের গীতিকারদের সাথে ভাব ও সংলাপের মাধ্যমে এবং এর আবিষ্কারক, সমালোচকদের দৃষ্টিতে কাহিনি সৃষ্টি করেছেন লেখক। আখ্যান কেন্দ্রীয় চরিত্র স্বাতী ও ময়ূরীর মাধ্যমে তুলে ধরলেও এর মূল আকর্ষণ চর্যাপদের গীতিকারগণ। ১৬ পর্বের এই উপন্যাসের প্রতিটি পর্বকে গল্প বললেও ভুল হবে না। আবার চর্যাপদকে নিয়ে উপন্যাস লেখার মাঝে কবিতা যোগ করা হয়েছে তাতে এটিকে কাব্য-উপন্যাস বলাও চলে। নাটকের মনোজাগতিক চিন্তা এটিকে অনেক বেশি ভাবার্থক করে তুলেছে। সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়েই সেই আদি কালের সমাজ ভাবনা, নারীদের জীবনচিত্র এবং পুরুষের মনের কামভাব তুলে ধরলেও এর কয়েকটি পর্ব বেশ আকর্ষণ করে। যেমন লুইপা-কথন, লুইপার কালসাপ, ও মেয়ে! তুই কাদিস কেন একা, বুকের মধ্যে দিয়ে ছুটছে হরিণ, অশান্ত মনে বিষধর সাপের কামড়, দেহ হচ্ছে শরীর নৌকা, খাঁটি মন তার দাড় ইত্যাদি।

চর্যাপদের ঘোর লাগা ভাষার মতোই উপন্যাসের ভাষা অনেক বেশি পাঠকের মনকে আলোড়িত করে। চর্যাপদের বিষয় ও ভাষার সাথে একালের ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন মোহিত কামাল। তবে চর্যাপদ গীতির আঙ্গিকে লেখা আর এই উপন্যাস বর্ণনাত্মক কথোপকথনে। এ উপন্যাসে সাহিত্যের সকল আঙ্গিকের মিশ্রণ ঘটেছে। যেমনটা সেলিম আল দীনের নাটকে দেখা যায়।

সাহিত্য যুগে যুগে নতুনের আবির্ভাব ঘটে- ঔপন্যাসিক মোহিত কামলের মাধ্যমে সেই চিত্র পাঠকের সামনে এসেছে প্রাচীন বিষয়কে আশ্রয় করে। রূপকের আড়ালে গীতিকারগণ চর্যাপদে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। এখানে সেগুলোই বর্ণনা ও ব্যাখ্যা রূপ পেয়েছে। এককথায় সহজভাবে চর্যাপদকে বুঝতে হলে এই বইটি সহায়ক। অসাধারণ কাব্য গৌরব নিয়ে বাংলা ভাষার আগমন। এর বিষয় যেমন রূপকের আড়ালে ঢাকা তেমনি এর ভাষাও সান্ধ্যভাষা। সান্ধ্যভাষা হলো আলো-আঁধারি ভাষা, কিছু বোঝা যায় কিছু বোঝা যায় না। কতক আলোয় ঝলমল করে আর কতক আঁধারে থেকে যায়। সেই আঁধারকেই আলো দেওয়ার প্রয়াস এই উপন্যাস। চর্যাপদের পদগুলো কাব্যগুণ, গীতি, চিত্রকল্প, ছন্দ, উপমা ও রূপক ইত্যাদি সাহিত্যমূল্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যকে মোহিত করে। খোলাদুয়ার দিয়ে দেখা যাবে একেকটা গানে আছে এক একটা জীবন্ত ছবি।

চর্যাগীতির রচনাকাল ৭ম-৮ম থেকে দ্বাদশ সাল পর্যন্ত ধরা হয়। তখনকার আলো-আঁধারি চিরায়ত যুগ, জীবনদর্শন, মনস্তত্ত্ব এবং বর্তমান যুগের প্রযুক্তিনির্ভর জীবন-আখ্যান ‘লুইপার কালসাপ’ উপন্যাস। আদি ও বর্তমানকালের সমাজ ও মনস্তাত্ত্বিক তুলনামূলক উপাখ্যানই এ উপন্যাসের আলোচ্য বিষয়। আর এই দুই কালের মধ্যে কি মিল ও অমিল তা উঠে এসেছে স্বাতী ও ময়ূরীর চর্যাপদ নিয়ে ভাবনার প্রতিফলনে। মানব দেহকে তরু আর তার পাঁচটি ইন্দ্রিয় যা তরুর বিভিন্ন শাখার সাথে তুলনা করেছেন লেখক। পাঁচটি শাখার সাথে তুলনা করা হয়েছে সে যুগের মানুষের সাথে এই যুগের মানুষের মনের অস্থির চঞ্চল মন যা কালসাপের মতো দংশন করে।

চর্যাপদ নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করা হয়। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একসাথে চারটি পু্ঁথি উদ্ধার করেন সেগুলো হলো চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, দোহাকোষ, কৃষ্ণাচার্য ও ডাকার্ণব। এর মধ্যে চর্যাপদকে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়। অনেক গবেষণার পর ১৯১৬ সালে 'তিন হাজার বছরের পুরাণ বাংলা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা' নাম দিয়ে প্রকাশ করেন আবিষ্কারক। চর্যাপদের মোট পুঁথির সংখ্যা ৫১ টি। এদের মধ্যে ২৪, ২৫, ৪৮ এবং ২৩ নং এর আংশিক পাওয়া যায়নি। এই প্রাপ্ত পুঁথিতে যে সমাজচিত্র, দর্শন, গীতি গানে নরনারীর জীবন প্রকাশ পেয়েছে তারই ভাববস্তু ও নিহিতার্থ লুইপা'র কালসাপ উপন্যাসের মূল বিষয়। চর্যাপদে যে নারীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেসব নারীরা সভ্য সমাজ থেকে দূরে বসবাস করে। তারা সমাজের চোখে অস্পৃশ্যা, উঁচুবর্ণে তাদের স্থান নেই। ডোমনি নিজেরা নিজেদেরকে নিজের শত্রু মনে করে। হরিণ যেমন নিজেই নিজের মাংসের জন্য নিজের শত্রু, নিজেকে রক্ষার জন্য সারাক্ষণ ছুটতে থাকে তেমনি নারীরাও নি়জের রূপ, দেহের জন্য নিজের শত্রু। নিজের সুন্দর মুখ তাদের শত্রু, তাদের দেহ তাদের শত্রু।

‘চঞ্চল চিত্ত কাল সাপের ছোবল খায়’ হাজার বছর আগে লুইপা রচিত ‘চঞ্চল চিএ পইঠা কাল’- এর আধুনিক ভাবার্থ। এভাবে একালে সামাজিক জীবনযাপনে তা কতটুকু প্রাসঙ্গিক তার তুলনামূলক আলোচনা করে লুইপার কলসাপ উপন্যাস রচনা করেছেন কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল। পাঁচ ইন্দ্রিয়ের সাথে মানুষের মস্তিষ্কে যোগাযোগ রয়েছে স্নায়বিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে। সেটাকেই ব্যবহার করে চর্যাপদের আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে উপস্থিত করেছেন ঔপন্যাসিক। হাজার বছর আগে চর্যাকার লুইপা'র অলৌকিক সংলাপ উপস্থাপন করে ইতিহাসের সরল পাঠ উপহার দিয়েছেন। আর মেডিটেশনের মাধ্যমে একালে নাট্যকর্মী স্বাতীর আত্মা ভ্রমণ করেছে হাজার বছর আগে চর্যাপদের রচয়িতার ধ্যানমগ্ন কুঁড়ে ঘরে। তার মধ্য দিয়ে অর্জিত জ্ঞানের আলোয় সে দেখতে পেরেছে সেকালের ব্রাক্ষণরাজন্যের ভোগ-বিলাস আর ব্যভিচারের বাস্তব চিত্র। এসব নিয়েই স্বাতী আপন আলোয় জেগে উঠে লুইপাকে অভিনবভাবে নিজের মস্তিষ্কে স্থান দিয়েছে। সেগুলো নিয়েই কথা বলেছে লুইপার সঙ্গে। এভাবেই সেকালে নৈতিক মূল্যবোধ ও জীবন আচরণকে উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠককে বোঝার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

উপন্যাসের নামকরণ অতুলনীয় ভাবনার বিষয়। "লুইপা’র কালসাপ" লুইপা শব্দটা মনে পড়লেই মানুষের মনে আসে হাজার বছর আগেকার সেই আদি কবি চর্যাপদকার লুইপার কথা । সাথে সাথে চর্যাপদ এবং চর্যাপদের সমাজ চিত্র। সে সমাজের নারীদের জীবনে কালসাপ ছিল নারীর শরীর। তার শরীরের গড়ন। ব্রাহ্মণরা দিনের আলোতে ডোমনি নারীদের কাছে না আসতে পারলেও রাতের আঁধারে ডোমনির ঘরে আসে। ব্রাহ্মণরা মনে করে রাতের আঁধারে কেউ দেখবে না। "আমি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, তোমাদের মতো নারীর ঘরের ঢুকেছি দেখলে চাঁদ যাবে না?"

মূলত এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে চর্যাপদের সমাজচিত্র। সে সমাজের মানুষের খাবার, থাকার পরিবেশ, ভয়, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা। সে সমাজের নারীরা চাঙাড়িতে ঘুমাতো। কাগনি ধানের চাল ছিল তাদের প্রিয় খাবার। শজনে ডাঁটা আর চিংড়ি মাছ দিয়ে সে খাবার ছিল তাদের অসাধারণ সুস্বাদু আর মনোহর। কুয়োর পানিতে কাকড়া আর শামুক ধরে রাখত। এগুলো তাদের ছিল প্রিয় খাবার। চর্যাপদের বেশিরভাগ লোক ছিল চাষা। চাষাবাদ ছাড়াও কেউ কার্পাস বানায়, কেউ চাঙাড়ি বানায়, কেউ কেউ শিকার করে, মাছ ধরে। যে সকল নারীরা এগুলো করার সুযোগ পায় না তারা এবং উঁচু জাতের মানুষের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনা তারা রাতের আঁধারে ব্রাহ্মণদের শয্যাসঙ্গী হতো, তবক দেওয়া পান তাদের কাছে ছিল খুবই সুস্বাদু এবং অতিথি আপ্যায়ন এর অন্যতম প্রধান উপকরণ। এসবের সুন্দর চিত্র ধরেছেন ঔপন্যাসিক লুইপা’র কালসাপ উপন্যাসে। এর ভাষা ও শব্দ চয়ন, বাক্যগঠন পাঠকের মনকে, মস্তিষ্ককে নাড়া দিতে নিশ্চিত।উপন্যাসটির বহুল প্রচার কাম্য।

লুইপা’র কালসাপ, মোহিত কামাল, বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৯, প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ, মূল্য : ২৫০ টাকা ।

এইচআর/পিআর

উপন্যাসের নামকরণ অতুলনীয় ভাবনার বিষয়। "লুইপা’র কালসাপ" লুইপা শব্দটা মনে পড়লেই মানুষের মনে আসে হাজার বছর আগেকার সেই আদি কবি চর্যাপদকার লুইপার কথা । সাথে সাথে চর্যাপদ এবং চর্যাপদের সমাজ চিত্র। সে সমাজের নারীদের জীবনে কালসাপ ছিল নারীর শরীর। তার শরীরের গড়ন। ব্রাহ্মণরা দিনের আলোতে ডোমনি নারীদের কাছে না আসতে পারলেও রাতের আঁধারে ডোমনির ঘরে আসে। ব্রাহ্মণরা মনে করে রাতের আঁধারে কেউ দেখবে না। "আমি উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, তোমাদের মতো নারীর ঘরের ঢুকেছি দেখলে চাঁদ যাবে না?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।